লেখক: রানা চক্রবর্তী
আম্রচরিত – প্রথম পর্ব পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন
আমের চর্চা মোঘলদের পর ইংরেজ আমলেও থেমে থাকেনি। সেই আমলে ভারতের ইংরেজ প্রশাসকদেরও আমের সুলুকসন্ধান নিতে দেখা গেছে। আমাদের দুটি বিখ্যাত আম ‘ল্যাংড়া’ ও ‘ফজলি’র সঙ্গে দুই ইংরেজ সাহেবের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। প্রথমটির সঙ্গে পাটনার ডিভিশনাল কমিশনার কর্কবান ও দ্বিতীয়টির সঙ্গে মালদহ জেলার কালেক্টর রেভেনশ সাহেবের অনুষঙ্গ আজও অনেকের মনে আছে।
বাংলার নবাবদের কল্যাণেই আর নবাবি সংস্কৃতির হাত ধরেই বাংলার আমের সুখ্যাতি। সুতরাং আম্রচরিত শেষ করার আগে তাঁদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা না করা অনুচিত হবে।
বাংলার নবাবদের উদ্যোগে দেশের নানা প্রান্ত থেকে বিভিন্ন জাতের আমের চারা সংগ্রহ করা হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় তাদের সংকরায়ণ ঘটানো, পরিচর্যা ও রসাস্বাদন জন্ম দেয় এক নিজস্ব সংস্কৃতির— যার পরতে পরতে ছিল রাজকীয়তার ছোঁয়া। আমচর্চার জন্য নবাবি আমলে বিশাল বিশাল আম বাগানে নানা প্রজাতির আমের চাষ হতো। এসব বাগানের দেখভাল করার জন্য থাকত নানা শ্রেণীর কর্মচারী, ছিলেন আম বিশেষজ্ঞ। কোন আম কখন খাওয়ার উপযুক্ত হয়েছে, কোন আমকে কীভাবে সংরক্ষণ করা হবে, তা দেখভাল করতেন আমের দারোগারা। সে সময় বিচক্ষণ ও সমঝদার দারোগা হিসেবে আরজুমান্দের বিশেষ সুনাম ছিল। আমের স্বাদ পরীক্ষা করার জন্য ছিলেন ‘পয়মান’ বা টেস্টার। আম পাড়া হতো এক ধরনের কাপড়ের তৈরি থলির সাহায্যে— এর স্থানীয় নাম ‘টুসি’। আম পাড়া হলে সেগুলোকে ‘আম্বাখানা’য় সংরক্ষণ করা হতো। সেখানে ভিন্ন জাতের আমকে পৃথকভাবে রাখার ব্যবস্থা ছিল। মুর্শিদাবাদের লালবাগে এখনো একটি ভগ্ন আম্বাখানার অস্তিত্ব চোখে পড়ে। আমের মধ্যে যেগুলো সবচেয়ে খানদানি যেমন কোহিতুর-কালাপাহাড়— এদের রাখা হতো তুলার বিছানায়। পাকার জন্য এগুলোকে তিন-চার ঘণ্টা অন্তর এপিঠ-ওপিঠ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে রাখা হতো।
নবাবি আমলে আম কাটার জন্য বিশেষ এক ধরনের সরু ছুরি ব্যবহার করার রেওয়াজ ছিল। খোসা ছাড়ানো হতো কাগজের মতো পাতলা করে। গোড়া থেকে শুরু করে বোঁটা পর্যন্ত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একটানা। আঁটিতে ছুরি লাগলে নাকি আমের স্বাদের পরিবর্তন ঘটে যেত। খোসা ছাড়ানোর পর আস্ত আমটাই পরিবেশন করা হতো। তবে ফজলি, দিলসাদ এসব আমকে লম্বাভাবে ফালা ফালা করে কাটার নিয়ম ছিল। আবার ভবানী চৌরস, ঝুমকা এসব আম চুষে খেতে হতো।
