জন্মান্তর

লেখক : পিনাকী চক্রবর্তী

“গত বছর জানিয়েছিলেন তাঁর লিঙ্গ পরিবর্তন করার কথা। সঞ্জয় বাঙ্গারের সন্তান অনয়া এখন পুরুষ থেকে মহিলা। ভারতীয় দলের প্রাক্তন ক্রিকেটার সঞ্জয়। তাঁর কন্যা অনয়া জানালেন লিঙ্গ পরিবর্তনের পর তাঁকে ঠিক কতটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। বেশ কয়েক জন ক্রিকেটার তাঁদের নগ্ন ছবি পাঠাতেন অনয়াকে। এমনকি এক জন প্রাক্তন ক্রিকেটার যৌন সম্পর্কের প্রস্তাবও দেন। ‘জেন্টলম্যানস গেম’ বলা হয় ক্রিকেটকে। সেই ‘জেন্টলম্যান’-দের ‘অভদ্র’ আচরণের কথা জানিয়েছেন অনয়া।”
– আনন্দবাজার 

সূর্যের তাপ ও উত্তাপ, ইদানিং কলকাতার রাস্তায় যতটুকু যন্ত্রণা ছড়ায়, তার চেয়ে ঢের বেশি ও আরও বেশি, অনেকটাই কষ্ট অগ্নিভের বুক জুড়ে। একটাই বুক, অথচ কষ্টের শেষ নেই।
অগ্নিভ, বয়স তিরিশ, বুটিকের দোকান খুলেছে, আজকে উদ্বোধন। নেতাজীনগর কলেজের সামনেই ছোট্ট দোকান, শান্ত পরিবেশ। রবিবার সকালেই সে এসে গিয়েছে। দুপুরে বন্ধুরা, শুভাকাঙ্ক্ষীরা ধীরে ধীরে আসবে। খুব বড় নয়, ছোট্ট আড়ম্বরহীন ঘরোয়া পুজো, খাওয়া, তারপর গল্প। এইসব ভাবতে ভাবতে অগ্নিভ চেয়ে আছে – হাত ঘড়িতে প্রায় সকাল এগারোটা!

আরও অনেকক্ষণ, অগ্নিভ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে, ঘড়িতে প্রায় এগারোটা চল্লিশ। দুপুরে গরম হাওয়া, পরিচিত মানুষের ভিড় দেখতে দেখতে ক্লান্ত, সেই সব মুখের ভিতর একটিও আপনজনের মুখ নেই! এই সংসারে, আপন খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত সে।
দূরে একটা ক্যাব এসে থামতেই, গাড়ির দরজা খুলে নামল বছর পঞ্চাশের এক মহিলা। অগ্নিভ সেই দিকে তাকিয়ে কিছুটা অবাক, অন্যমনস্ক, ও অন্য মনে বলতে শুরু করল, দিদি এসেছে!
মহিলা এগিয়ে এসে বলল, “সকালে অন্তত ফোন করতে পারতিস।
অগ্নিভ স্থির চোখে বলল, “দিদি, সব কথা ফোনে ফোনে বলা যায়?
“চাইলেই সব সম্ভব।”
“বাবা নিজে এসেও মিটিয়ে নিতে পারতেন!”
“তুই যাসনি কেন?”
“ইচ্ছা হয়েছিল, কিন্তু…”
“কিন্তু কী?”
“আমি তোদের শুধুই কষ্ট দিয়েছি। লজ্জায় নিজের উপর খুব রাগ হয়।”
“আমি সবসময় তোর পাশে ছিলাম। থাকব।

আরও অনেক কথা, অনেক অনেক কথা, দুজনেই বলছিল। প্রায় চল্লিশ মিনিট কথা চলেছে, দুজনেই দোকানের ভিতর ঢুকে সোফায় বসে বসে কথা বলছিল। অনেক বন্ধু ও বান্ধবী এসেছে। ইরাভি বলল, “সে আসেনি?
অগ্নিভ হাল্কা মাথা নেড়ে বলল, “না। আসেনি।”
“যোগাযোগ?”
“নেই।”
“কেন?”
“রাখতে চাইলে থাকত। দুজনেই ভুলতে চেয়েছি।”
“ভুলে গিয়েছিস? সত্যি?”
“সত্যি ভুলেছি কিনা জানি না!

