আমার মেটিয়াবুরুজ (পর্ব – ১৮)

লেখক : অনুপম ভট্টাচার্য

মাৎস্যন্যায় :
প্রকৃতির নিয়মানুযায়ী বড়ো মাছ ছোট মাছকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। দুর্বলের ওপরে চলে সবলের শোষণ। যুগে যুগে, কালে কালে এটাই ধ্রুব সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তারই এক উদাহরণ মেটিয়াবুরুজের রেডিমেড গার্মেন্টস শিল্প। আসুন সেই শোষণের ইতিহাস নিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখা যাক।
⚫ মেটিয়াবুরুজের রেডিমেড গার্মেন্টস শিল্পের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাদেরকে নিয়ে একটা যদি একটা পিরামিড বানানো যায়, সেই পিরামিডের শীর্ষে থাকবে হাট মালিক (মূলত বাঙালি মুসলিম কমিউনিটির মানুষ) এবং গদি মালিকেরা (মূলত মাড়োয়ারি কমিউনিটির মানুষ)। সব ধরনের শোষণের শীর্ষে এদের অবস্থান। শোষণের এই পিরামিডের শীর্ষে থাকা এই দুই প্রজাতি তাদের নীচে অবস্থান করা সব মানুষকেই শোষণ করে। ফারাক শুধু শোষণের মাত্রায়।
⚫ পিরামিডের দ্বিতীয় ধাপে অবস্থান করে বড়ো ওস্তাগররা। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার একাধারে হাট মালিক এবং অন্য দিকে বড়ো ওস্তাগরও। মেটিয়াবুরুজের রেডিমেড গার্মেন্টস শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষের মাত্র ৮-১০ শতাংশ বড়ো ওস্তাগর। এদের মধ্যে কেউ কেউ সরাসরি বিদেশে এক্সপোর্ট করবার কাজেও যুক্ত। মেটিয়াবুরুজের রেডিমেড গার্মেন্টস প্রোডাকশনের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এরাই বাজারে নিয়ে আসেন।
যেহেতু মেটিয়াবুরুজের রেডিমেড গার্মেন্টস শিল্প মূলত কপি পেস্ট ডিজাইনের ওপরে নির্ভরশীল, তাই এদের পক্ষেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বাজারে আসা নতুন ডিজাইনার ড্রেসের খোঁজ পাওয়া এবং সেই ড্রেসের কপি পেস্ট করে এই রাজ্যের বাজারে তা প্রথম লঞ্চ করবার সুযোগ সব থেকে বেশি রয়েছে। একই সাথে সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কোন ধরনের পোশাকের কতটা চাহিদা রয়েছে, সেটা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা তৈরি করাও এদের পক্ষেই সুবিধাজনক।
এদের পুঁজির পরিমাণ যেহেতু এদের নীচে থাকা এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত বাকি সমস্ত মানুষের থেকে বহুগুণ বেশি, তাই এরা একাধারে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ব্যবসায়িক, সব ধরনের সুবিধাই ভোগ করে থাকেন। ফলে একদিকে যেমন রাজনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষমতা ব্যবহার করে এরা নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করে