আমের নামের সঙ্গেও মিশে আছে নবাবি আমলের ইতিহাস। নবাব ফেরাদুন জার মা, রাইসুন্নেসা বেগমের নামে ‘বেগম পছন্দ’, ফেরাদুন জার ফেরদৌস মহল সাহেবার নামে ‘ফেরদৌস পছন্দ’, নবাব মুবারক দৌলার পৌত্র নবাব সফদার জং বাহাদুরের নামে ‘সফদার পছন্দ’ এসব নামকরণ হয়। নাটোরের রানী ভবানীর বিশেষ পছন্দের আমটির নাম করা হয় ‘ভবানী চৌরস’। তোতা পাখির ঠোঁটের মতো গোড়ার দিকটি দেখতে ছিল বলে একটি আমের নাম রাখা হয় ‘তোতা আম’। ওই আমটি নাকি নবাব ওয়াসিম আলি মির্জা তার বাগান থেকে নবাব রইস মির্জাকে উপহার দেন। ‘মির্জা পছন্দ’ আমটির উৎপত্তি মির্জা কোকার বাগানে। বর্তমানে অবশ্য এসব আমের অধিকাংশ দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেছে। তবু এদের নামের মধ্যেই এরা এখানো বেঁচে রয়েছে।
নবাবি আমলের যে আমের উল্লেখ না করলে আমচর্চার আলোচনা অসম্পূর্ণ রইবে, সেই আমের নাম কোহিতুর – যাকে বলা হতো আমের রাজা। তোয়াজে আর আদরে মানুষ হওয়া মুর্শিদাবাদের এই আমের চরিত্রে আছে নবাবি মেজাজের সব ওঠা-নামা, ভালো-মন্দ সব লক্ষণ। নবাব ওয়ালাকাদার সৈয়দ হোসেন আলি মির্জার তৃতীয় পুত্র নবাব আলি মির্জা এই আমের প্রবর্তন করেন। কালাপাহাড় প্রজাতির আমের সঙ্গে বিশেষ সংকরায়ণের মাধ্যমে তৈরি এই আম যখন পাড়া হয়, তখন মাটিতে পেতে রাখা হয় তুলার বিছানা। প্রতিটি আম রাখতে হবে তুলার বাক্সে। লোহার ছুরি বা বঁটি আমের গায়ে ছোঁয়ানোর প্রশ্নই ওঠে না। হয় রুপোর ছুরি নতুবা বাঁশের ছালকে তীক্ষ্ণ করে সেটা দিয়ে কাটতে হবে এই বিলাসী আম। জন্মলগ্ন থেকে অতি আদর পেয়ে এই আমের স্বভাব বড় স্পর্শকাতর এবং কিছুটা একগুঁয়ে। আমটি কেটে ব্যস্ত হয়ে অন্য কাজে হাত দেয়া যাবে না। খোসা ছাড়িয়ে সঙ্গে সঙ্গে না খেলে আভিমানী এই আম মিনিটে স্রেফ বরফের মতো গলে যাবে। পরিতাপের বিষয়, এই প্রবাদপ্রতিম আমটি আজ লুপ্তপ্রায়। আম গবেষক সমৃদ্ধ দত্ত যথার্থই লিখেছেন, ‘ইতিহাস প্রসিদ্ধ আমটি ধীরে ধীরে ঢুকে যাচ্ছে ইতিহাসেই। সামান্য কয়েকটি আমগাছ বেঁচে আছে।’ অনেক পুরনো আম ব্যবসায়ী এর নাম শুধু শুনেছেন, চোখে দেখার সৌভাগ্য তাঁদেরও হয়নি।
বাদশাহি ও নবাবি কালচারের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য রবীন্দ্রনাথের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পে চমৎকার চিত্রধর্মী গদ্যে আজো অভ্রান্ত প্রমাণিত হয়ে জ্বলজ্বল করছে। প্রচুর সুলম্ব পরিচ্ছদ, প্রচুর শিষ্টাচার এবং প্রচুর অবকাশ— এ তিনটি বাদশাহি আর নবাবি কালচারের হলমার্ক। প্রচুর অবকাশ ও শিষ্টাচারের জারক রসে আপ্লুত নবাবি সংস্কৃতির দৌলতে বাংলার নবাব, বেগম, রাজা-রানীদের আমচর্চায় মুর্শিদাবাদ, ঢাকা, লখনৌ এর নবাবি দরবার হয়ে উঠেছিল নানা কেতা ও শিষ্টাচারে বাহুল্যের জন্য বহুল নিন্দিত ও নন্দিত। ফলে আম উপভোগ করার জন্য নানা আভিজাত্যপূর্ণ শিষ্টাচার, বিস্তর নিয়ম-কানুন এবং হাস্যকর বাধা-নিষেধ নিয়ে সম্ভব-অসম্ভব কেচ্ছা-কাহিনীর জন্ম হতে খুব বেশি দিন লাগেনি এই তিন ক্ষয়িষ্ণু নবাবি সংস্কৃতির কেন্দ্রে।
