লেখক : মিত্রা হাজরা
জন্ম আর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এ জীবন প্রবাহ চলে । জন্মিলে মরিতে হবে, এটা ধ্রুব সত্য – উপনিষদ মনে করে মাটি, আকাশ, বাতাস, আগুন, আর জল দিয়ে তৈরি এই জগৎ। আমাদের হৃদমাঝারে প্রাণের বাস, এই প্রাণের হাত ধরে বেঁচে থাকা – প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যান বায়ুর কার্যকলাপ চলে জীবনভর। আঁতুড় ঘরে মায়ের গায়ের ওম নিয়ে জন্ম, আর চাঁদ সূর্যের খেলা দেখতে দেখতে অন্তিম সময়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ দিয়ে হয় জীবনের ইতি। এর মাঝে জীবনের আলোছায়া, জোয়ার-ভাটার লীলাখেলা। জন্মমৃত্যুর এই চক্র থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতেই রাজার ছেলে সিদ্ধার্থ পথকে করেছিলেন সম্বল। চৈতন্য মহাপ্রভু, লালন, কবীর – সকল মহাত্মাই যুগে যুগে মানবকে এই চক্র থেকে মুক্তির দিশা দেখিয়েছেন তাঁদের কর্ম ও বাণীর দ্বারা।
“শোন রাজন – নিঃসহায় অবস্থায় বিনাদোষে আমার পুত্রকে যেমন হত্যা করেছো, তুমিও তেমন পুত্রশোকে একদিন প্রাণ দেবে।” এই বলে অন্ধ মুনি পত্নী সহ প্রাণবিসর্জন দিলেন। অন্ধ মুনির একমাত্র সন্তানকে ভুলবশতঃ শিকার মনে করে শব্দভেদী বাণ ছুঁড়ে রাজা দশরথ হত্যা করেছেন । মাথায় অভিশাপ নিয়ে শোকাকুল হয়ে রাজা দশরথ অযোধ্যায় ফিরে এলেন। তাঁর রাজসভায় ঋষি মুনিরা শুনে বললেন, “এ তো শাপে বর হলো মহারাজ,আপনি পিতা হবেন অতি শীঘ্রই।কারণ পুত্র না জন্মালে পুত্রশোক পাবেন কিভাবে?” তখনও পর্যন্ত রাজা অপুত্রকই ছিলেন।
সরযূ নদীর তীরে সুদৃশ্য মহানগরী অযোধ্যা ধনধান্যে পূর্ণ। কথিত আছে স্বয়ং মনু এই নগরী নির্মাণ করেন। ইক্ষ্বাকু বংশের রাজা দশরথ এই নগরীর রাজা। তিনি প্রজাদের অতি প্রিয়,ধর্মপরায়ণ, শাস্ত্রজ্ঞ, নির্লোভ ও সত্যবাদী। তাঁর রাজসভায় আটজন বিশিষ্ট অমাত্য ছিলেন। বশিষ্ঠ, বামদেব নামে দুই ঋত্বিক যাগযজ্ঞ করতেন। ছিলেন সুমন্ত্র নামে পরমহিতকারী মন্ত্রী। নানা তপোনুষ্ঠান করলেও রাজা পুত্রসুখ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। ঋষিরা রাজাকে পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করতে পরামর্শ দিলেন। এও বলে দিলেন, এই যজ্ঞের ঋত্বিক হবেন ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি। ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি তখন রাজা লোমপাদের রাজ্যে অবস্থান করছেন। রাজা দশরথ নিজে চললেন অঙ্গরাজ্যে ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে অযোধ্যায় আনার জন্য ।
একদা অঙ্গরাজ্যে ভয়াবহ খরা হয়েছিল। বৃষ্টিহীন ছিল বেশ কিছুকাল, ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি আসার পর সেখানে বৃষ্টি হয় ও খরা কাটে। লোমপাদের রাজ্যে এসে রাজা বিনীতভাবে রাজসভায় তাঁর যজ্ঞের কথা জানালেন। মুনি ঋষ্যশৃঙ্গ যদি এই যজ্ঞের ঋত্বিক হন, বড় ভাল হয়। মুনি রাজি হলেন সস্ত্রীক এই যজ্ঞে পুরোহিতের কাজ করতে। অযোধ্যা নগরীতে এ সংবাদ যখন এল, সকলে খুশি হলেন।
বসন্তকালে ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি এই যজ্ঞের আয়োজন করতে বললেন, সরযূ নদীর উত্তরতীরে যজ্ঞভূমি নির্মাণ হ’ল। যত ধার্মিক রাজা সেই সময়ের, সকলে নিমন্ত্রিত হলেন। এলেন মিথিলাপতি জনক, এলেন কাশীরাজ, সপুত্র কেকয়রাজ, অঙ্গেশ্বর লোমপাদ, ও আরও অনেক রাজরাজারা। হোতৃগণ মন্ত্রদ্বারা দেবগণকে আহ্বান করে যথাযোগ্য হবির্ভাগ দিলেন। যজ্ঞস্থলে ব্রাহ্মণ, তপস্বী, শ্রমণগণ, সাধারণ প্রজা, দাস – সকলেই সামিল হলেন।
