লেখক : প্রভাস মণ্ডল
(অক্ষয়কুমার দত্তের শিক্ষাদর্শন এবং উনিশ শতক : নির্বাচিত পাঠ্যপুস্তক অবলম্বনে)
এক
১৮২২ সালের কথা। আর্থিক দৈন্যতাবশত, ব্যয়বহনে অক্ষম হয়ে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ বাংলা এবং সংস্কৃত বিভাগ তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেবছর। এই সংবাদে বর্ষীয়ান কেরীসাহেব বিরক্ত হয়ে কলেজ-কর্তৃপক্ষকে যে-চিঠি দিয়েছিলেন, তাতে বলছেন, “Convinced as I am, that the Bengalee language is superior in point of intrinsic merit to every language spoken in India, and in point of real utility yields to none, I can never persuade myself to advise a step which would place it in a degraded point of view in the College.” কেরী বাংলা ছাড়াও সংস্কৃত জানতেন, মারাঠী অভিধান প্রস্তুত করেছিলেন এবং তাঁর শ্রীরামপুর মিশন প্রায় চল্লিশটি ভারতীয় ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করেছিল, ফলে সেসব ভাষার অধিকাংশ সম্পর্কে এবং তাদের প্রভাব বিষয়েও কেরী মোটামুটি ওয়াকিবহাল ছিলেন বলেই ধরে নেওয়া যায়। সুতরাং সমস্ত ভারতবর্ষীয় ভাষার নিরিখে বাংলাভাষাকে যাচাই করাটা নেহাত কেরীর আবেগতাড়িত উচ্চারণ নয়, বরং খুবই সচেতনভাবে চিঠির কথাগুলি লিখিত হয়েছে। ফোর্ট উইলিয়ামের নেপথ্যে ওয়েলেসলির যে স্পষ্ট রাজনৈতিক অভিসন্ধি ছিল, সে-গন্ধ কেরীর উক্ত মন্তব্যের গায়েও সমানভাবে জড়িয়ে আছে বলেই বাংলাভাষাকে ‘superior’ হিসেবে মান্যতা দেওয়ার মধ্যে কোনও ভেজাল নেই। তবে যতই রাজনৈতিক হোক না কেন, একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বাংলাচর্চা বন্ধ করে দেওয়ার বিপক্ষে দাঁড়ানোটুকুই কেবল ঐতিহাসিক কিছু গুরুত্ব দাবি করতে পারে।
রাষ্ট্রীয় শাসন পরিচালনার জন্য যেমন, তেমনই পাশ্চাত্য ঘরানার আত্তিকরণের মাধ্যমে বঙ্গদেশীয় শিক্ষার অগ্রগতির ক্ষেত্রেও বাংলা ভাষার ‘superiority’ সম্বন্ধে অচিরেই নিঃসন্দেহ হয়ে যান এদেশের শিক্ষাচিন্তকের দল। ১৮৪০ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা’র নির্মাণ তেমনই একটা প্রকল্পের বাস্তবায়ন। সেই পাঠশালার একরকম প্রধান দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলেন উনিশ শতকের অন্যতম একজন সুলেখক ও শিক্ষাব্রতী শ্রদ্ধেয় অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০-১৮৮৬)।
উনিশ শতকের প্রথম দশকের কাছাকাছি সময় থেকেই সচেতন বঙ্গবাসী ইংরেজি শিক্ষা আয়ত্ত করবার তাগিদ অনুভব করতে শুরু করে। যুগপ্রয়োজনকে অস্বীকার করা চলে না। রামমোহন রায়ের মতো মানুষেরা তখন চাননি যে সংস্কৃত কলেজের পিছনে সরকারী অর্থ ব্যয় হোক, বরং ইংরেজি বিদ্যার উন্নতিকল্পে সেই টাকার সদ্ব্যবহার চেয়েছিলেন তিনি। এখানে উল্লেখ্য যে, ব্রিটিশ সরকার এদেশে ইংরেজি শিক্ষা প্রচলন বিষয়ে দীর্ঘকাল উদাসীন থেকেছে। উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের তথ্য অনুযায়ী ১৭৮১ থেকে ১৮২৪, এই ঔদাসীন্যের কাল। অন্যদিকে শ্রীরামপুর এবং চুঁচুড়ার পাদ্রীরা এদেশীয় বালকদের পাশ্চাত্য শিক্ষাদানে ব্রতী হয়েছিলেন ঠিকই, তবে ধর্মান্তরকরণের যে অভিপ্রায় নিহিত ছিল সেই কর্মকাণ্ডের পশ্চাতে, বাঙালি অচিরেই তা বুঝতে পারে এবং বিমুখ হয়। কিন্তু ইংরেজি শিক্ষালাভে উৎসাহের কমতি হয়নি। ফলত, সরকারী