পুজোর চিঠি – নবমী

লেখক – অতনু সাঁপুই

নবমীর চিঠি।।

বিয়াস,
সেই নবমী ছিল আমাদের একসঙ্গে কাটানো শেষ নবমী। একসঙ্গে .. একা একা। সেই নবমী। যার ক’দিন পরেই বিয়ে তোমার। সব ঠিকঠাক। পাড়ার সবাই জানতো, বিয়ে হবে তোমার আমার। যেই জানলো, তুমি হবে অন্য কারও। শুরু হল, অন্যভাবে দেখার। কিছুটা সমবেদনা আর অনেকটা অনুকম্পা নিয়ে। সান্ত্বনার হাত বাড়িয়ে পুজো পুজো ভাবটাই উড়িয়ে দিয়েছিল সারা পাড়া। সেই পাড়া। যেখানে মাঠের পাশের গাছটাতে হেলান দিয়ে অলস দুপুর শুনতো, তোমার আমার ভালবাসার গান। আর পাঁচিল জুড়ে কালচে সবুজ দাগ খুঁজতো, তোমার আমার খুনসুটি। সেই পাড়াটাই বড় অসহ্য হয়ে উঠেছিল সেই পুজোয়। তাই পালিয়েছিলাম চন্দননগরে মাসির বাড়ি। ষষ্ঠী-সপ্তমী-অষ্টমী পেরিয়ে মন আর মানলো না। নবমী সাত সকালে ঘরের ছেলে ঘরে। এর মাঝে অবশ্য বার দশেক ফোন করেছি তোমায়। তবে কথা হয়নি। তোমার গলা শুনেই রেখে দিয়েছি।

ফিরতেই বুড়ো বাবলুরা ছেঁকে ধরল।-“তুই কোথায় ছিলি বল তো? এ বছর পুরো পুজোটাই মাটি। যাকগে, এসে গিয়েছিস। আজ জমে যাবে।” আড়ষ্টভাবটা কাটিয়ে জিগ্যেস করলাম,-“বিয়াস.. বিয়াস কেমন আছে রে? দেখলি ওকে? ইয়ে.. মানে.. ও ভালো আছে তো?”
হা ঈশ্বর! যার কাছ থেকে এক সময় গোটা পাড়া, এমন কি বিয়াসের আত্মীয়-বন্ধুরাও বিয়াসের খবর নিতো। সেই সে এখন বিয়াসের খবর জানতে চাইছে? দুপুরে একবার দেখলাম তোমায়। মন্ডপে। এক ঝলক। এক ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল। পাড়া.. মোড়.. ট্রাম রাস্তা.. আর্চিস গ্যালারি.. কালীমন্দির পেরিয়ে..একছুট.. খুব জোরে.. কেউ.. কেউ যেন না ছুঁতে পারে.. ডাকতে না পারে পিছন থেকে। চিনতে না পারে.. জানতে না চায় কিচ্ছু। বিয়াস, ও ভাবে কেন তাকালে? যেতে যখন হবেই..

পুজোর শেষদিন লুটেপুটে নিতেই হবে। এক ফোঁটাও যেন বাদ না পড়ে। অনেক জোরাজুরিতেও রাজী না হওয়ায় আমাকে ছেড়েই বাবু দা, পাওয়েল, শঙ্কু-রা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল ঠাকুর দেখতে। তোমায় কেউ বলেনি অবশ্য। ধরেই নিয়েছে, গৌরীদান হয়ে গেছে। তুমি আর এ পাড়ার কেউ নও। অথচ এই গেলবারেই আমরা ওদের সঙ্গে.. একসঙ্গে গাড়িতে নবমী নিশি.. কী সব দিন ছিল। এক বছরেই বদলে গেল, হিসেব নিকেশ। বুড়ো আর বাবলু আমার অনেক বলা স্বত্তেও গেল না। নচিকেতা-র কথায় “দাম দিয়ে যন্ত্রণা কিনতে” চাইছি যখন.. পাড়ায় তখন অর্কেস্ট্রা। কোনও এক কণ্ঠীর গলায়-“শিশে কে ঘরো মেঁ দেখো তো.. ” তুমি এলে। দূর থেকে দেখলাম। আমার দেওয়া শাড়িটা পরেছিলে। হয়তো এই শেষবার। কী ভালো যে লাগলো.. আমরা তখন একদম লাইনের শেষের দিকের চেয়ারে। তুমি.. তোমরা বসলে গিয়ে সামনে। মাথার ভিড়ের ফাঁকে বারবার দেখছিলাম তোমায়। জানি, তুমি আর আমার নও। জানি, এই হয়তো শেষবার। তবু…মঞ্চে তখন “চোখের জলের হয় না কোনও রঙ..”। হঠাৎ দেখি, সামনে তুমি।-“তোমার সঙ্গে একটু দরকার ছিল। আসবে?” নিশিতে পেল যেন আমায়। সম্মোহিতের মতো গেলাম তোমার সঙ্গে। মঞ্চের পিছনে স্কুলঘরে। -” কী ব্যাপার তোমার? ছিলে কোথায় এ কটা দিন? একবারও কি বুঝবে না, এ কটাদিনই তো ছিল তোমায় দেখার শেষ সুযোগ। সে সুযোগও দিলে না। এত নিষ্ঠুর তুমি?” তোমার সামনে আমি চিরকালই নির্বাক শ্রোতা। বলে চললে, “আর তো দেখাও হবে না। কোনওদিন ফিরব না পুজোয়। ফিরলেও তুমি জানতে পারবে না। কক্খনও না। ……. ভালোবাসতে শিখিয়েছো আমায়। ভালবেসে পাগল হয়ে যেতে শিখিয়েছো। নিজে যেন ভালোবাসতে ভুলে যেও না। ভুলে যেও না, তোমার বিয়াস পৃথিবীর যে কোণেই থাকুক, তোমারই থাকবে। ..ভালো থেকো। জেনো, তুমি ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকবো।” আলগা করে রাখা আঙুল আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়েছিলাম। আঙুলের ফাঁক গলে সময় হারিয়ে যেতে দেখলাম। মুঠো খুলে পেলাম, স্বপ্নপোড়া ছাই। সেই নবমীর পরে আরও অনেক নবমী পার করে ফেললাম। কোথায় আছো, কেমন আছো, খুঁজতে যাইনি কখনও।

বিয়াস, আজও .. আলগা করে রাখি আঙুল, আঁকড়ে ধরে রাখব বলে..

শুভ নবমী।।


লেখক পরিচিতি – সংবাদমাধ্যমে ১৯ বছর কাটিয়ে ফেলা মামুলি ছাত্র। নিরন্তর পাক খেতে থাকা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলা শহুরে ফকির। ফ্যাতাড়ু না হতে পারার আক্ষেপ নিয়ে যার অহর্নিশ যাপন। রোজ রোজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খুঁজতে চাওয়া বোকাসোকা ছাপোষা.. “যা দেখি, সেটাই সত্যি? নাকি রাষ্ট্র যা দেখাতে চায়, আসলে অভ্যস্থ চোখে আমরা তাইই দেখি? যা সত্য, তা যে সত্য তা বুঝবে কেমনে? “

আগের ও পরের পর্বের লিঙ্ক<< পুজোর চিঠি – অষ্টমীপুজোর চিঠি -দশমী >>

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

রুচিশীল ও বিষয়ভিত্তিক আলোচনার জন্য ক্লিক করুন এখানে

sobbanglay forum