বঙ্গদেশের বাবুচরিত, বাবুদের প্রকারভেদ এবং বিখ্যাত লেখকদের কলমে বাবু

লেখক : রানা চক্রবর্তী

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের ভিতর দিয়ে ইংরেজরা বাংলার শাসন ক্ষমতা লাভ করে। ইংরেজরা তাদের নতুন শাসনব্যবস্থা ও ভূমিব্যবস্থা প্রবর্তন করে বাংলার গ্রাম্য সমাজের পুরনো কাঠামোকে ভেঙে ফেলল। ব্রিটিশরা বাংলার ক্ষমতা লাভের পর ক্রমাগত করের চাপে, দুর্ভিক্ষে গ্রামের দরিদ্র মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে গ্রাম ছেড়ে শহর কলকাতায় আসতে শুরু করে। কলকাতা শহর হয়ে উঠল এই সব ছিন্নমূল মানুষের আশ্রয়স্থল। ইংরেজদের সৃষ্টি এইসব নিম্নবর্গের ছিন্নমূল এবং উচ্চবর্গের শোষকরা একসঙ্গে কলকাতা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাস করতে থাকল। ‘মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁর চণ্ডীমঙ্গলে কলকাতার কথা খ্ৰীস্টিয় ষোল শতকেই উল্লেখ করেছিলেন। সে সময়ে কলকাতা ছিল নিতান্ত গ্রাম। কলকাতা নগরী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ইংরেজদের দ্বারা সতের শতকের শেষে। কলকাতার তখন রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল না, কলকাতা ছিল তখন ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির পণ্য আমদানি-রপ্তানির কেন্দ্র। কিন্তু সতের শতকের শেষার্ধে ইংরেজ শাসন স্থাপিত হওয়ায় রাতারাতি কলকাতার গুরুত্ব রাজধানী মুর্শিদাবাদকে ছাড়িয়ে গেল। কলকাতায় নতুন মানুষের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে নানা রঙ্গ জমে উঠেছিল। বিনয় ঘোষ লিখেছিলেন যে, কলকাতা শহরে প্রথমে যে ইংরেজরা এসেছিল, তাদের মধ্যে অধিকাংশ ছিল অস্তগামী মধ্যযুগের উচ্ছিষ্টতুল্য প্রতিনিধি। নতুন শিক্ষা বা নতুন সভ্যতার অগ্রদূত তারা ছিল না। তারা দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হতো, হিন্দুদের পূজা-পার্বণে যোগ দিত হিন্দুদের মতো তুক – তাকে বিশ্বাস করত। তাদের সঙ্গে চুল পরিচর্যাকর, বাজিকর সাহেবরাও এসেছিল।
বাংলার জমিদারদের মতো খানাপিনা ও জীবনযাপন করাটাকেই তখন ইংরেজরা আভিজাত্য মনে করত।
বঙ্গদেশে ইংরেজ শাসন চালু হলে ছিন্নমূল মানুষের পাশাপাশি প্রতাপশালী ‘বাবু’ নামে এক নতুন শ্রেণীর দেখা মেলে। প্রায় দু শ বছর আগে থেকে শিক্ষিত, ধনী পুরুষদের নামের আগে ‘বাবু’ শব্দের ব্যবহার শুরু হয়। অবশ্য তখনও বাবু শব্দের ব্যবহার মোটামুটি ধনী, শিক্ষিতদের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল। ‘বাবু’ পদ পূর্বে নিজে থেকে কারো ব্যবহার করার অধিকার ছিল না। এটা ছিল নবাব প্রদত্ত উপাধি। সম্মানিত ধনাঢ্য ব্যক্তি ভিন্ন নবাবেরা অন্য কাউকে এই উপাধি দিতেন না। ইংরেজ শাসনের পর সকলেই যত্রতত্র ‘বাবু’ হয়ে গেলেন।

