বিবাহবার্ষিকী

লেখক : অম্লান ভট্টাচার্য

ঘুম আসতে চাইছে না কিছুতেই অনেক রাত হলো কটা বাজলো বুঝতে পারছি না, উসখুস উসখুস করছি এই ভাবে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন সকাল হয়নি, রাত আছে, তিনটে সাড়ে তিনটে হবে । হঠাৎ কেমন একটা অনুভুতি হচ্ছে সমস্ত দেহ জুড়ে, একটা মিষ্টি গন্ধ ঘরের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে এবং আরো আশ্চর্য যে একটা চরম নিঃশব্দতা আমার চারপাশে, এ কেমন পরিবেশ সৃষ্টি হলো বুঝতে পারছি না কিন্তু আমাকে বিছানায় জোর করে শুইয়ে দিতে চাইছে কেউ উঠতে চেষ্টা করেও কিছু তেই পারছি না। আমার দুটো হাত যেন দু’দিকে শক্ত করে বাঁধা হয়েছে, পা ও অন্য দিকে একবিন্দুও নড়াতে পারছি না । ভয় পেয়ে গেলাম এই অবস্থা আমার কেন হলো কি করে সম্ভব হলো, ঘরের ভেতরে আমি তো একা কেউ তো নেই তবে আমি কি অসুস্থ হয়ে পড়লাম, স্ট্রোক জাতীয় কিছু হলো, কিছুই বুঝতে না পেরে চিৎকার করে উঠলাম গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোলো না ঠিক যেন আমার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে কোনো দিকে আমি কোনো সাড়া পাচ্ছি না অবশেষে বুঝতে পারলাম আমার সামনে কোন অশরীরী দাঁড়িয়ে আছে আর ক্রমশঃ তার শরীরের বিভিন্ন অংশ আমার উপর ছায়া বিস্তার করছে এবং আস্তে আস্তে আমাকে ঢেকে ফেলল আর আমি একপ্রকার ভয়ে আতঙ্কে উদ্বেগে মৃতবৎ অবস্থায় পড়ে রইলাম, আমি ধরেই নিয়েছি যে আমার জীবন শেষ অবস্থায় উপস্থিত, আর ঠিক এই সময় আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল বিকট ডোর বেলের আওয়াজে।

দরজা খুলে কাউকে দেখলাম না, ডান দিকে, বা দিকে, সামনে কেউ নেই। মেজাজটা খিঁচে গেল, একে তো ভোর রাতে ওইরকম দুঃস্বপ্ন, বিচ্ছিরি একটা স্বপ্ন কাউকে বলার মতো নয় তার উপর সকাল সকাল কে এইরকম মজা করল, আরেকবার মনটা খারাপ হয়ে গেল। শেষে দরজা বন্ধ করে ঘরে ঢুকতে গিয়ে মনে হলো কে যেন আমাকে একরকম ঠেলে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেল কিন্তু দেখতে পেলাম না কে এই আগন্তুক। এ আবার কি ঠেলা, ইনভিজিবল ম্যান, লে হালুয়া, কি হচ্ছে আজকে। বিছানার উপর এসে বসলাম এবং আমার এমন একটা ঘুম ঘুম পেল আমি যেন বসতেই পারছি না, ভাবলাম ঘুমোলে হবে না, একটু চা বানিয়ে খাই যদি ঘুমটা কাটে এই ভেবে এদিক ওদিক তাকাতে দেখি আমার সামনের রাইটিং টেবিলে এক কাপ ধূমায়িত চা রাখা আছে। উঠে গিয়ে দেখি সত্যিই চা আর ঠিক আমি যে ভাবে পান করি, দুধ চিনি দিয়ে বেশ ভালো এক কাপ গরম চা। আবার চায়ের প্লেটে দুটো বিস্কুট যা আমি রোজ খাই। আমি কিছুই না বুঝে হাত মুখ ধোয়ার বেসিনে দাঁত ব্রাশ করে এলাম এসেই চায়ের কাপে একটা লম্বা চুমুক। চা খেতে খেতে মনে হলো আরে এতো আমার চেনা জানা চা, রমা তো এই চা দুবেলা আমার জন্য বানাতো, তবে কি রমা চা বানিয়েছে কিন্তু তাই বাঃ কি করে হয়, রমা তো আজ অনেক দিন হলো, আমি আর ভাবতে পারলাম না, চা শেষ করে কাপ প্লেট সড়িয়ে রেখে রাইটিং টেবিলের উপর মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। ভাবলাম যাই একবার বাজারে যাই, রান্নার দিদি ও আসছে না আজ আসবে কিনা কে জানে, রান্না করে খেতে তো হবে, আরেকবার ভাবলাম খাবার অর্ডার করেই না হয় খাব, এই সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম এবং যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন অনেক বেলা হয়ে গেছে। ঘুম ভেঙে মনে হলো স্নান করতে হবে, খাবার অর্ডার করতে হবে, অনেক কাজ আছে, তাড়াতাড়ি করে চেয়ারটা কে পিছনে করে বেরোতে গিয়ে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলাম আর ঠিক তখনই আমাকে যেন কেউ ধরে ফেললো, পড়লাম না মাটিতে, সে যেন আমাকে জড়িয়ে ধরে আমাকে বিছানায় বসিয়ে দিল। এমন সময় ডোর বেল বেজে উঠলো আমি উঠে গিয়ে খুলে দেখি ডেলিভারি ম্যান একটা প্যাকেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আমাকে দেখে প্যাকেট হাতে ধরিয়ে দিল আর তখনি বুঝলাম আমাকে কেউ যেন সড়িয়ে দিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেল। জোর খিদে পেয়েছে তাই তাড়াতাড়ি করে বাথরুমে ঢুকে কোনো কোনোরকমে স্নান করে বেরিয়ে এলাম। ডাইনিং টেবিলে খেতে বসলাম, আমার চোখে জল চলে এল, টেবিল সাজিয়ে খাবার পরিবেশন করা হয়েছে, আমার প্রিয় মাটন বিরিয়ানি আর চিকেন ফ্রাই, কড়াই চিকেন, স্যালাড, ডেসার্ট শেষে এক বোতল ঠান্ডা পানীয়। আমার সত্যি চোখ থেকে জল পড়লো টপ টপ করে। এই সমস্ত খাবার ই আমার প্রিয়, রমা আর আমি মাঝে মাঝে এইরকম অর্ডার করে খাবার আনিয়ে বাড়িতে বসে খেতাম।