রাখতে পারেন, তেমনই এদের নীচে থাকা সমস্ত মানুষের রক্ত চোষায় এরা কমতি করেন না। এদেএর রাজনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষমতার ভয়ে এদের বিরোধিতা করা অনেকটা জলে বাস করে কুমিরের সাথে বিবাদ করবার মতোই। তাই সকলেই সযত্নে সেই চেষ্টা থেকে বিরত থাকেন। ফলে এদের একচেটিয়া সাম্রাজ্য অটুট রাখতে এদের ন্যুনতম চাপও নিতে হয় না।
বড়ো ওস্তাগরদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষমতা এবং প্রভাবের কারণে এরা সব থেকে কম শোষিত হয়। রুক্কা, ব্যাজ বা টাকা চোট যাওয়ার চাপও এদেরই সর্বনিম্ন। কিন্তু শোষণ করবার ক্ষেত্রে এরা প্রায় গদি মালিক এবং হাট মালিকদের সমতুল্য। শোষণের পিরামিডের শীর্ষে থাকা এই তিন শ্রেণীই মেটিয়াবুরুজের রেডিমেড গার্মেন্টস শিল্পের সব থেকে সুবিধাভোগী শ্রেণী।
⚫ পিরামিডের তৃতীয় ধাপে রয়েছে মাঝারি ওস্তাগররা। এদের অবস্থান অনেকটা সওদাগরি অফিসের বড়ো বাবুর মতো, যাকে অফিসারের গালাগাল শুনতে হয়, আবার নিচুতলার কর্মীদের ওপরে সেই ঝাল মেটাতে হয়। মাঝারি ওস্তাগরদের অবস্থাও তথৈবচ। হাট মালিক, গদি মালিক এবং বড়ো ওস্তাগররা এদের দেদার শোষণ করে। আবার এরাও তেমনই এদের নীচে অবস্থান করা মানুষদের শোষণ করতে পিছুপা হয় না। আগেই বলেছি যে মেটিয়াবুরুজের রেডিমেড গার্মেন্টস শিল্পের বেসিক প্যাটার্ন অন্যের ড্রেসের ডিজাইনের কপি পেস্ট করা, তাই মাল বাজারজাত করে সব মাল বিক্রি করে পুঁজি রোল করবার ক্ষেত্রে ঝুঁকির শুরু হয় এদের থেকেই।
⚫ ওস্তাগর শ্রেণীতে সব থেকে দুর্বল অবস্থান ছোট ওস্তাগরদের (পেটি ওস্তাগর)। সামাজিক ভাবে এদের অনেকেই ‘দিন আনি, দিন খাই’ আর্থিক অবস্থানে রয়েছে। এদের মূল লক্ষ্য থাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মাল বেচে টাকা ঘরে তোলা। কারণ পুঁজি আটকে গেলে এদের পক্ষে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। আর এই কপি পেস্ট শিল্পে সব থেকে দুর্বল অবস্থানে থাকার জন্য ম্যাক্সিমাম ঝুঁকি এদেরই বহন করতে হয়।
⚫ পিরামিডের চতুর্থ ধাপে রয়েছেন কাটিং মাস্টার। থান (ওস্তাগরদের পরিভাষায় কাঁচা কাপড়) থেকে রেডিমেড গার্মেন্টস, এই যাত্রার শুরু হয় কাটিং মাস্টারদের হাত ধরে। একজন ভালো কাটিং মাস্টার তাকেই বলে, যার হাতে কাপড়ের ওয়েস্টেজ সব থেকে কম হয়।
বড়ো ওস্তাগরদের নিজস্ব কাটিং মাস্টার আছে। তারা সাপ্তাহিক চুক্তিতে (ফুরন) কাজ করেন। প্রতি বুধবার কাজের পরিমাণের ওপরে নির্ভর করে তাদের পেমেন্ট করা হয়। যেহেতু একজন অভিজ্ঞ কাটিং মাস্টার পাওয়া অপেক্ষাকৃত কঠিন, তাই ধার বাকী কিছু থাকলেও মোটামুটি ঈদের সময়ে পেমেন্ট ক্লিয়ার করতেই হয়। ওস্তাগররা সাধারণত কাটিং মাস্টারদের টাকা কাটতে সক্ষম হয়না। এবং এদের টাকা মারা যাওয়ার পরিমাণও খুব কম।
