লেখক: অর্পিতা
পিয়ালী অফিস থেকে বের হয়ে গলির মোড় অবধি যেতেই বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামল, প্রথমে টুপ টুপ করে তারপর ঝমঝমিয়ে। মুদিখানা দোকানের শেডের তলায় দেওয়াল ঘেঁসে দাঁড়িয়ে পড়ল পিয়ালী। ব্যাগে ছাতা আছে কিন্তু বৃষ্টির এত জোরে পড়ছে ছাতা মানবে না। একটু দাঁড়িয়ে যাওয়াই ভালো। পিয়ালীর পাশেই একটা ছেলে আর মেয়ে ছুটে এসে দাঁড়াল, দুজনেই পিঠের ব্যাগটা সামনে করে নিয়েছে। “চল না একটু ভিজি!”, অনুনয়ের সুর মেয়েটার গলায়। “তুই চুপচাপ দাঁড়া এখানে, ঠান্ডা লেগে গেলে কাকীমা আমায় বকবেন।”, ছেলেটা মৃদু শাসন করে। “মা’কে বলব ছাতা কোচিং-এ ফেলে এসেছিলাম তখনই ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। প্লিজ চল না…।” মেয়েটি আবার জোর করে।
বৃষ্টি তখন ঝমঝমিয়ে পড়ে চলেছে। শ্রাবণ মাসের বাদলা এত তাড়াতাড়ি থামবে না কী! পিয়ালী ব্যাগটাকে কোলের কাছে চেপে ধরল। সায়ন আজ এত লেট কেন করছে কে জানে। কবজি উল্টিয়ে ঘড়ি দেখল পিয়ালী। এতক্ষণে এসে যাওয়ার কথা! বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ছোটো হতে লাগল। ধরে আসছে। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে। পিয়ালী ব্যাগ থেকে ফোন বার করে সায়নের নম্বর ডায়াল করল। রিং হচ্ছে… রিং হতে হতে কেটে গেল। কে জানে সায়ন হয়ত বৃষ্টিতে বেরতেই পারেনি। একটা ফোন তো করতেই পারত। চিন্তাগুলো এলোমেলো হয়ে গেল। একটা সময় বৃষ্টিতে ভিজতে কত ভালোবাসত পিয়ালী। কতদিন কলেজ থেকে ফেরার সময় ভিজে ভিজে ফিরেছে। ছাতা ব্যাগের কোনায় থেকে যেত। অথচ আজ বৃষ্টির থেকে পালিয়ে গেল ও। সায়নের সঙ্গে তখন নতুন বিয়ে হয়েছে। দুজনে দুজনায় মিশে আনন্দে আছে। দুর্গাপুজোয় ঠাকুর দেখে ফিরছে ঝমঝমিয়ে এল বৃষ্টি। সায়ন ছুটে গিয়ে কাছেই একটা শেডের তলায় গিয়ে দাঁড়াল। পিয়ালী তখনও খিলখিলিয়ে হাসছে। সায়ন জোরে ডাকছে, “কী হল এসো ভিজে যাবে যে…।” পিয়ালী ডাকল, “তুমিও চলে এসো ভিজবে…।” সায়ন আসেনি, পিয়ালী কাকভেজা ভিজে পরদিন ঠান্ডা লেগে জ্বর এসে যা তা অবস্থা। অগ্যতা পুজোর বাকি দিনগুলো ঘরেই কেটেছিল। সায়ন তখন পিয়ালীকে দিব্যি দিয়েছিল, “তুমি আর কোন দিন…”। পিয়ালী ফাজিল হেসে বলেছিল, “আমি তো দিব্যি মানি না।” কিন্তু তারপর থেকে আর কখনও বৃষ্টিতে ভেজেনি। কতগুলো বছর কেটে গেছে অথচ দিব্যি না মানা পিয়ালী আজও বৃষ্টিতে ভিজতে পারল না। অভ্যাসের বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়া এত সোজা নাকি! প্রায়দিনই অফিস থেকে ফেরার সময় সায়ন পিয়ালীকে নিয়ে ঘরে ফেরে। আজ দুপুরেই সায়ন ফোন করে বলে দিয়েছিল ওকে নিয়ে একসঙ্গে ফিরবে। কী যে হল! অথচ আজ পিয়ালীর অনির্বাণের সঙ্গে থিয়েটারে নাটক দেখতে যাওয়ার কথা। অনির্বাণ পিয়ালীর কলেজ বেলার বন্ধু। সায়নের সঙ্গে কুষ্টি মিলিয়ে বিয়েটা হয়েছিল। গ্রহ নক্ষত্র সব কিছু মিলে গেলেও যেটা মেলেনি সেটা হল মন। দাম্পত্য জীবনের পাঁচালী পড়তে পড়তে সায়নের সঙ্গে সংসারের বাঁধুনিটা যে কিছুতেই মজবুত হচ্ছে না সেটা পিয়ালী বুঝতে পারে বারে বারে। বোঝা না বোঝার মাঝে সংসারটুকু বোবা হয়ে গেছে। অথচ বাইরের লোকের কাছে দুজনের সমস্যাটুকু কিছুতেই বোঝাতে পারে না পিয়ালী। একটা অসোয়াস্তি সমসময় কাজ করে দুজনার মধ্যে। কারণে অকারণে বিশ্বাসের সেতুটুকু দুর্বল হয়ে গেছে। পিয়ালী এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে যেতে চায়। নাহ্! নতুন কোন সম্পর্কের খাতিরে নয়। ধরে নেওয়া যায় কেবল এই বৃষ্টি ভেজার খাতিরেই। যেটা পিয়ালীর জীবনে অপরিহার্য না হলেও প্রয়োজনীয় বটে। মাঝে মাঝে ভাবে সত্যি কি সায়নকে ও ভালোবাসতে পেরেছে!
