লেখক : রিমা গোস্বামী
সুখ বড়ই অনিশ্চিত। তার প্রমাণ এর আগেও বহুবার পেয়েছি । আবারও পেলাম, যখন শুনলাম আমার বনশ্রীদির ডিভোর্স হচ্ছে । বনশ্রীদি সম্পর্কে আমার মাসতুতো ননদ হলেও ওকে আমি বড় ভালবাসি। মানুষটা একদম খাঁটি, মন খুলে কথা বলে। স্বামী, ছেলে আর একটি মেয়ে নিয়ে সংসার দিদির। জামাইবাবু সরকারি সংস্থাতে উচ্চপদে আসীন। ছেলে পড়াশোনাতে খুব ভাল। চাকরি পেয়ে যাবে শীঘ্রই, আপাতত ট্রেনিংয়ে রাজ্যের বাইরে।
মেয়ে মাধ্যমিক দেবে বছর দুয়েক পরে। সুখের সংসার বনশ্রীদির । তবে সে শুধু সংসারে গৃহিণী হয়ে বসে থাকেনি কোনদিন । সেলাই শেখা বা আঁকা শেখা এসব নিয়েই মেতে থাকে দিদি। সবার সাথে এমন ভাবে মিশে যায় যে মনে হবে যেন একদম কাছের মানুষ । স্বামীর চাকরি, অর্থ নিয়ে কোন অহংকার নেই। খোলামেলা দিলখোলা একটা মানুষ যে অবলীলায় বেসুরো গাইতে পারে, হাত পা নেড়ে বিয়ে বাড়িতে নাচতে পারে ।
এমন একটা মানুষের ঘর কি করে ভেঙে যায় !
মেয়ে মানুষের ঘর ভাঙলে স্বাভাবিক ভাবেই তার চরিত্র আগে কলুষিত হয়। এ ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। অনেকদিন মানুষটার খবর না পেয়ে ভাবছিলাম কেমন আছে ওরা? একদিন দিদিকে মেসেজও করলাম কিন্তু কোন উত্তর পেলাম না । তারপর জামাইবাবুকে যথারীতি নক করলাম। বললেন, দিদি আজকাল বাপের বাড়ীতে। ওদের সম্পর্ক নাকি খারাপ! ভাবলাম মজা করছেন। তাই বললাম, সিরিয়াসলি বলুন না! আমার দরকার আছে দিদির সাথে।
জামাইবাবু জানালেন এটাই সত্যি। আর যদি সম্ভব হয় তবে যেন দিদিকে আমরা বোঝাই। দিদি যেন ফিরে আসে। খবর নিয়ে জানলাম দিদি বাপের বাড়ীতে কয়েক মাস ধরে। সোজা চলে গেলাম ওর কাছে। এত সুন্দর সংসার ছেড়ে কেন চলে এলো সে?
দিদিকে দেখে বুঝলাম অনেক যুদ্ধ করছে ভিতরে ভিতরে। ভেঙে পড়ছে দিদি । দিদিকে বললাম, চলো তোমায় দিয়ে আসি। জিজু তোমায় ফিরে পেতে চায়। বুঝলাম কোন ব্যাপারে একটা রাগারাগি হয়েছে। কিন্তু তার জন্য একটা সংসার ভাঙে?
বনশ্রী দিদি বলল, তবে শুনেই যা আজকে আমার সুখের চাদর দিয়ে সাজানো দুঃখের কাহিনী ।
আমি বিয়ের পর থেকেই এডজাস্ট করে আসছি। দিনের পর দিন একই এডজাস্টমেন্ট। না, সে আমাকে কোনদিন কোন অভাব দেয়নি । খেতে দিয়েছে, দামি জামাকাপড় বা গয়না কোনটার অভাব রাখেনি। তবে একটা জিনিসের অভাব প্রতি মুহূর্তে অনুভব করেছি। সেটা হল সম্মান। ছেলেকে মানুষ করেছি, সে খুব শীঘ্রই প্রতিষ্ঠিত হবে। মেয়ে বড় হচ্ছে নিজের মত। তারা দুজনেই বাধ্য ও ভদ্র। তাদের নিয়ে অভিযোগ করার কোন কারণ নেই। তারপরেও পান থেকে চুন খসলেই জুটেছে মার। চুলের মুঠি ধরে ধাক্কা ।
অবাক হলি? হবারই কথা । আসলে আমার ঝাঁ চকচকে জীবনে যে এতটা গ্লানি লুকিয়ে আছে সেটা কেউ বোঝেনি। মা বাবাকে বললে তারা বলেছে এডজাস্ট করতে। আজ বেরিয়ে আসার পর সকলে বলছে, চরিত্র খারাপ তাই এই বয়সে এটা করলাম । কিন্তু বিশ্বাস কর রাধু, আমি পারছিলাম না । আমাকে যেন জ্বলন্ত চিতায় রোজ রোজ কেউ সতী করছিল। আমি আর মানিয়ে নিতে পারিনি সেদিন।
ওর এক বন্ধুর স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে তার দুই নাবালক সন্তানের ভালমন্দ আমরাই দেখাশোনা করছিলাম । সেটাও তোর জিজুর ইচ্ছায়। মায়ায় জড়িয়ে গেছি বাচ্চা দুটোর সাথে। ওদের বাবা সুশীলবাবু মাঝেমাঝে আসেন আমাদের বাড়িতে। বেশ চলছিল সব কিছু। তোর জিজু আমাকে অসন্মান করত একলা থাকলে, সবার সামনে সন্মান দিয়ে এসেছেন। কয়েকদিন ধরেই কেমন যেন একটা সন্দেহ করছিল আমার সাথে সুশীলবাবুকে নিয়ে । তবে আমি অশান্তি বাড়াতে কোনদিন চাইতাম না তাই কোন কথা বলিনি । সেই রাতে খাবার টেবিলে আমাকে বলল, ছেনালী কতদিন ধরে চলছে শুনি? তা অত যদি প্রেম তাহলে চলে যাও সুশীলের হাত ধরে। আমার কাছে কেন খামোখা? সুশীল কি তোমার বাপের ঘরের পেট চালাতে চাইছে না? আমাকে তো দুইয়ে নিলে আজীবন।
সামলাতে পারিনি সেদিন অমন কথা। তাও ছেলে মেয়ের সামনে! তীব্র প্রতিবাদ করে ফেলেছিলাম। আর তার শাস্তি হিসেবে আমাকে রাতেরবেলা ঘর থেকে বের করে দেয় লোকটা। মেয়ে ভয়ে কাঁদছে, ছেলে বারবার অনুরোধ করছে তার বাবাকে, আমাকে ভিতরে ঢুকতে দেবার জন্য, আর আমি বাইরে শীতের রাতে কাঁপছি। লোকটা লাইট অফ করে শুয়ে পড়ল। ছেলেমেয়েকে একটা ঘরে লক করে দিয়েছিল।
অনেকটা সময় অপেক্ষা করে শেষে বাধ্য হয়েই গেলাম সুশীলবাবুর বাড়ি। রাত ওখানেই কেটে গেল । সারারাত কাঁদলাম। কিন্তু বিশ্বাস কর রাধু, আমার সাথে ওঁর তেমন কোনও সম্পর্ক নেই। সকালে তোর জিজু এল আমাকে খুঁজতে খুঁজতে। এসে আমাকে যা নয় তাই বলল। বলল যে, এখন রাত্রিবাসটুকুও হয়ে গেল। আমি আর পারিনি। বলেছিলাম, ঠিক আছে আমি সব অভিযোগ স্বীকার করে নিচ্ছি। আমি আর ওর সাথে ফিরব না।
কথাটা শুনে একটু ধাক্কা খেয়েছিল বৈকি। আসলে এতদিন অত্যাচার করেছে আর আমি সয়ে এসেছি। ভেবেছিল হয়ত রাতে বাইরে বের করে শাস্তি দেবে। তারপর একসময় ইচ্ছে হলে আমাকে আবার ভিতরে ঢুকতে দেবে। রাধু, তোর জিজু ভাবতে পারেনি যে আমি চলে আসব। আমার কথা শুনে একটু নরম হয়ে বলেছিল, তামাশা ছেড়ে বাড়ি ফিরে চলো।
আমি আর যাইনি । চলে এলাম বাপের বাড়ি। অভিযোগ মেনে নিলেও সুশীলবাবুর সাথে আমার কোন সম্পর্ক তো আসলে নেই। তাই ওখানে আমি থাকতাম না। এখানে এসে থেকে অনেক লড়াই , অনেক অপবাদ শুনে শেষে ডিভোর্স ফাইল করলাম। এখন বন্দি পাখিকে ফেরত পাবার জন্য মরিয়া লোকটা বলছে, ভুল তো মানুষ মাত্রেই হয়। আবার নতুন করে সব কিছু শুরু করাই যায়। কিন্তু নিজেকে আমার জায়গায় রেখে তুই বল রাধু, আসলে কি সম্ভব সেটা? এতদিন গ্লানি নিয়ে বেঁচে ছিলাম। হ্যাঁ, মানুষ আমাকে অভিজাত ভাবত। আজকে বদনাম নিয়ে বেঁচে আছি কিন্তু এটাও ঠিক, গ্লানি নেই। রোজ রোজ মার খেতে ভাল লাগছিল না বিশ্বাস কর। মাঝে মাঝে মনে হয়েছিল মরে যাই। মরিনি সন্তানদের জন্য। এখন ওরা বড় হয়েছে। আশা করছি সামলে নিতে পারবে। আমি একটু স্বস্তি পেতে চাই।
দিদি অনেক সময় ধরে একটানা কথা বলে হাপিয়ে উঠেছে। আমি দেখলাম দিদির চোখে জল। দিদির মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, বেশ করেছ তুমি। এক এক সময় অভাব অর্জনের বিনিময়ে মুক্তি পাওয়া বাঞ্ছনীয়।
স্যক্রিফাইজ্ করার অভ্যাসটা নারী জাতির মজ্জাগত হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর কোন বিদ্যাসাগর বা রামমোহন আসবেন না আমাদের বাঁচাতে। এখন নিজের লড়াই তো নিজেকেই লড়তে হবে।
লেখক পরিচিতি : রিমা গোস্বামী
রিমা গোস্বামী প্রতিলিপি (বাংলা) প্ল্যাটফর্মের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক। যুক্ত আছেন 'কুকু এফএম (হিন্দি)' এবং 'হইচই' এর সঙ্গে। 'দ্রাক্ষানী' তাঁর বিখ্যাত প্রকাশিত উপন্যাস।