“যাঁহার বুদ্ধি বাল্যে পুস্তকমধ্যে, যৌবনে বোতলমধ্যে, বার্ধক্যে গৃহিণীর অঞ্চলে, তিনিই বাবু।
যাঁহার ইস্ট দেবতা ইংরাজ, গুরু ব্রাহ্মধর্ম্মবেত্তা, বেদ দেশী সম্বাদপত্র এবং তীর্থ ন্যাশনাল থিয়েটার, তিনিই বাবু।
যিনি মিশনারির নিকট খ্রীষ্টিয়ান, কেশবচন্দ্রের নিকট ব্রাহ্ম, পিতার নিকট হিন্দু এবং ভিক্ষুক ব্রাহ্মণের নিকট নাস্তিক, তিনিই বাবু।
যিনি নিজ গৃহে জল খান, বন্ধু গৃহে মদ খান, বেশ্যা গৃহে গালি খান এবং মুনিব সাহেবের গৃহে গলাধাক্কা খান, তিনিই বাবু।
যাঁহার স্নানকালে তৈলে ঘৃণা, আহারকালে আপন অঙ্গুলিকে ঘৃণা এবং কথোপকথনকালে মাতৃভাষাকে ঘৃণা, তিনিই বাবু।” – শ্রী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

◆ আজব শহর কলকেতা ~

‘দ্য আর্লি হিস্ট্রি অ্যান্ড গ্রোথ অব ক্যালকাটা’ গ্রন্থের উপসংহারে এসে গ্রন্থকার বিনয়কৃষ্ণ দেব বাহাদুর দীর্ঘশ্বাস ফেলেন – যে কলিকাতার তিনি প্রত্যাশা করেছেন, সেই কলিকাতা সৃষ্টি হয়নি। রামায়ণ ও মহাভারতের নীতি উপদেশ অনুসরণ করেনি কলিকাতার মানুষ।

সুবল চন্দ্র মিত্রের অনুবাদ: “শিল্পবিজ্ঞানের সহায়তায় ও ধনদ্বারা সর্বপ্রকার সুখ ও ভোগবিলাস সংগ্রহ করাই পাশ্চাত্যদিগের চরম লক্ষ্য। প্রাচীন হিন্দুদিগের লক্ষ্যের সহিত কি বৈষম্য! হিন্দু সাংসারিক সুখ-দুঃখে সম্পূর্ণ উদাসীন। কিরূপে আত্মজ্ঞান লাভ করা যায়, কিরূপে পূর্ণতাপ্রাপ্ত হওয়া যায়, কিরূপে পরমব্রহ্মের সহিত যোগ সাধন করা যায়— এসমস্তই তাহার চরম লক্ষ্য। এই প্রাচীন আদর্শ হইতে অধঃপতনের কথা ভাবিতে চিত্ত বিষাদময় হইয়া উঠে। বড়ই দুঃখের বিষয় এই যে, যেরূপ লক্ষণ প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে, তাহাতে স্পষ্ট বুঝা যাইতেছে যে, সমাজের মূলভিত্তি ক্রমশঃ শিথিল হইয়া যাইতেছে।”

বিনয়কৃষ্ণ দেব বাহাদুরের মনঃকষ্টের কারণ, তিনি বাবু অধ্যুষিত কলিকাতাকেই তার সামনে দেখতে পেয়েছেন। কালীপ্রসন্ন সিংহ ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ লিখতে গিয়ে যেভাবে শহরটিকে এঁকেছেন—

“আজব শহর কলকেতা।
বাঁড়ি বাড়ি জুড়ি গাড়ি
মিছে কথার কি কেতা
হেথা ঘুঁটে পুড়ে গোবর হাসে
বলিহারী ঐক্যতা।”

হুতোম প্যাঁচার নকশায় কালীপ্রসন্ন সিংহের দেয়া বাবু পরিচিতি:

“বনেদী বড় মানুষ হতে গেলে বাঙালী সমাজে যে সব ভাষাগুলি আবশ্যক, আমাদের বাবুদের তা সমস্তই সংগ্রহ করা হয়েছে— বাবুদের নিজেদের একটি দল আছে, কতকগুলি ব্রাহ্মণপণ্ডিত, কুলীনের ছেলে বংশজ ক্ষত্রিয়, কায়স্থ, বৈদ্য, তেলী, গন্ধবেসে, কাঁসারী ও ঢাকাই কামার নিতান্ত অনুগত— বাড়ীতে ক্রিয়াকর্ম্ম ফাঁক যায় না, বাৎসরিক কর্ম্মেও দলস্থ ব্রাহ্মণদের বিলক্ষণ প্রাপ্তি আছে। আর ভদ্রাসনে এক বিগ্রহ, শালগ্রামশিলে ও আকবরী মোহর পোরা লক্ষ্মীর খুঁচির নিত্যসেবা হয়ে থাকে।”

উনিশ শতকের শুরু থেকে উদ্ভূত হয় নববাবু শ্রেণী। তাদের নিয়েই ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেন ‘নববাবু বিলাস’ ও ‘নববিবি বিলাস’। নববাবু বিলাসের প্রকাশকাল ১৮২৫।

বঙ্কিমচন্দ্রও তাদের ভালোই চিনেছিলেন:

‘যাঁহার যত্ন কেবল পরিচ্ছদে, তৎপরতা কেবল উমেদারিতে, ভক্তি কেবল গৃহিণী কিংবা উপগৃহিণীতে এবং রাগ কেবল সদগ্রন্থের উপর, নিঃসন্দেহে তিনিই বাবু।’

◆ রাঁড়, ভাঁড়, মিথ্যা কথা তিন লয়ে কলিকাতা ~

১২৭০ বঙ্গাব্দে শীল অ্যান্ড ব্রাদার্সের মুদ্রণযন্ত্রে প্যারিমোহন সেনের লেখা ‘রাঁড়, ভাঁড়, মিথ্যা কথা তিন লয়ে কলিকাতা’ ছাপা হলো। এটি গীতনাটক। শুরুতেই কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ হিতোপদেশ, যা বাবুদের অবশ্যমান্য—

১. পর স্ত্রী পর ধন, সদা করিবে হরণ।
২. মিথ্যা কথা প্রতারণার আশ্রয় নাও।
৩. মিছে কাল কর গত, মদ্যপানে হও রত।
৪. সুখ পাবে বিধিমত, বেশ্যাসক্ত হও।
৫. হাস খেল অনিবার, ত্যাজ পুত্র পরিবার।

এ রচনায় দুটি চরিত্র— একজন লম্পট একজন সাধু। সাধু এ কলিকাতায় কোথায় যাবেন বুঝতে পারছেন না। লম্পট তাকে আশ্বস্ত করে— এতে বোঝার কী আছে, আমার সাথে সোনাগাজী (একালে নাম সোনাগাছি) নামক প্রসিদ্ধ স্থানে চলো।

সাধু জানতে চান সেখানে কোনো দেবালয় কিংবা দুর্লভ দর্শন কিছু রয়েছে কিনা।

অবশ্যই, তার জবাব:

“কি আশ্বর্য সোনাগাজী রমনীয় স্থান।
গেলে পরে সুশীতল হয় মন প্রাণ
আনন্দের সীমা নাই প্রতি ঘরে ঘরে,
সুখ ভয়ে দুঃখ যেতে নাহি পায় ডরে
অধর্ম্মের লজ্জা হয়, ধর্ম্ম ভয় পায়
দেখিবে কেমন স্থান চল না তথায়।”

তারপর দুজনের মধ্যে অনেক কথা। বহু কসরত করে সাধুকে সেখানে নেয়া হলো। সাধু ভেতরে গিয়ে সজ্জিত নারীদের দেখে তাদের মনের ভাব ও তাদের বয়স জানতে আগ্রহী হলেন।

সাধুও বাবুদের মতো আগ্রহ নিয়ে ক্রমেই তাদের নিকটবর্তী হলেন। নারীর সুখস্পর্শে তারও শরীরে জাগরণ ঘটল। অশেষ কামবাসনা নিয়ে সাধু উল্টো বললেন, ‘হে মহাপুরুষ লম্পটবর! তুমিই ধন্য! তুমি বিলক্ষণ সুখে আছ, আমি চিরকালটা ধর্ম্ম-কর্ম্ম করে অসুখে কাটাইলাম, আর আমি সাধুত্ব চাহি না, চল একবার প্রমোদদায়িনী বারবিলাসীগণের সুখদ সহবাস দ্বারা অপবিত্র জীবন সফল করি।’