উদাসীনতার পরেও, এদেশে ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের জন্য বাঙালি দিগগজেরা এবং ডেভিড হেয়ারের মতো কতিপয় বিদেশি মানুষ মিলিত হয়ে ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ পত্তন করলেন। পাশাপাশি পাশ্চাত্য ঘরানায় বাংলা শেখার জন্য বাঙালিরা নিজেদের উদ্যোগেই অনেক স্কুল তৈরি করতে শুরু করেছিলেন তখন। কলকাতা স্কুল সোসাইটি কুড়িটি নতুন বিদ্যালয় স্থাপন করেছিল। এহেন বঙ্গদেশীয় শিক্ষার প্রেক্ষাপটে ইয়ংবেঙ্গলদের অবতরণ একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। মূলত ইয়ংবেঙ্গল সম্প্রদায়ের কৃতবিদ্যরা পশ্চিমী দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদি প্রয়োজনীয় বিদ্যার জন-সম্প্রসারণের জন্য বেশ কয়েকটি বাংলা-ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং বাংলাভাষায় পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রচলনের ওপর জোর দেন। বঙ্কিমচন্দ্র ‘লোকশিক্ষা’য় লিখেছিলেন, “বক্তৃতা সকল ত লোকশিক্ষার দিক্ দিয়াও যায় না; তাহার বহু কারণের মধ্যে একটি প্রধান কারণ এই যে, তাহা কখনও দেশীয় ভাষায় উক্ত হয় না। অতি অল্প লোকে শুনে, অতি অল্প লোকে পড়ে, আর অল্প লোকে বুঝে”। এই প্রবন্ধ প্রকাশ পাচ্ছে ১৮৮৮ সালে। ইয়ংবেঙ্গলরা দুই-তিনের দশকেই বঙ্কিমের মতো করে ভাবতে পেরেছিলেন। মনোতোষ চক্রবর্তী তাঁর গবেষণাগ্রন্থে দেখিয়েছেন, ১৮৩৩-৩৪ সাল থেকে রসিককৃষ্ণ মল্লিক, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল তাঁদের পরিচালিত সাময়িকপত্রের পৃষ্ঠায় আরবী-ফারসি-সংস্কৃতকে উপযুক্ত মাধ্যম হিসেবে মান্যতা দিতে নারাজ হন, বরং মাতৃভাষার পক্ষে বেশ জোরদার ওকালতি করতে থাকেন। হিন্দু কলেজে বাংলা শিক্ষা প্রণালীর অধোগতি নিয়েও নিন্দায় সরব হয়েছিল ইয়ংবেঙ্গল। বাংলা ভাষার উন্নতি বিষয়ে গঠনমূলক চিন্তাসমৃদ্ধ বেশকিছু প্রবন্ধ লেখেন তাঁরা সংবাদপত্রের পাতায়। এসময় ১৮৩৮ সালে সমস্ত সরকারী কাজকর্মে এবং বিচারালয়ে দেশীয় ভাষার প্রচলন হয়েছিল।
এই ঢেউ যখন উঠেছে বঙ্গদেশে, ঠিক সেই তরঙ্গেই গা-ভাসিয়ে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তত্ত্ববোধিনী সভা ১৮৪০ সালে গড়ে তুলেছিল তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা। সেই পাঠশালার ভূগোল ও পদার্থবিদ্যার শিক্ষক ছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত। পাঠশালার কথা বলতে গিয়ে তিনি যখন গ্রাম এবং শহরে শিক্ষার বৈপরীত্যের প্রসঙ্গ টানেন, তখনই বুঝতে পারা যায় কেবল নাগরিক সুবিধাভোগী কতিপয় মানুষের জন্য নয়, জনশিক্ষা অর্থাৎ mass education-ই তাঁদের অভিপ্রেত ছিল। তিনি বলেছিলেন, “…এইক্ষণে আমারদিগের স্ব স্ব সাধ্যানুসারে আপন ভাষায় শিক্ষা প্রদান করা, এবং এদেশীয় যথার্থ ধর্ম্মের উপদেশ প্রদান করা অতি আবশ্যক হইয়াছে নতুবা আর কিয়ৎকাল গৌণে ইংরাজদিগের সহিত আমারদিগের কোনো বিষয়ে জাতীয় প্রভেদ থাকিবেক না—তাঁহারদিগের ভাষাই এদেশের জাতীয় ভাষা হইবেক, এবং তাঁহারদিগের ধর্ম্মই এদেশের জাতীয় ধর্ম্ম হইবেক, সুতরাং ব্যক্ত করিতে হৃদয় বিদীর্ণ হয়, যে হিন্দু নাম ঘুচিয়া আমারদিগের পরের নামে বিখ্যাত হইবার সম্ভাবনা দেখিতেছি।” মন্তব্যটির ভিতরে এক স্বতন্ত্র দেশজ ভাব উঁকি দিচ্ছে দেখা যাবে। এই উচ্চারণ সময়ের ফসল তো বটেই, সেইসঙ্গে অক্ষয় দত্তের শিক্ষক-মানসেরও প্রতিফলন।