মাঝারি এবং ছোট ওস্তাগররা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজেরাই কাটিং মাস্টার। যদি কেউ পুজো, দেওয়ালী বা ঈদের সময়ে বাড়তি চাহিদা সামাল দিতে টেম্পোরারি কাটিং মাস্টার নিযুক্ত করেও, তাদের পেমেন্ট সচরাচর আটকে থাকে না।
ঝুঁকির নানান দিক :
🔴 বড়ো ওস্তাগর শ্রেণী ছাড়া মাঝারি এবং ছোট ওস্তাগরদের কারোরই প্রায় সারা দেশ ব্যাপী ফ্যাশন ট্রেন্ড, চাহিদা এবং জোগান সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেই। বাস্তবে থাকাও সম্ভব নয়। তাদের দৌড় ওই বড়ো ওস্তাগর পর্যন্ত। ফলে বাজারে মন্দার প্রথম ধাপ হিসেবে শুরু হয় বেলাগাম উৎপাদন। এর আগের পর্বে ব্যাখ্যা করা হয়েছে কিভাবে একটা ডিজাইনের দাম কমতে কমতে অবশেষে তার ঠাঁই হয় লাট ওয়ালার গদিতে। এক্ষেত্রে সব থেকে বেশি ঝাড় খায় এই দুই শ্রেণীর ব্যবসায়ীরা।
🔴 রুক্কা, ব্যাজ এই ধরনের বাধ্যতামূলক চোটের সাথে আর এক ধরনের চোটের কথা না বললেই নয়। অনেক দোকানে দেখবেন লেখা থাকে ‘আজ নগদ, কাল ধার’। সে বড়ো আদর্শ ব্যবসা, যেখানে ক্রেতা এবং বিক্রেতা ধার বাকি রাখায় বিশ্বাসী নয়। কিন্তু একদিকে বেলাগাম উৎপাদন, আর অন্য দিকে খুব তাড়াতাড়ি মাল বেচে পুঁজি রোল করবার তাগিদ, এই দুইয়ের চাপে মাঝারি এবং ছোট ওস্তাগররা বহু ক্ষেত্রেই বাধ্য হয় ক্রেতাকে ধার দিতে। সেখান থেকেই শুরু হয় আর এক ঠকানোর খেলা। বহু ক্ষেত্রেই ধারে মাল কিনে ডুব দেয় খরিদ্দার। ধার হয়ে যায় তামাদি। যেহেতু ক্রেতা এবং বিক্রেতার মধ্যে কোনও লিখিত চুক্তিপত্র থাকে না, তাই আইন আদালতের দরজা খটখট করেও লাভ নেই। স্রেফ ক্রেতার যদি সুবুদ্ধির উদয় হয়, অথবা বিক্রেতা তাকে নিজের এলাকায় বাগে পায়, তবে যদি বাকি থাকা টাকার খানিকটা উদ্ধার হতে পারে। পুরোটাই অনিশ্চিত। আর ধার দিয়ে নিজের ব্যবসা ডোবানোর অনেক উদাহরণ রয়েছে মেটিয়াবুরুজে।
আউটসোর্সিং :
কাটিং মাস্টারের থেকে রেডিমেড গার্মেন্টস তৈরি হওয়ার বাকি সমস্ত পর্যায়ের পুরোটাই হয় আউট সোর্স করে। এরা সকলেই ফুরন বা চুক্তি ভিত্তিক কাজ করেন। এবং সেই চুক্তিও পুরোপুরি মৌখিক। ফলে সব থেকে বিপন্ন অংশ এরাই।
♦ কাপড় মাপ মতো কাটার পরে আসে সেলাইয়ের কাজ। কাপড় সেলাই করবার জন্য যাদের কাছে যায়, তাদের অধিকাংশ মানুষের বাস নন্দীগ্রাম, ডায়মন্ড হারবার এবং বারাসাত। এই ক্ষেত্রেও পুঁজির জোর যার যেমন, তার ওপরে নির্ভর করে কেউ নিজেই সেলাই করেন। আবার কেউ কেউ এক্সট্রা দরজীও কাজে নেন। সবটাই হয় কাজের পরিমাণের উপর নির্ভর করে।
