লেখক : ড: অভীক সিংহ
“ধুর বাঁ*, এটা চা হয়েছে ? শালা আমি সকালে মুতলেও এর থেকে ভাল স্বাদ হয় ।” আমি চায়ের কাপটার দিকে তাকিয়ে মৃদুগলায় বলে উঠলাম ।
“ছি ছি ছি, কি ভাষা”, আমার পাশ থেকে সহ-অধ্যাপক ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন, “তুমি না দেশের ভবিষ্যৎ তৈরী করছ । তোমার মুখে কি এই ভাষা মানায় ?”
“আরে ছাড়ুন তো”, আমি একটু ক্ষেপেই বলে উঠলাম, “সক্কাল সক্কাল চায়ের এইরকম থোবড়া দেখলে মেজাজ আর ভাষা – দুটোরই একশো আট হয়ে যায় । বা*র চা বানিয়েছে ল্যা** আমার ।” এই বলতে বলতে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে লাউঞ্জের বাইরে গিয়ে বসলাম । আমার পাশে সহ-অধ্যাপক ভদ্রলোকও এসে বসলেন । আলতো গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “কি ব্যাপার ? সক্কাল সক্কাল এইরকম মেজাজ বিগড়ে কেন ?”
আমি চায়ের কাপটা রেখে একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম, “আর বলবেন না । পরীক্ষার খাতাগুলো চেক করছি, শালারা খাতায় একেবারে হেগেমুতে এক করে রেখে দিয়েছে । এরা নাকি দেশের ভবিষ্যৎ । গাণ*র দল যত্তসব ।”
ভদ্রলোক হো-হো করে হেসে উঠে বললেন, “ওহ এই ব্যাপার । সে তো আমারও একই অবস্থা । তা ভায়া, দেশের শিক্ষাব্যবস্থাটাই তো মায়ের ভোগে চলে যাচ্ছে । এদেরই বা দোষ দিই কি করে বল তো ।”
আমি মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললাম, “তা খুব একটা ভুল বলেননি । কিন্তু পুরো ট্রাইমেস্টার পড়ানোর পরে খাতায় এইসব মাল দেখলে মটকা গরম হয়ে যায় ।”
তিনিও সমর্থন করে বললেন, “সেটাও ঠিক । কিন্তু তুমি একটু মাথাটা ঠান্ডা রাখো । বাড়িতে বাচ্চার সামনে যেন আবার এইসব গালাগালি দিয়ে বসো না । তখন কিন্তু হিতে বিপরীত হয়ে যাবে ।”
“আর বিপরীত । এই গত পরশুই ধরুন না, সন্ধ্যেবেলায় নিজের ঘরে বসে বসে বাচ্চার কথায় এমন বিষম খেয়েছি, যে আর বলার নয় ।”
“বলো কি । গল্প আছে নাকি ?”
“নাহলে আর বলছি কি ।” আমি হাতের সিগারেট থেকে ছাইটা আলতো টোকায় ফেলে বললাম ।
ইতিমধ্যে লাউঞ্জের বাইরে বেশ কিছু সহ-অধ্যাপক হাতে চা-কফি নিয়ে এসেছেন । আমার পাশে বসা ভদ্রলোক একটু গলা চড়িয়েই সবাইকে ডাকলেন, “এই এদিকে আসুন সবাই, অভীকের নতুন গল্প আছে ।” গল্পের কথা শুনেই সবাই জটলা করে এসে হাজির হলেন । একজন জিজ্ঞাসা করলেন, “কি অভীক, আবার কিছু কেস খেয়েছ মনে হচ্ছে ?”