ধীরে ধীরে দিন ফুরিয়ে দিনের আলো নিভে আসে, আকাশের কোলে দোল খায় রাতের তারা, সন্ধ্যায় ফুরায় দিনের যত পাওনা যত দেনা, হিসেব নিয়ে হিসেবী খাতায় বেহিসেবী হয়ে ওঠে অগ্নিভ। অনেক দিন, অনেক রাত এইরকম একটা বুটিক দোকানের স্বপ্ন দেখেছিল চারটি চোখ, দুটি অগ্নিভর আর বাকি দুটো এখন সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়েছে। ঘড়িতে ন’টা, রাধারাণী দোকানের শাটার নামিয়ে বলল, “তুমি থাকবে? আমি যাচ্ছি।”
এরপর দোকানের ভিতরের এসি শুধু চলছে, মনের বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনায় বয়ে যায় বাহিত ও বর্জিত এবং নিমজ্জিত অর্ধনিমিলিত ধূসর সাদা অতীত, একান্ত যাপন। হ্যাঁ, নতুন জীবনেও একান্তই একান্ত একীভূত একক যাপিত সত্যি লুকিয়েছে ও লুকিয়ে আছে।

অগ্নিভ সোফায় হেলান দিয়ে শুয়ে, সামনে ক্যাশ কাউন্টারে রাখা ফুলদানির দিকে তাকিয়ে ফিরে যায়…

(১)

“আপনি এখানে!”
“হ্যাঁ, খেলা দেখতে ভালো লাগে। আপনি?”
“আমাকে আমার এক বন্ধু নিয়ে এসেছে।”
“ও! আপনি আসেননি?”
“না না, তেমন ব্যাপার নয়। আমি খেলার কিছুই জানি না।”
“সবুজ মেরুণ জার্সি হচ্ছে মোহনবাগান। হলুদ জার্সি ইস্টবেঙ্গল।”
“আপনি খুব খেলা দেখেন, না?”
অগ্নিভ কথাগুলো বলছিল, ও শুনছিল, অচেনা অজানা মানুষটার সাথে, খুব আন্তরিক ভাবেই। প্রথম দেখায় একজন অপরিচিত মানুষের মধ্যে লিঙ্গগত পরিচয় খুঁজতে রাজি নয় অগ্নিভ। ছোটবেলা থেকেই মানুষের শরীরের লিঙ্গের গুরুত্ব তাকে টেনে-হিঁচড়ে কুপোকাত করতে পারেনি। আমরা যেমন – তোমরা যেমন, এবং আরও অনেকেই যারা যাদের মতন বা নিজেদের মতন – সকলেই অপরিচিত মানুষের সাথে আলাপ করলে, প্রথম পরিচয়েই মানুষটিকে ছেলে-মেয়ের পরিচয়ের গন্ডিতে আটকে রাখে। অগ্নিভ শুধুই দুই চোখ দিয়ে মানুষ দেখে, মানবিকতার স্পর্শকাতর মুহূর্ত অনুভব করে। এটা একটা লড়াই, একটা যুদ্ধ, একটা যুদ্ধের প্রস্তুতি পর্ব – সে উপলব্ধি করে। খুব ছোটবেলা থেকেই চারপাশের মানুষের ভিতরে একটা ক্রাইসিস সে টের পেয়েছে, সেক্স-আইডেন্টিটি ক্রাইসিস, লিঙ্গগত বিপন্নতা বোধ, ধীরে ধীরে এইসবের মধ্যে নিজেকে মানিয়ে নিতে অসুবিধা হয়। 

