শুভঙ্কর সান্যালের প্রেম

লেখক : অরিজিৎ লাহিড়ী

১.

মধ্য কলকাতার ট্রেন্ডি পাব “দ্য মিডনাইট আওল”। শুক্কুরবারের রাত, চারদিকে নীল-গোলাপি আলোর ঝলকানি। পাবের মিউজিক সিস্টেমে বেজে চলছে ইংলিশ ক্লাসিক, বি জিজের “স্টেইন’ অ্যালাইভ”। গোটা পানশালা যেন গানের তালে তাল মেলাচ্ছে। এক কোণায় বসে হুইস্কির গ্লাস হাতে ফোন স্ক্রল করছে শুভঙ্কর। অবিবাহিত, তিরিশ পেরিয়েছে, মনের মধ্যে একরাশ নিস্তব্ধতা। কর্মব্যস্ত একঘেয়ে সপ্তাহ শেষে, ওর পালানোর রাস্তা—একটা লার্জ হুইস্কি আর চেনা গানের চেনা ছন্দ।

তখনই সে এল।

শ্রাবণী, চল্লিশের কোঠায়, চোখে মুখে একরাশ হতাশামাখা ব্যঙ্গের হাসি। তার ব্যক্তিত্বপূর্ণ হাঁটাচলা দেখে বোঝাই যায় যে, অনেকগুলো দৃষ্টি তার দিকে ফিরবে। বিবাহিত হলেও দাম্পত্য জীবনে তার শান্তি নেই। ছেলের বয়স পনেরো। আর এখানে ও এসেছে নিজের ইচ্ছেতে একাকী, বিরক্তির জীবন থেকে কিছুটা মুক্তির খোঁজে, কিন্তু একফোঁটাও প্রস্তুতি ছিল না শুভঙ্করকে “আই উইল সারভাইভ” গানের কথায় উত্তেজিত হয়ে ঠোঁট মেলাতে দেখবার – কী অদ্ভুত ইরোনি!
“সার্ভাইভিং, আর উই?” বার কাউন্টার লাগোয়া শুভঙ্করের পাশের চেয়ারে বসে হাসতে হাসতে প্রশ্ন করল শ্রাবণী।
“হ্যাঁ, না হলে কী আর এখানে আসা হত?” শুভঙ্করও হাসল, “আমার তো এখন মনে হচ্ছে, *লভ অ্যাকচ্যুয়ালি* লায়েড টু আস!”
সহজভাবে কথাবার্তায় ডুবে যেত লাগল ওরা, একে অপরের সাথে হাসি ভাগ করে নিচ্ছিল অপরিসীম সাবলীলতায়, ড্রিংকে চুমুক দিতে দিতে, যেন এটা তাদের প্রথম ডেটই নয়। “এই বেঢপ উডল্যান্ডের জুতোটা তাহলে তোর সিগনেচার স্টাইল ফর ফার্স্ট ডেট?” ঠোঁটে তির্যক হাসি ঝুলিয়ে প্রশ্নটা করল শ্রাবণী। প্রতি উত্তরে শুভঙ্কর বলল, শ্রাবণীর ইন্সট্যাগ্র্যাম স্টোরিতে ঘুরে ফিরে আসা সাদার্ন অ্যাভেন্যুর ক্যাফের ল্যাতে কাপের কথা।

বেশ কয়েকটা চুমুকে, কথায় কথায়, তারা আলাপ জমাল। হঠাৎ, অতর্কিতে, কোনরকম চিন্তাভাবনা না করেই, শ্রাবণী শুভঙ্করকে একটা অপ্রতিরোধ্য গোত্রের চুমু খেয়ে বসল—চোখেমুখে হালকা মাদকতা আর এতটুকু সংকোচ নেই। চারপাশের সবাই হকচকিয়ে গেল কি গেল না, তাতে শ্রাবণীর কিছু এসে যায়না। ওরা দু’জন খুব হাসছিল, যেন নিজেদের পাগলামিতেই আনন্দ।

বয়সের ব্যবধান ভেঙে দেওয়া একটা প্রেম অথবা প্রেমের মতই কিছুর সূচনালগ্নের সাক্ষী ছিল “দ্য মিডনাইট আওল” বার, যার সূত্রপাত ঘটিয়েছিল ফেসবুক স্টোরিতে পোস্ট করা ছবির সঙ্গে কিছু গান আর মেসেঞ্জারে ককটেল নিয়ে বার্তালাপ মাস চারেক আগে।

২.

নভেম্বর মাসের এক শনিবার সন্ধ্যায় শুভঙ্কর এসেছে শ্রাবণীর আমন্ত্রণে তার বাড়িতে। শ্রাবণী ইণ্টিরিয়ার ডিজাইনার, উঠতি অন্ত্রেপ্রেণর, তাই রুচিশীল তার হিন্দুস্তান পার্কের বাড়ির অন্দরসজ্জা। তার স্বামী অপ্রতিম অফিসের কাজে কানাডা আর ছেলে মামার বাড়িতে। দু’জনের জন্যই একদম কাঙ্ক্ষিত পারফেক্ট পরিবেশ।
লিভিং রুমে বসে দু’জনে একের পর এক ড্রিঙ্ক করছিল। রেকর্ডে বাজছিল “হোটেল ক্যালিফোর্নিয়া”। কথায় কথায় রাতটা যেন সেই আগের দিনের পাগলামিতে ভরে গেল।
সেই রাতে যা ঘটেছিল, তা দুজনের জন্যই স্মরণীয়।

সকাল বেলায়, সূর্যের আলোর ঝলকানিতে শ্রাবণী নিজের গায়ে পোশাক জড়াতে জড়াতে হেসে বলল, “দেখ, ডোন্ট গেট এনি আইডিয়া মিস্টার! এটা কিন্তু জাস্ট একটা রাতের ব্যাপার।”
শুভঙ্করও হাসল, যদিও ভিতরে একটা ঝাঁকুনি তার লাগল। মনে মনে ভাবল, কিছু বলবে কি বলবে না—এটা কি সত্যিই এক রাতের ব্যাপার?

৩.

ওদের দেখাসাক্ষাৎ চলতেই থাকে। কখনও ক্যাফেতে, কখনও বইয়ের দোকানে। গসিপ আর হালকা হাসিঠাট্টা ধ্রুবক, কিন্তু কোন রোমান্টিক মুহূর্ত নয়। শ্রাবণী শুভঙ্করকে নিয়ে মজা করে, “তোর ফ্যাশন সেন্সটা টেরিব্যল”—আর সে পাল্টা প্রশ্ন করে, “তোর ইনস্ট্যাগ্র্যামের ল্যাতেগুলোর থেকেও?”
কিছু উপহারও আনে শুভঙ্কর—ফুটপাথ ঘেঁষা দোকানে খুঁজে পাওয়া অদ্ভুত চাবির রিং, বা পুরনো ভিনাইল রেকর্ড। শ্রাবণী সেগুলো নেয় মিষ্টি হাসিমুখেই। একাকী রাতে শুভঙ্কর তার কথা ভাবে বিছানায় শুয়ে শুয়ে, চোখের সামনে ভেসে ওঠে তাদের সেই রাতের ঘনিষ্ঠ মুহূর্তগুলো, শ্রাবণীর হাসি, সোজাসাপ্টা কথা, হঠাৎ করা চুমু—সবকিছু ওর মাথায় ঘোরে। বিছানায় শুয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে শুভঙ্কর। নিজেকে বোঝাতে চায়, এতে বেশি কিছু ভাবার দরকার নেই; শুরু থেকেই তারা দুজন স্পষ্ট করে নিয়েছে যে এটা স্রেফ একটা… মজা।

এক সন্ধ্যায়, ওদের আড্ডা জমেছে একটা রুফটপ বারে, পিছনে বাজছে “ড্রিম অন”। ওরা দু’জনেই কথায় কথায় রোজকার মত হারিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ শুভঙ্করের মনে সাহস এল কিছু একটা বলার, কিছু সত্যি কথা!
“সো শ্রাবণী!” শুভঙ্কর একটু নিচুস্বরে কাঁপা গলায় বলল, “আই ডোন্ট নো, দ্যাট মে বি দেয়ার… মে বি দেয়ার মোর টু আস, দ্যান জাস্ট ড্রিংকস অ্যাণ্ড জোকস।”
শ্রাবণী একটু থমকাল, তারপর নিজের অপ্রস্তুতভাবটা কাটিয়ে বলল, “তুই খুব সুইট একজন মানুষ! কিন্তু, ইউ নো – রোমান্সের জন্য আমি আসিনি এখানে। আই হ্যাভ গট আ কিড, আ হাসব্যান্ড – ইভেন হি’জ মোর অফ আ স্ট্রেঞ্জার অ্যাট দিস পয়েন্ট। আর তুই… ইউ আর জাস্ট লুকিং ফর আ ব্রেক ফ্রম বিয়িং অ্যালোন! আরন’ট ইউ?”
শুভঙ্কর যথাসম্ভব মনের ভেতরের ভাবটা চেপে রেখে বলল, “তাহলে আমি কি তোর প্রিন্স চার্মিং নই?”
শ্রাবণী তার হাতটা ধরে হাসতে হাসতে বলল, “সরি, কিন্তু প্রিন্স চার্মিংকে এই পেইসলি শার্ট একদম মানায় না।”
শুভঙ্করের ভিতরটা গুলিবিদ্ধ হয়ে ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে। ও চুপ করে গেল, মনে হ’ল কিছু বলবে, কিন্তু হাসতে হাসতে দুঃখটা সহজেই গিলে নিল হুইস্কি সাওয়ারের সাথে সাথে।