এ সাধুবর কলিকাতার বাবুদের মতো বেশ্যাসক্ত হয়ে আয়েশে জীবনযাপন করতে লাগলেন। আশ্রমে ফিরে যাওয়ার নামটিও করলেন না।

◆ বাবুদের রবিবার ~

শ্রী শ্যামাচরণ সান্যাল ১২৭০ বঙ্গাব্দে কলিকাতার শীল অ্যান্ড ব্রাদার্স থেকে ‘হদ্দ মজার রবিবার’ প্রকাশ করলেন।

বাবুদের পরম প্রত্যাশার দিন রবিবার। মদ্য পান করার পর শ্যামাচরণের একটি চরিত্র মস্তরামের মনে যখন উল্লাস সঞ্চারিত হলো, পরনের বসন মাথায় বেঁধে নাচতে নাচতে বলতে লাগল:

“হায়রে মজার রবিবার।
ছেড়ে বুড়ো মাগি মদ্দ লুটতে হদ্দ মজার তার মদ্যপানে মত্ত হয়ে, বাবুরা বিবি লয়ে, ক্রমে ক্রমে যাচ্ছেন বোয়ে, বিবর্ণ সুবর্ণাকার।
পরিবারে দিয়ে ফাঁকি, বাস্তুভিটে বাঁধা রাখি।
প্রেমদা প্রেমের পাখি, হচ্ছে যত কুলাঙ্গার।”

বড় বাবু মস্তরামকে বিষ্ণুর মধ্যে গণ্য করলেন, মস্তরাম শুরুতেই তাকে যে গীতটি শুনিয়েছে তা হচ্ছে—

“ধন্য কল্কেতা শহর ধন্য রবিবার
ঘরে ঘরে লুটচে মজা গাইয়ে বাহার
অলিগলি যথা যাই, কত মজা দেখতে পাই,
এমন সহর দু’টি নাই, রসের আধার।
স্থানে স্থানে নৃত্য গান, কিবা সুর কিবা তাল
রাগিণী সখের প্রাণ, বড় চমৎকার।”

মদ যখন মস্তরামকে ভালোই ধরে বসল, সোনাগাছি বেশ্যালয়ে বাবুগমন কাহিনী বলতে থাকল—

“যাহারা প্রসিদ্ধ বাবু সুরসিক জন
রতি মহোৎসবে মাতি ব্যয় করে ধন
মধ্যবিত্ত বাবু যারা সুরসিক অতি
রবিবারে তাহারাই ভুঞ্জে নানা রতি।
আর এমন পরিবেশে মদ-মাংস-গাঁজা-গুলি চলে যত ইচ্ছে তত।”

◆ কলিকাতার সেরা বাবু ~

কোম্পানি আমলে কলিকাতায় অর্থবিত্ত-পতিপ্রত্তিতে খ্যাতিমান বাবু ছিলেন আটজন। ললিতা প্রসাদ দত্ত বর্মা লিখেছেন:

“ঐ বাবুদিগের মধ্যে প্রত্যেকেই অপর বাবু অপেক্ষা আপনাকে অধিকতর অমিতব্যয়ী প্রমাণ করিবার জন্য বড়ই ব্যস্ত থাকিতেন এবং স্বীয় স্বীয় ঐশ্বর্য্যমদে মত্ত হইয়া ধরাকে সরার ন্যায় জ্ঞান করিতেন। ঐ সকল বাবুগণ অজস্র অর্থ ব্যয় করিয়া সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করিতেন। তাহাদিগের ভৃত্যগণ সর্ব্বদাই তাহাদিগকে সপ্তম স্বর্গে তুলিয়া দিয়া নিজ নিজ অভীষ্ট সিদ্ধি করিতে কুণ্ঠিত হইত না; তাহাদিগের টাকা রোদ্রে শুকাইয়া মণকরা আড়াইসের শুখতি বাদ দিতে পরাঙ্মুুখ হইত না এবং বাবুগণ ঐরূপ অসঙ্গত ব্যাপার বুঝিয়া ও জানিয়া হেলায় তাহাদিগকে ঐরূপ অন্যেরা কার্য্যে প্রশ্রয় দিতেন।”

