ইচ্ছে ডানা

লেখক : শর্মিলা মাইতি

নীলাঞ্জনা ওরফে নীলুর পিঠ ঠেকে গেছে দেওয়ালে। সে কোনো দিন ভাবেই নি এমন পরিস্থিতি তার জীবনে আসতে পারে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত সে রঙিন স্বপ্নে বিভোর ছিল। কিন্তু আজ সেই স্বপ্নের সবটাই ফিকে হয়ে গেছে।
এখন ভাবলে সবটাই কল্পনা বলে মনে হয়। বেশ কয়েক বছর আগের কথা , নীলু তখন একটা ছোটখাটো অফিসে কর্মরতা। অফিসের মাইনে সংসার চলে না ঠিকমতো তাই একটু আধটু টিউশনি করত সে। এর-ই মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তার জীবন। মেয়ে বড় হলে মধ্যবিত্ত সব পরিবারের মতো ই নীলুর পরিবার ভাবছিল তার বিয়ের কথা। তাই সেই মতো চলছিল দেখাশোনার পর্ব।
হঠাৎ করেই একজনের সঙ্গে নীলুর বিয়ে প্রায় ঠিক হয়ে যায়। পাত্রের নাম সায়ন্তন দে, বলিষ্ঠ দেহ গায়ের রং ফর্সা। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান এবং একটি সরকারি অফিসে কর্মরত। খুব সহজেই নীলুর পরিবারের কাছে এই পাত্র গ্ৰহনীয় হল। হবু স্বামী ও নতুন সংসারের মোহ গ্ৰাস করল নীলুকে। চোখে তার এখন নতুন স্বপ্ন। তবে বিয়েতে এখন ও বেশ কিছু মাস দেরী তাই নিজেরা নিজেদের মত একটু আলাপ জমানোর জন্য দেখা করল ক্যাফেটেরিয়া তে। হাল্কা অথচ স্নিগ্ধ ও মিষ্টি সাজে নীলু পূর্বে ঠিক হওয়া একটা ক্যাফে তে অপেক্ষা করছিল সায়ন্তন এর জন্য। একটু দেরীতে সায়ন্তন এল, এবং এসে সে যা বলল তা শুনে নীলু তো অবাক। সায়ন্তন বলল এত ডেসপারেট মেয়ে তার ভালো লাগে না তাই নীলু নিজের নয় বরং তার কথা মত চলবে, প্রথমে একটু অন্যরকম লাগলেও নীলু তাই মেনে নিয়েছিল। এই মেনে নেওয়া টা দিনের পর দিন এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করল যে এখন নীলুর সমস্ত কাজে সায়ন্তন এর খবরদারি শুরু হল। অফিসের যাওয়া আসা, টিউশনি পড়তে যাওয়া সব কিছুই করতে হত সায়ন্তন এর কথা মতন আর না শুনলে তাকে সহ্য করতে হত অশালীন ও অপমানজনক নানা কথা। ভেতরে ভেতরে নীলু মানসিক যন্ত্রণায় শেষ হয় যাচ্ছিল। দুটো মনের কথা বলার মত লোক সে পায় নি। বাড়িতে ও কিছু বলতে সাহস হয় নি নীলুর, কারণ তার বাবা অসুস্থ, কিন্তু তার ও মেয়ের বিয়ে নিয়ে বাবা মা বেশ আনন্দিত। নীলু জানলার ধারে মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবত প্রকৃতির এই মুক্ত রূপ কি সুন্দর কিন্তু সে পরাধীন, অপমান আর অপমানে ই কি তবে তার জীবনের ইতি ঘটবে। এমন সময় বেজে ওঠে ফোনের রিংটোন, ‘অচিন পাখি’…সায়ন্তন এর ফোন, ফোন রিসিভ করতে দেরী হওয়ায় আবার ওর সেই বস্তাপচা কথা।
সময় যে বড় ই গতিশীল তাই দেখতে দেখতে বিয়ের দিন এগিয়ে এল, বিয়ের কেনাকাটা ও শুরু হয়ে গেল। কিন্তু এর ই মাঝে চলছিল নীলুর মনে দ্বন্দ্ব। সত্যি কি নীলু বিয়ে করে সুখী হবে? না কি সব টা এলোমেলো হয়ে যাবে। সায়ন্তন এর কথা মানেই তার শেষ পর্যন্ত একটা বড় ঝামেলায় গিয়ে শেষ হবে। এর একমাত্র কারণ হল সায়ন্তন এর ‘কথা’ , যা নীলু কে নিঃশব্দে ক্ষত বিক্ষত করে।নীলুর কাছে সায়ন্তন তার মনের প্রেমাস্পদ থেকে সরে গিয়ে একটা বিরক্তিকর বস্তুতে পরিণত হয়েছে। ওর কথা গুলো বড্ড বেশি রূঢ়।