অগ্নিভ দোলাচলে দুলছে, ছোটবেলা থেকেই মানুষের প্রতি তাঁর সন্দেহ, শুধুই সন্দেহ নয়, ধীরে ধীরে মানুষের থেকে দূরত্ব শুরু হয়ে যায়। খুব অল্প পরিসরে সে ঘোরাঘুরি করে না, অনেক মুখ ও মুখোশের মাঝে, অল্প গুটিকয় ভালবাসার প্রহর খুঁজে পেয়েছে, সেইগুলি নিয়ে বেঁচে আছে। সামনে যে ছেলেটি বসে বসে ময়দানের দিকে তাকিয়ে আছে, কথা হচ্ছে, অগ্নিভ পাশের সিটে বসে উত্তেজনা নিচ্ছে, হাসছে কথা বলছে।
অগ্নিভ বলল, “আপনি প্রায়ই খেলা দেখতে আসেন?
ছেলেটির বয়স তিরিশ। হাল্কা চেহারা, ফর্সা গায়ের রং, মুখে “অরিকে দমন করে যে” অরিন্দম হাসি, সুপুরুষ বলা যায়। কেননা অগ্নিভ পুরুষের সৌন্দর্য্য উপেক্ষা করতে পারেনি। তার বয়সী ছেলেরা মেয়েদের সাথে ডেট করেছে, ঘুরতে গিয়েছে, প্রেম প্রিয়াসী হয়ে প্রিয়ের পিপাসার্ত হৃদয়ে হ্রদে অবগাহন করে। আর অগ্নি পুরুষ-প্রার্থী, পুরুষের হৃদয় খোঁজে, সে পুরুষের শরীরে ঘামের গন্ধে সন্ধ্যা-সাগর পাড়ি দেওয়া একাকী নায়ক নাবিক হতে চেয়েছে, বহু ছেলের প্রেমে পিছলেছে, এই পুরুষ মানুষটিকে নিজের মানুষ মনে হয়।
অগ্নিভ বলল, “আমি বন্ধুর সাথে এসেছি। আপনি?”
ছেলেটি বলল, “বন্ধুদের সাথে।

খেলা শেষ হয়েছে, আলো নিভে গিয়েছে স্টেডিয়ামের, নেতাজি ইনডোর থেকে বেরিয়ে দু’জনেই আলাদা হয়ে যাবে। কলকাতা একদা খেলার শহর, আজ শুধুই খেলনা ঘর, স্মৃতি পাল্টে বিস্মৃতি হয়ে ওঠে, খেলা আর খেলনায় ভেসে যায় কলকাতার প্রিয় স্বপ্ন-মুখরিত মানুষের আদরের নৌকো। অনেক রাত নয়, তবু খেলা থেমে গেছে, মানুষের ভিড় ফিরছে হাল্কা হয়ে, মাথার উপরে আকাশ, স্থির ধীর চাঁদ। অগ্নি বলল, “আপনার নাম?
ছেলেটি হেসে বলল, “মেহেবুব।”
অগ্নিভ ছেলেটির চোখের দিকে তাকিয়ে আছে।

অগ্নিভ বালিগঞ্জের মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেহেবুবের ফোন নম্বর পেয়ে সে নিজেই ফোন করেছিল, এর মধ্যে প্রায় তিনমাস কেটে গিয়েছে। রবিবারের বিকেলে ওরা দু’জনে দু’জনের হাত ধরেছে, দাঁড়িয়ে আছে, সন্ধ্যায় দাঁড়িয়ে আছে আকাশের নিচে, অনেক গতি নিয়ে গাড়ি ছুটছে, দোকান খোলা, মানুষের ভিড়। দু’জনে ক্যাফেতে ঢুকল।
মেহেবুব, আমাদের মধ্যে ভালবাসা কবে থেকে জন্ম নিয়েছে?”
অগ্নিভ, ভালবাসার বীজ আমরা নিয়েই জন্মেছি।
আমাদের ভালবাসা আমাদের কাছে স্বীকৃত। কিন্তু…
সমাজে অনেক রকমের অনুভূতি রয়েছে, উপাদান রয়েছে। ভালবাসা উপাদান নয়, সম্পর্ক উপাদান। ভালবাসা হচ্ছে অনুভূতি।
অনুভূতি সমাজের কাছে স্বীকৃত?
মেহেবুব হেসে ফেলল। বালিগঞ্জের ছোট্ট ক্যাফের ভিতরের পরিবেশ খুব ছিমছাম, হলুদ হলুদ আলো, সাদা-লাল ফুলদানি, হাতে তৈরি পোড়ামাটির শো-পিসে ঘরোয়া মুহূর্ত তৈরি হচ্ছে, দুই প্রেমিক চোখে চোখে কথা বলছে। অনেক কথা মুখে বলা যায় না, চোখের পলকে মুহূর্তের মুহূর্ত যাপন ঘটে যায়।
মেহেবুব হেসে বলল, সম্পর্ক নিয়ে সমাজের মাথাব্যথা আছে, সম্পর্ক নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু অনুভূতি স্বাধীন।

