লেখক: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ
বিয়ের পর প্রথম স্পর্শ পেয়েছিলাম ওর। পার্থিব যা কিছু স্পর্শ এর আগে অবধি পেয়ে এসেছিলাম, সে সবের থেকে মধুর ছিল সেটা। সে সবের থেকে গভীর ছিল সেটা, এতটাই গভীর যে বিয়ের এক বছরের মাথায় আরও একটি প্রাণ এল সংসারে।
বিয়ের প্রথম কয়েক মাস কোনও অভিযোগ ছিল না আমার, কোনও অভিমান ছিল না আমার। কিন্তু ধীরে ধীরে আমার আর নীলিমার সম্পর্কটা কেমন বদলে গেল যেন। ও বড় বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ল সংসারের নতুন আগন্তুককে নিয়ে। তাকে নিয়ে আমরা সবাইই ব্যস্ত ছিলাম, কিন্তু নীলিমা তার সবটুকু সময় দিয়ে ফেলেছিল আমাদের ছোট্ট খোকাকে। ওর দুনিয়াটায় আমার স্থান খুঁজে পাচ্ছিলাম না কোথাও।
সকালে ঘুম থেকে উঠে বাবাকে চা দেওয়া থেকে শুরু করে রাতে গান শুনিয়ে খোকাকে ঘুম পাড়ানো অবধি সারাক্ষণই ও নিজের দায়িত্ব পালন করে সুষ্ঠুভাবে। একবার খোকা ঘুমিয়ে পড়লে আমার হাত ওর হাতকে ছোঁয়ার চেষ্টা করেছিল। আদরভরে হাতটা সরিয়ে দিয়ে ও বলেছিল, “কি করছ! খোকা জেগে যাবে যে!”
আমি বলেছিলাম, “খোকাকে বাবা মার কাছে শুতে দিতে পার তো একদিন!”
যেন ওর বুক থেকে হৃদপিণ্ডটাই খুলে নিয়েছিলাম, এভাবে তাকিয়ে ও বলেছিল, “সে আবার হয় নাকি? খোকা আমায় ছাড়া শোবেই না তো।”
খোকা ওর মাকে জড়িয়ে ধরে শোয়। খোকা শোয় আমার আর নীলিমার মাঝে। আমি আর কথা না বাড়িয়ে পাশ ফিরে শুয়েছিলাম তারপর, পাশ ফিরে শুয়েছিলাম অভিমানভরে।
ধীরে ধীরে নিজেকে বুঝিয়ে নিয়েছিলাম আমি। বাবা হয়ে গেলে দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়। তখন পুরনো প্রেমিকসত্বা হয়তো ভুলে যেতে হয়। আমিও আমার সব দায়িত্ব বুঝে নিলাম আস্তে আস্তে। তবে প্রেমিকসত্বা আমার রয়েই গেল, যদিও হাবে-ভাবে প্রকাশ করলাম না আর সেটা। এমন সময় একদিন অফিসের বড়বাবু ডেকে পাঠালেন আমায়। একটা কাজে যেতে হবে রাজ্যের বাইরে। এর আগে অনেকবারই মানা করেছিলাম আমি, তখন পরিবারই ছিল আগে। কিন্তু সেদিন ভাবলাম যাই। পরিবারের কথা ভেবেই যাই। পয়সা আসবে কিছুটা বেশি, আর সংসার চালাতে বেশি পয়সা তো লাগবেই। তাছাড়া খোকাও বড় হচ্ছে, পয়সার দরকার অস্বীকার করা যায় না এখন। সেইসব ভেবেই আমি তিনমাসের জন্য পাড়ি দিলাম অন্য রাজ্যে।
প্রথম দুমাস বাড়ির সাথে, খোকার সাথে, নীলিমার সাথে কথা হত ঠিকঠাক। যেমনটা হয় আর কি! শেষ মাসে একদিন অসময়ে ফোন এল নীলিমার। গলাটা একটু ধরা ধরা। জিজ্ঞেস করল, “কি করছ?”
“এই কাজ আর কি?”