ছোট ওস্তাগররা নিজেদের কারখানাতেই এক্সট্রা দর্জি রেখে কাজ করে। পুরো কাজই হয় ফুরন সিস্টেমে৷ যত ডজন মাল সারা সপ্তাহে করতে পারবে, তত ডজনের মজুরি পাবে। বাজার খারাপ থাকলে, ওস্তাগরের কাজ বন্ধ হলে এরা বেকার। মালের রেট ডিজাইন হিসেবে, সাইজ হিসাবে নির্ধারন হয়। দর্জিরা সারা সপ্তাহ কাজ করে ২৫০০- ৩০০০ টাকার কাজ করে। থাকাটা ওস্তাগর এর কারখানায় হলেও খাওয়া নিজের খরচে। কিছু কিছু ওস্তাগর খাবার দিলেও “খোরাকি”র দরুন টাকা কাটে। বাকি ক্যান্টিন, হোটেলে খাওয়া দাওয়া।
মাঝারি এবং বড় ওস্তাগরা নিজেদের কারখানায় দর্জি রাখলেও হিউজ প্রোডাকশনের জন্য নির্ভর করে পেটি ওস্তাগার এবং ডায়মন্ড হারবার, নন্দীগ্রাম, বারাসাতের কারখানার উপর। এছাড়া মহেশতলা, বিড়লাপুর, ফলতা,লক্ষীকান্তপুর,কাকদ্বীপ,জয়নগর,ক্যানিং,বসিরহাট এলাকাতেও এই কাজের প্রচুর আউটসোর্সিং হয়।
এই সব জায়গায় দর্জিরা কেউ দশটা বারোটা সেলাই মেশিন কিনে ছোট মাঝারি কারখানা করে রেখেছে। এরা ওস্তাগরদের কাটিং হওয়া মাল, সুতো, আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্র নিয়ে গিয়ে ওই দশ পনেরো জনকে দিয়ে করায়৷ ওস্তাগরের থেকে যদি কোনো মালের সেলাই এর রেট ১৫০ টাকা পায়, সেটা ওই ১০-১২ জন যারা কাজ করছে ওর কারখানায় তাদের ১০০ টাকা দেওয়া হয়। (বোঝানোর জন্য একটা অ্যামাউন্ট দিলাম)
এদের সাথে মৌখিক চুক্তিতে কাজ দেয় ওস্তাগররা। বিভিন্ন ওস্তাগরের বিভিন্ন পলিসি থাকে। কেউ বলে যা কাজ হবে, তার হাফ প্রতি সপ্তাহে পাবে। যে টাকা বাকি পড়তে থাকবে, সেটা সিজনের শেষে একবারে পাবে এরকম বিভিন্ন চুক্তি থাকে।
পেটি ওস্তাগার কোনো একটা বা দুটো বা একাধিক ডিজাইন এদের দেয়। শর্ত থাকে নির্দিষ্ট ডিজাইনের মাল নির্দিষ্ট দামের মধ্যে করে দিতে হবে। এরা কাপড় কিনে, কাটিং করিয়ে, সেলাই, প্যাকিং সব কিছু করে ওস্তাগরের কাছে জমা করে। ওস্তাগর নিজের লভ্যাংশ থেকে পেটি ওস্তাগার দের দেয়না। তাই পেটি ওস্তাগারকে যে রেটে মাল রেডি করতে বলা হয় সেই রেটে মাল বানাতে গিয়ে সবাই কে কিছু কিছু কম রেট দিতে হয়। সারা বছর কাজ পাবে এই রেটে পোষালে করো না হলে অন্য জন আছে।
কাজ করেই পেমেন্ট খুব কম ক্ষেত্রেই হাতে হাতে পাওয় যায়। হাটের দিন পার হবার পরে টাকা দেওয়া হয়৷ যে দিন পেমেন্ট দেওয়া হয়, সেটাকে “হপ্তার” দিন বলে।

আগের ও পরের পর্বের লিঙ্ক<< আমার মেটিয়াবুরুজ (পর্ব – ১৭)

লেখক পরিচিতি : অনুপম ভট্টাচার্য
এমন একজন, যে এখনো নিজের পরিচিতির খোঁজে রয়েছে। আশা করি জীবনের দৌড়ে ফিনিশিং পয়েন্ট আসার আগে তার অনুসন্ধান শেষ হবে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা আহ্বান - বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন