নামের ফেরে

লেখক : অভীক সিংহ

“হে হে হে, জবরদস্ত দিয়েছে গুরু,” আমি ফোনের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলাম।
সান্যালদা চায়ের কাপে প্রথম চুমুকটা দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করল, “কী কেস, অভীক?”
“আরে তুমি নিজেই দেখো গুরু,” বলে হাসতে হাসতে ফোনটা সান্যালদার দিকে এগিয়ে দিলাম। “কলেজের পাশেই একটা নতুন রেস্তোঁরা খুলেছে। তারই মেনুকার্ডটা হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েছে। দেখো একবার।”
“কই দেখি তো,” বলে সান্যালদা চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে আমার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে মেনুকার্ডটা দেখতে দেখতে হো-হো করে হেসে উঠল, “সত্যিই জবরদস্ত। এদের মাথায় এসব আসে কোত্থেকে?”
“মুরগী তন্দুরির নাম ‘কুঁকরু কি রূহ’ – মাইরি এই সব গুলতানি করেই রেস্তোঁরাগুলো চলছে।”
“আরে এ তো কিছুই না।” সান্যালদা আমাকে ফোনটা ফেরত দিয়ে চায়ের কাপে আরেকটা চুমুক দিয়ে বলল, “গেল শনিবার বিকেলে সমুদ্রের পাশে একটা ছোট হোটেলে গিয়েছি শান্তিতে একটু ঢুকুঢুকু করতে। শালা খাব কি, মেনুকার্ড দেখেই তো পিলে চমকে গেল।”
“কেন?” আমি একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করলাম।
“আরে মেনুকার্ডে ড্রিঙ্কসের নামগুলো দেখেই তো চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল। কি সব নাম, বাপরে! ‘সেক্স অন দ্য বীচ’ থেকে শুরু করে ‘বার্ণিং ডিজায়ার’, ‘ওয়েট লিপ্স’, ‘স্ট্রিপ অ্যাণ্ড গো নেকেড’ – মাথা ঘুরে গিয়েছিল একেবারে। ‘ভার্জিন মোহিতো’ দেখে তো আমি নিজেই মোহিত হয়ে গেলাম।” সান্যালদা প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলে গেল।
আমি হে-হে করে হাসতে হাসতে বললাম, “সত্যি, এরা পারেও বটে। মেনুকার্ড একেবারে পানুকার্ড হয়ে গিয়েছে।”
“আরে এদের হাতে পড়লে তো তোমার নাম অভীক থেকে পালটে ভীকু মাহত্রে বানিয়ে দেবে।  এদের গুণে ঘাটতি নেই।” সান্যালদা হাসতে হাসতে বলল।
“আরে এই নাম নিয়ে কেত্তন থেকে মনে পড়ল,” আমি চায়ের কাপটা তুলে একটা চুমুক দিয়ে বললাম, “আমাদের পাড়ার এক দাদা তো নামের চক্করে পুলিশের কবলে পড়ে গিয়েছিল। শেষে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পেয়েছিল।”
“নামের জন্য পুলিশ? এবারে গল্পে মশলার পরিমাণটা একটু বেশি বাড়াবাড়ি রকমের হয়ে যাচ্ছে না অভীক? মানে যা ইচ্ছে তাই?” সান্যালদা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল।
“There are more things in Heaven and Earth, সান্যালদা, than are dreamt of in your philosophy – এই জগতে কত কিছু ঘটে যাচ্ছে, সবই কি তোমার-আমার বোধগম্য হবে?” বলে আমি চায়ের কাপে আরেকটা চুমুক দিলাম।
“তা বলে যুক্তি দিতে না পেরে এই ভাবে গল্পের মধ্যে শেক্ষপিয়র বাবুকে গুঁজে দেবে?” সান্যালদা মুচকি হেসে বলল।
“উনি তো সর্বময়। তবে এই গল্পে কিন্তু স্বয়ং হিটলার বাবাজী আছেন।” বলে আমি চায়ের কাপে একটা লম্বা চুমুক দিলাম।
“তোমার পাড়ার গল্পে হিটলার! মাইরি, ইণ্টারেস্টিং কেস। এবারে তো গল্পটা শুনতেই হচ্ছে।” সান্যালদা একটু নড়েচড়ে বসল।
“একদম তাই।” বলে আমি চায়ের কাপটা চুমুক দিয়ে শেষ করে একটা সিগারেট ধরালাম। একটা লম্বা সুখটান দিয়ে গল্পটা শুরু করলাম।

তখন স্কুলে পড়ি, এই ক্লাস ফাইভ কি সিক্স হবে। থাকি মেদিনীপুরে। সেই সময় তো প্রায় প্রত্যেক পাড়াতেই একজন করে দাদা গোছের লোক থাকত, যারা পাড়ার প্রায় সমস্ত কাজেই কোমর বেঁধে উদ্যোগ নিত। দুর্গাপুজো হোক, বিশ্বকর্মা পুজো হোক, পাড়ায় কারও বাড়িতে অন্নপ্রাশন, বিয়ে বা শ্রাদ্ধ হোক, পাড়ায় ক্রিকেট অথবা ফুটবল ম্যাচ হোক, কিংবা রাতের বেলায় পাড়ায় পাহারা দেওয়া হোক – উদ্যোগ নেওয়ার ব্যাপারে এই দাদারা থাকত সবার আগে। দাদু-ঠাকুমাদের আদরের নাতি, কাকু-কাকিমাদের বিশ্বস্ত অ্যাসিস্ট্যাণ্ট, আর আমাদের মত কচিকাঁচাদের অলিখিত গার্জেন ছিল এই দাদারা। বাড়ির দালানে বা রকে, চায়ের বা মুদির দোকানে, পুকুরপাড়ে বা খেলার মাঠে – সব জায়গাতেই এনাদের অবাধ আনাগোনা। মোদ্দা কথা হ’ল, এই দাদারাই ছিল আমাদের আটপৌরে পাড়াগুলোর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ এবং অবলম্বন। এখন তো আর সেই পাড়াও নেই, আর সেই দাদারাও নেই। বিশ্বায়নের যুগে আমরা পেয়েছি অনেক কিছু, কিন্তু হয়ত হারিয়েছি তার চেয়ে আরও অনেক বেশি। যাক গে, বাদ দাও, সেই সব নিয়ে আর দুঃখ করে লাভ নেই। বরং আবার গল্পে ফেরা যাক। তো এই দাদারাই পুরো বছর পাড়াগুলোকে মাতিয়ে রাখত। কিন্তু উৎসাহের আতিশয্যে মাঝেমধ্যেই একটু আধটু কেলোও হয়ে যেত।

আমাদের পাড়াতেও ছিল এইরকম এক দাদা, নাম ‘বুল্টিদা’। সেই বুল্টিদা ছিল আমাদের পাড়ার মিনি লোকনাথ বাবা – মানে রণে-বনে-জলে-জঙ্গলে গাড্ডায় পড়লে বুল্টিদাই এসে উদ্ধার করবে। পাড়ার সকলের নয়নের মণি, অন্ধের যষ্ঠি ছিল আমাদের বুল্টিদা। একবার তো পনেরই আগষ্টের কয়েকদিন আগে আমাদের সবাইকে ডেকে বলল, ‘এবারের স্বাধীনতা দিবসে আমরা বড় করে একটা রক্তদান শিবির করব। তোদের সবাইকে লাগবে কিন্তু, অনেক কাজ আছে।’ আমরা তো সবাই এক পায়ে খাড়া, বুল্টিদার আদেশ বলে কথা। আমরা প্রায় সমস্বরেই বললাম, ‘কী করতে হবে শুধু বলো, আমরা করব।’ বুল্টিদা দু’হাত তুলে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘শান্তি, শান্তি। সবার কাজ ভেবে রাখা আছে, সময় আসলে ঠিক বলব। কিন্তু প্রথমেই রক্তদান শিবিরটার জম্পেশ দেখে একটা নাম ঠিক করতে হবে।’ ওই এক মহাদোষ ছিল বুল্টিদার। খুঁজেপেতে তস্য ইতিহাস, রাজনীতি, আর সাহিত্য ঘেঁটে অত্যন্ত বিদকুটে গোছের নাম বানাত। দু’দিন পরেই পাড়ার ক্লাবে বুল্টিদার জরুরী তলব, রক্তদান শিবিরের নাম ভেবে ফেলেছে। আমরা সবাই দল বেঁধে হাজির হতেই বুল্টিদা অত্যন্ত গাম্ভীর্যের সাথে শুরু করল, ‘দেখ, বৃটিশরা আমাদের দেশের মানুষের রক্ত শোষণ করেছে। আর সেই রক্ত বইয়েই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। এবারে অন্যদিকে দেখ, আমরা একজন মানুষের কাছ থেকে রক্ত নিয়ে অন্য মানুষকে জীবনের স্বাধীনতা দান করছি। সেই জন্য, আমি আমাদের শিবিরের একটা নাম ভেবেছি – শোষণ থেকে স্বাধীনতা।’ বলেই বুল্টিদা বেশ গর্বের সাথে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেমন হয়েছে এবারে বল?’ আমরা স্পিকটি নট। বুল্টিদার যুক্তি আমাদের মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে দেওয়ালে ঠোক্কর খেয়ে পিংপং বলের মত গড়াতে গড়াতে আলমারির তলায় গিয়ে ঢুকে গিয়েছে। নামটার মাথামুণ্ডু কিছু উদ্ধার করতে না পারলেও সাহস করে কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না, নচেৎ কানমলা জুটতে পারে। বুল্টিদা বয়েসে আমাদের চেয়ে ঢের বড়। তাই আমরা সবাই পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে কোনমতে ঢোক গিলে ঘাড় কাৎ করে সম্মতি দিলাম। যদিও গেল বছর ফুটবল টুর্ণামেণ্টের নাম ‘এগারোর দল, একটাই বল’ রাখাতে পাড়ার অনেকের কাছেই বকুনি খেয়েছিল, আর অন্য পাড়ার ফুটবল দল তো খেলতে এসে হেসেই লুটোপুটি। ব্যাপারটা এখন বুঝতে পারলেও তখন তো কিছুই বুঝিনি। কিন্তু বুল্টিদার বকুনি আর কানমলার ভয়ে আমরা কেউই আর সেই প্রসঙ্গটা তুললাম না।

ক্রমে ক্রমে এসে গেল স্বাধীনতা দিবস। সকাল থেকে শিবিরের তোড়জোড় চলছে। আমরা সবাই ব্যাজ লাগিয়ে, মাথায় টুপি পড়ে তৈরী। আর আমাদের সামনে বুল্টিদা সাদা পাঞ্জাবী-পায়জামা পড়ে তৈরী। বুল্টিদা একটু চিন্তায় পায়চারি করছে, কারণ আমাদের মিউনিসিপ্যালটির কাউন্সিলর শিবির উদ্বোধন করতে আসছেন। কিছু গণ্ডগোল দেখলে উনি বুল্টিদাকে আপাদমস্তক রগড়ে দেবেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই লালবাতি দেওয়া গাড়িতে করে হাজির স্বয়ং কাউন্সিলর। বুল্টিদা দৌড়ে গিয়ে ওনাকে সসম্মানে গাড়ি থেকে নামিয়ে আমাদের শিবিরের দিকে আনতে লাগলেন, আমরা হাতে ফুল আর ফিতে কাটার কাঁচি নিয়ে পিছুপিছু হাঁটছি। শিবিরের সামনে এসে কাউন্সিলর ভ্রূ কুঁচকে ওপরে লাগানো নামের বোর্ডটার দিকে তাকালেন। আমরা প্রমাদ গণলাম। পিছন থেকে হোঁৎকা মৃদুস্বরে বলল, ‘কেলো করেছে রে।’ কয়েক সেকেণ্ড বোর্ডটার দিকে তাকিয়ে থেকে তিনি বুল্টিদার দিকে ঘুরে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এই নামটা কি তুই রেখেছিস?’
বুল্টিদা একটু বিনয়ের সাথে মাথা চুলকে বলল, ‘হেঁ হেঁ স্যার, ওই আর কি। একটু স্বাধীনতার ইতিহাসটা –’
‘ঠাস-ঠাস করে দু’টো চড় মেরে তোকেই ইতিহাস বানিয়ে দেব।’ কাউন্সিলর প্রায় গর্জে উঠলেন, ‘তোকে বলেছিলাম নামকরণ নিয়ে চ্যাংড়ামো না করতে। কথাটা কি মাথায় ঢোকেনি?’
বুল্টিদা চুপ। আমরা লুডোর ছক্কার মত নটনড়নচড়ন। কাউন্সিলর বুল্টিদার উপরে বোমাবর্ষণ করছেন, আর বুল্টিদা কাদায় লেবড়ে সাদা পতাকা হাতড়ে বেড়াচ্ছে। সে একেবারে শোচনীয় দশা, শিবির প্রায় বন্ধ হয় আর কি। শেষে আমাদের মধ্যে ন্যাড়া অনেকটা সাহস যুগিয়ে কাউন্সিলরকে বলল, ‘খুব ভুল হয়ে গিয়েছে স্যার। আমরা কথা দিচ্ছি আর এ’রকম হবে না। আমরা সবাই মিলে শিবিরটা করেছি স্যার। আপনাকে আমরা হাত জোড় করে অনুরোধ করছি স্যার, প্লিজ রাগ করবেন না।’ আমাদের সবার সম্মিলিত অনুরোধে কতকটা গলে গিয়েই কাউন্সিলর সেদিন আমাদের শিবিরটা উদ্বোধন করলেন। বুল্টিদা সে যাত্রা মানেমানে বেঁচে গেলেও কাউন্সিলর কিন্তু যেতে যেতে শাসিয়ে গেলেন, ‘এই বাচ্চাগুলোর জন্য তোকে এবারের মত ছেড়ে দিলাম বুল্টি। কিন্তু ভবিষ্যতে যদি নাম নিয়ে আর এইরকম বেগড়বাঁই করেছিস, তখন কিন্তু তোকে পুলিশে দেব বলে দিলাম। কথাটা মনে রাখিস।’ সেবারে আমাদের রক্তদান শিবির সফলভাবে হলেও একটু চোনা রয়ে গেল। তবে আমরা ভেবেছিলাম হয়ত এই ঘটনার জেরে বুল্টিদার কিছুটা শিক্ষা হবে। কিন্তু ভুলে গিয়েছিলাম যে কুকুরের লেজকে লোহার পাইপে ঢুকিয়ে রাখলেও পাইপ বেঁকে যেতে পারে, কিন্তু লেজ সোজা হবে না। আমাদের ধারণা অচিরেই ভ্রান্ত প্রমাণিত হ’ল।

কয়েকমাস যেতে না যেতেই বুল্টিদার মাথায় আবার পোকা নড়ে উঠল। এবারে ইংরেজি নববর্ষের দিনে যোগব্যায়াম প্রতিযোগিতার কথা ভেবেছে। যথারীতি আমাদের ডাক পড়ল পাড়ার ক্লাবে। বুল্টিদার তলব পেয়ে আমরা সবাই হাজির। বুল্টিদা আমাদের সবাইকে সামনে বসিয়ে শরীরচর্চা এবং মনোঃসংযোগের বিষয়ে গভীর জ্ঞান দিয়ে নিজের কথাটা পাড়ল। ‘দেখ, এখনও অব্দি যা হয়েছে, ভুলে যা। যা খবর পেলাম, এই সামনে নববর্ষে পাশের পাড়ায় ক্রিকেট ম্যাচ হবে, নতুনপল্লী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করছে, রাজাবাজার তো শুনছি ক্যুইজ প্রতিযোগিতা করছে। আমাদেরকে তাই নতুন কিছু ভাবতে হবে। তাই আমি ভেবেছি এবারে আমরা একটা যোগব্যায়াম প্রতিযোগিতা করব। তোদের কিন্তু থাকতে হবে। বেশ বড় করে আয়োজন করব ভেবেছি।’ নতুন একটা অনুষ্ঠানের সুযোগ পেয়ে তো আমাদের উত্তেজনার শেষ নেই। মাঝে বুবাই একবার আমতা আমতা করে বলেই ফেলল, ‘বুল্টিদা, এবারে আর নাম নিয়ে গণ্ডগোল –’
বুবাইকে শেষ করতে না দিয়েই বুল্টিদা হো-হো করে হেসে বলল, ‘আরে নাম নিয়ে কিচ্ছু ভাবিস না। হুঁ-হুঁ বাওয়া, যা নাম ভেবেছি না এবারে, কাউন্সিলর দেখে একেবারে উল্টে যাবে।’
‘কী নাম ভেবেছো?’ আমি একটু সাহস করেই জিজ্ঞাসা করলাম।
‘সেটা সারপ্রাইজ। ওটা একদম প্রতিযোগিতার দিন দেখতে পাবি।’ বলে বুল্টিদা একটা রহস্যময় হাসি দিল।
‘কেলো করেছে রে, এবারে আমরা সবকটা পুলিশের বাটাম খাব,’ পিছন থেকে হোঁৎকা ফুট কাটল।
বুল্টিদা হোঁৎকার কথায় পাত্তা না দিয়েই বলল, ‘এবারে ব্যবস্থা কিন্তু জোরদার করতে হবে। ইজ্জৎ কা সওয়াল হ্যায়। আর কথা নয়, তোরা আজ থেকেই কাজে লেগে পড়।’
আমরাও আর বাক্যব্যয় না করে নিজেদের কাজগুলো বুঝে নিয়ে লেগে পড়লাম।

দেখতে দেখতে এসে গেল নববর্ষ। শহরের সমস্ত পাড়া সেজে উঠেছে উৎসবের মেজাজে। আমরা সবাই সক্কাল সক্কাল তৈরী হয়ে পৌঁছে গিয়েছি খেলার মাঠে। সেখানেই যোগব্যায়াম প্রতিযোগিতা হবে। কিছুক্ষণের মধ্যে বুল্টিদাও এসে হাজির। আমরা সবাই বুল্টিদাকে প্রতিযোগিতার নামের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করাতে বুল্টিদা মুচকি হেসে কিছু না বলে আঙুল তুলে দেখাল। মাঠের একদম সামনের দিকে প্রতিযোগিতার নামটা লাল শালু দিয়ে ঢাকা, সেটা কাউন্সিলর এসে খুলবেন আর শুরু হবে প্রতিযোগিতা। দেখে আমাদের একটু পেট গুড়গুড়, বুক ঢিপঢিপ করল। উত্তেজনা আর ভয়মিশ্রিত একটা অনুভূতি। কি যে আছে কপালে, কে জানে। এদিকে প্রতিযোগীরাও এক এক করে আসতে শুরু করেছে। আমরা সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি শালু সরিয়ে নাম দেখার। বুল্টিদাও একটু অন্যমনস্কভাবে চিন্তিত মুখে পায়চারি করছে মাঠের সামনে। দেখতে দেখতে মিনিট কুড়ির মধ্যেই কাউন্সিলরের লালবাতিওয়ালা গাড়ি পোঁ-পোঁ শব্দে এসে হাজির। যোগব্যায়াম প্রতিযোগিতার খবর পেয়ে শহরের পুলিশের বড়কর্তাও এসেছেন। আমরা সবাই মিলে দু’জনকেই সসম্মানে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে আসলাম মাঠের সামনে। বুল্টিদা আমাদের সবার আগে মার্চ করতে করতে চলেছে, আমরা পিছুপিছু। হাঁটতে হাঁটতে সবাই এসে হাজির সেই শালু দিয়ে ঢাকা নামের সামনে। বুল্টিদা সেটার নীচে দাঁড়িয়ে কাউন্সিলরের দিকে ফিরে বলতে শুরু করল, ‘স্যার, শরীরচর্চা এবং মনোঃসংযোগের মধ্যে সম্পর্ক অতি নিবিড়। আমার স্বপ্ন, আগামী প্রজন্মকে এই মনোঃসংযোগের উপহার তুলে দেওয়া। সেই স্বপ্নকে চরিতার্থ করার লক্ষ্যেই আমাদের আজকের এই প্রতিযোগিতা।’
কাউন্সিলর চুপ করে বুল্টিদার কথা শুনে বললেন, ‘নামটা কী রেখেছিস?’
বুল্টিদা সগর্বে বলল, ‘এবারে আমাদের প্রতিযোগিতার নাম দেখলে আপনি গর্ববোধ করবেন স্যার। এই নিন।’ বলে শালু খোলার রঙীন দড়িটা কাউন্সিলরের হাতে তুলে দিতে দিতে বলল, ‘আপনি নিজেই দেখুন স্যার, কেমন হয়েছে।’
অজানা আশঙ্কায় আমাদের হৃদপিণ্ড তখন প্রায় গলা অব্দি উঠে এসেছে, পেটের মধ্যে একগাদা মাছি ভোঁ-ভোঁ করছে। কাউন্সিলর বুল্টিদার হাত থেকে দড়িটা নিয়ে আস্তে আস্তে শালুটা খুললেন, আর বেরিয়ে আসল সেই বহু প্রতীক্ষিত নামটা। আমরা সবাই কয়েক সেকেণ্ড হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম সেই ঐতিহাসিক নামটার দিকে। কাউন্সিলরের মুখে বিস্ময়, অবিশ্বাস, আর রাগ একসাথে স্পষ্ট হয়ে উঠল। পুলিশের বড়কর্তাও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে। আমাদের তো সামনে সাক্ষাৎ ভূত দেখার মত অবস্থা। পিছন থেকে হোঁৎকা একবার অস্ফুটে ককিয়ে উঠল, ‘সব্বোনাশ করেছে রে।’ কাউন্সিলর বুল্টিদার দিকে ফিরে গর্জে উঠলেন, ‘বুল্টি, এটা ডেঁপোমি হচ্ছে, অ্যাঁ? তোকে সাবধান করেছিলাম নাম নিয়ে চ্যাংড়ামি না করতে। আজ তোকে কে বাঁচায় দেখি।’
বুল্টিদা আমতা আমতা করে বলতে গিয়েছিল, ‘আসলে মনোঃসংযোগের সাথে –’
‘চোপ! আর একটাও কথা না।’ কাউন্সিলর আবার গর্জে উঠলেন। তারপরে পুলিশের বড়কর্তার দিকে ফিরে বললেন, ‘এটাকে তুলুন তো জীপে। তোর নামকরণ করা বের করছি আজ। চল তুই থানায়, তোর মাথা থেকে জন্মের মত নামকরণের ভূত নামাচ্ছি।’
‘ইয়েস স্যার,’ বলে পুলিশের বড়কর্তা বুল্টিদাকে কান ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে জীপে তুলল। বুল্টিদা কচি পাঁঠার মত লাফালাফি করেও কিছু করতে পারল না। আমরা হাঁ করে পুরো ঘটনাটা দেখে গেলাম।

এই অবধি বলে আমি সিগারেটটা ফেললাম। সান্যালদা এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল। এবারে একটু আড়মোড়া ভেঙ্গে জিজ্ঞাসা করল, “তোমাদের সেই দাদাকে পুলিশ তুলে নিয়ে গেল?”
“হ্যাঁ, তবে বিকেলেই ছেড়ে দিয়েছিল। বুল্টিদাকে থানাতে নিয়ে গিয়ে কান ধরে ওঠবোস করিয়ে নীলডাউন করে রেখে দিয়েছিল। শেষে আর কোন অনুষ্ঠানে নামকরণ না করার মুচলেকা লিখিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল। বেচারা তারপর থেকে আর কোনদিন কোন অনুষ্ঠানের নামকরণ করেনি।”
“আচ্ছা, আসল কথাটাই তো জিজ্ঞাসা করা হয়নি,” সান্যালদা চেয়ার থেকে উঠে সামনের দিকে ঝুঁকে বসে বলল, “সেই প্রতিযোগিতার নামটা কী ছিল?”
“কিছু আন্দাজ করতে পারো?” আমি মুচকি হেসে জিজ্ঞাসা করলাম।
“একেবারেই না। আমার অত নামকরণের অভিজ্ঞতা নেই। তুমি আর রহস্য না করে বলেই ফেলো তো।” সান্যালদা একটু অধৈর্য্য হয়েই বলল।
“নামটা ছিল –” বলে আমি একটু চুপ করে থেকে সান্যালদার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললাম, “কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প।”
“হোয়াআআআআট?” বলে সান্যালদা কপাল চাপড়ে মাথা নেড়ে অট্টহাস্য করে উঠল।


আগের ও পরের পর্বের লিঙ্ক<< হপ্তা উশুল

লেখক পরিচিতি : অভীক সিংহ
গল্পটির লেখক ড: অভীক সিংহের জন্ম পশ্চিমবঙ্গে। পেশায় অর্থনীতির অধ্যাপক এবং গবেষক, যুক্ত আছেন লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে, বর্তমান বাসস্থান চীন। তবে ভালবাসাটা আজও লেখালিখি, পেন্সিল স্কেচ, যন্ত্রসংগীত, এবং নিত্যনতুন রান্নাবান্নার সাথেই রয়ে গিয়েছে। প্রথম বই "R.E.CALL: এক Recollian-এর গল্প" প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। দাদুর হাত ধরে কবিতা দিয়ে লেখালিখির সূত্রপাত হলেও এখন প্রবন্ধ এবং গল্পতেই মনোনিবেশ করেছেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।