লেখক: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ
- সিনেমার নাম: উমা
- পরিচালনা: সৃজিত মুখোপাধ্যায়
- প্রযোজনা: এসভিএফ এন্টারটেনমেন্ট
- অভিনয়: যীশু সেনগুপ্ত, সারা সেনগুপ্ত এবং অন্যান্য সাবলীল শিল্পীরা।
- সময়: ২ ঘণ্টা ২৯ মিনিট
সৃজিত মুখার্জির ছবি উমা আমাকে প্রথমেই মনে করিয়ে দিল নোলান পরিচালিত ইন্টারস্টেলার সিনেমাটি। পাঠক আশ্চর্য হবেন না। আসলে সৃজিতের সিনেমার একটা বিশেষ দিকই হল একটি গল্পে অনেকগুলো গল্প। একটি আবেগে অনেকগুলো আবেগ। উমা প্রধানত মানবিকতার নজির গড়া একটি সত্যি ঘটনার ওপর বানানো একটি সিনেমা। তবে প্রথমেই আমার চোখে যেটা পড়ল সেটা হল বাবা আর সন্তানের নিখাদ যে ভালবাসা। যে ভালোবাসার গল্প শেষ দেখেছিলাম ইন্টারস্টেলার সিনেমাটায়। মাঝে এই নিয়ে অন্য অসাধারণ সিনেমা বেরিয়ে থাকলেও আমার দেখা নেই। আবার অনেকদিন পর বাবা সন্তানের ভালোবাসা নিয়ে দেখতে পেলাম উমা। এই গল্পে শুধুই উমার জন্য তার বাবা হিমাদ্রির ভালবাসা নয়, পাশাপাশি এক হেরে যাওয়া পরিচালকের তার ছেলের জন্য যে ভালবাসা সেটাও উমার গল্প।
এই গল্প ইন্টারস্টেলার এর বাবা মেয়ের সেই ভালোবাসার কথা মনে করায়, যেখানে কুপার স্পেসে যাওয়ার আগে মেয়েকে বলে সে ফিরে আসবে যখন তার বয়স তার মেয়ে মার্ফের বয়সের সাথে সমান হবে। তখন মেয়ে তাকে বলেছিল তার মানে সে আর ফিরে আসবে না। তখন সন্তানের ভালোবাসার কাছে কুপারের সব যুক্তি, সব আবেগ ভেঙে পড়েছিল। এখানেও দেখি বাবাদের চরিত্রের সেই দিক। মেয়ের ইচ্ছেপূরণ করতে গিয়ে একটা শহরের চিরাচরিত নিয়ম ভেঙে ফেলার কথা ভাবতে কোন যুক্তির ধার ধারেনি হিমাদ্রি, নিজের সবকিছু বেচে শুধুই তার মেয়ের ইচ্ছের কথা ভেবেছিল সে। আসলে সব কালের সব দেশের বাবারা এইরকমই হয়। সৃজিত সেটা বুঝেছেন। শুধু বুঝেছেন না সেটা অনুভব করেছেন এবং অনুভব করিয়েছেন আমাদেরও।
গল্পের দ্বিতীয় বিষয় একটি সত্যি ঘটনা যার ওপর বানানো হয়েছে ছবিটা। কানাডার একটি শহর সেন্ট জর্জে একজন মরণাপন্ন শিশু ইভানের জন্য একটি শহর ২০১৫ সালের অক্টোবরেই ক্রিসমাস পালন করে। সারা শহরের মানুষ এক হয়ে একটি ছোট্ট শিশুর ইচ্ছেপুরন করে। এই ঘটনা বাংলায় করতে চাইলে দুর্গাপুজোর চেয়ে আর ভালো বিষয় হতেই পারে না। সেটাই সিনেমার তৃতীয় বিষয়, দুর্গাপুজো এবং বাংলার মানুষ। মার্চমাসে পুজো করতে গেলে বাধা আসে বিভিন্ন। সেই বাধা কাটিয়ে কিভাবে বাবা তার মেয়ে উমার ইচ্ছেপুরন করে, সেটাই সিনেমার গল্প। কিন্তু বাবা তো শুধু তার মেয়ের ইচ্ছের কথা বলেছে। সেই ইচ্ছের আসল রূপকার তো পরিচালক ব্রহ্মানন্দ। কিভাবে সে শহর জুড়ে সেই দুর্গাপুজো তৈরি করে, সেটাই