“এই নে তুই ব্যাগ টা ধর আমি একটু ভিজি… ধর ধর…”। মেয়েটির কথায় পিয়ালীর ভাবনার তার ছিঁড়ে গেল। ব্যাগটা ছেলেটার হাতে দিয়ে নাছোড়বান্দার মতন মেয়েটা রাস্তার মাঝখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে খিল খিল করে হাসছে। “বুদ্ধুরাম তুইও আয় না… দেখ ভীষণ রিফ্রেশ লাগবে। সত্যি রে৷” পিয়ালীর ফোনটা বেজে ওঠে, চেন খুলে ফোন বার করে। সায়ন। “কি গো কোথায় তুমি কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি, একটা ফোন তো করবে!” পিয়ালীর গলায় বিরক্তি ঝরে পড়ে। “হ্যালো, হ্যালো… হ্যাঁ ম্যাডাম আপনি প্লিজ নীলরতন হাসপাতালে একবার চলে আসবেন… হ্যালো…”। অপর প্রান্ত থেকে অপরিচিত গলা ভেসে আসে। পিয়ালীর বুকের ভিতরটা ধক করে ওঠে, “হ্যালো, সায়ন কোথায় কী হয়েছে ওর… হ্যালো…।”
– “ম্যাডাম প্লিজ একবার আসুন। ছোটো একটা বাইক অ্যক্সিডেন্ট হয়েছে, ঘাবড়ানোর কিছু নেই… হ্যালো… শুনছেন…।”
পিয়ালীর বুকের ভিতর হাজার বিস্ফোরণ ঘটে যায়। নীলরতন এখান থেকে বেশী দূরে নয়, হাত পা কেমন যেন কাঁপছে। পিয়ালী জোরে হাঁটা লাগায়, তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে হবে। বাসে উঠতে হবে। আরও জোরে হাঁটতে থাকে পিয়ালী। পিয়ালী হাঁটছে না দৌড়াচ্ছে। বৃষ্টি আবার জোরে পড়তে থাকে। পিয়ালী ভিজে যাচ্ছে। চোখের জল মিশে যাচ্ছে বৃষ্টিতে, কাজল ঘেঁটে যায়। গলার কাছে দলা পাকায় কান্না। কেন কেন পিয়ালী ছুটে যাচ্ছে! আশপাশের জলছবি ঝাপসা লাগে ওর। হালকা সবুজ চুড়িদারটা ভিজে সপসপে হয়ে গায়ে সেঁটে গেছে, পিয়ালী ছুটতে থাকে। হঠাৎ করে ওর মনে পড়ে যায় সায়ন দিব্যি দিয়েছিল “তুমি আর কোন দিন…”। পিয়ালী ব্যাগ থেকে তড়িঘড়ি ছাতা বার করে। পিয়ালী সায়নের দেওয়া দিব্যি যে ভাঙতে চায় না।
ছবি: কুন্তল
লেখকের কথা: অর্পিতা
অর্পিতা কলকাতার বাসিন্দা। নেহাত খেয়াল বশেই একদিন ডায়েরির পাতা থেকে লেখাটা মেইল করে পাঠিয়ে দিয়েছিল পরিচিত বানিজ্যিক ম্যগাজিনে ৷ সেই ছাপার অক্ষরে প্রকাশ পেল অনুগল্প। তারপর খোলা চোখে বাস্তব অভিজ্ঞতায় কখনও কল্পনার আঁচড় মিশিয়ে একের পর এক লেখা প্রকাশ পেল কখনও ফেসবুকের দেওয়ালে কখনও বা লিটিল ম্যগাজিনের পাতায়। কখনও বা প্রকাশিত হল গল্প সংকলনে।
Lekha ta ses ke no karo na??
মিষ্টি গল্প। ভাল লাগল দিব্যি দিয়ে বললাম
মিষ্টি সুন্দর একটা গল্প।
😃
Osadharon.
খুব সুন্দর…
Khub sundor….❤❤❤
ভালো লাগলো লেখা টা
Ses ta nijer moton bujhe nite besh lage
সুন্দর গল্প