আমি সেই চায়ের কাপটা তুলে অনিচ্ছাসত্ত্বেও একটা চুমুক দিয়ে বললাম, “হমম, তা একটু খেয়েছি বটেই ।”
“তাহলে দেরি কিসের, শুরু করো ।”
আমি চায়ে আরেকটা চুমুক দিয়ে সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে শুরু করলাম ।
ইদানিং বাড়িতে বাচ্চাকে ইংরেজি বর্ণমালা শেখাতে শুরু করেছি । ক্রেস থেকেই বলল যে ওকে একটু একটু করে বর্ণমালার সাথে পরিচয় করাতে । কিন্তু সে মক্কেল তো আর এক জায়গায় বসে পড়বে না, তাই তার পিছনে ঘুরে ঘুরে “A to Z” আউড়ে যেতে হয় । তো এইভাবে শুনতে শুনতেই আস্তে আস্তে মক্কেল একটু একটু করে শিখতে শুরু করেছে, বইটাও নিজে নিয়ে বর্ণগুলো দেখে । মাঝে মাঝেই ঘরের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে বর্ণগুলো এলোমেলোভাবে নিজে নিজে বলতে থাকে । তো বিপত্তিটা বাধল যেদিন বর্ণগুলো ঠিকঠাকভাবে বলতে শুরু করল ।
তো সেদিন রোজকার মতই কলেজ থেকে ফিরে গিয়ে নিজের ঘরে বসে কম্পিউটারে ইমেলটা দেখছি, আর একটা দরকারি ইমেলের উত্তর লিখছি । আর আমার খুদে বিচ্ছুটি ঘরের মধ্যে ঘুরঘুর করছেন । আচমকা ছুটে এসে আমার চেয়ারের হাতলটা ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে নিজের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে একরকম উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠলেন, “BC” । শব্দদুটো ওর মুখে শুনে আমার প্রায় ভিরমি খাওয়ার জোগাড় । একলহমায় “BC” শব্দটির বাংলা এবং হিন্দি অর্থগুলো মাথায় ভেসে উঠতেই পেটের মধ্যে গুড়গুড় শুরু হয়ে গেল । মাথার মধ্যে সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মত ভেসে উঠতে লাগল, আমি বিগত দু’-তিন সপ্তাহের মধ্যে ওর সামনে কি কি বলেছি, আর ভেবে চলেছি তার মধ্যে খিস্তি কত শতাংশ হতে পারে । কোনকিছুর উত্তর না পেয়ে ওকে নার্ভাস স্বরে একটা আলতো ধমক দিয়ে বললাম, “এই, এসব কি বলছিস ?” আমার কাঁপাকাঁপা গলায় ধমক শুনে তিনি আরও উৎসাহিত হয়ে চেয়ারের হাতল ধরে ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে দ্বিগুণ জোরে বলে উঠলেন, “BC” । এবারে আমার কপালে বিন্দুবিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে । সবে আড়াই বছর বয়স, এইসব শিখলো কোত্থেকে ? নিশ্চয়ই ক্রেসে অন্য কোন বাচ্চার কাছে । কিন্তু আমি নিজে কি কখনও বাড়িতে ওর সামনে এইসব বলেছি ? হাজার খুঁজেও কিছু উত্তর পাচ্ছি না । ইমেলের উত্তর তখন মাথায় উঠেছে, আর আমার দুশ্চিন্তার পারদটা ক্রমশঃ ঊর্ধ্বগামী হয়ে চলেছে । এখনই “BC”, এরপরে কি হবে ? “KC”…”MC”…ভেবেই গলাটা শুকিয়ে গেল ।
ঠিক এমন সময় ঘরে প্রবেশ করলেন আমার স্ত্রী । মাকে দেখেই আমার খুদে বিচ্ছুটি একছুটে গিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরেই বলে উঠল, “D-E-F” । আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে আছি । ব্যাপারটা পুরোপুরি বোধগম্য হওয়ার আগেই আমার স্ত্রী বলে উঠলেন, “দেখেছো কি সুন্দর বলছে । রান্নাঘরে আমাকে A বলেই পালিয়ে তোমার কাছে চলে এসেছে । আর এখন D-E-F বলছে । মাঝের B-C টা কি তোমায় বলেছে ?”
আমি মনে মনে আমার খুদেটিকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বললাম, “হ্যাঁ, তাই বটে । আমাকে বাংলায় BC বানিয়ে ইংরেজিতে BC বলে গেল ।”
সিগারেটটা শেষ হয়ে গিয়েছিল । ফিল্টারটা ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, “এরপরেও কি বাড়িতে কোন খিস্তি দেওয়ার রিস্ক নেব ভেবেছেন ?”
সবাই মিলে হো-হো করে হেসে উঠলাম ।
লেখক পরিচিতি : ড: অভীক সিংহ
লেখকের জন্ম পশ্চিমবঙ্গে । পেশায় অর্থনীতির অধ্যাপক এবং গবেষক, যুক্ত আছেন গোয়া ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্টের সাথে । তবে ভালবাসাটা আজও লেখালিখি, পেন্সিল স্কেচ, যন্ত্রসংগীত, এবং নিত্যনতুন রান্নাবান্নার সাথেই রয়ে গিয়েছে । তাঁর লেখা প্রথম বই "R.E.CALL: এক Recollian-এর গল্প" প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে । দাদুর হাত ধরে কবিতা দিয়ে লেখালিখির সূত্রপাত হলেও এখন প্রবন্ধ এবং গল্পতেই মনোনিবেশ করেছেন ।