অনেক রসিক ব্যক্তির মন্তব্য, আম একটি ফলমাত্র নয়, আম একটি বিশেষ সময়ের সংস্কৃতির সংজ্ঞাবিশেষ। কেউ কেউ আরো একধাপ এগিয়ে বলেন, আমচর্চা কাব্যচর্চার মতোই সুস্থ রুচির ব্যাপার। লখনৌ এর এক নবাব নাকি বলেছিলেন, যারা নিজের স্ত্রীকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করে সম্মান দিতে পারেন না বা চান না, তাঁরা সূক্ষ্ম আমচর্চার মীড়, গমক, তান কী করে উপলব্ধি করবেন? আমের সমঝদারদের একাংশের দৃষ্টিতে আম নিজেই একটি অনুষ্ঠান। তাঁদের যুক্তি মোটেই উপেক্ষণীয় নয়, তাঁদের যুক্তির সপক্ষে দেয়া তথ্যও প্রমাদশূন্য— নির্ভুল। আম বাগান তৈরিতে প্রচুর সহৃদয় যত্ন ও বিশেষ দক্ষতা প্রয়োজন। আমের চারা বড় হলে মঞ্জরি হতে ফল পাকানো, পাকা ফল পরম মমতায় গাছ থেকে নামানো, তুলার বিছানা তৈরি করে সেই পাকা ফলকে লালন, কচি শিশুর মতো কিছু ফল পর পর পাশ ফিরিয়ে দেয়া, ঠাণ্ডা জলেতে ডুবিয়ে রেখে দিয়ে বাঁশ, রুপা কিংবা হাতির দাঁতের ছুরিতে কেটে পাথর বা চীনামাটির পাত্রে পারিবেশন— এসবই তো এক বিশাল অনুষ্ঠান। জাপানিদের চা-পরবের মতো অনুষ্ঠান বাঙালির আম-পরবও প্রশংসার দাবি রাখে।
আম খাওয়া নিয়ে বিস্তর বাছ-বিচারের জন্ম দিয়ে বাংলার নবাব পরিবারের অনেকে আজও গাল্পিক হিসেবে সুখ্যাত হয়ে আছেন। তাঁদের নামে প্রচলিত অনেক কাহিনী অবশ্যই ভিত্তিহীন, তবু আমচর্চা করতে করতে নবাবদের সর্বনাশ হয়েছিল— এমন অপবাদের পেছনে যে তাদের বাড়াবাড়ি রকমের আমাসক্তির ভূমিকা রয়েছে, তারও কিছুটা আভাস মিলবে। জনশ্রুতি বলে কোনো কোনোও নবাব নাকি গরমের দিনে অন্দরমহল ছেড়ে বেগম-শাহজাদা-শাহজাদি ও নকর-চাকরানিদের সঙ্গে নিয়ে বিশেষ আমগাছের নিচে সংসার পাততেন। কোনো আম গাছের তলায় খুব ভোরে, কোনো গাছের তলায় সূর্য ডোবার পর, কোথাও দুপুরের সূর্যের প্রচণ্ড উত্তাপে এবং কোথাও বা গোধূলিবেলায় কিংবা মধ্যরাত্রিতে স্থান বদল করতেন। ব্যাপারটা পাগলামির লক্ষণ বলে মনে হলেও কিন্তু আসলে তা নয়। এখানে নবাবদের পুরুষাণুক্রমে অর্জিত সূক্ষ্ম বিচারে একটা সাক্ষ্য নাকি পাওয়া যায়। যে আম পূর্বের আকাশে আলোরেখা ফোটার ঠিক আগ মুহূর্তে খাওয়ার কথা, সেটি দুপুরের কাঠফাটা রোদে খেলে শুধু বিস্বাদই মনে হতো না, শরীরের অম্ল, পিত্ত, বায়ু, কফ ইত্যাদি ভীষণ কুপিত হয়ে দেহে বিরাট ওলট-পালট হওয়ার আশঙ্কা থাকত।