দুই
প্রথমত, ‘আপন ভাষায়’ শিক্ষার প্রসঙ্গে আসা যাক। তত্ত্ববোধিনী সভাই পাঠশালার জন্য পাঠ্যবই প্রস্তুতের কাজ করত। অক্ষয় দত্ত নিজেও এই বিষয়ে উদ্যোগী হয়ে বালকদের উপযোগী ‘চারুপাঠ’ (১ম ভাগ ১৮৫২, ২য় ভাগ ১৮৫৪, ৩য় ভাগ ১৮৫৯), ‘ভূগোল’ (১৮৪১), ‘পদার্থ বিদ্যা’ (১৮৫৬) ইত্যাদি উৎকৃষ্ট সব গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ইংরেজি ভাষার বিভিন্ন বই থেকে নানা উপাদান সংগ্রহ করে দেশজ কাঠামোয়, সুললিত বঙ্গভাষায় এবং অতি সহজেই বালকের বোধগম্য হবে, এমন ভঙ্গীতে রচনা করেছিলেন সেইসব পুস্তিকা। ‘চারুপাঠ’ প্রথম ভাগের ভূমিকায় লিখেছিলেন, “বাঙ্গালা ভাষায় সুপ্রণালী-সিদ্ধ পুস্তক অতি অল্প। এ সময়ে বালকদিগের পাঠোপযোগী দুই একখানি গ্রন্থ রচনা করিতে পারিলে অনেক উপকার দর্শিতে পারে, এই বিবেচনায় চারুপাঠ প্রস্তুত করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি।” এই কথার মধ্যে বাংলা পাঠ্যবইয়ের ইতিহাসের প্রতি ইঙ্গিত স্পষ্ট। বঙ্গভাষায় রচিত পাঠ্যপুস্তক যে-পথ বেয়ে অক্ষয়কুমার পর্যন্ত এসেছিল ফোর্ট উইলিয়াম থেকে তার একরকম সূচনা বলা চলে।
শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসানো বাংলাভাষায় কেরী এবং তাঁর বাঙালি পন্ডিতের দল ইংরেজ সিভিলয়নদের জন্য যেসব পাঠ্যপুস্তক রচনা করেছিলেন, তাতে আদৌ তেমন লাভ হয়নি নবাগত সাহেবদের। কিন্তু যাদের জন্যই হোক, বাংলাভাষায় পাঠ্যবই রচনার প্রাথমিক প্রয়াসের জন্য ফোর্ট উইলিয়াম যুগের বিশেষ একটু গুরুত্ব আছে। কেরী ও তাঁর পন্ডিতদের বাংলা লেখা প্রসঙ্গে শিবনাথ শাস্ত্রীর মন্তব্য এক্ষেত্রে স্মরণীয়। শাস্ত্রীমশাই লিখছেন, “এই সকল গ্রন্থের অধিকাংশের ভাষা পারসী-বহুল ও দুর্ব্বোধ। তখনকার বাঙ্গালা ও বর্ত্তমান বাঙ্গালাতে এত প্রভেদ যে, পাঠ করিলে বিস্মায়াবিষ্ট হইতে হয়।” পরবর্তীতে এইসকল গ্রন্থপ্রণেতার লেখায় সাধুভাষার ব্যবহার-বাহুল্যের কারণে বাংলা ক্রমে আরও জটিলতর রূপ নিয়েছিল। ফলে প্রাথমিক পর্যায়ের ভাষাশিক্ষা এধরণের পাঠ্যবই অবলম্বনে কোন পথে এগোতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে হবে যে, এই গ্রন্থগুলির কোনটাই এদেশীয়দের উদ্দেশ্যে যেমন লিখিত হয়নি, তেমনই, এসব পুস্তিকা ঠিক বালকপাঠ্য নয়।
এরপর বঙ্গদেশ জুড়ে ইংরেজি শিক্ষার রব উঠলে হিন্দু কলেজ এবং কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী নানা স্থানে অনেকগুলি বিদ্যায়তন গড়ে তুলেছিলেন বাঙালিরাই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি হলে পাঠ্যপুস্তকের প্রয়োজন পড়ে। ফলস্বরূপ ১৮১৭ সালেই গড়ে উঠল কলকাতা স্কুলবুক সোসাইটি। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, স্কুলবুক সোসাইটির পাঠ্যপুস্তক প্রকাশের দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল পাদ্রী এবং ইংরেজ কর্মচারীদের ওপর। ফলত ‘তাঁহাদের মনের ভাব, তাঁহাদের উদ্দেশ্য সাধনের পন্থা এই সব লইয়া বাঙালী বালকদের পাঠ্য পুস্তক রচিত হইল’ (উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়)। অক্ষয় দত্ত যখন আশঙ্কা করেন, “খ্রীষ্টিয়ান ধর্ম্মের যে রূপ প্রাদুর্ভাব হইতেছে তাহাতে শঙ্কা হয় কি জানি পরের ধর্ম্ম বা এদেশের জাতীয় ধর্ম্ম হয়”, তখন কি এধরণের পাঠ্যবইগুলির দিকেও ইঙ্গিত করেন তিনি? হবেও-বা। আরবি, ফারসি, ইংরেজি, সংস্কৃতের পাশাপাশি বাংলা ভাষাতেও স্কুলপাঠ্য বই সোসাইটি থেকে প্রকাশ পাচ্ছিল। প্রথমদিকে মে, পিয়ার্সন, হার্লে প্রমুখ ইংরেজ পাদ্রী বাংলা ভাষায় বালকপাঠ্য পুস্তক রচনা শুরু করেন। ১৮২০ সালে স্কুলবুক কর্তৃক প্রকাশিত ‘পত্র কৌমুদী’ বইটিকে উল্টে দেখলে প্রশ্ন জাগে, ঠিক কোন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এমন একটি গ্রন্থ ‘পাঠশালার নিমিত্ত’ ছাপা হল? সে-বইয়ের বাংলাও অপরিপক্কতার জন্য স্বাভাবিকভাবেই বেশ দুরূহ। অক্ষয় দত্ত কি ছাত্রাবস্থায় এসব বই দেখেননি? কিয়ৎকাল পরে সোসাইটির সদস্য রামকমল সেন, রাধাকান্ত দেব-রা ইংরেজি, আরবি ভাষার গল্প বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। রামমোহন রায় একটি ভূগোল গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। বাংলা-ইংরেজি অভিধান তৈরি হতে থাকে। অর্থকরী বিদ্যার দিকেও সোসাইটির সচেতন লক্ষ্য ছিল বলেই স্কুলপাঠ্য হিসেবে খতিয়ান, জমাবন্দি, তলব বাকি ইত্যাদি বৈষয়িক বিদ্যাও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এছাড়া ‘বেঙ্গলী স্পেলিং বুক’, ‘মনোরঞ্জন ইতিহাস’-এর মতো বই প্রকাশ পাচ্ছে তখন। ‘দিগদর্শন’ কাগজটিকেও পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। ১৮৪০ সালে প্রকাশ পেয়েছিল মার্শম্যানের ইতিহাসগ্রন্থ থেকে অনুবাদিত ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’। এই ধরনের উত্তম বালকপাঠ্য সেই সময়ে কমই লিখিত হয়েছে। সোসাইটি থেকে প্রকাশিত প্রাথমিক বাংলাভাষা পরিচয়ের বই সম্পর্কে অক্ষয়চন্দ্র সরকার ‘পিতা-পুত্র’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, “আমরা প্রথমে স্কুলবুক সোসাইটির বর্ণমালা পড়িয়াছিলাম। তাহাতে ছিল ‘জল পড়ে, ছাতা ধর’। মদনমোহনের শিশুশিক্ষা পড়িয়াছিলাম।” এই শেষোক্ত গ্রন্থটি (প্রথম ভাগ ১৮৪৯) অবশ্য অনেক পরের রচনা। ততদিনে অক্ষয় দত্তের অভূতপূর্ব প্রতিভা সুবিদিত কিন্তু ‘চারুপাঠ’ (প্রথম ভাগ ১৮৫২) তখনও লিখিত হয়নি। শিশুশিক্ষার নিমিত্ত সুপাঠ্য গ্রন্থ রচনার কাজ সমাধা হয়েছে বলেই অক্ষয়বাবু হয়ত কিশোর এবং যুবকদের প্রতি অধিক মনোযোগী হয়েছিলেন। তবে কৈশোরকালে উপযুক্ত অভিভাবক ও সঠিক শিক্ষার প্রয়োজন যে সবচেয়ে বেশি এই বোধের প্রখরতাই তাঁকে বালকপাঠ্য রচনায় অনুপ্রাণিত করেছিল বলে মনে হয়। তার সঙ্গেই যুক্ত হয়েছিল বাংলা বালকবোধ্য এবং সুলিখিত পাঠ্যপুস্তকের অপর্যাপ্ততা।
বিদেশীর লেখা বাংলা, এদেশীয়দের নীরস বঙ্গানুবাদ ও তথ্যসমৃদ্ধ, এবং কখনও কিছু জটিল কেজো বাংলায় বালকদের শিক্ষা প্রদান করলে তা যে কখনই চিত্তাকর্ষক বা ফলপ্রসু হবে না অক্ষয় দত্ত তা বুঝেছিলেন। তাছাড়া বানান, বর্ণমালা বা অভিধানের বই যত প্রকাশিত হয়েছিল ইতিপূর্বে, উপযুক্ত বালকপাঠ্য সে-পরিমাণ হয়নি। যখন অক্ষয় দত্ত গ্রন্থপ্রেণতা হিসেবে পরিচিত হয়েছেন, সেসময় স্কুল বুক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত ‘বঙ্গীয় পাঠাবলী’ নামক গ্রন্থ বালকদের পাঠ্যপুস্তক হিসেবে বাজারে চলছিল। সে-বইয়ের প্রতি খন্ডেই খেয়াল করলে দেখা যাবে বিচিত্র বিষয় একত্রে দুমলাটের ভিতর পুরে দেওয়া আছে। স্বর্ণের বিষয় থেকে শুরু করে মুসলমানদের পির, সিন্ধুনদীর বৃত্তান্ত ইত্যাদি বিচিত্র জিনিস তাতে ঠাসা। একটির সঙ্গে আরেকটির বিষয়গত মিল প্রায় নেই বললেই চলে। উল্লেখ্য যে, বইগুলির কোন কোন খন্ড বিভিন্ন সংবাদ ও সাময়িকপত্র কিংবা কোন গ্রন্থে প্রকাশিত লেখার সংকলন মাত্র। ফলত, একটি বইয়ের ভিতরেই নানা ঢঙের বাংলা ভাষা পড়তে হত। বালকদের পক্ষে হয়তো ব্যপারটা ঠিক সুখকর এবং উপকারী ছিল না। অক্ষয়বাবু যখন চারুপাঠ লিখলেন, প্রথম ভাগে দেখা যাবে মূলত পৃথিবীর ভূপ্রকৃতি এবং কিছু প্রাণীজীবন বিষয়ক নানা প্রাথমিক ধ্যান ধারণা দেওয়া রয়েছে একত্রে। আবার দ্বিতীয় ভাগে পৃথিবীর এই বস্তু, প্রাণীজগত ও সৌরজগতের আরও বিস্তৃত পরিচয় এবং এদের পিছনে যে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলি সক্রিয় সেগুলির যথাযথ সহজবোধ্য বিবরণ উপস্থিত করেছিলেন। এভাবেই ধাপে ধাপে প্রায় বৈজ্ঞানিক একটি পদ্ধতিতেই শিক্ষাদান কার্যটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন অক্ষয়কুমার। হরেক কিসিমের পসরা যৌক্তিক পারম্পর্যহীনভাবে এক ডালিতে সাজানো এবং পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক ব্যখার খামতি দেখেই হয়ত তিনি ‘সু-প্রণালী সিদ্ধ’ পুস্তকের অভাব বোধ করেছিলেন। বালকদের সুবিধার জন্য সমস্ত অধ্যায়ের শেষে তুলনামূলক কঠিন শব্দগুলির সরল বাংলা অর্থের তালিকা প্রস্তুত করে দিয়েছিলেন। বঙ্গীয় পাঠাবলী ধরনের পুস্তকে এ-জিনিস দেখা যায় না। আবার ‘ভূগোল’ গ্রন্থের ভূমিকাতে জানাচ্ছেন, “ইংরাজী দুই মাইলে এক ক্রোশ এবং এক গজে দুই হাত, এইরূপ পরিমাণ এতদ্দেশে প্রচলিত আছে ফলতঃ অন্য প্রাচীন প্রকার পরিমাণ সহজে লোকের বোধগম্য হয় না, এইজন্য চলিত প্রথামতে দেশ পর্ব্বত নদী প্রভৃতির পরিমাণ করা গিয়াছে”। বোঝা যায় শিক্ষাবিস্তারের কাজকে সহজ করতে হলে যে সময়োপযোগী পাঠ্যবই রচনার প্রয়োজন, সে বিষয়েও কতখানি সচেতন ছিলেন তিনি। পাশাপাশি বালকপাঠ্য বইয়ের ভাষা নিয়ে ক্রমাগত চিন্তা করে গেছেন। তাঁর সুযোগ্য উত্তরপুরুষ সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন যে, বাংলা ব্যকরণকে কীভাবে ‘সংস্কৃত-নিরপেক্ষ’ করে তুলেছিলেন অক্ষয়কুমার। “সম্বোধন পদে ‘মুনে!’ ‘দেবি!’ প্রভৃতির পরিবর্তে ‘মুনি!’ ‘দেবী!’ লিখিবার রীতি তিনিই প্রবর্ত্তন করেন”, চারুপাঠ তৃতীয় ভাগের একত্রিংশ মুদ্রণের ভূমিকায় লিখেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। ভাষাকে একতাল বোঝার মতো বহন করতে হলে বালকমনে শিক্ষার স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ যে সম্ভব নয়, সেদিন অক্ষয় দত্ত ছাড়া খুব কম মানুষই এত নিবিড়ভাবে তা অনুভব করতে পেরেছিলেন।
পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন অক্ষয়বাবু। যখন ‘পদার্থ বিদ্যা’র মতো বিজ্ঞানগ্রন্থ রচনায় হাত দেন তিনি, স্বাভাবিকভাবেই ইংরেজি এমন অনেক শব্দের সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাঁকে, যেগুলির যথাযথ বাংলা আভিধানিক প্রতিশব্দ নেই। অক্ষয় দত্ত নিজে দায়িত্ব সহকারে বহু বিদেশী বিজ্ঞান-বিষয়ক শব্দের বাংলা পরিভাষা নির্মাণ করেছিলেন এদেশীয় ছাত্রদের সুবিধার্থে। অনেক পরে রাজশেখর বসু তাঁর ‘বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান’ প্রবন্ধে এই কাজের নানা সুবিধা-অসুবিধার কথা আলোচনা করে লিখেছিলেন, “পরিভাষা-রচনা একজনের কাজ নয়, সমবেত ভাবে না করলে নানা ত্রুটি হতে পারে।” কিন্তু এই পর্বতপ্রমাণ কাজের একটি ঐতিহাসিক সূচনার নিতান্ত প্রয়োজন ছিল এবং অক্ষয় দত্তের হাতেই ঘটেছিল তার শুভ মহরৎ। রাজশেখর বলেছিলেন প্রাথমিক বিজ্ঞান বিষয়ে অবগত না হলে কঠিন বৈজ্ঞানিক সন্দর্ভ বুঝতে পারা যাবে না। অক্ষয়কুমারের চিন্তাও সে-পথেই এগিয়েছিল বলে মনে হয়।
অক্ষয় দত্তের বাংলা লেখার লালিত্য এবং সরস মাধুর্য ও পরিমিতিবোধের দিকে ইঙ্গিত করে প্রমথনাথ বিশী লিখেছিলেন, “চারুপাঠে রস আছে, কিন্তু রসিকতা নাই”। প্রথম জীবনে অক্ষয়বাবু কবিতার চর্চা করতেন, ফলে তাঁর রসসমৃদ্ধ মনন নিয়ে সংশয় থাকার কথা নয়।
তিন
ছাত্রাবস্থাতে অক্ষয়কুমারের মধ্যে প্রচলিত হিন্দুধর্মের প্রতি একটা বীতরাগ জন্মেছিল। গৌরমোহন আঢ্যের ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে পড়ার কারণে অল্প বয়স থেকেই ইংরেজি ভাষার ওজনদার সব বইপত্র ছাড়াও উচ্চ গণিতশাস্ত্র, মনোবিজ্ঞান,পদার্থবিদ্যা ইত্যাদি পাশ্চাত্য ঘরানার যৌক্তিক বিদ্যার সংস্পর্শে আসার ফলে সে-বীতরাগ জন্মেছিল বলে মনে হয়। যদিও পরবর্তীকালে যুক্তিবিদ্যাকে ত্যাগ করেননি কখনও, জ্ঞানের অন্যতম হাতিয়ার করেছেন। প্রথাগত প্রার্থনাসর্বস্ব ধর্মকে কখনই প্রশ্রয় দেননি বরং ‘ব্রহ্মজ্ঞান’-সর্বস্ব উচ্চমার্গীয় ব্রাহ্মধর্মই ছিল তা়ঁর আশ্রয়। তবে যখন বলেন ‘যথার্থ ধর্ম্মের উপদেশ প্রদান করা অতি আবশ্যক’, তখন তিনি যে কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের দিকে ইঙ্গিত করেন না ‘ধর্ম্মনীতি’ গ্রন্থটিই তার প্রমাণ। তাতে লিখছেন, “উপচিকীর্ষা, ভক্তি, ন্যায়পরতা এই তিন প্রধান বৃত্তির নাম ধর্ম্মপ্রবৃত্তি”। দেশীয় ভাষায় পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা এবং এই নৈতিক ধর্মসংক্রান্ত উপদেশের আশ্চর্য এক সহাবস্থান অক্ষয় দত্তের শিক্ষাদর্শনের অন্যতম একটি দিক। ‘চারুপাঠ’ গ্রন্থখানিই তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। অর্থাৎ কেবলমাত্র জ্ঞানবৃদ্ধি নয়, সেই সঙ্গে মানসিক উন্নতি হওয়া চাই। নৈতিক শুদ্ধতা গড়ে ওঠা প্রয়োজন। যখন পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের কাজ করেছেন এই দর্শনই তাঁকে চালিত করেছিল। এখানে বলা প্রয়োজন যে, ‘ধর্ম্মনীতি’ (১৮৫৬) বা ‘চারুপাঠ’ প্রকাশের অনেক আগে থেকেই বঙ্গানুবাদে ইংরেজি হিতোপদেশের মতো বইয়ের প্রচলন ছিল, কিন্তু সেসবের ভিতরে স্পষ্টতই খ্রীস্টধর্মের সরব আত্মপ্রচার বিদ্যমান। অক্ষয় দত্তের নীতিশিক্ষা সেই অর্থে কোনও সাকার মূর্তির স্মরণ নিতে বলে না, কোনও আনুষ্ঠানিক ধর্মাভ্যাসে নিজেকে জড়িয়ে রাখার উপদেশ দেয় না, বরং নিখাদ আত্মশুদ্ধি ও আত্মোপলব্ধির পাঠ প্রদান করে। তিনি ‘পরমেশ্বর’, ‘জগদীশ্বর’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেন তাঁর লেখায় কিন্তু নিছক যুক্তিহীনভাবে ভক্তিতে মাথা নত করতে শেখান না, বরং ঈশ্বর-সৃষ্ট নিয়মের কথা বলে তার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি বিশ্লেষণ করে দেখান। পরমেশ্বরকে বিজ্ঞানের সঙ্গে এক পংক্তিতে বসিয়ে দেন অক্ষয়কুমার।
বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানচর্চার লেখালিখির ভিতরে ক্ষণে ক্ষণে নীতিশিক্ষা, উচিত-অনুচিতের উপদেশ দিতে ভোলেন না তিনি। উনিশ শতকের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে, যখন ইংরেজি শেখা নব্যবাবুদের কাছে মদ্যপান হল আধুনিক হবার একমাত্র পন্থা, একাধিক নারীসঙ্গ যখন সামাজিক মর্যাদা লাভের মানদণ্ড, এমতাবস্থায় অক্ষয়বাবু বুঝেছিলেন, “অধিক বয়স্ক ব্যক্তিকে হিতোপদেশ প্রদান করিলে কোন ফল দর্শে না”, বরং বালকদের মধ্যে এই রোগ সঞ্চারিত হওয়াকে প্রতিরোধ করা একান্ত জরুরি। লক্ষ্যণীয় যে, বাহ্যজগত সংক্রান্ত জ্ঞানচর্চার বিবিধ বিষয়ের মাঝখানে ‘তরুণ-বয়স্ক ব্যক্তিদিগের প্রতি উপদেশ’ শীর্ষক একটি লেখা ‘চারুপাঠ’-এর প্রথম দুটি ভাগের মধ্যেই অবিকৃতভাবে বর্তমান। সে-লেখায় নব্যযৌবনের দিকে ইঙ্গিত করে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ভাল-মন্দের ফারাক বুঝিয়ে দিয়েছেন। কোন কাজগুলি করণীয় নয়, একপ্রকার নিষেধের ভঙ্গীতেই সেগুলি লিপিবদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু কেবলমাত্র নৈতিক শুদ্ধতা এবং চারিত্রিক উন্নতির মধ্যেই তাঁর লক্ষ্য সীমাবদ্ধ থাকেনি। স্বদেশের অগ্রগতিতে অর্জিত শিক্ষার যথাযথ প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ছাত্রদের সচেতন করে দেন তিনি। বালকবয়সকে নির্মল এবং উর্বর মৃত্তিকাস্বরূপ জ্ঞান করতেন, বুঝতেন এ-বয়স বিপথগামীতার সম্ভাবনায় ভরপুর। সে-কারণে একতরফা কেবল বালকদের শিক্ষিত করলেই যে কার্যসমাধা হয় না তা উপলব্ধি করেই বলতে পেরেছিলেন, “শিক্ষকেরা অঙ্কুর রোপণ করুন, পিতামাতারা তাহাতে বারি সেচন করিতে যত্নযুক্ত থাকুন।” এই অঙ্কুর অর্থে সদুপদেশ, যার যথাযথ এবং এই সম্মিলিত পরিচর্যায় ফলপ্রদায়ী মহীরুহ হওয়া সম্ভব। শিক্ষণ প্রক্রিয়া বিষয়ে এই সম্পূর্ণতাবোধ অক্ষয় দত্তের শিক্ষাদর্শনকে এক অনন্য উচ্চতা প্রদান করেছিল।
ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ (১ম ভাগ ১৮৭০, ২য় ভাগ ১৮৮৩), ‘বাষ্পীয় রথারোহীদিগের প্রতি উপদেশ’ (১৮৫৫), কিংবা ‘প্রাচীন হিন্দুদিগের সমুদ্রযাত্রা ও বাণিজ্য বিস্তার’ (১৯০১)-এর মতো উচ্চস্তরের কিছু গ্রন্থ প্রণেতা অক্ষয়কুমার দত্তকে স্বয়ং বিদ্যাসাগর মহাশয় ‘one of the very few of the best Bengali writers of the time’ বলে সম্মানিত করেছিলেন। এমনকি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য যখন নর্ম্মাল স্কুল তৈরি হয়, তখন সে-প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব অক্ষয়কুমার ছাড়া আর কারও হাতে তুলে দেওয়া ঠিক মনে করেননি ঈশ্বরচন্দ্র। বিচক্ষণ বিদ্যাসাগর অক্ষয়বাবুর শিক্ষাচিন্তা এবং জ্ঞানচর্চার পরিধি সম্পর্কে অবগত ছিলেন বলেই তাঁর এই নিঃসন্দেহ নির্বাচন।
অক্ষয় দত্ত শিক্ষাক্ষেত্রে আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পুরাতন কাঠামোর উপর নতুন প্রাণ সংস্থাপনের যে প্রয়াস চালিয়েছিলেন, বিদ্যাচর্চার ভবিষ্যৎ-পথ তাতে আলো পেয়েছিল। এ-কাজে তেমন যোগ্য সঙ্গত পাননি বলেই হয়তো নিজেকে ‘চন্দ্রসুধালোভী উদ্বাহু বামন’ বলে মনে হয়েছিল তাঁর। কিন্তু অক্ষয়কুমারের শিক্ষাচিন্তার মূল্য বুঝতে পারা গেছে সময়ান্তরে। যে প্রথম ইট তিনি রেখেছিলেন, তার উপরেই বহুতল ইমারত গড়ে উঠেছে আজ।
বিংশ শতাব্দিতে প্র.না.বি আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, “একালের ছেলেরা অক্ষয় দত্তের নাম ভুলিতে বসিয়াছে, তাহারা পান্থপাদপ ও পুরুভুজের রহস্য জানিতে পারিল না, চারুপাঠ অনেককাল হইল পাঠ্যতালিকা হইতে বর্জিত।” তা সত্ত্বেও বর্তমানে যখন বিভিন্ন শ্রেণীর জন্য বয়সোচিত এবং যুক্তিগ্রাহ্য বিষয়-নির্বাচন করে বৈজ্ঞানিক ও মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতিতে একটি সুসমঞ্জস বালকোপযোগী পাঠ্যবই নির্মিত হতে দেখি, অক্ষয় দত্তের কথা সর্বাগ্রে মনে পড়ে। কেবল স্পষ্টভাষায় নৈতিক উৎকর্ষ সাধনের পাঠ এখন সিলেবাসের বাইরে।
