লেখক: রণজিৎ বিশ্বাস
রাত্তির দুটো বেজে গেছে। টালির চাল দেওয়া উঁচুতে ছোট্ট জানলা থাকা ছোট ঘরটায় এখনো একটা হলুদ বাল্ব জ্বলছে আর নিস্তব্ধ রাতে প্রখর ভাবে শোনা যাচ্ছে একটা পুরোনো সেলাই মেশিনের ঘরঘর শব্দ। মেশিনে বসে ফাতেমা। পা-মেশিন। তাই একটা পুরোনো কাঠের স্টুলে বসে পা দিয়ে মেশিন ঘোরাচ্ছে আর সিমেন্ট উঠে ক্ষয়ে যাওয়া প্রায় মাটি বেরোনো মেঝেতে বসে শুকুর বিরাট একটা কালো কাঁচি হাতে খাদির কাপড় মাপ মত কেটে যাচ্ছে। কাটা কাপড়ের টুকরো অনেক জমে গেছে। ফাতিমার হাতের সেলাই নিখুঁত তাই একটু সময় লাগছে। সেই অবসরে শুকুর স্থির হয়ে বসে কিছু ভাবার অবকাশ পাচ্ছে।
শুকুর ভাবছে। অনেক মাল জমে গেছে। সেই মার্চ মাস থেকে কাজ শুরু হয়েছে। তার আগে কাঁচা মাল আনার জন্য ভৈরববাবুর স্মরণাপন্ন হয়ে সুদূর কর্ণাটক থেকে খাদি ভবনের তৈরী কাপড় আনিয়েছিল। তিন রকমের রঙ, গেরুয়া সাদা আর সবুজ। ফাতিমা বলে, এতো দূর থেকে এতো খরচ খরচা করে অমন খাদির কাপড় আনার কী দরকার? শুকুর মাথা নাড়ে, বলে, আমরা দু’পুরুষ এই জাতীয় পতাকার ব্যবসা করছি। আমার আব্বাজান এই পতাকার ব্যবসা শুরু করেন। তাঁর গুরু বলেছিল, প্রথম না কি হিঙ্গলিবেঙ্কাইয়া নামে একটা লোক এই তেরঙ্গা পতাকার ডিজাইন করে দিয়েছিল। সরকার বাহাদুর বলেছিল শুধু খাদি কাপড়ের ওপরই একটা অশোক চক্রের ছাপ্পা মারতে হবে যাতে চব্বিশটা দন্ড থাকবে। আমি আব্বাজানের সঙ্গে ছোট বেলা থেকেই ওই ছাপ্পা মারার কাজটা করছি। আমি তো বেশীদূর লেখা পড়া করিনি। আম্মিজান বলেছিল, শুকুর পড়ুক, অফিসার হোক। আব্বা বলেছিল, আমি যে কাজ করি তার চেয়ে আর বড় কাজ-কাম আর কিছু হয় না। যখন ২৬ শে জানুয়ারী আর, ১৫ই আগষ্ট সারা দেশে আমাদের মত সামান্য মানুষের হাতে তৈরী পতাকা হাওয়ায় পত-পত করে ওড়ে তখন এই চালা ঘরে থাকা মানুষগুলোর বুক গর্বে ভরে ওঠে। শুকুর ভাবে, হয়তো পয়সা নেই তার ঘরে কিন্তু স্বাধীনতার সুখ যে কত বেশী, কত বড়। প্রধানমন্ত্রী থেকে সব মুখ্যমন্ত্রীরা ওদের তৈরী ফ্ল্যাগ তোলে। সব সরকারি অফিস, স্কুলে ওই পতাকাই তোলা হয়। যখন নীল আকাশে বর্ষার মেঘ সরিয়ে পতাকাগুলো ওড়ে তখন কেউ ভাবে যে একটা টালি ছাওয়া ঘরে ওদের রাতজাগা মেহনতে ঐগুলো তৈরী হয়েছে?