জনশ্রুতি এখানেই শেষ হয়নি। আরো আছে। একবার কোনো এক নবাব নাকি জোর করে নিয়ম ভেঙে যে আম সকাল সাড়ে দশটায় খাওয়ার কথা, তা রাত সাড়ে দশটায় খেয়ে ফেলে নিদ্রায় শুধু বিভীষিকাই দেখেননি, প্রচণ্ড উত্তাপে ঘাম ছেড়ে বিছানা ভিজিয়ে ফেলেছিলেন। তার ওপর রাতভর ঘরের ভেতর গ্যাস বেলুনের মতো শূন্যে ভেসে বেড়িয়ে এবং বিয়ের আসরের ব্যান্ড পার্টির মতো আওয়াজে বায়ু ত্যাগ করে সবার ঘুমেরও ব্যাঘাত ঘটিয়েছিলেন প্রচুর। আম নিয়ে বাড়াবাড়ির ফল হিসেবেই এ ধরনের অবাস্তব কাহিনীর জন্ম হয়েছিল।
আম বড় অহঙ্কারী ফল। বস্তুত মসৃণ ত্বক, উজ্জ্বল বর্ণ, অনবদ্য অবয়ব আর মন মাতানো সৌরভের মানদণ্ডে আম রীতিমতো দৃষ্টিনন্দন, যেন রূপের রানী। তার মনে অহঙ্কার যদি বাসা বাঁধে তবে অবাক হওয়ার কিছু নেই। রসাল যে কত দেমাগি, তার গুমর যে কত ভারী, সে খবর মাইকেল মধুসূদনের চেয়ে কে আর বেশি জানেন। মধুকবির রসাল ও স্বর্ণলতিকার কথোপকথন কবিতাটিই তো এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ। নীতিকথা শেখানোর উদ্দেশ্যে রচিত হলেও কবিতাটিতে আমের গুণাবলির ফিরিস্তি এবং আমের অহঙ্কারী মনোভাবের একটি চমৎকার রসোত্তীর্ণ আলেখ্য রয়েছে। রসাল স্বর্ণলতিকাকে তাচ্ছিল্য করে বলছে,
“শুন মোর কথা ধনি,
নিন্দ বিধাতারে!
নিদারুণ তিনি অতি;
নাহি দয়া তব প্রতি;
তৈই ক্ষুদ্রকায়া করি সৃজিলা তোমারে।”
দীন স্বর্ণলতিকাকে ব্যঙ্গ করে বলার মধ্যে রসাল কিছু করুণাও মিশিয়ে দিতে ভোলেনি। এর পরই আত্মগরিমা প্রচারে নেমে গেল রসাল:
“মধু মাখা ফল মোর বিখ্যাত ভুবনে
তুমি কি তা জান না ললনে?”
কবিতাটির শেষ প্রান্তে রসাল তার অহঙ্কারের কিঞ্চিৎ শাস্তি প্রকৃতির হাত থেকে পেয়েছিল— এমন তথ্যও কবি দিতে ভোলেননি।
আম শুধু অহঙ্কারীই নয়, বেজায় একগুঁয়েও বটে। কৃষিবিজ্ঞানী ও উদ্যানবিদদের সব কলাকৌশলের ফাঁদ এড়িয়ে রসাল ঋতুর নিয়মনিষ্ঠার প্রতি আজও ঐকান্তিক রয়ে গেছে। ফল, ফুল, সবজির চরিত্র আজ বহুদিন হলো ভুলে গেছে মৌসুমের প্রতীক্ষা। সারা বছর ধরেই পাওয়া যায় কমলা কিংবা ফুলকপি বা পুঁই-পালংশাক। কিন্তু ব্যতিক্রম আম। বাঙালির সবচেয়ে প্রিয় এই ফলটির জন্য আজো ক্যালেন্ডারই ভরসা। এপ্রিল যাব যাব করছে, আর মে দরজায় বাইরে দাঁড়িয়ে— এই হলো আমের আগমনের কাল। সময়সীমার এই বাধ্যবাধকতা ছিল আকবরের কালে। তারও আগে এমনই ঋতুনিষ্ঠ ছিল আম কালিদাসের কালেও। এখন হাইব্রিড ফল, ফুল, সবজি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সাফল্যে সারা বছরই ফলন হয়। কিন্তু আমের একগুঁয়েমিকে এখনো বাগে আনতে পারেননি