—————————————–
ঋণ :
শ্রী স্বপনকুমার মন্ডল (অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়),
দীপঙ্কর পাড়ুই (লোকসংস্কৃতি গবেষক)
তথ্যসূত্র :
১. দত্ত, অক্ষয়কুমার. চারুপাঠ (প্রথম ভাগ), সংশোধিত সংস্করণ, কলকাতা, প্রবোধচন্দ্র মজুমদার এন্ড ব্রাদার্স, ১৯৩০
২. দত্ত, অক্ষয়কুমার. চারুপাঠ (দ্বিতীয় ভাগ), ত্রিংশতম সংস্করণ, কলকাতা, সংস্কৃত প্রেস ডিপোজিটরি, ১৮৯৬
৩. দত্ত, অক্ষয়কুমার. চারুপাঠ (তৃতীয় ভাগ), একত্রিংশ সংস্করণ, কলকাতা, সংস্কৃত প্রেস ডিপোজিটরি, ১৯১২
৪. দত্ত, অক্ষয়কুমার. ধর্ম্মনীতি (প্রথম ভাগ), একাদশ সংস্করণ, কলকাতা, সংস্কৃত প্রেস ডিপোজিটরি, ১৮৯৫
৫. দত্ত, অক্ষয়কুমার. ভূগোল, তত্ত্ববোধিনী সভা, কলকাতা, ১৮৪১
৬. দত্ত, অক্ষয়কুমার. পদার্থ বিদ্যা, কলকাতা, সংস্কৃত প্রেস, ১৮৫৬
৭. বঙ্গীয় পাঠাবলী (তৃতীয় খন্ড), কলকাতা, কলকাতা স্কুলবুক সোসাইটি, ১৮৫৪
৮. শাস্ত্রী, শিবনাথ. রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, দ্বিতীয় সংস্করণ, কলকাতা, এস. কে. লাহিড়ী এন্ড কোং, ১৯০৯
৯. মুখোপাধ্যায়, উপেন্দ্রনাথ. হিন্দুজাতি ও শিক্ষা (প্রথম খন্ড), কলকাতা, (ফোনিক্স প্রিন্টিং ওয়ার্কস)
১০. সেন, সুকুমার. বাঙ্গালা সাহিত্যে গদ্য, কলকাতা, রঞ্জন প্রকাশালয়, ১৯৩৪
১১. দাস, সজনীকান্ত. বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাস, পরিবর্ধিত সংস্করণ, কলকাতা, মিত্রালয়, ১৯৫৯
১২. বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রজেন্দ্রনাথ. অক্ষয়কুমার দত্ত, কলকাতা, বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ, ১৯৪১
১৩. চক্রবর্তী, মনোতোষ. হিন্দু কলেজ ও উনিশ শতকের বাংলার সমাজ, কলকাতা, সুবর্ণরেখা, ১৯৭৯
১৪. বন্দ্যোপাধ্যায়, অসিতকুমার. উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ ও বাংলা সাহিত্য, কলকাতা, বুকল্যান্ড প্রাইভেট লিমিটেড, ১৯৫৯
১৫. বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রজেন্দ্রনাথ ও সজনীকান্ত দাস, সম্পাদক. বিবিধ প্রবন্ধ (বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ), কলকাতা, বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ, ১৯৫৯
১৬. বিশী, প্রমথনাথ. চিত্র-চরিত্র, হাওড়া, বঙ্গভারতী গ্রন্থালয়, ১৯৪৯
১৭. বসু, রাজশেখর. বিচিন্তা, দ্বিতীয় সংস্করণ, কলকাতা, ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড পাবলিশিং কোং প্রাইভেট লিঃ, ১৯৫৬
১৮. মুখোপাধ্যায়, হরিমোহন, সম্পাদক. বঙ্গভাষার-লেখক (প্রথম ভাগ, পিতা-পুত্র), কলকাতা, বঙ্গবাসী অফিস, ১৯০৪
১৯. মুখোপাধ্যায়, প্রবীর, সম্পাদক. বাঙালির শিক্ষাচিন্তা (প্রথম খন্ড : প্রথম ভাগ), দ্বিতীয় মুদ্রণ, কলকাতা, দীপায়ন, ২০১৩
লেখক পরিচিতি : প্রভাস মণ্ডল
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র। বর্তমানে পুরুলিয়ার সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে গবেষণারত। শখ বই পড়া, সিনেমা দেখা, ছবি তোলা। ভ্রমণের প্রতি অগাধ ভালোবাসা রয়েছে।