সেই সময় ব্রহ্মার বলে বলীয়ান রাবণ নানাভাবে দেবতাদের পীড়ন করছে। দেবতারা একযোগে ব্রহ্মার কাছে গিয়ে এর বিধান চাইলেন। ব্রহ্মা সকলকে নিয়ে ভগবান বিষ্ণুর কাছে এলেন। শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী বিষ্ণুর কাছে সকলে রাবণবধের উপায় জানতে চাইলেন। বিষ্ণু লোকহিতকামনায় মর্ত্যে অবতীর্ণ হতে মনস্থ করলেন।দেবতারা রাজা দশরথের পুত্রেষ্টি যজ্ঞের কথা জানালেন । বিষ্ণু রাবণবধের জন্য রাজা দশরথের পুত্রত্ব স্বীকার করলেন। যজ্ঞাগ্নি থেকে সর্বসুলক্ষণযুক্ত পুরুষ প্রকট হলেন, হাতে স্বর্ণনির্মিত পাত্রে পরমান্ন। বললেন, “রাজা, এই পরমান্ন তোমার মহিষীদের ভাগ করে দাও। তুমি সন্তান পাবে।” দেবতাদের বিনম্র শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানিয়ে রাজা দশরথ তাঁর প্রথমা পত্নী কৌশল্যাকে অর্ধেক পরমান্ন দিলেন, আর অর্ধেক দিলেন প্রিয় পত্নী কৈকেয়ীকে। কৌশল্যা ও কৈকেয়ী উভয়েই তাঁদের ভাগ থেকে অর্ধেকাংশ রাণী সুমিত্রাকে দিলেন। সুমিত্রা তাঁদের দুজনেরই প্রিয় ছিলেন। কিছু সময় পর তিন রাণীই গর্ভবতী হলেন। এই খবর শুনে রাজা দশরথ যারপরনাই খুশি হলেন। রাজ্যে আনন্দের বান ডাকল।
রাণী কৌশল্যার বৈদ্য এসেছেন কোশল থেকে, সাথে দাসদাসী আত্মীয়পরিজন। কোশলের রাজকন্যা তিনি, কোশলরাজ এক উত্তরাধিকারীর জন্মের গুরুত্ব বোঝেন। পর্যাপ্ত সাবধানতা অবলম্বন করা হয়েছে। মা হওয়ার আনন্দে, বেদনার কষ্টের মধ্যেও কৌশল্যার প্রাণসত্তা প্রদীপ্ত। তাঁর সন্তান রাজ্যের প্রথম উত্তরাধিকারী হবে, সে সকল সৌভাগ্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করবে – এই ভেবেই আনন্দে আছেন রাণী কৌশল্যা। মনে মনে ভগবান পরশুরামকে স্মরণ করছেন রাণী। জ্যোতিষীরা গণনা করে বলেছেন, সূর্য মধ্যগগনে যাবার পূর্বে যদি সন্তান জন্মগ্রহণ করে, তবে সে মানবশ্রেষ্ঠ হিসাবে লক্ষ লক্ষ বছর পূজিত হবে।
রাণী কৌশল্যা চৈত্রনবমী তিথিতে পুনর্বসু নক্ষত্রে রামের জন্ম দিলেন। তারপরে কৈকেয়ী পুষ্যা নক্ষত্রে ভরতকে ও সুমিত্রা অশ্লেষা নক্ষত্রে লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্নের জন্ম দিলেন। গন্ধর্বগণ মধুর সংগীত ও অপ্সরাগণ নৃত্য করতে লাগলেন। দেবতারা আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগলেন। অযোধ্যায় উৎসব শুরু হয়ে গেল।
ধাইমা সদ্যোজাত শিশুর পিঠে মৃদু চাপড় দিচ্ছে, রাণী কৌশল্যা বললেন, “আমার সন্তানকে আমার কাছে দাও।” টেনে নিলেন বুকে, মুহূর্তে শিশু কেঁদে উঠল, কৌশল্যা আদর করে ডাকলেন, “রাম!” তিনি ভগবান পরশুরামকে স্মরণ করছিলেন। সূর্য তখন মধ্যগগনে, জোড় করে রাণী স্মরণ করলেন রুদ্রকে, “ভগবান রুদ্র, কৃপা কর আমার রামকে।” খবর পেয়ে রাজগুরু বশিষ্ঠ এলেন, এসেছেন রাজা দশরথ। রাজা সংবাদবাহককে বহুমূল্য হীরের হার গলা থেকে খুলে উপহার দিয়েছেন। মহর্ষি শিশুর মুখের দিকে চেয়ে আশীর্বাদ করে বললেন, “রাম!” তিনি দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছেন, নতুন যুগের সূচনা হচ্ছে। শিশুকে কোলে তুলে নিলেন রাজা দশরথ, উচ্চারণ করলেন, “রাম!” তখনই তাঁর মনে পড়ল অন্ধ মুনির অভিশাপ। রামনাম করেই তাঁর পুত্রশোকে প্রাণ যাবে একদিন। তবে এখন প্রাণ ভরে দেখে নিচ্ছেন নিজের সন্তানকে। এই দেবশিশুর মুখ দর্শন করেই তিনি তৃপ্ত। আর মৃত্যু তো ধ্রুব সত্য, তাকে কি আর অস্বীকার করা যায়? আরও একবার আনন্দে রাজা উচ্চারণ করলেন, “রাম!”
লেখক পরিচিতি : মিত্রা হাজরা
প্রাক্তন শিক্ষিকা ডিএভি পাব্লিক স্কুল চাই বাসা । ঝাড়খণ্ড।