লেখক : অভীক সিংহ
“আহহ,” ধূমায়িত চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সান্যালদা একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, “সক্কাল সক্কাল পেটে একটু গরম চা না পড়লে মগজ খোলে না মাইরি।” বলে সান্যালদা চায়ে আরেকটা চুমুক দিল।
“সেটা কিন্তু খাঁটি কথা বলেছ সান্যালদা,” আমি খবরের কাগজটা সরিয়ে সামনের টেবিলে রাখা চায়ের কাপটা তুলে একটা চুমুক দিয়ে বললাম, “সক্কাল সক্কাল জিভে একটু চা না ঠেকালে দিনটা ঠিকমত শুরুই হয় না।”
“ভাবো তো অভীক, এই চা না থাকলে কী হতে পারত?”
“অনেক কিছুই হতে পারত,” আমি চায়ে আরেকটা চুমুক দিয়ে বললাম, “তবে চা না খাওয়ার চেয়ে চা না থাকাটা আরও বেশী বিপজ্জনক হতে পারত।”
“অ্যাঁ? সে আবার কি? বুঝলাম না ব্যাপারটা,” সান্যালদা চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে বলল, “চা না থাকা আর চা না খাওয়ার মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়?”
“বিশাল বড় পার্থক্য সান্যালদা,” আমিও চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে বললাম, “চা না খেলে দিনটা হয়ত খারাপ যাবে। কিন্তু চা না থাকলে দিনটা হয়ত লকআপেও কাটাতে হতে পারে।”
“লকআপে?” সান্যালদা এবারে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “মানে?”
“মানে চা না থাকলে আমাকে হয়ত লকআপেই পুরে দিত।” আমি নির্বিকারচিত্তে উত্তর দিলাম।
“এই রে,” সান্যালদা এবারে একটু চিন্তার সুরে বলল, “আবার একটা গাঁজাখুরি গল্প দেবে।”
“সত্য বড়ই বিচিত্র জিনিস, সান্যালদা।” আমি চায়ের কাপটা তুলে আরেকটা চুমুক দিয়ে বললাম, “সত্যি ঘটনা কিন্তু গল্পকে বলে বলে ফ্রি কিকে দশটা গোল দিতে পারে।”
“এক মিনিট, মানে তুমি বলতে চাইছ যে এই লকআপের কেসটা সত্যি ঘটনা?” সান্যালদাও চায়ের কাপটা তুলে একটা চুমুক দিল।
“বলতে চাইছি না, বলছি।” দেয়া নেয়া-তে কমল মিত্রের স্টাইলে বললাম।
“চা, তুমি, আর লকআপ – বেশ ইণ্টারেস্টিং লাগছে কিন্তু। আচ্ছা শুরু থেকে বলো তো ব্যাপারটা, শুনি একবার।” সান্যালদা চেয়ারে হেলান দিয়ে আরাম করে বসল। মুখে তখনও একটা অবিশ্বাস আর বিস্ময় মাখা হাসি।
“দাঁড়াও, চা-টা আগে শেষ করে নিই।” বলে এক চুমুকে চায়ের কাপটা শেষ করে একটা সিগারেট ধরালাম। একটা লম্বা সুখটান দিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে শুরু করলাম।
তখন আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছি, খুব সম্ভবত সদ্য সেকেণ্ড ইয়ার। তামাম ইঞ্জিনিয়ারদের পাখনা গজানোর সবথেকে প্রশস্ত সময় হ’ল এই সেকেণ্ড ইয়ার। ঠিক এই সময়টাতেই আমাদের যাবতীয় কুকর্মের হাতেখড়ি। সে লোকাল জনতার সাথে ক্যালাকেলি করা হোক, বা দোকানে খেয়ে পয়সা না দিয়ে পালানো হোক, বা চলন্ত বাসের পিছনে ঝুলতে ঝুলতে কণ্ডাক্টরকে ফাঁকি দেওয়া হোক। কিন্তু এই সব কিছুর ঊর্ধ্বে ছিল বিনা টিকিটে ট্রেনযাত্রা। আহা, সেই সব ঘটনাগুলোর কথা ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়। বিধান, কোলফিল্ড, রাজধানী, শতাব্দী, রূপসী বাংলা – মোটকথা হ’ল দুর্গাপুর, বাঁকুড়া, বা মেদিনীপুরের উপর দিয়ে যাওয়া যে কোন এক্সপ্রেস ট্রেনের নাম কর, কখনও না কখনও তাতে অন্তত একবার বিনা টিকিটে চেপেছি। কুকর্মটা আস্তে আস্তে আমাদের সবার একটা নেশায় পরিণত হয়েছিল। ধরা যে কখনও পড়িনি, তা নয়। কিন্তু ওই যে কথায় বলে না, নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকর্ষণটা বরাবরই বেশি। তাছাড়া সেই সময় পকেটও তো আর ভারী থাকত না। তাই টিকিটের পয়সা কেটে অন্তত এক সপ্তাহের চা-বিড়ির ব্যবস্থা হয়ে যেত। তো সেই রকম একটা ঘটনার কথা আজ বলব।
বন্ধুদের সাথে হঠাৎ প্ল্যান হয়েছে কলকাতা বইমেলা দেখতে যাওয়ার। সকালে বিধান ধরে দুর্গাপুর থেকে কলকাতা, তারপরে সেখান থেকে বাস ধরে ময়দান। বইমেলা দেখে কলকাতা থেকে রাতের ট্রেন আবার ধরে আবার ব্যাক টু দুর্গাপুর। তো প্ল্যানমাফিক আমরা সক্কাল সক্কাল স্টেশনে হাজির। আমরা বলতে আমাদের পনের-ষোলজন বন্ধুদের একটা দল। প্রত্যেকেই কমবেশি বিনাটিকিটে যাত্রায় পারদর্শী। স্টেশনে বসে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমার চোখ পড়ল একটা জিনিসের উপরে। তোমার হয়ত মনে আছে, সেই সময়টায় স্টেশন আর বাসস্ট্যাণ্ডগুলোতে হরেকরকম ওজন করার মেশিন থাকত, একটু লম্বা মত, তাতে লাল-নীল আলো জ্বলত, আর তার পাশে একটা গোল চরকি ঘুরত। সেই মেশিনের পেটের ভিতরে একটাকার কয়েন ফেললে টুংটাং করে আওয়াজ হত, আর একটা ছোট্ট পিচবোর্ড মার্কা শক্ত কাগজে ওজন ছাপা হয়ে বেরিয়ে আসত তার পেটের ভিতর থেকে। কখনও কখনও সেই কাগজের পিছনে কোন উক্তি অথবা ভবিষ্যৎবাণী লেখা থাকত। কেন জানিনা, ছোটবেলা থেকেই আমার ওই মেশিনটা খুব অদ্ভুত লাগত। সুযোগ পেলেই ওজন করতাম, আর সেই কাগজগুলো নিজের পড়ার টেবিলের খাঁজে খাঁজে জমিয়ে রাখতাম। সেদিন সকালে দুর্গাপুর স্টেশনে মেশিনটা দেখে সেই সুযোগটা ছাড়লাম না। বন্ধুদের বসিয়ে রেখে আমি টুক করে সাইড কেটে মেশিনটার উপরে দাঁড়িয়ে তার পেটের ভিতরে টুং করে ফেলে দিলাম একটা এক টাকার কয়েন। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই ওজনছাপা বেরিয়ে আসল সেই মোটা পিচবোর্ডের কাগজ। আর আমিও সেই কাগজটা পকেটে রেখে আবার ফিরে আসলাম। ইতিমধ্যে স্টেশনের মাইকে ট্রেনের ঘোষণা হয়ে গিয়েছে, একনম্বর প্ল্যাটফর্মে আসছে। দু’-তিন মিনিটের মধ্যেই ট্রেন চলে আসতেই আমরা দলবেঁধে একটা কামরার মধ্যে সেঁধিয়ে গেলাম। কামরায় রোজকার মতই ভিড়, বেশির ভাগটাই ডেলি প্যাসেঞ্জারদের। সকালের দিকটায় ওইসব লোকজনে ঠাসা কামরাগুলোতে টিকিট চেকাররা সাধারণত উঠত না, তাই আমরাও অনেকটাই নিশ্চিন্ত। ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে বিড়ি টানতে টানতে, ঝালমুড়ি খেতে খেতে, আর আড্ডা মারতে মারতে বেশ মজার সাথেই চললাম।
প্রায় আড়াই ঘণ্টা পরে ট্রেন এসে দাঁড়াল হাওড়া স্টেশনে ঢোকার মুখে। প্রতিবার ওই জায়গাটায় এসে ট্রেন দাঁড়িয়ে যেত বেশ কিছুক্ষণের জন্য, হয়ত প্ল্যাটফর্ম পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করত। আমরাও অপেক্ষা করতাম ওই জায়গাটার জন্যেই। ওই জায়গাটার একটু পাশেই রেলওয়ে বিভাগ থেকে একটা ফুটো পাঁচিল তৈরী করে রেখে দিয়েছিল। আমরা বরাবর ওই জায়গাটা আসলেই ট্রেন থেকে নেমে সেই ফুটো পাঁচিলের ভিতর দিয়ে পালাতাম। কিন্তু কেন জানিনা, সেদিন আমার ট্রেন থেকে নেমে পালাতে ভীষণ ল্যাদ লাগছিল। আমার বন্ধুদের ট্রেন থেকে নামতে দেখেও আমি নড়লাম না। সবাই বলল, “কী রে? বসে আছিস কেন? চ’।” আমি বললাম, “নাহ, আজ ভাবছি হাওড়া স্টেশনের মেনগেট দিয়েই বেরবো। তোরা এগিয়ে গিয়ে গেটের বাইরে অপেক্ষা করিস, আমি এসে যাব।” আমার বন্ধুরা একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে আমার দিকে কেমন একটা অবিশ্বাসের দৃষ্টিনিক্ষেপ করে বলল, “ঢ্যামনামি মারিস না, চলে আয় বলছি।” আমিও একটা হাই তুলে বললাম, “আজ তো শালা মেনগেট দিয়েই বেরবো, দেখি আজ কোন মামায় ধরে।” বন্ধুরা জোরাজুরি করে হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, “যা পারিস কর। আমরা গেটের কাছাকাছিই থাকব। কোন ক্যাওড়া হ’লে আওয়াজ দিস, আমরা চলে আসব।” আমি হাত তুলে বরাভয় মুদ্রায় বললাম, “তথাস্তু।”
ট্রেনটা হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ঢুকতেই টুক করে নেমে পড়ে চারিদিকটা একবার ভাল করে দেখে নিলাম। না, আশেপাশে কোন টিকিট চেকার দেখা যাচ্ছে না। নিশ্চিন্ত মনে কাঁধে ব্যাগটা নিয়ে এগোলাম সামনে একটা চায়ের দোকানের দিকে। গরম চায়ের ভাঁড়ে একটা চুমুক দিতেই মাথায় এসে গেল একটা বিদকুটে আইডিয়া। সেই সময়টায় ট্রেনের টিকিটগুলো কেমন দেখতে ছিল, মনে আছে? ছোট্ট পিচবোর্ড মার্কা শক্ত কাগজের, খুব গাঢ় বাদামী রংয়ের। চেকাররা টিকিট চেক করার পরে টিকিটের পাশে টুক করে কেটে দিত, অর্থাৎ টিকিট চেক করা হয়ে গিয়েছে। সেই টিকিটের চেহারাটা চোখে ভেসে উঠতেই মাথার মধ্যে আইডিয়াটা একেবারে পরিষ্কার হয়ে গেল। ভাঁড়ে উঁকি মেরে দেখলাম, নীচের দিকে প্রায় দু’চুমুক মত চা বাকি আছে। আমি সটান পকেট হাতড়ে বের করে আনলাম সেই ওজন ছাপা টিকিটটা। চোখের সামনে টিকিটটাকে একবার ভাল করে দেখে নিয়ে সোজা চুবিয়ে দিলাম চায়ের ভাঁড়ে। চায়ের দোকানের লোকটাও আমার সেই কাণ্ড দেখে হাঁ হয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ চায়ের মধ্যে চুবিয়ে রাখতেই টিকিটটা একেবারে ভিজে ফুলে ঢোল হয়ে একটা ভদভদেমার্কা চেহারা নিয়েছে। সেটাকে দেখলে কিছুটা ট্রেনের টিকিটের মত লাগলেও সেটার মর্মোদ্ধার করা কারও বাপের সাধ্যি নেই। চায়ের ভাঁড়টা ফেলে সেই টিকিটটাকে দুটো আঙ্গুলে চেপে ধরে প্রশান্তচিত্তে এগোলাম মেনগেটের দিকে।
স্টেশনের মেনগেটের কাছাকাছি আসতেই ধরল এক টিকিট চেকার, আমাদের ভাষায় “মামা”। আমি আড়চোখে গেটের দিকে তাকিয়ে দেখলাম গেটের বাইরে আমার বন্ধুরা একটু আড়াল থেকে অধীর আগ্রহে আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। তো সেই মামা আমার কাছে টিকিট চাইতেই আমি আঙ্গুলের মাঝে ধরা ভদভদে টিকিটটা তার সামনে তুলে ধরলাম। সে বেচারা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে জিজ্ঞেস করল, “এটা আবার কী?”
আমি পেটের মধ্যে হাসি চেপে রেখে একটু জোর দিয়ে মুখটা বেজার করে করুণ স্বরে দীর্ঘশ্বাসের সাথে বললাম, “আর বলবেন না স্যার, কপালটাই খারাপ। হিসি করতে করতে টিকিটটা হাত থেকে পড়ে গেল টয়লেটের ড্রেনে। ড্রেন থেকে তুলতে তুলতেই হিসিতে ভিজে গিয়ে –”
আমাকে আর শেষ করতে না দিয়ে চেকার ভদ্রলোক প্রায় ককিয়ে উঠলেন, “মানে? এই টিকিটটা হিসিতে পড়ে গিয়েছিল?”
চেকারের গলার আওয়াজ শুনে পেটের মধ্যে চেপে রাখা হাসিটা যেন একেবারে ঝাঁকানো সোডার বোতলের মত ভসভসিয়ে প্রায় গলা অব্দি উঠে এসেছিল। প্রাণপণে হাসিটাকে চেপে রেখে মুখটা বেজার করে সেই আগের মত করুণ স্বরেই আবার বললাম, “কী করি বলুন স্যার। হাজার হোক, টিকিট তো। আপনি নিজেই দেখুন একবার, গন্ধটা এখনও –”
“ফ্যাল, ফ্যাল ওটা এখনই।” চেকার লাফিয়ে দু’হাত পিছনে সরে গিয়ে চিৎকার করে উঠল, “বেরো শালা, দূর হ’ এখান থেকে। হাতে করে হিসিমাখা টিকিট – শালা, দেখে অব্দি আমার গা গুলোচ্ছে। এখনই বেরো এখান থেকে, নাহলে এক কানগোড়ায় বাজাব।” আমি চুপচাপ টিকিটটা পাশে ফেলে দিয়ে বেজার মুখ করে গেট দিয়ে বেরিয়ে গেলাম।
এই পর্যন্ত বলে সান্যালদার দিকে চেয়ে দেখি সান্যালদা আমার গল্প শুনতে শুনতে চায়ের সাথে একটা পার্লে জি বিস্কুট খাওয়ার প্ল্যান করছিল। কিন্তু গল্পের চক্করে বিস্কুটটা বেশিক্ষণ ভিজে একটু ভদভদে হয়ে গিয়ে টপাক করে চায়ের কাপে ডুব মারল। আমি দেখে একটু মুচকি হেসে বলতে যাচ্ছিলাম, “সান্যালদা, বিস্কুটটাকে দেখে আমার কিন্তু –”
“অ্যাই চোপ, একদম না,” আমাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে সান্যালদা চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে দিয়ে একবার আমার দিকে তাকিয়ে দেখল, তারপরে চায়ের কাপটার দিকে চেয়ে একটু অস্বস্তির সাথেই বলল, “এবার থেকে চায়ের মধ্যে বিস্কুট পড়লেই মাইরি এই কথাটা মনে পড়বে।”
সান্যালদার কথা শুনে আমি হেসে উঠলাম।
লেখক পরিচিতি : অভীক সিংহ
গল্পটির লেখক ড: অভীক সিংহের জন্ম পশ্চিমবঙ্গে। পেশায় অর্থনীতির অধ্যাপক এবং গবেষক, যুক্ত আছেন লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে, বর্তমান বাসস্থান চীন। তবে ভালবাসাটা আজও লেখালিখি, পেন্সিল স্কেচ, যন্ত্রসংগীত, এবং নিত্যনতুন রান্নাবান্নার সাথেই রয়ে গিয়েছে। প্রথম বই "R.E.CALL: এক Recollian-এর গল্প" প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। দাদুর হাত ধরে কবিতা দিয়ে লেখালিখির সূত্রপাত হলেও এখন প্রবন্ধ এবং গল্পতেই মনোনিবেশ করেছেন।
Darun
Oshadharon laglo golpo ta.
অনেক ধন্যবাদ ইব্রাহিম ভাই
অনেক ধন্যবাদ কাকা