মেহেবুবের সাথে কাটানো মুহূর্তে অগ্নিভ নিজেকে খুঁজে পায়। এই যে শরীর, ভিতরে বহমান বেহিসেবী, বাহিত, ও বর্জিত সত্ত্বা রয়েছে, সেই সত্ত্বার অস্তিত্ব খুঁজে পায়, কিংবা এখনও খুঁজে ফিরছে মনের মানুষ, যে হাত ধরে জানিয়ে দেয় – পুরুষ কারাগারে বন্দী এক নারী, সে বর্জিত নয়, স্বীকৃতিই বর্জনকে গ্রহণ করে নিতে পারে, গৃহ দেয়, গৃহদাহ দেয়, ভালবাসায় ভালবাসায় গৃহদান করে।

মেহেবুব আজ কলকাতা থেকে দিল্লী ফিরছে। সে অগ্নিভকে একটা প্রস্তাব দিয়েছিল। এখনও জবাব পায়নি। মনের কাছে যে জন থাকে, সে যখন কাছে থেকে দূরে যায়, মন খুব কাঁদে, ছটফট করে, যন্ত্রণা হয়। অগ্নির মনে হচ্ছে এক ছুটে ওকে ঘিরে ধরে বলে, “উইল ইউ ম্যারি মি?”

ঘড়িতে রাত দশটা, গাড়ি থেকে নেমে পাড়ার মোড়ে দাঁড়াতেই সামনে দাঁড়িয়ে আছে! সলিল বসু, বাবার বন্ধু। একসময় অগ্নিভের বাবা প্রীতিকর সেনের সাথে ফুটবল খেলতেন, এখন অবশ্য বাচ্চাদের খেলা শেখান। সলিল এগিয়ে এসে বলল, “অগ্নি, মাঠে যাওয়া ছেড়ে দিলে কেন?”
অগ্নিভ চুপ করে থেকে বলল, “একটু ঝামেলার মধ্যে আছি কাকু।”
“ইদানিং দেখছি পুরুষ মানুষের চেয়ে মেয়ে মানুষ সাজতে বাঙালি ছেলেরা বেশি পছন্দ করছে। তুমিও সেই দলে নাম লিখিয়েছ নাকি?”
“ছেলে আর মেয়ে আলাদা সত্ত্বা কাকু।”
“তোমার বাবা বলছিলেন, তুমি খেলাধুলো ছেড়ে দেবে?”
“তাতে অসুবিধা কোথায়?”
“আমার অসুবিধা নেই। তোমার বাবার আছে।”
“কাকু আপনি আমাকে ছোটবেলা থেকে দেখছেন। আমার বয়স বাইশ বছর। আমি নাবালক নই।”
“অগ্নি, তুমি বুঝতে পারছ তোমার বাবার আপত্তি।”
“না কাকু আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
সলিল কিছুক্ষণ থেমে বলল, “আমি বলছি। তোমার বাবার একটা সামাজিক সম্মান আছে। তুমি সেই সম্মান নষ্ট করতে পার না।”
“বুঝলাম না কাকু।”
“ওই ছেলেটার সাথে তোমার এতো ঘোরাঘুরি কীসের? তুমি নাকি বলেছো তোমরা বিয়ে করবে?”
“এটা আপনাকে কে বলল?”
“তোমার বাবা।”
“অসুবিধা?”
“ছেলে হয়ে ছেলেকে বিয়ে? সমাজটাকে কোন পথে নিয়ে যাচ্ছ?”
“কেন? আমি তো ঘুষ খাচ্ছি না, বা চাকরি চুরি করছি না। তাহলে লজ্জা হবে কেন?”
“এইটুকু বুঝবার মতন অবস্থায় থাকলে, প্রীতি তোমার সাথে সরাসরি কথা বলত।”
“কাকু আমার ভালো লাগছে না। এই ব্যাপারে আলোচনা করতে চাইছি না।”
“করতে হবে। ব্যাটাছেলে হয়ে কোনও বিকৃত মানসিকতাকে সমর্থন করব না। পুরুষ মানুষ না তুমি! এই সব নোংরামি বরদাস্ত করা হবে না। পরবর্তী প্রজন্ম বখে যাবে।”
“আমার পার্সোনাল ব্যাপার।”
“তাই? প্রীতি যখন আমাকে বলে দিয়েছে তোমাকে শুধরাতে, আমি ঠিক শুধরে দেব। এটা আর ব্যক্তিগত ব্যাপার নেই।