ললিতা প্রসাদ তাদের অপচয় প্রতিযোগিতার বিস্তারিত লিখেছেন। আট বাবুর মধ্যে সবার আগে উচ্চারিত হতো তনু বাবুর নাম। বাবু তো বাবু নয়, তনু বাবু। আট বাবুর তালিকা—

১) তনু বাবু: হাটখোলার মদনমোহন দত্তের পুত্র রামতনু দত্ত।
২) নীলমণি বাবু: চুচূড়ার প্রাণকৃষ্ণ হালদারের ভাই নীলমণি হালদার।
৩) গোকুল বাবু: বাগবাজারের গোকুলচন্দ্র মিত্র।
৪) রাজ বাবু: মহারাজা নবকৃষ্ণ বাহাদুরের পুত্র রাজা রাজকৃষ্ণ।
৫) ছাতু বাবু: জোড়াসাঁকোর শান্তিরাম সিংহের বংশধর ছাতু সিংহ।
৬) দর্প বাবু: পঞ্চানন ঠাকুরের পৌত্র দর্প নারায়ণ ঠাকুর।
৭) সুখময় বাবু: নকু ধরের দৌহিত্র রাজা সুখময়।
৮) মিত্র বাবু: চোরবাগান এলাকার মিত্র বংশের সন্তান।

◆ শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘বাবু’ ~

‘রামতনু লাহিড়ী ও তত্কালীন বঙ্গ সমাজ’— শিবনাথ শাস্ত্রীর লেখা বইটি সে সময়ের সবচেয়ে বেশি উদ্ধৃত ও বিশ্বস্ত দলিল। এ বইয়ে বহুবার ‘বাবু’ প্রসঙ্গ এসেছে। এমন একটি অধ্যায় থেকে উদ্ধৃতি—

“এই সময়ে সহরের সম্পন্ন মধ্যবিত্ত ভদ্র গৃহস্তদিগের গৃহে ‘বাবু’ নামে এক শ্রেণীর মানুষ দেখা দিয়াছিল। তাহারা পারসী ও স্বল্প ইংরাজী শিক্ষার প্রভাবে প্রাচীন ধর্ম্মে আস্থাহীন হইয়া ভোগসুখেই দিন কাটাইত। ইহাদের বহিরাকৃতি কি কিঞ্চিত বর্ণনা করিব? মুখে, ভ্রুপাশে ও নেত্রকোণে নৈশ অত্যাচারের চিহ্নস্বরূপ কালিমা রেখা, শিরে তরঙ্গায়িত বাউরি চুল, দাঁতে মিশি, পরিধানে ফিনফিনে কালাপেড়ে ধুতি, অঙ্গে উত্কৃষ্ট মসলিন বা কেমরিকের বেনিয়ান, গলদেশে উত্তমরূপে চুনট করা উড়ানী ও পায়ে পুরু বগলস সমন্বিত চিনের বাড়ীর জুতা। এই বাবুরা দিনে ঘুমাইয়া, ঘুড়ি উড়াইয়া, বুলবুলির লড়াই দেখিয়া, সেতার এসরাজ বীণ প্রভৃতি বাজাইয়া, কবি, হাপ আকড়াই, পাঁচালি প্রভৃতি শুনিয়া, রাত্রে বারাঙ্গনাদিগের আলয়ে আলয়ে গীতবাদ্য ও আমোদ করিয়া কাল কাটাইত; এবং গড়দহের মেলা ও মহেশের স্নানযাত্রা প্রভৃতির সময়ে কলিকাতা হইতে বারাঙ্গনদিগকে লইয়া দলে দলে নৌকাযোগে আমোদ করিয়া যাইত।”

শিবনাথ শাস্ত্রীর আরেকটি প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি বাবু সংস্কৃতিকে আরো স্পষ্ট করে তোলে—

