লেখক : অরিন্দম দাস
হারিয়ে ফেলেছি। নিজেকে। আমার মধ্যে একটা আমি ছিলাম কোন এক কালে। হারিয়ে গেছে সে। দশটা ছটার গুতোয়। আসলে দশটা সবাই বলে তাই বললাম। পৃথিবী উল্টে যাক, রাহুল দ্রাবিড় ‘জবানি ফির না আয়ে’ র চটুল ভঙ্গিতে তোয়ালে নিয়ে নেচে দিক, দিদি বিশুদ্ধ হিন্দিতে সাড়ে-সতের পাতার বক্তৃতা নামিয়ে দিক মায় ফিলিপ ঘোষ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন উচ্চারণ করে তাক লাগিয়ে দিক কোন দিকে তাকানোর সময় নেই যতক্ষণ না নটা পনেরর মধ্যে মুখটা এসে বায়োমেট্রিক ফেস ডিটেকশন মেসিনটাকে দেখাই। সে এতেই খুশি। পুং করে একটা শব্দ করে আমারই আগের এক ছবি স্ক্রিনে দেখিয়ে দাঁত কেলিয়ে বলে – ‘এসে গেছো বাবুসোনা, যাও এবার লেগে পরো’।
আমিও সোনা মুখ করে ঢুকে যাই অফিসে। শুরু হয়ে গেল চাক্কি পিসিং এন্ড পিসিং। বাই দা ওয়ে এই চাক্কি পেশাই ব্যপারটা আগে জেলে গেলে বলা হত না? আরও তো অনেক কাজ ছিল। সঞ্জয় দত্ত শুনেছি রান্না করত। ওর বায়োগ্রাফির ফিল্মটা দেখাই হয় নি। শালা কতদিন সিনেমাই দেখিনি। কি বলছিলাম যেন? ও চাক্কি পিসিং। হ্যাঁ এটাই ঠিকঠাক শুনতে লাগছে। পুরো গম ভেঙে আটা করে দেয়। জমতে থাকে ধীরে ধীরে, ক্লান্তি, স্ট্রেস, টেনশন। একটা একটা দিন করে আসে রবিবার। ভদ্রলোক এতটাই অভদ্র যে তাঁর আসতে লাগে ছয়দিন আর যেতে লাগে কয়েক ঘন্টা। মায়ের সাথে এক টেবিলে খাওয়া আর ঘুমের কয়েকটা ঘন্টা ব্যতিরেকে বাকি সময়টা বাজার করা, বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার,বাথরুম পরিষ্কার এই সব কেশোৎপাটিত কাজ করেই কেটে যায় যেটাকে ছুটির দিন বলা ততটাই বেঢপ যতটা তুষার কাপুরকে সুপারস্টার বলা। প্রতিদিনের মধ্যে সকালে কোমডে বসে হাতে ফোন নিয়ে আঙুল ঘষাঘষি আর রাত্রে ফিরে শাওয়ারের তলাতে দাঁড়িয়ে ক্লান্তি ধুয়ে ফেলার চেষ্টা এই দুটো সময় পছন্দের। আগে রাত্রে শাওয়ারের নিচে দাঁড়ানোর সময় ব্লুটুথ স্পিকারটা নিয়ে ঢুকতাম বাথরুমে, বাইরে মোবাইলের জিও সাওয়ানে কানেক্ট থাকত ফসিলস এর কোন না কোন অ্যালবাম। এখন তো প্রশ্নই নেই এসবের। অফিস থেকে ফিরছি না শ্মশান থেকে ফিরছি বোঝার জো নেই। মা যে আমায় শুধুমাত্র বাথরুমে ঢুকতে অ্যালাও করে এটাই আমার কপাল। পারলে রাস্তায় বালতি রেখে দেয়।
ও হ্যাঁ, যেটা দিয়ে শুরু করেছিলাম।
হারিয়ে যাওয়া।
মাইরি বলছি। আর ভালো লাগছে না।
যেটার জন্য সারা মাস গাধা সাজছি। ইয়েস। ঠিকই ধরেছেন। সবে ধনে নীলমনি। স্যালারি। সেটাই আমার না। অ্যাকাউন্টে ঢুকতে না ঢুকতেই ছ্যাঁচড়ার মত হাত পেতে আছে ইএমআই, ইসিএস, এই খরচ, সেই খরচ ইত্যাদি, প্রভৃতি। আমার নিজের কপালে? বাবাজী কা ঠুল্লু। আমি আবার পরের দিন জীবনকে ধূর্বাল বলে ঝোলা হাতে বেড়িয়ে যাই ফেস ডিটেকশন মেশিনে মুখ দেখাতে।
এখন ভাবছেন হটাৎ এত ভ্যান্তারা কিসের?
হিংসায় মশাই হিংসায়।
একটা ভিডিও দেখলাম ফেসবুকে। এক রিক্সাওয়ালা। দারুন স্বাধীন। রাস্তার ধার ঘেঁষে দাঁড় করিয়েছেন যানটিকে। মনের আনন্দে গান গেয়ে যাচ্ছেন। কয়েকপেগ বা বোতলখানেক যে পেটে পড়েছে বোঝাই যাচ্ছে। সুখটা দেখছিলাম। হতে পারে ওর বাড়িতে অভাব। সে আমিই কোনসা টাটা বিড়লা।সেই তো আমার ও নিজের জন্যে কিছু কিনতে গেলে ইএমআই চোখ রাঙায়, ই সিএস খিস্তি দেয়। কই আমি তো একদিনও অফিস না গিয়ে ফোনটা সুইচ অফ করে গঙ্গার পাড়ে বসে এরকম দিল খুলে গান গাইতে পারব না। দায়িত্ব মাথার ওপর বসে ঠ্যাং দোলাচ্ছে। তাই হিংসা করা ছাড়া কোন উপায় নেই। আর ভাবা ছাড়াও কোন উপায় নেই যে – শালা একটা দিন অন্তত নিজের মত বাঁঁচবো, নিজের ইচ্ছাগুলোর গুরুত্ব দেবো।
হয়ত ভাবতে ভাবতেই দায়িত্বের নাগপাশ আরও কঠিন হবে। তবুও একদিন শাওয়ারের তলায় ভিজতে ভিজতে শুনবো রুপম ইসলাম গাইছে-
“তবু আশা এক অদ্ভুত অব্যয়
এই আশাটুকু আমাদের সঞ্চয়
আজও আশা আছে বলে হেরে গেছে যত
হেরে যাওয়ার ভয়।”
লেখক পরিচিতি : অরিন্দম দাস
লেখকের জন্ম ১৯৮৯ সালের ৬ই জুন হাওড়ায়। বেসরকারী সংস্থায় কর্মরত। অনিয়মিত লেখক। জীবনের কিছু বিশেষ মুহূর্তকে জীবন্ত রাখতেই মূলত কলম ধরা।