লেখক – অয়ন মৈত্র
দাদু-ঠাকুমার সাথে নাতি নাতনির সম্পর্কটা, শীতের দুপুরে মাছরাঙা রোদের মত অনেকটা। প্রথাগত তীব্রতা নেই। নেই নিয়মমাফিক উষ্ণতার ওঠা-নামা। কিন্তু তবুও ভেতর ভেতর কেমন যেন এক পৃথিবী গভীরতা তৈরি হয় রোজ একটু একটু করে। এ রোদ, কপালে নিয়ে, মাছরাঙার পাশে বসে প্রতীক্ষা চলে. . .। প্রতীক্ষা চলে. . . ।পল, অনুপল, মুহূর্ত শেষ হয়ে গিয়ে কখন একটা যুগ শেষ হয়ে যায়, মাছরাঙা বসেই থাকে একটা মাছের অপেক্ষায়। এখানে মাছরাঙার মাছ ধরাটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ এর মাঝের অন্তহীন প্রতীক্ষাটা যেখানে দাদু- নাতি, কিংবা দাদু- নাতনি মিলে গল্প চলে।
এই প্রবীণেরা আসলে এক বিরামহীন পাহারাদার যারা মা- বাবার অনুশাসন থেকে আমাদের বরাবর বাঁচিয়ে এসেছে কোন পারিশ্রমিক ছাড়াই। যারা সযত্নে আমাদের রোজ রাতে পক্ষিরাজের পিঠে চাপিয়ে তারপর ঘুমোতে গেছে।যারা রোজ রোজ, দিনের পর দিন, আমাদের বুঝিয়ে গেছে আমার যে অনুভূতি আমার মা-বাবাকে বোঝানো যায় না, সে আবেগ বোঝার এখনো এক বন্ধু আছে, যার সামনে আজও কেঁদে ফেলা যায় প্রকাশ্যেই।
পৃথিবীর সব দেশ, সব দ্বীপ, সব অক্ষাংশেই সমস্ত দাদু দিদার নাতি নাতনিরা, তাদের ছেড়ে আসা একেকটা ভোরবেলা। জীবনের এই প্রান্তটায় পৌঁছে যখন মনে হয় বাকি পথটা একাই হাঁটতে হবে, গুটি গুটি পায়ে পিছন থেকে আওয়াজ আসে- ঠাম্মি তুমি কোথায় যাচ্ছ? এই ডাক শুনে থমকে দাঁড়ানোটা আসলে মনের লালিত ইচ্ছেটার-ই নিয়ন্ত্রিত প্রকাশ-কেউ একটা কথা বলার মত যদি থাকত!
মানুষের জীবনের একমাত্র স্বার্থহীন সম্পর্ক বোধহয় এটা। মান অভিমান, চাওয়া পাওয়া, প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির সব সম্পর্কের শেষে যতটুকু ভূখন্ড পড়ে থাকে, দাদু সেখানে বসেই তার দাদুভাইকে গল্প শোনায়,বাবা ছোটবেলায় কি দুষ্টু ছিল।সেই ভূখণ্ডেই ঠাকুমা ছাত্রী হয়ে যায় সদ্য স্কুলে ঢোকা নাতনির কাছে।
সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে কম আলোচিত সম্পর্ক দাদু ঠাকুমার সাথে নাতি নাতনির।সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র সম্পর্ক যেখানে দুই বন্ধুর মাঝে গোটা একটা শতাব্দী আধশোয়া হয়ে ঘুমোয়।