লেখক : অভীক সিংহ
প্রথম দৃশ্য:
“আর ড্রিঙ্ক করো না প্রবীর, শরীর খারাপ করবে।” শ্বেতা কাতর কণ্ঠে বলল।
“আজ আমায় প্লিজ আটকিও না,” মদের বোতলটা হাতে ধরে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে মাথা নিচু করে ধীরকণ্ঠে প্রবীর বলল, “মনের মধ্যে অনেকগুলো কথা জমে আছে, সেগুলো আমায় ঠেলে বাইরে বের করতেই হবে। আজ আমার এই ড্রিঙ্কটা লাগবেই। আজ বাধা দিও না।”
শ্বেতা আর বাধা দিল না, চোখের জল মুছে চুপ করে প্রবীরের পাশে বসল। সামনে মেঝেতে আল্ট্রাসাউন্ড রিপোর্টটা পড়ে আছে, আজই সন্ধ্যেবেলায় পেয়েছে। বেশিদিন নয়, এই দু’মাস আগেই শ্বেতা অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় ওদের দু’জনের খুশির অন্ত ছিল না। অনেক বছর অপেক্ষার পরে প্রথম সন্তান, হয়ত তার স্বপ্নেই ধূসর জীবনের বোবা টানেলের শেষে একটুখানি আলোর প্রত্যাশা করেছিল ওরা দু’জনে। কিন্তু, আজ বিকেলে ট্রান্সডিউসারটা শ্বেতার পেটে রেখে ডাক্তারের “নো হার্টবিট” কথাটা কানে যাওয়ার সাথে সাথেই ওদের সময়টা যেন সেই বোবা টানেলেরই নিথর অন্ধকারে অকস্মাৎ স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। ক্লিনিকের মধ্যে ডাক্তারের দিকে নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল দু’জনে, চারিদিক থেকে একটা ভয়াবহ কায়াহীন শূন্যতা যেন একটু একটু করে গ্রাস করছিল। ক্লিনিক থেকে বাড়ি পর্যন্ত কেউ কোন কথা বলেনি। শ্বেতা গাড়ির জানালায় মাথা রেখে নিঃশব্দে কাঁদছিল, আর প্রবীর একেবারে পাথরের মত চুপ – চোখের কোণায় একফোঁটাও জল নেই। বাড়িতে এসেও একটাও কথা বলেনি। কীই বা বলত? কী বলে সান্ত্বনা দিত শ্বেতাকে? কী বলে ওর কান্না থামাত? ও জানত, সব কথা, সব আশ্বাসই আজ অপর্যাপ্তকর। একটা অসহ্য যন্ত্রণা আর রাগ ভিতর থেকে মনটাকে ভীষণভাবে বিষিয়ে দিচ্ছিল, ইচ্ছে করছিল সবকিছু ভেঙে তছনছ করে ফেলতে। শ্বেতার দিকে ফিরে তাকাল একবার, সে খাটের একপাশে বসে হাতের তালুতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। প্রবীরের মনের মধ্যে এক ভীষণ তোলপাড়। “অনেক হয়েছে, আজ আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব।” মনে মনে কথাগুলো বলে ঘর থেকে উঠে রান্নাঘরের দিকে গেল প্রবীর। ফ্রিজটা খুলে মদের বোতলটা বের করে ঘরে ফিরে আসল। শ্বেতাও বোতল হাতে প্রবীরকে ঘরে ঢুকতে দেখে অবাক হ’ল না। ও আন্দাজ করেছিল, আজ হয়ত এমনই একটা কিছু ঘটবে। তবুও, চোখের জল মুছে কিছুটা শক্তিসঞ্চয় করে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি ঠিক আছ?”
“না।” প্রবীর কঠিন গলায় উত্তর দিল।
“ড্রিঙ্কটা কি করতেই হবে?” শ্বেতা জিজ্ঞাসা করল।
“হ্যাঁ, আজ লাগবে।” প্রবীর আগের মতই কঠিন গলায় উত্তর দিল।
বলে বোতলের ঢাকনাটা খুলে গলায় তরল পানীয় ঢালতে শুরু করল। শ্বেতা বুঝতে পারছিল, আজ কিছু একটা হবেই।
কিছুক্ষণ পরে বোতলটা শেষ করে প্রবীর চাইল শ্বেতার দিকে, চোখে উদভ্রান্তের মত দৃষ্টি। জড়ানো গলায় একটু কষ্ট করেই বলল, “আমাদের কী ভুল ছিল বল তো?”
শ্বেতা চোখ নামিয়ে ভেজাগলায় বলল, “জানি না।”
“কিন্তু আজ তো আমার উত্তর চাই,” প্রবীরের গলায় উত্তেজনা, চোখে একটা আগুন।
“তুমি কি মনে কর প্রশ্ন করলেই তুমি তার উত্তর পেয়ে যাবে?”
“জানি না। তবে আজ প্রশ্নগুলো করবই। করতেই হবে আমাকে।”
“ছেড়ে দাও প্রবীর, লাভ নেই।”
“তোমার কি মনে আজ আমি লাভ-ক্ষতি নিয়ে ভাবছি?” জড়ানো গলায় প্রবীর বলল। “হারানোর মত আর কী আছে আমাদের? একটু বাঁচতে চেয়েছিলাম দু’জনে, সেটা অন্যায়? নিজেদের মত একটা সংসার করব ভেবেছিলাম, সেটা ভুল?” প্রবীরের গলা কেঁপে আসে।
“হয়ত আমাদের ভালটা কেউ চায় না।” শ্বেতা মাথা নিচু করে বলল।
“কেউ আমাদের ভাল করবে না, শ্বেতা। নিজেদেরটা নিজেদেরকেই বুঝে নিতে হবে।” কথাটা বলে বোতলটা সরিয়ে রেখে খাট থেকে উঠে দাঁড়াল প্রবীর। “যারা আমাদের সাথে নেই, তাদের কোন প্রয়োজন নেই আমাদের জীবনে।” বলে টলতে টলতে টেবিলে রাখা ফোনটার দিকে এগোল। শ্বেতা জানে, এখন প্রবীরকে আটকাতে যাওয়ার চেষ্টা করা বৃথা। অনেক রাগ, অনেক ক্ষোভ, অনেক অভিমান, অনেক দুঃখ জমে আছে প্রবীরের ভিতরে। ওর মনের ভিতরে তিল তিল করে যে আগ্নেয়গিরির সৃষ্টি হয়েছে, আজ তা লাভা উদ্গীরণ করবেই।
ফোনটা হাতে নিয়ে কোনওমতে টলতে টলতে ফিরে এসে খাটে বসল প্রবীর। কপালের ঘামটা মুছে একবার শ্বেতার দিকে তাকিয়ে ফোনে নম্বর ডায়াল করল। ওর মায়ের নম্বর। শ্বেতা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, প্রবীরের হাত কাঁপছে। সেই কম্পমান হাতেই ফোনটা কানে ধরল প্রবীর, রিং হচ্ছে। কয়েক সেকেণ্ড পরে ওদিক থেকে প্রবীরের মায়ের গলা ভেসে আসল, “হ্যালো, বাবু বলছিস?”
“হ্যাঁ।” প্রবীরের কাঁপা গলায় উত্তেজনা স্পষ্ট।
“কেমন আছিস বাবু?”
“তোমাকে একটা খবর দিতে ফোন করলাম।”
“হ্যাঁ, বল না।”
একটু থেকে প্রবীর বলল, “আমাদের বাচ্চাটা আজ মারা গেল।” প্রবীরের গলা অসম্ভব শান্ত।
“এ বাবা। কী করে?”
“সেটা আমি কী করে জানব?”
“এত ভাবিস না, আবার হয়ে যাবে।”
এতক্ষণ শান্ত হয়েই প্রবীর কথা বলছিল। কিন্তু মায়ের শেষ কথাটা কানে যেতেই যেন ওর ধৈর্য্যের সব বাঁধ ভেঙ্গে গেল। “তোমার লজ্জা করল না এই কথাটা বলতে? এতটুকুও লজ্জা করল না? নিজেকে আমার মা বল? কোন সাহসে বল?” চিৎকার করে উঠল প্রবীর।
“কিন্তু আমি তো –”
“আর একটাও কথা তুমি বলবে না। সেই বিয়ের পর থেকে আমাদের জীবনে একের পর এক সমস্যা তৈরি করে চলেছ। বিয়ের দিন থেকে শ্বেতাকে অপমানের পর অপমান করে চলেছ। আমাদের বিয়ে ভাঙ্গার সবরকম চেষ্টা করেছ। সমস্যাটা কোথায় তোমার? বিয়েতে পণ নিতে পারনি বলে রাগ? না কি বিয়ের পর ছেলের ইনকামে ভাগ বসাতে পারবে না বলে? কোনটা?”
“কী সব বলছিস? একটু শান্ত হ’।”
“শান্তই ছিলাম, এতদিন শান্তই ছিলাম। শুনতে চাও? যখন চাকরি পাই, হাতে একটা পয়সা নেই। স্টাইপেণ্ড বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তখন চাকরির জায়গাতে গিয়ে প্রথম দু’-তিন মাস চালানোর জন্য কয়েকটা টাকা ধার চেয়েছিলাম। কত টাকা মনে আছে? পঞ্চাশ হাজার। তুমি কি বলেছিলে তখন মনে আছে? তুমি বলেছিলে, বাবার চেম্বার ভাল চলছে না, বাবার আয় কমে গিয়েছে। আর তার পরের মাসেই উত্তর ভারত ট্যুর করতে বেরিয়ে পড়লে। সে তোমরা যে চুলোয় খুশি বেরোও, আমার তাতে কিছু যায় আসে না। ঠিক যেমন আমরা খেতে না পেলেও তোমাদের কিছু যায় আসে না।”
“আমার তো একদম মনে নেই রে বাবু, এ’রকম কিছু বলেছিলাম বলে।”
“তোমার কোনদিন কোন কথা মনে পড়বে না। মনে পড়লে যে নিজের দোষগুলোই বেরিয়ে পড়বে। তোমার স্মৃতিশক্তি একদম ঠিক সময়েই উবে যায়। দু’বছর আগে যখন শ্বেতা ইউটেরাসের সমস্যা নিয়ে প্রায় মারা যাওয়ার মুখে বসেছিল, তখন আমার চাকরির ঠিক নেই। সঞ্চয়ও এমন নেই যে ওকে কোন ভাল নার্সিংহোমে ভর্তি করাতে পারি। আবার তোমাদের সামনে ভিক্ষে চেয়েছিলাম। কী বলেছিলে তখন, মনে আছে?”
“না, আমার সত্যিই মনে নেই রে।”
“বলেছিলে, হাসপাতালে ভর্তি করে দে, সস্তায় হয়ে যাবে। এই কথাটা তো একটা রাস্তার অজানা লোকও আমাকে বলে যেতে পারত। ওর ইউটেরাসের সমস্যা পুরোপুরি ঠিক হয়নি, আর সেজন্য আমি আমার বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পারলাম না। বাবা তো ডাক্তার, পয়সাও তো জীবনে কম কামায়নি, তোমার জন্যও তো কিছু কম করেনি। তাও তো ছোট থেকে তো কানের কাছে বলে গেছ, যে আমিই নাকি তোমাদের বয়সকালের ভরসা। একবারের জন্যও মনে হয়নি যে ভরসার প্রয়োজনটা আমারও হতে পারে? একবারের জন্যও মনে হয়নি যে আমরাও মানুষ? আমাদেরও বাঁচার অধিকার আছে? আমার বাচ্চাটারও বাঁচার অধিকার ছিল?” প্রবীরের গলায় আগুন ঝরছে, চোখে জল।
“দেখ বাবু, তুই কিন্তু এবারে –”
“কী? বাড়াবাড়ি করছি? হ্যাঁ, করছি। শুরুটা তোমরা করেছ, শেষ আজ আমি করব। আমার কাছে তো কিছুই ছিল না, কিন্তু তোমাদের কাছে তো পয়সার অভাব নেই। বাবা আজ প্রতি মাসে চেম্বার-নার্সিংহোম-পেনশন মিলিয়ে যা রোজগার করে, সেটা আমার প্রায় চারমাসের মাইনের সমান। তার পরেও, আমার চাকরির অবস্থা জেনেও, বোনের বিয়ের সময় টাকা চাইতে চলে এসেছিলে। আমাদের শেষ সঞ্চয়টুকু নিংড়ে নিতে চেয়েছিলে। কত টাকা লাগবে তোমার? কত, আর কত পেলে তোমার পয়সার ক্ষিদে মিটবে? তোমরা শালা মানুষ?”
“না, আমরা তো জানোয়ার। তাই তো এইভাবে কথা বলার সাহস পাচ্ছিস।”
“এখনও কিছুই দেখনি। কিন্তু এবারে যদি আমাদের সাথে আর কোনরকম যোগাযোগ রাখার চেষ্টা কর, তাহলে মনে রেখ, আমি কিন্তু তোমারই ছেলে। আমি প্রতিশোধ নিতে কতদূর অব্দি যেতে পারি, সে ধারণা তোমার আছে। আমি কিন্তু তোমাদের সাবধান করে দিচ্ছি।”
প্রবীর আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ফোনের ওপার থেকে এবারে একটা গম্ভীর গলা ভেসে আসল, “বাবু, আমি বাবা বলছি।”
প্রবীর কয়েক সেকেণ্ডের জন্য চুপ করে গেল। একটু থেমে শান্ত আর দৃঢ় গলায় বলল, “বাবা, তুমি তো সব জানতে, তাও চুপ করে ছিলে?”
“ও তুই বুঝবি না।”
“বিশ্বাস কর বাবা, আমি আজ আর জানতেও চাই না। তুমি আমাকে সবসময় মাথা তুলে বাঁচার কথা বলে এসেছ। আর তুমি যে মায়ের কাছে শিরদাঁড়াটা বিক্রি করে দিয়েছ, সেটা বুঝতে একটু সময় লেগে গেল।”
“তোর মাকে তো জানিসই–”
“বাহ, চমৎকার বাবা। আজও তুমি মাকেই সমর্থন করে গেলে। অবশ্য সে তো বিয়ের পর থেকেই করে আসছ। গরীব ছেলে, বড়লোক মেয়ে – খুব চেনা লেনদেনের গল্প। কিন্তু আমি তো ছিলাম তোমারই অংশ, তোমার কি একবারের জন্যও মনে হয়নি আমার পাশে দাঁড়ানোর কথা?”
“আমি ঠিক জানতাম তুই করে নিবি।”
“বাবা, তোমার মনে আছে, দাদু তোমাকে বারবার বলত সন্তানকে দারিদ্রের মধ্যে মানুষ করতে। কিন্তু তুমি মনে হয় বরাবর দারিদ্র আর বঞ্চনার মধ্যে পার্থক্যটা করে উঠতে পারনি। তুমি ঠিকই বলেছ, আমি নিজেই করে নিতে পারব। এই অবধি পৌঁছতে পৌঁছতে অনেক কিছু হারিয়েছি, আজ নিজের সন্তানকেও হারালাম। তবে আজ মৃত্যুকে এভাবে আসতে দেখে আমার হারানোর ভয়টা কেটে গেল। আমার আর তোমাদের কোন প্রয়োজন নেই। আজ তোমরা না থাকলেও আমার আর কিছু যায় আসে না। আমাকে নিজেই করে নিতে হবে, কারণ আমি জানি, আমার পিছনে কেউ নেই, কোনদিনও ছিল না।”
কয়েক মুহূর্ত নিস্তব্ধতার পরে উত্তর আসল, “দেখ যা ভাল বুঝিস, কর।”
“হ্যাঁ বাবা, এখন নিজের ভালটা বুঝতে শিখে গিয়েছি। তবে এই ভালটার মধ্যে তোমাদের আর কোন জায়গা নেই। একটাই অনুরোধ, আর কোনদিন আমাদের সাথে যোগাযোগ করো না, তোমাদের সাথে কোনরকম সম্পর্ক আর রাখতে চাই না আমি। তোমার টাকাপয়সা তোমারই থাকুক, ওসব বোনকে দিয়ে যেও। যে টাকা আমার বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পারল না, আমার বউকে সুস্থ করতে পারল না, ক্ষিদের সময় আমাদের দু’মুঠো ভাত দিতে পারল না, সেই টাকার কোন প্রয়োজন আমাদের নেই। পারলে আমার নামে একটা শ্রাদ্ধশান্তি করে দিও, আর এটাই ধরে নিও যে আমরা তোমাদের জন্য মৃত। ভাল থেক।”
এই বলে প্রবীর ফোনটা কেটে ছুঁড়ে ফেলে দিল মেঝেতে। তারপরই মাটিতে বসে পড়ে ছোট ছেলের মত চিৎকার করে কেঁদে উঠল।
দ্বিতীয় দৃশ্য:
দু’ঘণ্টা হয়ে গিয়েছে অপারেশন থিয়েটারের বাইরে বসে। ভোরবেলায় ফোনটা আসা মাত্র গাড়ি নিয়ে ছুটেছে। কি ভাগ্যিস ড্রাইভারকে আগে থেকে বলে রাখা ছিল। সকাল ন’টায় অপারেশন শুরু হওয়ার কথা, প্রবীরও সেইমত প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু অপারেশন যে হঠাৎ সকাল ছ’টায় করতে হবে, সেটা কে জানত। পড়ি-কি-মরি করে হাসপাতালে ছুটতে ছুটতে এসে দেখে শ্বেতাকে অপারেশন থিয়েটারে ইতিমধ্যেই নিয়ে চলে গিয়েছে। হাসপাতালে পৌঁছতে পঁয়তাল্লিশ মিনিট মত লাগে, তাই এসে পৌঁছতে মিনিট দশ দেরী হয়েছে। তার মধ্যেই এতকিছু। একজন নার্সকে জিজ্ঞাসা করাতে তিনি বললেন সব মিলিয়ে তিনঘণ্টা মত লাগতে পারে। তখন থেকে অপারেশন থিয়েটারের বাইরেই বসে আছে প্রবীর।
আজ প্রায় এক বছর হয়ে গিয়েছে প্রবীরের নিজের বাড়ির সাথে কোন যোগাযোগ নেই। সমস্ত সম্পর্ক একরকম চুকিয়েই দিয়েছে। কিন্তু আজ এই অপারেশন থিয়েটারের বাইরে একা বসে থাকতে থাকতে এক এক করে সব স্মৃতিগুলো তার চোখের সামনে ভিড় করে আসছিল। বিয়ের রাতে প্রবীরের মায়ের গয়না নিয়ে খোঁটা সহ্য করতে না পেরে শ্বেতা কেঁদেছিল, তবুও প্রবীরকে কিছু বলতে দেয়নি। ভেবেছিল হয়ত সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। তারপরে পিএইচডির শেষদিকে প্রবীরের স্টাইপেণ্ড বন্ধ হয়ে যায়, শ্বেতা তখন নিজের সমস্ত সঞ্চয় প্রবীরের হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল, “এইটুকু ছাড়া আমাদের কাছে আর কিছু নেই।” মায়ের কাছে সাহায্য চেয়েও বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে এসেছিল। শ্বশুরের সাহায্য দু’জনেই প্রত্যাখ্যান করেছিল। শেষে একটা চাকরি নিয়ে ব্যাঙ্গালোর চলে আসে, সম্বল সেই সামান্য সঞ্চয়টুকু। প্রথম কয়েকমাস কষ্টেসৃষ্টে কাটানোর পরে একটু একটু করে নিজের সংসার গুছিয়ে নিতে শুরু করেছিল দু’জনে। তখনই ধরা পড়ে শ্বেতার ইউটেরাসের সমস্যা। ব্যাঙ্গালোরের ডাক্তাররা বলেছিল, ভাল জায়গায় চিকিৎসা করাতে না পারলে শ্বেতা বাঁচবে না। সেদিনও তার মা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, দেখাদেখি বাবাও কিছু বলে নি। নেহাত কপালের জোরেই সরকারি হাসপাতাল থেকে শ্বেতা নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছিল, কিন্তু ওর শরীর ভিতর থেকে হয়ে গিয়েছিল অনেকটাই দুর্বল। তখন শ্বেতাকে বেসরকারি নার্সিংহোমে চিকিৎসা করানোর মত আর্থিক পরিস্থিতি প্রবীরের ছিল না। তার কয়েকমাস পরে প্রবীর একটা ভাল চাকরি পাওয়াতে দু’জনেই একটু শান্তি অনুভব করেছিল। হয়ত ভেবেছিল, টানা তিনবছরের আর্থিক টানাপোড়েন থেকে পরিত্রাণ পেয়ে এবারে নতুন প্রজন্মকে স্বাগত জানাবে ওরা দু’জনে। কিন্তু শ্বেতার শারীরিক দুর্বলতার কারণে তাদের প্রথম শিশুটি পৃথিবীর আলো দেখার সুযোগটাই পেল না। যদি সেদিন মায়ের কথা অমান্য করে বাবা একটু সাহায্য করত, তাহলে হয়ত সেই ঘটনাটা ঘটত না। কিন্তু প্রবীর বুঝে উঠতে পারেনি তার বাবার এইরকম ব্যবহারের কারণ। কেন মায়ের কথায় বারবার গুটিয়ে যায় মানুষটা? ছোট থেকে বাবার কোন কথা সে তো অমান্য করেনি। স্কুল, কলেজ, পড়াশুনো, চাকরি – জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে সে বাবার মাথা উঁচু করার চেষ্টা করেছে, তাহলে বাবার এইরকম বিরূপ ব্যবহারের কারণ কি? বাবার প্রতি তার ভালবাসা আর শ্রদ্ধার এই কি প্রতিদান? অনেক ভেবেও কোন উত্তর পায়না প্রবীর, শুধু একটা তিক্ত অভিমানে মন ভরে আসে।
“প্রবীর সেনগুপ্ত কে আছেন এখানে?” নার্সের ডাকে আচমকা চিন্তার সূত্রটা কেটে যায়।
“আমি,” প্রবীর হাত তুলে বলে।
“আপনি ভিতরে আসুন, ডাক্তারবাবু ডাকছেন।” নার্স গম্ভীরমুখে বলে।
ভয়ে, অজানা আশঙ্কায়, প্রবীরের গলা শুকিয়ে যায়। হৃদস্পন্দন একধাক্কায় বেড়ে যায় অনেকগুণ, বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে থাকে কপালে। সে কোন কথা না বলে দ্রুতপায়ে নার্সের পিছু নেয়। নার্স তাকে নিয়ে যায় অপারেশন থিয়েটরের দিকে। এমন সময়…
“কনগ্র্যাচুলেশনস।” বলে চারজন নার্স আর ডাক্তার হাততালি দিয়ে অভিবাদন জানায় প্রবীরকে। প্রবীর হাঁ করে তাকিয়ে আছে বেডে শুয়ে থাকা শ্বেতার দিকে। শ্বেতার কোল আলো করে রয়েছে তোয়ালেতে মোড়া তাদের সন্তান। ছোট্ট মানুষটা নিজের হাতের মধ্যে শ্বেতার হাতের একটা আঙুল ধরে রেখেছে।
“অত দূর থেকে দেখছেন কি? কাছে যান, ছেলেকে কোলে নিন।” ডাক্তার হাসতে হাসতে প্রবীরের পিঠে হাত রেখে বললেন।
প্রবীর ধীরপায়ে শ্বেতার কাছে এগিয়ে গেল, শ্বেতার চোখে আনন্দাশ্রু, মুখে এক অনাবিল হাসি। প্রবীরের মুখে আজও কোন ভাষা নেই, এই অনুভূতি কথায় বলে বোঝানো অসম্ভব। শ্বেতার দিকে হাত বাড়াতে শ্বেতা সাবধানে প্রবীরের কোলে তুলে দিল নিজেদের সন্তানকে। তাকে কোলে নিতেই প্রবীরের সারা শরীরে যেন একটা বিদ্যুৎপ্রবাহ বয়ে গেল। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, সে আস্তে আস্তে ছোট হয়ে যাচ্ছে। ছোট হতে হতে বিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে ওই শিশুটায়। আর ওর জায়গাতে কে দাঁড়িয়ে আছে? কে ও’টা? বাবা? হ্যাঁ, বাবাই তো। অতীত-বর্তমান সব গুলিয়ে যাচ্ছে প্রবীরের। মনের মধ্যে জমে থাকা কষ্ট, রাগ, অভিমান – সব যেন ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে ওই ছোট্ট শিশুর মুঠোর চাপে। সন্তানকে বুকের মধ্যে চেপে জড়িয়ে ধরতেই প্রবীরের গলা থেকে নিজের অজান্তেই কয়েকটা চেনা শব্দ বেরিয়ে এল, “বাবু, কেমন আছিস?”
কথাগুলো উচ্চারণ করতেই ভিতরটা মুচড়ে উঠল প্রবীরের। ছেলেকে শ্বেতার হাতে দিয়ে প্রবীর বেরিয়ে এল অপারেশন থিয়েটারের বাইরে। আজ আবার ওর হাত কাঁপছে। কাঁপা হাতেই ফোনটা বের করে নম্বর ডায়াল করল, বাবার নম্বর। রিং হচ্ছে। কয়েক সেকেণ্ড পরে ওদিক থেকে একটা ভারী গলা ভেসে আসল,
“বাবু, কেমন আছিস?”
লেখক পরিচিতি : অভীক সিংহ
গল্পটির লেখক ড: অভীক সিংহের জন্ম পশ্চিমবঙ্গে। পেশায় অর্থনীতির অধ্যাপক এবং গবেষক, যুক্ত আছেন লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে, বর্তমান বাসস্থান চীন। তবে ভালবাসাটা আজও লেখালিখি, পেন্সিল স্কেচ, যন্ত্রসংগীত, এবং নিত্যনতুন রান্নাবান্নার সাথেই রয়ে গিয়েছে। প্রথম বই "R.E.CALL: এক Recollian-এর গল্প" প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। দাদুর হাত ধরে কবিতা দিয়ে লেখালিখির সূত্রপাত হলেও এখন প্রবন্ধ এবং গল্পতেই মনোনিবেশ করেছেন।
অসাধারণ একটি গল্প
অনেক ধন্যবাদ গুরু ❤️