৪.

ওদের দেখাসাক্ষাৎ কমে এসেছে অনেক। বছরে এক অথবা দু’বার, বাকিটা ফোন আর হোয়াটস্যাপ। যখন ওরা দেখা করে, এক ধরণের নীরব বোঝাপড়ায় আটকে থাকে দু’জনে, একটি অদৃশ্য সীমারেখা, যা কেউই আর অতিক্রম করতে চায় না।

এই সেদিন শ্রাবণী বলল, ওরা আগামী পাঁচ বছরের জন্য সপরিবারে মিশিগান চলে যাচ্ছে। ছেলের ভবিষ্যৎ, বরের চাকরি… বিয়ে ব্যাপারটা খুব জটিল একটা রাজনীতির মত।
শুভঙ্কর মনের ভিতরের কষ্টটা চেপে হাসল, একটা মেকি হাসি হেসে বলল, “তাহলে দক্ষিণ কলকাতার ওভারপ্রাইসড ল্যাতে দেখা যাবে না তোর ইন্সট্যাগ্র্যামে।”

বাড়ি ফেরার আগে, সে শ্রাবণীকে ছোট একটা উপহার দিল—একটা মামুলি স্নো গ্লোব। শ্রাবণী সেটা নিয়ে হাসল, আর হয়ত শেষবারের মতন আলিঙ্গন করল।

সেই রাতে, শুভঙ্কর শুয়ে শুয়ে ভাবছিল, হয়ত অন্য কোন দুনিয়ায় সে তার মনের সব কথা বলত, হয়ত ওরা একসাথে থাকত। কিন্তু বাস্তবতা তার সামনে একটাই —সবটাই শুধু মুহূর্ত।

৫.

আজ তিনবছর পর শুভঙ্কর আবার ফিরে এসেছে “দ্য মিডনাইট আওল”-এ। একা বসে তার হুইস্কির গ্লাসটা ধরে আছে, আর স্পিকারে বাজছে “বয়েজ ডোন্ট ক্রাই”। ওর মুখে একটা উদাস হাসি, নিজেরই কষ্ট যেন বুঝতে পারছে না। শ্রাবণী ঠিকই বলেছিল হয়ত, নিজের একাকীত্ব থেকে পালাচ্ছিল। কিন্তু পালাতে গিয়ে আবার নতুন করে আরও একা হয়ে পড়ল।

পাবটা আবারও মানুষে ভরে যাচ্ছে। হয়ত ওর জীবনে কোন রূপকথার প্রেম আসবে না, অথবা, হয়ত একদিন এমন কেউ আসবে, যে শুধু হেসে পালিয়ে যাবে না। তার আগে, এই জায়গাটাই তাকে আবার টেনে আনবে। ও সেই একই গানে ঠোঁট মেলাবে, আর অপেক্ষা করবে জীবন তাকে আবারও অবাক করবে কি না।
অন্যরকম কোন দিনের জন্য… ঠিক এমনটাই ভাবতে ভাবতে শুভঙ্কর গ্লাসটা শেষ করল।