অগ্নি তাকিয়ে আছে, শরীর জ্বলে যাচ্ছে, দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে, এতক্ষণে মনে হচ্ছে সে পুরুষ নয়, পুরুষের দেহ-কারাগারে বন্দী এক নারী, শোষিত, অবহেলিত জনপদে উদ্ভাসিত উদ্ভাবিত হাজার হাজার বছরের নিপীড়িত ও পীড়িত এবং প্রেরিত, অবলোকিত প্লাবিত যে ইতিহাস, যেখানে পুরুষ বধ্যভূমিতে হত্যা করে নারীর স্বাধীনতা, পুরুষ বুঝিয়ে দেয় সীমারেখা পেরিয়ে গেলেই স্বেচ্ছাচারিতার অপবাদ নিয়ে আজীবন অভিশপ্ত নির্বাসিত করে দেওয়া হয়।
অগ্নি বলল, চোখের চাহনি খুব শক্ত, কন্ঠ দ্রুত ও দৃঢ়, “আমার জীবন আমি বুঝে নেব। মেহেবুব আমার ভালবাসা। বাবাকে গিয়ে বলে দেবেন, ঘরের ব্যাপার ঘরে রাখলেই ভাল করতেন উনি।

অগ্নিভ আর  মেহেবুবের সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে। বাইশ বছরের অগ্নিভ আর তিরিশ বছরের মেহেবুব, কলকাতার রাস্তায়, সল্টলেকের বড় বড় গাছের ছায়ায়, হাতে হাত ধরে – পরিবেশ ভবন, করুণাময়ী ক্যাব নিয়ে ঘুরেছে। এক বছর ঠোঁটে ঠোঁট, হাতে হাত, চোখের পাতায় সাথী চোখ – বৃষ্টি, নিরুত্তাপ, কখনও উত্তাপ, আবার ভালবাসার জলতরঙ্গ বেজেছে – এই সম্পর্ক প্রাপ্তির নিকটে গিয়েও সমাপ্তি পেল।
সম্পর্ক হঠাৎ ভেঙে যায় না। ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের পিছনে একাধিক কারণ আছে, একাধিক কারণের ফিরিস্তি লিখে লাভ নেই, বিকেলের নিজস্ব আলো যখন ফুরিয়ে যায়, মন খারাপের বিকেল হয়ে ওঠে, মন খারাপ হয়, ভাল হয়, কিন্তু মন নিয়ে হিসেব চাইতে নেই, লাভ নেই, লোকসান নেই, তাই এই চাওয়ার অস্তিত্ব নেই।
ওদের সম্পর্ক ভেঙে গেল।
দুইজন মিলে এক জীবন একসাথে কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি।

যেদিন মেহেবুব চলে গেল, অগ্নিভ খুব কেঁদেছিল। এক জন্মে ও এই জন্মে অগ্নির মুক্তি হয়নি। কীসের মুক্তি? নারীদেহের স্বীকৃতি, আজন্ম আশ্বাস। মেহেবুব অনেক বুঝিয়েছে। অগ্নিভ ফিরিয়েছে সেই সব কথা, সেই সব যন্ত্রণা, আর নিজেকে। মেহেবুব নিজের প্রেমিকার শরীর দেখতে চেয়েছে, পৃথিবীতে একমাত্র মানুষ মেহেবুব, বুঝতে পারত অগ্নিভ মুক্তি চায়, এই জন্মেই জন্মান্তরের মুক্তি সে দাবী করে। পুরুষ দেহে, সত্তায় নারী। তাহলে কেনই বা এই পালিয়ে বেড়ানো! নিজেকে মেনে নেওয়া শক্ত, কিন্তু মেনে নেওয়া যায়, নিতে হয়, এই সুযোগ সকলের জীবনে আসে না।
সেইদিন দু’জনে শিলংয়ের একটা হোটেলে ছিল। অনেক রাত অবধি, নরম মোমের মতন বিছানায় জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে দুই পুরুষের নগ্নতা! তাও ফিরে যেতে হয়েছে! সম্পর্ক ভেঙে যায়। অনেক বুঝিয়েছিল মেহেবুব, ঝগড়া, অভিমান হয়ে ঢেউ হয়ে কেঁদেছে অগ্নিভ। আয়না ভাঙে, জুড়ে দাও – আয়নায় তবুও ভেঙে যাওয়া, ভাঙনের ক্ষত দাগ রয়ে যাবে।

(২)