কিন্তু এবারের স্বাধীনতা দিবস শুকুরের কাছে একটু অন্যরকম। হাজার চিন্তা ওর মাথায় এসে ভীড় করে। মার্চ মাস থেকে কাজ শুরু হলেও তার কত আগে থেকে কাঁচা মাল কেনা। ভৈরববাবুকে তো সামান্য পেমেন্ট করেছিল যা প্রত্যেকবারই করে। হোলসেলার বিপিন সিকদারেরও দেখা নেই। একদিন ফোনে কথা হয়েছিল, বলেছিল, এবার মার্কেটের অবস্থা খুব খারাপ। মাল যাবে কি না তার ঠিক নেই, লকডাউন সব মাটি করে দিল। বড়বাজার তো কতদিন বন্ধ ছিল। এখন আগরওয়ালা তো মাল কতটা নেবে বা আদৌ নেবে কিনা কিছুই বলছে না। ও ভাবে। কোন ভরসাতেই বা নেবে? সব ইস্কুল কলেজে পতাকা টাঙ্গায়, কবে সেগুলো খুলবে কে জানে। লোকের বাড়ি বাড়ি কিছু টাঙ্গায়। তবে মানুষের এইসব ইচ্ছেগুলো আস্তে আস্তে কমে আসছে। ভৈরববাবু তো আর ধার-বাকি বেশী দিন রাখবে না। শুকুরের এতো চিন্তা দেখে ফাতেমা কাজ থামিয়ে ওর পাশে এসে বসে, বলে, কী এতো ভাবছো গো। শুকুর চিন্তিত মুখে বলে, এবারের ব্যবসা নিয়ে ভাবছি। এ’রকম অবস্থা তো কখনো হয়নি। খুব চিন্তায় আছি। ভৈরববাবুর থেকে মাল নিয়েছি, দেনা তো হয়েই আছে, পাওনা তো মেটাতেই হবে। ফাতেমা বলে, ওনাকে যদি বুঝিয়ে সুঝিয়ে বলা যায়। মাথা নাড়ে শুকুর, বলে, তা তো হবে না। উনি সে কথা মানবেন কেন? কিছু বলার তো মুখ নেই। চাইতে এলে ঘরে লুকিয়ে থাকতে হবে।
ফাতেমার ভীষণ কষ্ট হয়। ভাবতে থাকে, এবার এমন হল কেন ? কোনোবারই তো এমন হয় না। ওর সাদি হওয়ার সময় শ্বশুর আব্বার এটা কত বড় ব্যবসা ছিল। ও লেখা-পড়া বিশেষ জানে না, কিন্তু সেলাইটা খুব ভালোই জানত। ওর আব্বাজান তো মেটিয়াবুরুজের নামকরা দর্জি। সেই সুবাদেই ওদের সাদির কথা পাকা হয়। ও সংসারে এসে সেলাইয়ের কাজে লেগে পড়বে এটাই উভয় পক্ষেরই ইচ্ছে ছিল। তাই দেনমোহর নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। শুকুরও সে কথা ভাবে। শুকুরের মনে সবসময় একটা গর্ব হত। অন্য দর্জিদের থেকে ও যে আলাদা সেই বোধটা সব সময় অনুভব করত। ওরা জামা-প্যান্ট-চুড়িদার-শেওয়ানী বানায় আর ও বানায় জাতীয় পতাকা। যে জওয়ানেরা গোলাগুলি নিয়ে যুদ্ধ করে তাদের হাতে থাকে ওদের তৈরী তেরঙ্গা পতাকা। দেশের জন্যে গোলাগুলি নিয়ে লড়তে পারে না কিন্তু ওদের তৈরী তেরঙ্গা পতাকা রক্ত তো গরম করে দিতে পারে। এই দুরবস্থার সময় ফাতেমা একটা পরামর্শ দেয় শুকুরকে। বলে, এখন না হয় ফ্ল্যাগ তৈরীটা বন্ধ রাখি। আমি শৌখিন চুড়িদার, ব্লাউজ ভালোই তো করতে পারি। এখন যদি ঐগুলো তৈরী করতে শুরু করি? এমন দুরবস্থা তো আর থাকবে না। ভৈরববাবুর দেনাটাও কিছু কিছু করে মিটিয়ে দিতে পারবো। শুকুর ফুঁসে ওঠে, বলে, তুই আমার বিবি হয়ে একথা বলতে পারলি? পতাকার কারিগররা একরকম দেশ সেবাই করে। সেই আমার আব্বাজনের সময় থেকে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কত রক্ত, কত লড়াই করে এই স্বাধীনতা এসেছে। এখনো দেশে কত গরীব-দুঃখী রয়েছে যারা দিনের পর দিন খেতে পায় না তবু তো তারা স্বাধীন, অন্য দেশের, ইংরেজদের দাসত্ব করতে হয় না।
