১১টা ৩৬ এর রামপুরহাট প্যাসেঞ্জার এবং সেই ঝালমুড়িওয়ালা

লেখক : দেবাশীষ মজুমদার

আমি অবাক হয়ে দেখলাম। মানুষটা রামপুরহাট প্যাসেঞ্জারের সরু দরজা পেরিয়ে পরের কামরায় চলে গেল। কিছুক্ষন পর আওয়াজ ভেসে এলো- ঝালমুড়ি, দশ পনেরো কুড়ি… ঝালমুড়ি, একটুকরো নারকেল দিয়ে খান ঝালমুড়ি।

২০০৪ সাল। শ্যামনগরে থাকি। কম্পিউটার এপ্লিকেশন নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন করছি তখন। সকাল ৭টা থেকে প্রাকটিক্যাল ক্লাস থাকত যতীন দাস পার্ক মেট্রোর পাশে আই.বি.এমে। ভোর ভোর চলে যেতে হত। ১০.৪৫ নাগাদ ক্লাস শেষ হওয়ার পর মেট্রো ধরে দমদম আসতাম । সেখান থেকে ১১.৩৬ এর রামপুরহাট পাসেঞ্জার ধরে বাড়ি। আসার পথে খিদে পেয়ে যেত প্রতিদিনই। গাড়িতে উঠত বাবার বয়সী এক ঝালমুড়িওয়ালা। রোজই দেখতাম একটা আকাশী নোংরা জামা রয়েছে তার গায়ে। মাঝেমাঝেই ঝালমুড়ি কিনে খেতাম । বেশ ভালোই লাগত সেই ঝালমুড়ি। শুধু বেশী ঝাল দিতে বারণ করতাম। ছোটবেলা থেকেই আমি ঝাল খেতে পারি না । ঝালমুড়িকাকুও বেশ রসিয়ে কসিয়ে মুড়ি মেখে দিতেন। অদ্ভুত স্বাদ তার। আজও যেন সেই স্বাদের ঘ্রাণ পাই। এ স্বাদের ভাগ না হওয়াই ভালো। সেবার শরৎ এল, আকাশে শুরু হল পেজা তুলোর আনাগোনা, কলেজেও পনের দিনের ছুটি পড়ে গেল। রামপুরহাটের কামড়ায় বসে পরিষ্কার আকাশ আর মেঘ দেখতে দেখতে বাড়ি ফিরলাম। মনে এক অদ্ভুত আনন্দ। পুজো আসছে যে! কিন্তু সে আনন্দ বাড়ি ফেরার পর শরতের আকাশে মিলিয়ে গেল। মানি ব্যাগ হাতড়ে দেখি দুটো ৫০০ টাকার নোট গায়েব। মনে পড়ল কলেজে ফীস দিতে গিয়ে মানিব্যাগ বার করে কাউন্টারে ফীস দিয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলাম কাউন্টারে। রিসেপশনের ক্লার্ক জানাল কোনো টাকা পায়নি। অবশ্য পেলেও বলবে না। আজ থেকে কুড়ি বছর আগে ওই হাজার টাকার মূল্য ছিল অনেক। মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। টিউশন করে জমানো টাকা। ভেবেছিলাম পুজোতে খরচ করব । গানের আর পুরোনো বাংলা সিনেমার সিডি কেনার খুব শখ ছিল আমার। লেখালেখির শখ তখনও আসেনি। তাই বই খুব বেশী কিনতাম না। সব ভেস্তে গেল। সাথে মাথা-মন-শরীর সবটা খারাপ হয়ে গেল। বকা খাওয়ার ভয়ে বাড়িতে কিছুই জানালাম না। কিন্তু পুরো পুজো মনমরা হয়ে কাটালাম। পুজোর পর কলেজ খুলল। কেউ সেই হারানো টাকার সুরাহা করতে পারল না। দীপাবলি কেটে গেল আর আমিও জীবনের প্রবাহে ভুলে গেলাম সেই যন্ত্রনার কথা ।

একদিন ফিরছি। আবারো সেই ১১.৩৬ রামপুরহাট পাসেঞ্জার। আবারো সেই ঝালমুড়িওয়ালা। সেদিন খাওয়ার ইচ্ছে নেই তবু সে এগিয়ে আসতে লাগল আমার সিটের দিকে। অবশ্য জানবেই বা কী করে আমার ইচ্ছে নেই। বললাম- আজ খেতে ইচ্ছে করছে না। কিনব না আজ। আপনি আসুন । কাকু হেসে বললেন- না না, কিনতে হইব না। আইজ আমিই কিছু কই। পুজোর আগে শেষ যেদিন ঝালমুড়ি খাইলা সেদিন তোমার পকেট থিকা দুখান ৫০০ টকার নোট পইড়া গেছিল। আমি পাইয়া তুইল্যা রাখছি। ভাবছি তোমারে পাইলে দিয়া দিমু নে। কিন্তু পাই আর কোথা! আজ পাইছি, কিন্তু টকা আনি নাই। পরদিন লইয়া যাইও। সত্যি সত্যিই পরেরদিন ২টো ৫০০টাকার নোট এনে ধরিয়ে দিলেন আমার হাতে। অসম্ভব এক খুশিতে ভরে গেল মন। আমি খুশি হয়ে ১০০ টাকা কাকার হাতে দিতে গেলাম, সে নিল না। হেসে চলে গেল। যাওয়ার আগে শুধু বলে গেল- মাঝেমইধ্যে ঝালমুড়ি খাইও। ওইটাতেই হইব। আমি অবাক হয়ে দেখলাম। মানুষটা রামপুরহাট প্যাসেঞ্জারের সরু দরজা পেরিয়ে পরের কামড়ায় চলে গেল। আওয়াজ ভেসে এল- ঝালমুড়ি। দশ পনেরো কুড়ি… ঝালমুড়ি, একটুকরো নারকেল দিয়ে খান ঝালমুড়ি ।

তারপর আর বিশেষ দেখা হয়নি ওঁর সাথে। কলেজের প্রাকটিক্যাল শিফ্ট হয়ে গেল লালবাজার এরিয়ায়। সময় বদলে হয়ে গেল দুপুর। কিন্তু আজও ঝালমুড়ি দেখলেই ভদ্রলোককে মনে পড়ে যায়। সেই আকাশী রঙের প্রায় নোংরা জামা, সেই না কাচা লুঙ্গি, সেই দাড়ি ভর্তি মুখ। চাহিদা আর লোভকে নূন্যতম করে কীভাবে সততার সাথে বেঁচে থাকা যায়, উনি শিখিয়ে দিয়ে গেছিলেন আমাকে। আজও আমার আইডলদের তালিকায় ওপরের দিকেই থাকবেন তিনি। মাথা উঁচু আর পা’দুটো মাটিতে রেখে বাঁচতে শিখিয়ে দিয়ে গেছেন যে। এমন কজনই বা পারে! আমার কাছে উনি কোনো সেলেব্রেটির চেয়ে কম নয়।


লেখক পরিচিতি : দেবাশীষ মজুমদার
লেখক একজন সরকারী চাকুরে | লেখালেখি ভালোবাসেন ।

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা আহ্বান - বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন

দীপায়ন