কৃষিবিজ্ঞানীরা। বিচ্ছিন্নভাবে অন্য ঋতুতে কিছু আমের ফলন হলেও আমজনতার রসনার সমর্থন না পাওয়া এসব তথাকথিত অকালের বা বারোমাসি আম খুব একটা কল্কে পায়নি। আম কেন এমন নাছোড় মৌসুমবাদী, সে যেন এক রহস্য। বিজ্ঞানীরা হয়তো এই রহস্যও একদিন সমাধা করে ফেলবেন। যারা আমচর্চায় মগ্ন, তারা আমের আরো একটি রহস্যের সদুত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছেন। সে রহস্যটি হলো ‘অফ ইয়ার’ আর ‘অন ইয়ারে’র অনিশ্চিত। যে বছর আমের প্রচুর ফলন হয়, তাকেই বলা হয় ‘অন ইয়ার’। আর যে বছর আম উৎপাদন কম তার নাম ‘অফ ইয়ার’। এক বছরে কোনো কোনো এলাকার বাগানে আমের বাম্পার ফলন। আর পরের বছর একই মাটি, একই আবহাওয়া, একই সার, একই বীজ এবং একই পরিচর্যায় নিয়মের পৌনপুনিকতা সত্ত্বেও বাগানে ফলন খুব সামান্য। কেন এমনটি হয়? এই প্রশ্নের এখনো জবাব মেলেনি। প্রশ্ন রয়েছে আরো। এমন নয় যে, এ বছর আমের অন ইয়ার হলো, ফলে আসছে বছর অফ ইয়ার হবে। এমনটিও সবসময় হয় না। পর পর দুই বছর অন ইয়ার। এমনটি অবশ্যই হতে পারে। কিন্তু কোন বছর আমের অন ইয়ার আর কোন বছর অফ ইয়ার হবে, তার নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী সম্ভব নয়। আমের জীবনবৃত্তান্ত আজো রহস্যে ঘেরা।
বঙ্গদেশে আমের চাষ প্রতি বছরই বেড়ে চলেছে। নানা নামের, বিচিত্র স্বাদের, বৈচিত্র্যময় রঙের অজস্র আম থাকলেও বাংলাদেশে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আম নিয়ে মাতামাতি কিন্তু সীমাবদ্ধ কয়েকটি প্রজাতি নিয়ে। হিমসাগর, গোপালভোগ, ক্ষীরসাপাতি, ল্যাংড়া আর ফজলি আম— বাঙালির হিরো হিমসাগর। হিমসাগরের মুকুট ছিনিয়ে নেয়ার জন্য প্রতীক্ষা করছে ল্যাংড়া, ফজলি। এর বাইরে যেসব আম বাজারে পাওয়া যায়, সেগুলো এলাকাভিত্তিক জনপ্রিয় আম যেমন— বাংলাদেশের রংপুরের হাঁড়িভাঙ্গা, দিনাজপুরের সূর্যমুখী। কিছু আম রয়েছে, যার পরিচিতি কম; কিন্তু স্বাদে-গন্ধে উৎকৃষ্ট। এগুলো সাধারণত বাজারে ওঠে না— ব্যক্তিগত বাগানের এসব আম পরিবারের সদস্য ও বন্ধু-বান্ধবের মাঝে বিলানো হয়। এই গোত্রের একটির নাম ‘মধু গুগগুলি’, কুলবরইয়ের চেয়ে একটু বড়, খেতে হয় চুষে চুষে— কারণ আম এত ছোট যে, কাটলে আর কিছুই থাকে না। খেতে ভারি মিষ্টি এই আম কখনো বাজারে পাওয়া দুষ্কর।
রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে আম নিয়ে বেশকিছু রসালো গল্প রয়েছে। এসব গল্পের মূলে রয়েছে ‘অরুণ-বরণ’ আমের প্রতি কবির তীব্র আকর্ষণ। এই পছন্দের ফলটির সঙ্গে সাময়িক বিচ্ছেদও যেন তার পক্ষে ছিল কষ্টকর। শিলাইদহে তাঁর সংসারের ভাণ্ডারে আম ফুরিয়ে এলে তৎক্ষণাৎ চিঠি যেত স্ত্রীর ‘ভাই দুটি’র কাছে কলকাতা থেকে আম পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে। শিলাইদহে অবশ্য কবির হাতের কাছেই মজুদ ছিল খুলনা, রাজশাহীর হিমসাগর, ল্যাংড়া, ক্ষীরসাপাতি— নানা জাতের সুমিষ্ট আম। তবে মনে হয়, কবির রুচির স্বাদের চাহিদা মেটাতে এসব স্থানীয় আমের তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না, নতুবা কলকাতায় আমের বরাত যেত না। সম্ভবত কবি ছেলেবেলা থেকেই রাজধানী কলকাতার বাজারের চালানি আম খেয়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কলকাতার আম বলতে তখন এবং এখনো বোঝায় মুর্শিদাবাদ, বিহার, কাশীসহ উত্তর প্রদেশের নানা বাগানের উৎকৃষ্ট ল্যাংড়া, হিমসাগর, দশেরী, চৌসা ইত্যাদি আম। শিলাইদহের আশপাশে এদের সচরাচর দেখা মিলত না বলেই অনুমিত। স্ত্রীর পাঠানো আমের মধ্যে কোন কোন প্রজাতির আম কবির রসনার আকাশে রোহিনী হয়ে উদিত হয়েছিল, আজ আর তা জানার উপায় নেই।
কবি নিজে আম ভালোবাসতেন, বোলপুরে অতিথি অভ্যাগতদের আম দিয়ে আপ্যায়িত করে তৃপ্তি পেতেন। একবার আমের মৌসুমে তার আমন্ত্রণে শান্তিনিকেতনে অতিথি হয়েছেন বিদেশ থেকে বেড়াতে আসা এক প্রিয় বন্ধু। বন্ধুর সঙ্গপ্রত্যাশী রবীন্দ্রনাথের ভারি ইচ্ছা, তিনি আরো ক’টা দিন থেকে যান। কিন্তু অতিথি কিছুতেই রাজি না হওয়ায় শেষ চেষ্টা হিসেবে কবি তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন এই বলে যে, এখন আমের ভরা মরশুম চলছে, এমন সময়ে তাড়াহুড়ো করে বোলপুর ছাড়তে নেই।
আমের লোভ দেখিয়ে প্রিয়জনকে ধরে রাখার কবি-প্রচেষ্টার এ গল্পটি ভারত চন্দ্রের বিদ্যা সুন্দরের কাহিনীই যেন মনে করিয়ে দেয়। বিয়ের পর নায়ক সুন্দর যখন বিদ্যাকে ছেড়ে কাঞ্চীপুরে ফিরে যেতে চাইল, তখন বিদ্যাও স্বামীকে সুমিষ্ট আমের মৌসুমের কথা মনে করিয়ে দিয়ে আরো কয়েকটা দিন কাছে পেতে চেয়েছিলেন।
‘জ্যৈষ্ঠ মাসে পাকা আম এ দেশে বিস্তর
সুধা ফেলে খেতে আশা করে পুরন্দর’
বিদ্যা চিহ্নিত এ আমটির নাম অবশ্য ভারত চন্দ্র কোথাও উল্লেখ করেননি। করলে আমাদের কাজে লাগত আজ।
বঙ্গদেশের আম-কাহিনীর কোনো সমাপ্তি টানা সম্ভব নয়, কারণ আমাদের জাতীয় চেতনাও ইতিহাসের সঙ্গে আম-কাহিনীর স্রোত বিপুল গৌরবে প্রবহমান।
তথ্যসূত্র:
1. আম, মাহবুব সিদ্দিকী, আগামী প্রকাশনী
2. Romance of the Mango: The Complete Book of the King of Fruits, Kusum Budhwar, Penguin Books India (২০০৩)
লেখকের কথা: রানা চক্রবর্তী
রানা চক্রবর্তী পেশায় সরকারী কর্মচারী। নেশা ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা আর লেখালিখি। নিজেকে ইতিহাসের ফেরিওয়ালা বলতে ভালবাসেন।