আমরা কেউ জানতেই পারি না আমাদের মধ্যে ই একজন কিলার থাকে আর সে হল ‘কথা’। অথচ এই কথা দিয়ে ই আমরা অন্য মানুষের সাথে প্রথম আলাপ করে থাকি।সায়ন্তন এর রূঢ় ও অপমান জনক কথা গুলো নীলুর মনকে প্রতিবার ই ক্ষত বিক্ষত করে। কথা যে মানুষ কে মৃত্যুর মুখে পর্যন্ত ঠেলে দিতে পারে আজ নীলু তার জীবন দিয়ে বুঝলো। একদিন নীলু অফিস থেকে ফিরছিল এমন সময় দেখা হল তার পুরনো বন্ধু রিদ্ধির সঙ্গে। রিদ্ধি আর নীলু এক সঙ্গেই স্কুল লাইফ শেষ করেছিল, আর তার পর তাদের জীবন বয়েছিল অন্য পথে। রিদ্ধি যেন নীলুর কাছে বৈশাখীর তপ্ত দুপুরে একঝলক মেঘের মত।
রিদ্ধি কে দেখে নীলু আর নিজেকে সামলাতে পারেনি। নীলু রিদ্ধিকে তার সমস্ত কথা জানায়, রিদ্ধি সব শুনে তো অবাক। নীলুর এই মানসিক বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে রিদ্ধি নীলুর পাশে দাঁড়ায়। রিদ্ধি নীলু কে বোঝায় বিশ্বাস আর সম্মান সম্পর্কের ভিত। অ্যাডজাস্টমেন্ট সেই ভিতকে আরো দৃঢ় করে , কিন্তু শুধু একতরফা অ্যাডজাস্টমেন্ট দিয়ে কোন সম্পর্ক টেকে না। রিদ্ধির‌ কথা গুলো নীলু কে যেন নতুন ভাবনা য় ভাবিত করল।
ভালোবাসা একটা অঙ্কুরিত বীজ যাকে জল আলো সব দিতে হয় শুধু বেড়াজালে আবদ্ধ করলে তাকে বাঁচানো যায় না। সায়ন্তন এই ভাবনা গুলো থেকে সহস্র যোজন দূরে,ও শুধু অধিকার বোঝে আর কিছু নয়।

রিদ্ধির কথা শুনে নীলুর মন আরো অস্থির হয়ে গেল। এত দিন এই সম্পর্ক নিয়ে অন্য কিছু ভাবে নি সে শুধু পরিবারের কথা ভেবে। কিন্তু এখন নীলুর মনে হচ্ছে নিজে একটু মুক্তির স্বাদ পাবার জন্য যদি স্বার্থপর হই,তাতে কি খুব বেশী অন্যায় করা হবে? এটা ও তো ঠিক তার কাছে এই সম্পর্কটা একটা বড় বোঝা হয়ে গেছে,সায়ন্তন কে এখন সে ভয় পায়,বিয়ে যেন বিভীষিকাময়।
এখনো পর্যন্ত নীলু সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না কি করবে? আর তো একমাস বাকি,একবার নিজের জীবন নিয়ে জুয়া খেলে দেখবে নাকি যদি জিতে যায়…না তা হল না অফিস থেকে ফেরার পথে সায়ন্তন এর রূঢ় কথা ও ব্যবহার নীলু কে এবার তার চরম সিদ্ধান্তে পৌঁছে দেয়। সে নিজে স্বার্থপর হবে এবং তার ইচ্ছে ডানা কে আর সে ছেঁটে ফেলবে না বরং নতুন দিনের জন্য অপেক্ষা করবে।


লেখক পরিচিতি : শর্মিলা মাইতি
সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে,তাই বড়ো হওয়াটা ও সাধারণ ভাবেই। বাংলা বিভাগের ছাত্রী। নিজের একটা আলাদা পরিচিতি গঠনের সামান্য প্রয়াস মাত্র।

4 Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা আহ্বান - বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন