জন্মান্তরবাদ ও বর্তমান সমাজ

লেখক : ইচ্ছেমৃত্যু

অতঃপর স্বামী সম্বিতানন্দ মহারাজ বলিলেন, “বর্তমানের সকল ঘটনাই প্রমাণ করিতেছে যে জন্মান্তরবাদ চিরন্তন সত্য। ডারউইন যে বিবর্তনবাদের ধারণা দিয়াছিলেন তাহা জন্মান্তরবাদ হইতেই অনুপ্রাণিত”।
এক ফুটকাটা ডেঁপো ছোকরা বলিল, “কী কেলো! ডারউইনের ইভোলিউশনেও জন্মান্তরবাদ!”
স্বামীজি বলিলেন, “ওহে অর্বাচীন, হিন্দুদিগের প্রাচীন মুনি ঋষি আহোরিত জ্ঞান যে সকল পুস্তকাদিতে বিবৃত আছে তাহা তো পঠন করিলে না। তোমাদের জ্ঞান খুব বেশি হইলে বিগত তিন শতকের! সেই জ্ঞান লইয়া কী করিয়া মহাবিশ্বের বিচার করিবে? বিশ্বের বিবর্তন তত্ব জানিতে হইলে হিন্দু ধর্মের অতি প্রাচীন সমস্ত পুস্তকাদি অধ্যয়ণ করিতে হইবে”।
দাবড়ানি খাইয়া ডেঁপো ছোকরাটি চুপ করিয়া গেল, বাকিরা সব মস্তক হেলাইয়া সম্মতি জানাইল যে স্বামীজি যাহা বলিতেছেন ঠিকই বলিতেছেন। স্বামীজি বলিতে শুরু করিলেন, “তোমাদিগকে কঠিন করিয়া বলিলে বুঝিবে না, তাই তোমাদিগকে সহজ করিয়া বলিতেছি। তোমরা, এমনকি যাহারা নিরক্ষর তাহারাও প্রায়শই বলিয়া থাকো ‘বাঁদর ছেলে’ কিন্তু কখনও কি ভাবিয়া দেখিয়াছো ইহা কেন বলিয়া থাকো? এইসব বালকেরা পূর্বজন্মে যে বানর ছিল তাহাই প্রমাণ করে। আর এই কথাটি ডারউইনের নাম শোনে নাই এমত নিরক্ষর ব্যক্তিরাও বলিয়া থাকে। আসলে প্রাচীন মুনিঋষির নিকট হইতে শুনিয়াই আমরা এই শিক্ষা লাভ করিয়াছি। ইহাকে পূর্বে ‘শ্রুতি’ বলা হইত। এই সেদিন ডারউইন আসিয়া বলিল আমাদিগের পূর্বপুরুষ বানর ছিল – কিন্তু ইহাতে আর নতুনত্ব কী রহিল!”
সবাই সমস্বরে “ঠিক ঠিক” বলিতে লাগিল। ডেঁপো ছোকরাটি চুপ করিয়া থাকিতে না পারিয়া বলিল “আর যখন বলা হয় ‘গর্দভ কোথাকার’, তখন কি তার পূর্বপুরুষ গাধা ছিল?” সবাই ছেলেটিকে ক্রুদ্ধ হইয়া দেখিতে লাগিল। স্বামীজি অবশ্য মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিলেন, বলিলেন “মনে জিজ্ঞাসা থাকা খুব ভাল। প্রশ্ন করিবে। তোমার এই প্রশ্নের উত্তরও আমাদিগের গ্রন্থে বর্তমান। তাহাকে ‘কর্মফল’ বলা হইয়া থাকে। কোনও গর্দভ তাহার জীবনে উৎকৃষ্ট কর্ম করিলে তাহাকে মনুষ্যজন্ম প্রদান করা হয়। কিন্তু একেবারে দুইধাপ তিন ধাপ উন্নীত হইয়া কেহ মনুষ্য জন্ম লাভ করিলেও সাধারণ মনুষ্যের মত মেধা পায় না। সাধারণ মনুষ্যেরা জ্ঞান-মেধা সবই তাহার পূর্ব মনুষ্য জন্মের অভিজ্ঞতা দিয়া অর্জন করিয়া থাকে। ফলত, গর্দভের মেধা কম হইয়া থাকে। বর্তমান যুগের অধিকাংশ মনুষ্যই পূর্বজন্মে মেষ ছিল বলিয়াই প্রতিপন্ন হয়, তাই উহারা গড্ডলিকা প্রবাহে জীবন অতিবাহিত করিতেছে। আর কিছু শৃগাল, সারমেয় ইত্যাদি মনুষ্য জন্ম লইয়া বর্তমান যুগের রাজনীতি সামলাইতেছে। শুধুমাত্র অল্পকিছু মানবই পুনরায় মানবজন্ম লইয়াছেন – তাঁহাদের মধ্যেই মনুষ্যত্ব টিকিয়া রহিয়াছে…”