হঠাৎই, ওর চোখ চলে গেল পাশের টেবলে। এ কী, শ্রাবণী! এই তো আজ সকালে, ফেসবুকে শ্রাবণী লাইভ করছিল ওর মিশিগানের এক ক্লায়েন্টের সাজানো অ্যাপার্টমেন্ট থেকে, মাঝে আট ঘন্টায় এতটা পথ কীভাবে এল শ্রাবণী? ওর নেশা তো মাথায় ওঠেনি, অথচ পাশের টেবলে একাকী বসে ম্যাকবুকে দৃষ্টিনিবদ্ধ করে রাখা নারীটি যে শ্রাবণী, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
ফোন থেকে ফেসবুক খুলে সার্চে গিয়ে শ্রাবণী দত্ত টাইপ করতে যে সব প্রোফাইল ওর চোখের সামনে ভেসে উঠলো, তারা কেউ ওর চেনা শ্রাবণী নয়।
“এক্সকিউজ মি জেন্টলম্যান! তোমার সাথে একটু গল্প করতে পারি?” ওর টেবলের সামনে দাঁড়িয়ে পাশের টেবলের সপ্রতিভ মহিলাটি।
“হাই, আমার নাম শ্রাবণী,” অনুমতির তোয়াক্কা না করে বসে পড়া মহিলাটির মুখের কথা কেড়ে নিয়ে শুভঙ্কর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, “দত্ত, শ্রাবণী দত্ত, বাড়ি সিক্স হিন্দুস্তান পার্ক, ইন্টিরিয়ার ডিজাইনার – রাইট?”
প্রায় আকাশ থেকে পড়বার ভঙ্গিতে মহিলাটি বললেন, “তুমি… তুমি কী করে…?”
বছর চৌত্রিশের শুভঙ্কর সান্যাল জানে, আরও অনেক কিছুই সে জানে শ্রাবণীর ব্যাপারে। কিন্তু সেসব কথায় না গিয়ে একটা চাপা হাসি হেসে বলল, “ও কিচ্ছু না! ওয়াইল্ড গেস! বাই দ্য ওয়ে… শুভজিৎ মৈত্র, রিজিওনাল মার্কেটিং ম্যানেজার।” অবলীলায় তুমুল আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে নিজের মিথ্যে নাম এবং পরিচয় দিতে তার কোন অসুবিধা হল না।
শ্রাবণী অবাক হয়ে বলল, “ওয়াইল্ড গেস করে এত পারফেক্ট বলে দিতে পারলে তুমি? ইউ মাস্ট বি নোয়িং মি। আমরা কী ফেসবুক বা ইনস্ট্যাগ্র্যামে কানেক্টেড?”
শুভঙ্কর বলে চলল, “ছেলের জন্য সেপারেশন হচ্ছে না… বিয়েটা করে ফেঁসে গিয়েছ। হাসব্যান্ড মিশিগান যাবে, তোমরাও যাচ্ছ… আর দু’বছরের মধ্যে হয়ত… এত ইনফো কী সোশ্যাল মিডিয়াতে থাকতে পারে?”
শ্রাবণী এবার বলল, “তোমাকে আমি চিনি না। মিশিগানে যাওয়ার একটা ম্যাটার নিয়ে অফ কোর্স আমার বরের অফিসে কথাবার্তা চলছে। বাই দ্য ওয়ে, আমি আজ অবধি কোন অ্যাস্ট্রোলজি এক্সপার্ট যে এত অ্যাক্যুরেট বলতে পারে, জাস্ট…”
“আনইম্যাজিনেবল, তাই না?” শুভঙ্কর বলল। “আমি কোন জ্যোতিষ না! ওসব ভাঁওতায় বিশ্বাসও করি না। ইন ফ্যাক্ট, আমি তোমার অনেক কিছুই জানি, যা কোন জ্যোতিষ জানে না। কিন্তু আজ আমায় বেরোতে হবে… নাইস টু মিট ইউ হিয়ার।” শুভঙ্করের গলার স্বর দৃঢ় এবং কঠিন।
“একটু দাঁড়াও প্লিজ! আবার কবে দেখা হবে?” কাতরস্বরে প্রশ্ন করে শ্রাবণী দত্ত।
“জানি না,” হালকা হাসি হেসে বিল মিটিয়ে দিতে দিতে শুভঙ্কর সান্যাল বলল, “রিক অ্যান্ড মর্টির কমিক্সের মত ডিফারেন্ট ডাইমেনশন অফ রিয়ালিটিজ ক্যান কনভার্জ সমটাইমস। হয়ত তোমার সাথে কোন শুভঙ্কর সান্যালের দেখা হয়ে যাবে আগামীদিনে! হয়ত, তার জন্যই তোমার অনিচ্ছাসত্ত্বেও মিশিগান যাওয়ার ব্যাপারটা… অনেক কিছুই ঘটতে পারে। এনিওয়ে… টেক কেয়ার!”