সিনেমার গল্প। কিভাবে বাংলার মানুষ এই অসময়ের উৎসবে সেই একই আবেগ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, একটা বাচ্চার ইচ্ছাপূরণে সামিল হয় সেটাই তো সিনেমার গল্প। এভাবেই একটা গল্পে তৈরি হয়েছে অনেকগুলো গল্প। যখন মহিতোষের চরিত্রে অনিন্দ্য নিজের ভুল বুঝতে পেরে কেঁদে ওঠে, তখন মনে হয় এতাই তো আমার শহর, যেখানে বিপদের সময় সবাই সবার পাশে দাঁড়ায়। সিনেমায় এই যে আশার কথা, সেটাই তো সিনেমার গল্প।
এরপরের গল্প সিনেমার কথা। একটা সিনেমার অনেকটা জুড়েই যে থাকে পরিচালক এবং তার কথা। সৃজিতের সিনেমাগুলোতে বরাবরই সিনেমার কথা ফুটে ওঠে। সে তার প্রথম সিনেমা অটোগ্রাফই হোক, বা হেমলক সোসাইটি, বা চতুষ্কোণ। এখানেও গল্পের মধ্যে সিনেমার আবহ, সিনেমার কথা, সিনেমার আক্ষেপ আছে। তাই তো হেরে যাওয়া এক পরিচালক এক মাস্টারপিস করার নেশায় মেতে ওঠে উমার বাবার মতোই, মেতে ওঠে অনেক যুক্তির তোয়াক্কা না করে। অবশেষে যখন বিসর্জন ঘাটে তার দেখা ক্লাইম্যাক্স সে পায় না, তার মধ্যে ফুটে ওঠে সেই অভিব্যক্তি, সেই আক্ষেপ। গোবিন্দ চরিত্রে রুদ্রনীল এর গলায় “আমরা সিনেমা বানাই, সিনেমার মত কিছু বানাই না।” যে আসলে পরিচালক সৃজিতেরই কথা সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। সিনেমার মাধ্যমে এই বাংলাতেই এক অল্টারনেট জগত বানানো দারুন আইডিয়া। সেই চেষ্টাতেই নেমে পড়ে সকল কলাকুশলীরা।
গল্পের আরেকটা মূল বিষয় কিন্তু বাঙালিয়ানা। সৃজিত যে বাঙালিয়ানার কথা বলে চলেছেন সমানে, বলেছিলেন বাইশে শ্রাবণে, বলেছিলেন জাতিস্বরে। যেভাবে বাঙালিরা এখন বাংলা ভুলতে বসেছে, অন্যান্য ভাষার রমরমা বাঙালির ক্লাসরুম থেকে শুরু করে বেডরুমেও, যেখানে এখন বিদেশে গিয়ে বাঁদরনাচের শুটিং হয়, সেখানে সিনেমাতে দেখতে পাবো বিদেশে বসে বাবা ছোট থেকেই মেয়েকে কিভাবে বাংলা শিখিয়ে চলেছে। বাঙালিকে সেটা দেখতে হবে, বুঝতে হবে।যেখানে বাঙালিরাই নিজেদের নিয়ে এখন হীনমন্যতায় ভোগে, সেখান থেকে এই সিনেমা অবশ্যই দর্শনীয়।
এইরকম করে বিষয় গুনতে গেলে অনেকগুলো বিষয় দাঁড় করানো যাবে। সেই সব বিষয় সমানতালে মাথায় রেখে সিনেমাটা এগিয়েছে। আমরা মিশে গেছি সিনেমাটার সাথে। সৃজিতের থেকে অন্য ধারার ছবি এটা। একেবারে পারিবারিক। অনেকবার চোখে হাত দিয়ে হয়েছে সিনেমার মাঝে, অনেকবার।
অভিনয়ে উমার চরিত্রে সারা খুব সাবলীল। কেউ বলবেনা এটা তার প্রথম সিনেমা। যীশু, অনিন্দ্য, শ্রাবন্তী প্রত্যেকেই দারুণ অভিনয় করেছে। তবে আমার বিশেষ করে বাবুল সুপ্রিয়, রুদ্রনীল আর অঞ্জন দত্তের চরিত্র গুলোতে তাদের অভিনয় মন ছুঁয়ে গেছে। বাবুলের মেকআপ আর উচ্চারণ চরিত্রটিকে একবারে বাস্তবে রূপায়িত করেছে।
এবার আসি সিনেমার চিত্রনাট্যে। যেহেতু এখানে কিছু অসংলগ্নতা পেয়েছি, তাই এটা সবার শেষে আলোচনা করছি। সিনেমাটি অবশ্যই আবেগের সিনেমা, কিন্তু শুধু আবেগ দিয়ে সিনেমা হবে না। তাতে যদি চিত্রনাট্য একেবারে নিখুঁত হয়, সেই সিনেমাই তো বেঁচে থাকে চিরকাল। সিনেমাটিতে মনোজ মিত্রের অভিনীত চরিত্রই তো বলেছে, “সবার ওপরে গল্প সত্য…”
তো এবার আসি সেই গল্পের সত্যতা এবং বাস্তবতা নিয়ে।
সিনেমার বিষয় অবশ্যই বাস্তবভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু উমার মুখে একডালিয়া বা দেশপ্রিয় পার্কের পুজো দেখার ইচ্ছে শুনে দু-চার দিনেই সেই ক্লাবগুলোর সাথে কথা বলে তাদের রাজি করিয়ে অত সুন্দর প্রতিমা এবং প্যান্ডেল তৈরি কি বাস্তবেই সম্ভব?
হঠাৎ ব্রহ্মানন্দর স্ত্রী এবং সন্তান কিভাবে বিসর্জনের দিন এক হয়ে গেল, সেটা নিয়ে তাড়াতাড়ি সিনেমা শেষ করার স্বার্থে না কি গল্পের স্বার্থে?
বিসর্জনের দিন সবার মাঝে হঠাৎ দুজন জুনিয়র আর্টিস্টের চুমু খাওয়ার মধ্যে দিয়ে কি প্রমাণ করলেন পরিচালক?
বস্তি মানে সেখানে শুধু পুরুষরাই থাকে না, থাকে মহিলা এবং বাচ্চারাও। তাহলে বস্তি খালি করা গুন্ডা হঠাৎ উমাকে দেখে তার কাজ ছেড়ে দিল কেন? তাছাড়া মহিতোষের থেকে উমার কাহিনী আশা করি শুনেই এসেছিল। তাহলেও কেন? এত আবেগ তো সে গুণ্ডাই বা হতে গেল কেন?
তবে এত গুলো প্রশ্ন আমার কাছে খুব বেশি বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি। কিন্তু প্রশ্ন গুলো রয়ে গেছে। এ সিনেমা যেহেতু আবেগের, আমি আবেগ দিয়ে দেখেছি। ভালো লেগেছে অবশ্যই।
লেখকের কথা: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ
লেখকের জন্ম পশ্চিমবাংলায়। পেশায় একটি বহুজাতিক সংস্থার তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। নেশায় লেখক এবং পরিচালক। বাঙালির জনপ্রিয় ওয়েবসাইট সববাংলায় এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। কবিতা থেকে শুরু করে গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, চিত্রনাট্য সবকিছুই লিখতে ভালবাসেন। লিটিল ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক বিভিন্ন ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখেছেন। স্রোত থেকে প্রকাশিত তাঁর কবিতার সংকলন দৃষ্টি এবং বালিঘড়ি। এছাড়া তথ্যচিত্র, শর্ট ফিল্ম বা অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের ভিডিও পরিচালনা করেন। ধর্ম এবং বিজ্ঞান তাঁর প্রিয় বিষয়। ভ্রমণ তাঁর অন্যতম শখ। অন্যান্য শখের মধ্যে রয়েছে স্কেচ, ফটোগ্রাফি, ছবি ডিজাইন করা।