ডেঁপোটি স্বামীজিকে প্রায় থামাইয়া দিয়া বলিল, “তাহলে আগের প্রজন্মের মানুষগুলির কী হল?”
“তাঁহাদের অধিকাংশই নির্বাণ লাভ করিয়াছেন। বুদ্ধদেবের কথা তো তোমরা শুনিয়াছো। সেইরকমই সমস্ত জ্ঞানীগুণি ভাল মানুষেরা যখন নির্বাণ লাভ করেন তখন তাঁদের আর পৃথিবীতে জন্মাইতে হয় না। তাঁরা এই সৌরজগৎ হইতে মুক্তি পাইয়া আরও উন্নত কোন গ্রহে বিভিন্ন জন্মান্তরের মধ্য দিয়া যাইতে থাকেন। পূর্ব প্রজন্মের মনুষ্যেরা অনেক মহৎ ছিলেন বলিয়া তাঁহাদের অনেকের সেই জন্মই ছিল পৃথিবীতে অন্তিম জন্ম। ফলত মনুষ্যকুলের প্রচুর শূন্যপদ পূরণ করিবার নিমিত্ত বহু মনুষ্যেতর প্রাণী মনুষ্যে উন্নীত হয়। তাহারাই এই প্রজন্ম শাসন করিতেছে। বিশ্বাস না হইলে পরিবেশের দিকে তাকাইয়া দেখ, একের পর এক প্রাণীকুল সংখ্যায় কমিয়া আসিতেছে যাহাদের আমরা বিপন্ন প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত করিতেছি”।
ডেঁপোটি এতক্ষণে খানিক বিশ্বাস করিয়াছে এই রকম এক ভাব করিয়া বলিল, “তাহলে তো মহামুস্কিল। এই মানুষরূপী জন্তু জানোয়াররাই পৃথিবী শাসন করতে থাকবে!”
স্বামীজি বলিলেন, “আশঙ্কিত হইবার কারণ নাই। মহাকালের বিচারে এই সময়কাল অতি অল্প। ইহারা ক্রমেই মনুষ্যগুণ প্রাপ্ত হইবে, এবং পুনর্জন্ম লইলে সেই গুণ পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত হইবে। এবং এইভাবে জন্মান্তরের দ্বারাই মনুষ্য সমাজের উন্নতি হইতে থাকিবে, বিবর্তনবাদ দ্বারা নহে”।
সকলে সমস্বরে বলিল, “জয় স্বামী সম্বিতানন্দ মহারাজের জয়!”
শুধু ডেঁপো ছোকরাটি পকেট হইতে স্মার্টফোন বাহির করিয়া গুগল অনুসন্ধানে ব্যস্ত হইয়া গেল।


লেখক পরিচিতি : ইচ্ছেমৃত্যু
জন্ম বর্ধমানের বর্ধিষ্ণু গ্রামে। পেশায় নরম তারের কারিগর আর নেশায় - রীতিমত নেশাড়ু, কী যে নেই তাতে - টুকটাক পড়াশোনা, ইচ্ছে হলে লেখা - সে কবিতা, গল্প, রম্যরচনা, নিবন্ধ যা কিছু হতে পারে, ছবি তোলা, বাগান করা এবং ইত্যাদি। তবে সব পরিচয় এসে শেষ হয় সৃষ্টিতে - পাঠক যেভাবে চিনবেন চিনে নেবেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।