শুভঙ্কর সান্যাল প্রায় চোখের নিমেষেই পাব ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

৬.

শ্রাবণী এখন মিশিগানে থাকে। তাঁর স্বামী-সন্তান নিয়ে ছোট পরিবারে কোন ঝঞ্ঝাট নেই। এখানকার বাঙালি কমিউনিটিতে তাঁর ইন্টিরিয়র ডিজাইনিং ব্যবসা এর মধ্যেই বেশ নাম করে গিয়েছে। কিন্তু এক সন্ধ্যায়, সব কিছু বদলে গেল।

একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। রাতের খাবারের পর, সে জানালার পাশের চেয়ারটাতে বসে এক কাপ কফি হাতে বাইরে তাকিয়ে ছিল। বাইরে হালকা ঠাণ্ডা বাতাস চলছিল, শহরের আলো দেখা যাচ্ছিল। ঠিক তখনই, তার চোখে পড়ল কিছু।
পূর্বদিক থেকে একটা হালকা রূপালী আলো ভেসে আসছে। প্রথমে সে ভাবল, হয়ত এটা তার চোখের ভুল। কিন্তু আলোটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল, এবং সে উপলব্ধি করল—এটা কোন সাধারণ আলো নয়, একটা রহস্যময় শক্তি, যা আছড়ে পড়তে চাইছে তার ওপরে। শ্রাবণী কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল এবং জানালার দিকে এগিয়ে গেল।

ঠিক তখনই, সেই আলো ঢুকে পড়ল তার ঘরে। ঘর হঠাৎ ঠাণ্ডা হয়ে গেল, এবং এক গভীর নিঃশব্দতায় ভরে গেল। শ্রাবণী শ্বাসরোধ করে দাঁড়িয়েছিল। তারপর সেই আলো থেকে একটা স্বচ্ছ সিলুয়েট বের হয়ে এল। একজন মহিলা, যার মুখটা অবিকল শ্রাবণীর মত।
“শ্রাবণী,” সেই মহিলা বলল, তার গলার স্বর যেন অন্য কোথাও থেকে আসছে, এক অন্য জগৎ থেকে। “আমি তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি।”
শ্রাবণী ভয় পেয়ে গেল। “তুমি কে? তুমি কী চাও?”

শ্রাবণী কিছু বুঝতে পারছিল না। তবে সেই মহিলার চোখে কিছু ছিল, যা তাকে জানিয়ে দিল, এটা কোন সাধারণ ঘটনা নয়। মহিলা এগিয়ে আসল এবং এক লহমায় শ্রাবণীকে নিজে কাছে টেনে নিল। তার হাত স্পর্শ করতেই শ্রাবণী হঠাৎ দেখতে পেল, তার চারপাশের ঘর বদলে যাচ্ছে। মিশিগানের রাস্তা, বাড়ি, গাছ – সব কিছু হঠাৎ এক অন্য সময়ে চলে যাচ্ছে।
তারা কোথাও চলে যাচ্ছিল – এক রহস্যময় জায়গায়, যেখানে সময় একধরনের প্রবাহিত অমীমাংসিত প্রবাহ। হঠাৎই, সেই মহিলার হাত শ্রাবণীর হাতের মধ্যে মিশে গেল। চমকে উঠল শ্রাবণী, কিন্তু কোনও অস্বস্তি ছিল না। যেন পুরনো কিছু ফিরে আসছে।

শ্রাবণী বসে আছে মধ্য কলকাতার ট্রেন্ডি পাব “দ্য মিডনাইট আওল”-এ। তার সামনে যে বসে আছে, সে ওর দিকে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল। “কেমন আছিস?” গলা এবং মুখ – দু’টোই শ্রাবণীর পরিচিত। শুধু সামনের মানুষটার চেহারায় কিছুটা বয়সের ছোঁয়া লেগেছে।
শ্রাবণী, সাবলীলভাবেই টেবিল থেকে লং আইল্যান্ড টি’য়ের গ্লাসটা তুলে নিয়ে চুমুক দিয়ে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল, “ভাল আছি শুভঙ্কর। খুব ভাল আছি।”


লেখক পরিচিতি : অরিজিৎ লাহিড়ী
সীমিত সময়ের লেখক। কর্পোরেট কর্মী।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।