রাত, এখন মাঝরাত, এখন দোকানের ভিতর অগ্নিভ একা। অতীতের সাথে সেও জেগে রয়েছে, অতীত থেকে গিয়েছে, একটা জন্মে পূর্বজন্মের আঁচড় রয়ে যায়! ক্ষত আর বিক্ষত। অক্ষতও ক্ষতবিক্ষত হয়ে ওঠে স্বপ্নে। অগ্নিভ অতীত থেকে ফিরেছে। সামনে কাচের টেবিলের উপর মোবাইল ফোন রাখা আছে। শুনতে পেল আওয়াজ।
চলভাষ স্ক্রিনে ভেসে ওঠে মেসেজ। অগ্নিভ পাঁচ বছর আগে ফিরে গিয়েছিল, অন্ধকার স্বপ্ন-ভাঙা রাত থেকে ফিরেছে। ডান হাতে মোবাইলে মেসেজ দেখল। সত্তর বছর বয়সী একটি লোক নিজের নগ্ন ছবি পাঠিয়েছে। দেখেই গা ঘিন ঘিন করছে। ছিঃ, এই লোকটাই আট বছর আগে, রাতে পাড়ার মোড়ে অগ্নিভকে অনেক কিছু বলেছিল।
বাবা মারা গিয়েছে, বেঁচে থাকলে সলিল কাকুর বিকৃত চেতনার পরিচয় পেয়েও হয়তো নিস্পৃহ রইতেন। নিয়তির মুচকি হাসি হেসে, অগ্নিভ মনে মনে বলল, “তুমি যেতে পার কিন্তু যাবে? কোথায় যাবে? সলিল কাকুর মতন মানুষ সমাজের ভিতর রয়েছে, এক জন্ম থেকে আরেক জন্ম, জন্ম থেকে জন্মের অন্তর, জন্মান্তর হয়। সেই জন্মান্তর থেকে মুক্তি নেই সহজে!

মেহেবুব সেই শিলং-রাতে, অগ্নিভকে বলেছিল, পরিবারের সম্মান, বাবাকে আঘাতের ভয় থেকেও অনেক দামী জন্মান্তরের সুখ। সেই রাতে মেহেবুবকে ফিরিয়ে দিয়েছিল অগ্নিভ, আজও ওরা পৃথিবীর দুই প্রান্তে, কলকাতা আর উগান্ডা।

আবার মেসেজ টোন বেজে উঠল।
অগ্নিভ উঠে দাঁড়িয়ে, ফোনের মেসেজ পড়ল। সলিল কাকু, নিজের খালি গা আর জাঙ্গিয়া পরা ফটো পাঠিয়েছে, লিখেছে – “প্লিজ একসেপ্ট মি।” একরাত শুতে চায়।

অগ্নিভ সামনে আয়নার সামনে গিয়ে সালোয়ার কামিজ খুলে ফেলল। বুকের উপর খুলে ও ঝুলে থাকা দুটো স্তনে হাত রেখে বলল – সুখহীন জন্মান্তর।
অপারেশনের পর, অগ্নিভ পুরুষ থেকে নারী হয়েছে, জন্ম থেকে ঘটেছে জন্মান্তর, সেখানেও ভাসছে জন্মান্তরের অভিশাপ!
অগ্নিভ মোবাইলে সলিল কাকুর মেসেজ পড়ল –  “তুমি খুব সেক্সী, অগ্নিভি। আই লভ ইউ।”

অগ্নিভি আয়নায় নিজেকে দেখছে, দুটো চোখে জন্মান্তরের যন্ত্রণা, কাঁদছে, দুটো হাতের তালু দিয়ে চোখের জল মুছে দিয়ে প্রশ্ন করল –অগ্নিভ না অগ্নিভি, নাকি জন্মান্তরের প্রেত, অশরীরী তুমি, সত্যি করে উত্তর দাও জন্মান্তরের মুক্তির স্বাদ কেমন?


লেখক পরিচিতি : পিনাকী চক্রবর্তী
জন্ম কলকাতায় নব্বইয়ের দশকে। লেখালেখি খুব ছোটবেলা থেকেই। সব ধরণের লেখা লিখতে পছন্দ করেন। পেশাদার লেখক। ইতিমধ্যে চিত্রনাট্য লিখেছেন। তাঁর লেখা একাধিক গল্প দৃশ্য মাধ্যমে চিত্রায়ণ করা হয়েছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।