“কবে আসছো তুমি?”
“এই তো সামনের সপ্তা! বলেছিলাম তো! খোকা কি করছে এখন?”
নীলিমা কিছুক্ষণ চুপ।
“কি হল?” উদ্বিগ্ন আমি জিজ্ঞেস করলাম আবার।
“আমার ওপর রাগ করেছ তুমি?” জিজ্ঞেস করল নীলিমা।
এক সপ্তাহ পর আমি ফিরে এলাম নিজের রাজ্যে, নিজের বাড়িতে, নিজের ঘরে। রাতে খাওয়ার পর শুতে এসে দেখি খোকা নেই বিছানায়।
“খোকা কোথায়?” বিছানা থেকে উঠতে উঠতে জিজ্ঞেস করলাম আমি। দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছে নীলিমা। আমায় বাধা দিয়ে বলল, “দাদু ঠাম্মার কাছে”
“কিন্তু ও কাঁদবে যে…”
“কিচ্ছু কাঁদবে না। শুয়েও পড়েছে এতক্ষণে…”
আমায় বিছানায় শুইয়ে দরজায় খিল তুলে এল নীলিমা। ওর খসে পড়া শাড়ির আঁচল আমার মুখ ঢেকে দিল। আঁচল সরিয়েও কোনও আলো দেখতে পেলাম না আমি। কারণ ঘরের আলো নিভে গেছে ততক্ষণে।
তবে এই অন্ধকারেও আমি দেখতে পেলাম নীলিমাকে। অন্য এক নীলিমাকে। চোখ দিয়ে নয়, স্পর্শ দিয়ে। আমার শরীরে ও ঝড়ের মত বইতে লাগলো। সেই ঝড়ে আমার মনে জমে থাকা রাগ দুঃখ অভিমান সব কোথায় খড় কুটোর মত উড়ে গেল।আমায় ও গিলে ফেলল পুরো, গিলে ফেলল আমার সব সত্বা।
পরের দিন সকালে আমি ঘুম থেকে উঠলাম যখন, নীলিমা তখনও ওঠেনি। এই প্রথমবার বোধহয় ওর থেকে আগে আমি ঘুম থেকে উঠলাম। নীলিমা আমায় জড়িয়ে আছে খোকার মত। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে একটা চুমু খেলাম আমি। হঠাৎ খেয়াল হল, আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মনের মধ্যে খচখচানি একটা। কাল রাতের গভীর স্পর্শে আমাদের সম্পর্কটা গভীর হয়েছে আরও। কিন্ত সেই গভীরতা কি আবার কোনও আগন্তুককে নিয়ে আসবে? সে কি নিয়ে চলে যাবে আমার নীলিমাকে আমার থেকে দূরে! আমি মাথার ঘাম মুছে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। নীলিমাকে জড়িয়ে ধরলাম খোকার মত।
ছবি – লেখক
লেখকের কথা: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ
লেখকের জন্ম পশ্চিমবাংলায়। পেশায় একটি বহুজাতিক সংস্থার তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। নেশায় লেখক এবং পরিচালক। বাঙালির জনপ্রিয় ওয়েবসাইট সববাংলায় এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। কবিতা থেকে শুরু করে গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, চিত্রনাট্য সবকিছুই লিখতে ভালবাসেন। লিটিল ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক বিভিন্ন ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখেছেন। স্রোত থেকে প্রকাশিত তাঁর কবিতার সংকলন দৃষ্টি এবং বালিঘড়ি। এছাড়া তথ্যচিত্র, শর্ট ফিল্ম বা অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের ভিডিও পরিচালনা করেন। ধর্ম এবং বিজ্ঞান তাঁর প্রিয় বিষয়। ভ্রমণ তাঁর অন্যতম শখ। অন্যান্য শখের মধ্যে রয়েছে স্কেচ, ফটোগ্রাফি, ছবি ডিজাইন করা।
Golpogulo sotti khub valo…Thanks erokom bastob feelings gulo amader samne tule dhorar jonno…