ফাতেমা শুকুরের মেজাজ চেনে। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে এক সময় বলে, আমরা যদি কাল ভৈরববাবুর বাড়ি গিয়ে বুঝিয়ে বলি যে এখন টাকাটা ফেরৎ দিতে পারবো না, লক-ডাউন উঠলে দেবো। শুকুর বলে, ও বাবু কঠিন আছে, মানবে কেন? ফাতেমার নিজের ওপর আস্থা আছে। বলে, আমি ওনাকে বুঝিয়ে বলব। আর তা ছাড়া ওনার সঙ্গে এ বাড়ির লেন-দেন তো আজকের নয়! সেই আব্বাজানের সময় থেকে চলে আসছে, আর এখনকার দেশের দুরবস্থারকথা তো উনি জানেনই।
রাত গড়িয়ে সকাল হতে দেরী হল না। ওরা দুজনে ঘুমিয়েছিল সামান্যই। সকালে বেরোতে হবে এই চিন্তায় দুজনেই চোখের পাতা এক করতে পারেনি। সকালে নামাজ পড়েই নামমাত্র নাস্তা করে ওরা দুজনেই বেরিয়ে পড়ল আলিপুরের উদ্দেশে। ভৈরববাবু আলিপুরে থাকেন। কিন্তু লকডাউনে বাস, অটো সবই তো বন্ধ। শুকুর দেখলো ওর পুরোনো স্কুটারে মোটামুটি তেল আছে, হয়ে যাবে। লকডাউনের জন্যে অনেক দিন ও তাতে চড়েনি তাই ধুলো জমে আছে। ও ধুলো ঝেড়ে স্টার্ট দিয়ে দেখল ঠিক আছে সব। ও ফাতেমাকে বলল, আয়, দেখি কী হয় । ফাতেমা স্কুটারে বসতেই শুকুর সেটা স্টার্ট দিল, বলল, এই দ্বিতীয় হুগলী সেতুটা হওয়াতে আমাদের এই হাওড়ার লোকেদের খুব সুবিধে হয়েছে। মুহূর্তেই আলিপুর পৌঁছে যাবো, আগে মনে আছে যখন খুব ছোট ছিলাম, এই ব্রীজটা হয়নি, আব্বার সঙ্গে কত ঘুরে ভৈরববাবুর বাড়ি যেতাম। লকডাউনের জন্য রাস্তা ফাঁকাই ছিল। ফাতেমা বলল, এই তো ‘নবান্ন’। সরকারী অফিস। এই ব্রীজের জন্যে কত যাওয়া-আসার সুবিধে। শুকুর ‘নবান্ন’র সামনে গাড়িটা রেখে দাঁড়াল। দেখল নবান্নর মাথায় একটা বিশাল তেরঙ্গা পতাকা নীল আকাশে হাওয়ায় পত পত করে উড়ছে। শুকুরের পাশে দাঁড়িয়ে ফাতেমা সেই পতাকাটা দেখছিল আর ভাবছিল, পতাকাটার মাপ কতটা হবে, অশোকচক্রের ছাপটা ঠিক মাঝ বরাবর পড়েছে কি না? আর শুকুর ভাবছিল, পতাকাটা স্বাধীন ভারতের স্বাদ নিয়ে উড়ে চলেছে। ওদের মত কেউ না কেউ ওটা সেলাই করেছে, কত গর্ব তাদের।
ছবি: পাভেল পাল
লেখকের কথা: রণজিৎ বিশ্বাস
কলেজের প্রাক্তন বাংলার অধ্যাপক। কর্মজীবনে নানা কর্মব্যস্ততায় লেখার সুযোগ না থাকায় এখন সদ্য অবসরের পর লেখালিখি করে সময় কাটান। ছোট গল্পের সাথে কবিতাও লেখেন। নিয়মিত গানবাজনার চর্চা করেন ও ছবিও আঁকেন।
খুব ভালো লাগলো গল্প –স্বাধীনতা র স্বাদ। অনেক শুভেচ্ছা রইল।
খুব ভালো লাগল…👌