আমি কি করবো বুঝতে না পেরে পুরো খাবার কে দুটো ভাগে ভাগ করলাম, আমার দিকে একটা প্লেট আর বাঁদিকে একটা প্লেট সাজিয়ে পরিবেশন করলাম, সমান ভাগে মাটন বিরিয়ানি, চিকেন ফ্রাই, কড়াই চিকেন, স্যালাড ও ডেসার্ট, শুধু ঠাণ্ডা পানীয় ভাবলাম খাওয়ার শেষে গ্লাসে ঢেলে নেব। কিন্তু খাবার খেতে কিছুতে মন করল না, হঠাৎ মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখি অনেকগুলো মেসেজ বন্ধু বান্ধবরা পাঠিয়েছে, কারণ হচ্ছে আজ আমাদের ওয়েডিং অ্যানিভারসারি আর সেই উপলক্ষে এইসব মেসেজ। টেবিল থেকে উঠে ঘরের দরজার ছিটকিনি আলতো করে খুলে জাষ্ট দরজা ভেজিয়ে দিলাম, আমার কেবলই মনে হচ্ছিল রমা নিশ্চয় আসবে যদি দরজা বন্ধ দেখে ফিরে যায়, ঘরেই ছিলো চারটে বড়ো মোমবাতি এনে টেবিলের উপর সেঁটে দিলাম, জ্বালালাম না, রমা এসে নিজের হাতে আলো আনবে, জানলার সমস্ত পর্দা ভালো করে লাগিয়ে দিলাম, ঘরটা বেশ আঁধার হয়ে এলো এমনিতেই মাঘ মাস বিকেল হলেই আঁধার নেমে আসে, মিউজিক সিস্টেম অন করলাম, রমার প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সুর চালিয়ে রাখলাম যাতে ও ঘরে ঢুকতে ঢুকতে শুনতে পায়, ঘরের ভেতরে চারিদিকে একটা মিষ্টি গন্ধের রুম ফ্রেশনার স্প্রে করলাম, হালকা নাইট ল্যাম্প জ্বালিয়ে রাখলাম, রঙিন কাগজের চেইন যা ঘরেই ছিলো বের করে সাজিয়ে তুললাম ঘরের ভেতর। মোটামুটি যা করা সম্ভব তাই করে আমি বিছানায় এসে বসলাম। কিন্তু আমার অস্থিরতা ক্রমেই বাড়ছে, ধৈর্য্য হারাচ্ছি, কারণ রমা আসবে তো, কিন্তু ও আসবে কি করে, ওকে তো আমি নিজ হাতে ভালোবাসার অভিনয় করতে করতে হঠাৎ বুঝলাম আমাকে কেউ চেপে ধরেছে, আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, খুব কষ্ট হচ্ছে, আমি বোধহয়না, আমার কষ্ট হচ্ছে, আমি মরে যাচ্ছি, ঘরের দরজা খুলে কেউ যেন ঘরে ঢুকে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে, আমাকে আদর করছে, ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে আদর করছে যার হাত আমার শরীরে তার মুখটা এক ঝলক দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে সমস্ত প্রতিরোধ থেকে নিজেকে মুক্ত করলাম এবং ঘেমে নেয়ে একসার হয়ে ধড়মড় করে উঠে বসলাম। আমি বোধহয় স্বপ্ন দেখছিলাম, দুঃস্বপ্ন, উঠে ঘরের আলোগুলো জ্বালালাম, চোখ চলে গেল খাবার টেবিলে, আমার পাশের প্লেট একদম পরিষ্কার কে যেন ভালোভাবে পরিষ্কার করে খেয়ে নিয়েছে আমার পরিবেশিত খাবার এবং আরো আশ্চর্য যে ঠান্ডা পানীয় অর্ধেক খেয়ে বাকিটা আমার প্লেটের পাশে রেখে দিয়েছে। আমি দরজা বন্ধ করতে গিয়ে দেখি বাইরে দরজার পাশে একগোছা রজনীগন্ধা দেয়ালে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে।

লেখক পরিচিতি : অম্লান ভট্টাচার্য
জন্ম ২৫ ডিসেম্বর ১৯৫৭, কলকাতা। স্কুল - ঢাকুরিয়া রামচন্দ্র হাইস্কুল, কলেজ - সেন্টপলস, বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক, কলা বিভাগে স্পেশাল স্নাতক, কারিগরি শিক্ষা, কম্পিউটার ডিপ্লোমা ও টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউটে শিক্ষা গ্রহণ, কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি অবশেষে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭ অবসর। এযাবৎ তিনটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত, মূলত কবিতা প্রাধান্য পেয়েছে লেখালেখিতে এবং এই সূত্রে চতুর্থ কাব্যগ্রন্থের প্রকাশ।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

রুচিশীল ও বিষয়ভিত্তিক আলোচনার জন্য ক্লিক করুন এখানে

sobbanglay forum