লেখক : হৃদয় হক
বাংলায় কত-শত শব্দ যে আছে! কিছু শব্দ হাসায়, কিছু শব্দ কাঁদায়, কিছু শব্দ অন্তরে মৃদু দোলা দেয়। অন্তর দুলে জন্ম দেয় অব্যক্ত অনুভূতি। এ-সবের মাঝে আছে প্রিয় শব্দ, পছন্দের শব্দ। আছে অপ্রিয় শব্দ, অপছন্দের শব্দ। কিছু শব্দ শুনতে এতোই ভালো লাগে যে, বার বার শুনতে ইচ্ছে করে। আবার কিছু শব্দ শুনলেই যেনো গা-জ্বালা করে। মন রেগে যায়।
আচ্ছা, গালমন্দ ব্যতীত কোনো শব্দ কী কখনো অপ্রিয় হতে পারে? কিংবা অপছন্দের? হয়তো হয়৷ পছন্দের শব্দের মতো সাধারণ কিছু শব্দ বাক্যে ব্যবহৃত হয়ে কী অপছন্দ হতে পারে? হয়তো পারে। তবে, অপছন্দ মানে ঘৃণা নয়। এ শব্দটি আমি ঘৃণা করি এবং এ শব্দটি আমার অপছন্দের – কথা দুটি আমার কাছে এক নয়।
বহু আগে ছোট এক লেখায় পড়েছিলাম, বাংলা সাহিত্যের দিকে তাকালে অনেক লেখকের লেখায় কিছু শব্দের প্রয়োগ হয়তো তুলনামূলক বেশি দেখা যায়। অবশ্য এ জন্য সেই শব্দকে লেখকের প্রিয় শব্দ বলা হয়তো ভুল হতে পারে। আবার, না-ও পারে।
পছন্দের শব্দ নিয়ে কথা শোনা গেলেও, অপছন্দের শব্দ নিয়ে কিছু কখনো পাইনি। আমার অবশ্য আলাদা করে ভীষণ প্রিয় অর্থে কোনো প্রিয় শব্দ নেই। তবে অপছন্দের শব্দ আছে বৈকি! তবে এ-ও আপেক্ষিক, চরম আপেক্ষিক!
“আমি” দিয়েই শুরু করি। আমি শব্দটা খারাপ নয়। “আমি” শব্দটা শুনলেই প্রথমে মনে পড়ে যায় দেকার্তের বিখ্যাত কথা – “Cogito, ergo sum” অর্থাৎ ইংরেজিতে, “I think, therefore I am”। বাংলা আর নাই-বা করি। শব্দটা গুরুত্বপূর্ণ, আবার অনেকের কাছে হয়তো সুপ্ত ভাবে প্রিয়। আমার ক্ষেত্রে এই শব্দটাকে খুব একটা ভালো লাগে না। না, এমনটা নয় যে একদমই অপছন্দের! এই যেমন উপরের বাক্যটায় এ শব্দের সাথে আমার কোনো অপছন্দের কিছু নেই। সত্যি বলতে কি, অন্য কারো লেখায় “আমি” শব্দ দেখলেও আমার খুব একটা অপছন্দ হয় না। কিন্তু নিজের লেখায় “আমি” পছন্দের নয়। বেশ বিরক্তিকর এক শব্দ। এমনকি বেখেয়ালি লেখার সময় কিংবা লেখার টানে আমি শব্দটা অজান্তেই ব্যবহার করে ফেলি। কিন্তু পরে, নিজের লেখা নিজেই পড়ার সময় যখন এই শব্দের দেখা পাই, তখন এক বিরক্তিকর অনুভূতি কাজ করে। মনে মনে ভাবি, “আমি” শব্দ ছাড়াও তো এ বাক্য লেখা যায়। অতপর শব্দটি সরিয়ে দিই।
নিজের লেখায় “আমি” দেখলে মনে হয়, কোথায় যেনো আমিত্ব বা আমিত্বের সুপ্ত প্রকাশের গন্ধ পাচ্ছি। এ আমার ভালো লাগে না। কিন্তু সম্পাদনার আগে বেখেয়ালি বা লেখার টানে যে নিজের লেখায় অপছন্দ শব্দ “আমি” চলে আসে? তার মানে কী নিজের ভেতর সুপ্ত অবস্থায় আমিত্ব বেড়ে ওঠছে? আবার নিজেই তা লেখায় চলে আসে, সুপ্ত ভাবেই! সুপ্তের সুপ্ত! বড্ড বাজে বিষয়। তবে আজকাল অতো হয় না। হতে দেই না।
কিন্তু এ লেখা আমার না হয়ে যদি অন্য কারো লেখা হতো। সেখানে যদি সেই জাগায় “আমি” শব্দটা থাকতো, তাহলে আমার কোনো অসুবিধাই যেনো হতো না! আবার সাধারণ কাজে, যেমন ধরুন একটি জাতীয় উদাহরণ — “আমি ভাত খাই”। এই ভাত খাওয়ার “আমি” নিজের লেখায় লিখলেও বিন্দুমাত্র খারাপ লাগতো না। এ এক আজব মন আমার। তবে, সেই বিশেষ “আমি” শব্দটি আমার পছন্দ নয় বিধায় কোনো আপত্তি নেই। একে ভালো লক্ষ্মণ মনে হয়। আসলে, অনেক ভেবে দেখলাম। সেই আমিকে আমরা’য় পরিণত করায় এক অসাধারণ অনুভূতি আছে।
অধিকাংশ সময়েই আমি’র পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকে আমরা। পর্দা ভেদ করে আমরা-কে সামনে আনা জরুরী। আমরা’য় আমি থেকে প্রচুর অনুভূতি আছে। তাই বলে আমি’তে অনুভূতি নেই তেমনটি’ও নয়। কিছু আমি’র অনুভূতি হয়তো আমরা-কে’ও হার মানায়। নানান দিক থেকে হয়তো আমরা এগিয়ে। কিন্তু, আমি’র পর্দার আড়ালে যেমন আমরা থাকে, ঠিক তেমনি আমরা’র কঠিন পর্দার আড়ালেও আমি লুকিয়ে থাকতে পারে। ভেবে দেখলাম, সেই আমি আমরা’র মধ্যেই থাকা ভালো। আমরা’র পর্দা সরিয়ে যত্রতত্র ছড়িয়ে পড়লে কটু লাগে। আমরা’র আমি, আমরা’র মধ্যে প্রথম থেকেই আমি রূপে থাকে পারে৷ আবার আমরা মিলেও একটা আমি তৈরি করা যায় বা সুপ্ত অবস্থায় জন্মায়। এই আমি আর আমরা’য় খুব একটা পার্থক্য নেই। এই আমি ক্ষমতাবান। এই “আমি” আমার প্রিয়। কিন্তু এই আমিকে “আমি” লেখা যায় না। লিখতে হয় “আমরা”।
আচ্ছা “প্রিয়” শব্দটা সুন্দর না? আমার ভালো লাগে। আবার ধরুন, পাঠক, দর্শক কিংবা শ্রোতা – এ শব্দগুলো? এ শব্দগুলোও আমার পছন্দের। কিন্তু অদ্ভুত এবং অজানা এক কারণে “প্রিয় পাঠক” শব্দটা আমার ভালো লাগে না। কিন্তু “প্রিয় দর্শক” বা “প্রিয় শ্রোতা” অথবা “সুপ্রিয় দর্শক”, “সুপ্রিয় শ্রোতা” – এগুলো আমার পছন্দের। তার মানে কী পাঠক প্রিয় অথবা সুপ্রিয় হতে পারে না? বা হোক সেটা আমি চাই না? না তেমটা মোটেই নয়। কিন্তু “প্রিয়” ও “পাঠক” শব্দ দুটি পাশাপাশি বসে “প্রিয় পাঠক” হলে আমার কেমন যেনো লাগে। নিজের লেখায় তো এটি কখনো লিখিই না, অন্য কারো লেখায় দেখলেও ভালো লাগে না। কিন্তু হয়তো সেই লেখকের ভালো লাগে। হয়তো সেই লেখকের অধিকাংশ পাঠকের ভালো লাগে।
আচ্ছা, এ শব্দগুলো কী শুনতেই ভালো লাগে বিধায় “প্রিয় পাঠক” আমার ভালো লাগছে না? যেমন: টেলিভিশনে প্রিয় বা সুপ্রিয় দর্শক শুনতে আমার ভালো লাগে। আবার বেতারে প্রিয় বা সুপ্রিয় শ্রোতা শুনতেও আমার ভালো লাগে৷ কিন্তু কল্পনা করছি – লেখক বলছেন “প্রিয় পাঠক”, না অনুভূতি পাল্টাচ্ছে না। আচ্ছা তার মানে কি এমন যে, যে-সব শব্দ শুনে ভালো লাগে তাদের পড়তেও ভালো লাগে? তা-ও আমার ক্ষেত্রে অনিশ্চিত। যেমন ধরুন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। শব্দটা আমার অপছন্দের নয়। কিন্তু শোনার ক্ষেত্রে অতো পছন্দ করি না। লেখাতে পড়তেই বেশি ভালো লাগে৷
আসলেই লেখার শব্দ ও শোনার শব্দ সবসময় এক না। বক্তৃতা ও লেখার স্বাদ আলাদা হওয়ার অনেক কারণ আছে। হয়তো এটিও সেসব কারণের একটি।
এবার ধরুন “বন্ধুরা”। “বন্ধু” শব্দটি আমার প্রিয় একটি। আমিও ব্যবহার করি লেখায়, কথায়৷ যদিও “বন্ধু” থেকে “দুস্ত” তুলনামূলক বেশি ব্যবহার করি৷ কিন্তু কোনো গ্রুপ বা পেজে যখন সকলের উদ্দেশ্যে “বন্ধুরা” দিয়ে লেখা শুরু করেন তখন আমার ভালো লাগে না। না, এমনটা নয় যে সেখানকার সকলে আমার বন্ধু না বা বন্ধু হতে পারে না৷ কিংবা যিনি আমাদের জানাচ্ছেন তিনি আমাদের বন্ধু নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে শব্দটা কেমন যেনো। আমার ক্ষেত্রে তো মনে হয় “বন্ধুরা” বলে উল্টো যে বন্ধু ভাব ছিলো সেটা যেনো অন্যকিছু হয়ে যায়। যেনো উল্টো আরো বেশি ফরমাল হয়ে ওঠে। শুধু লেখাতেই নয়, বাস্তবেও যদি কেউ গ্রুপের মধ্যে “বন্ধুরা” বলে সকলের উদ্দেশ্য কথা বলা শুরু করে তাহলেও সেটি আমার ভালো লাগবে না। এমন কিছু না বলে সরাসরি শুরু করলেই আমার বেশ ভালো লাগে বা লাগবে। এ এক শব্দ লেখা ও শোনা দু’টোতেই পছন্দ নয়।
আচ্ছা, শুধু আমারই এমন হয়? নাকি হয় আপনাদেরও?
লেখক পরিচিতি : হৃদয় হক
শিক্ষার্থী। সময়ে অসময়ে প্রধানত জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে লেখালেখি করি।