“তৎকালে বিদেশে পরিবার লইয়া যাইবার প্রথা অপ্রচলিত থাকাতে এবং পরস্ত্রীগমন নিন্দিত বা বিশেষ পাপজনক না থাকাতে প্রায় সকল আমলা, উকীল এবং মোক্তারের এক একটি উপপত্নী আবশ্যক হইত। সুতরাং তাহাদের বাসস্থানের সন্নিহিত স্থানে স্থানে গণিকালয় সংস্থাপিত হইতে লাগিল। পূর্বে গ্রীস দেশে যেমন পণ্ডিতসকলও বেশ্যালয়ে একত্রিত হইয়া সদালাপ করিতেন, সেইরূপ প্রথা এখানেও প্রচলিত হইয়া উঠিল। যাহারা ইন্দ্রিয়াসক্ত নহেন, তাহারাও আমাদের ও পরস্পর সাক্ষাতের নিমিত্ত এই সকল গণিকালয়ে যাইতেন। সন্ধ্যার পর রাত্রি দেড় প্রহর পর্যন্ত বেশ্যালয় লোকে পূর্ণ থাকিত। বিশেষতঃ পর্বোপলক্ষে সেথায় লোকের স্থান হইয়া উঠিত না। লোকে পূজার রাত্রিতে যেমন প্রতিমা দর্শন করিয়া বেড়াইতেন, বিজয়ার রাত্রি তেমনি বেশ্যা দেখিয়া বেড়াইতেন।”

◆ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাবু ~

স্বব্যাখ্যাত বাবুর আংশিক উদ্ধৃতি না দিলে এ উদ্ধৃতিবহুল নিবন্ধটি প্রতিবন্ধী হয়ে পড়বে।

জনমেজয় কহিলেন, ‘হে মহর্ষে! আপনি কহিলেন যে কলিযুগে বাবু নামে এক প্রকার মনুষ্যেরা পৃথিবীতে আবির্ভূত হইবেন। তাহারা কি প্রকার মনুষ্য হইবেন এবং পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া কি কার্য্য করিবেন তাহা শুনিতে বড় কৌতূহল জন্মিতেছে। আপনি অনুগ্রহ করিয়া সবিস্তারে বর্ণন করুন।’

বৈশম্পায়নের জবাব বেশ দীর্ঘ, বাবুর প্রতিটি বৈশিষ্ট্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবু কাটছাঁট করে কেবল ক’টি বৈশিষ্ট্য সংক্ষেপে তুলে ধরছি—

১. বাবুরা চশমা-অলঙ্কৃত, উদরচরিত্র, বহুভাষী, সন্দেশপ্রিয়।
২. বাবুরা চিত্রাসমাবৃত, বেত্রহস্ত, রঞ্জিত কুন্তল।
৩. বাবুরা বাক্যে অজেয়, পরভাষা পারদর্শী, মাতৃভাষা বিরোধী।
৪. পা শুষ্ককাষ্ঠের ন্যায় হলেও পলায়নে সক্ষম, হাত দুর্বল হলেও কলম ধরতে ও বেতন গ্রহণে পটু।
৫. বিনা উদ্দেশ্যে সঞ্চয় করেন, সঞ্চয়ের জন্য উপার্জন করেন। উপার্জনের জন্য বিদ্যা অধ্যয়ন করেন, বিদ্যা অধ্যয়নের জন্য চুরি করেন।
৬. চুরুট ও তামাকের মাধ্যমে তাদের মুখে অগ্নি লেগেই থাকবে।
৭. সূর্য তাদের দেখতে পায় না, তারা দিনে ঘুমান রাতে জাগেন।
৮. কাব্যের কিছুই বোঝেন না, কিন্তু কাব্যপাঠেও সমালোচনায় প্রবৃত্ত।
৯. বাবু উৎসবে দুর্গা পূজা, স্ত্রীর ইচ্ছেতে লক্ষ্মী পূজা, উপপত্নীর ইচ্ছেতে সরস্বতী পূজা এবং পাটার লোভে গঙ্গা পূজা করেন।
১০. যার বাক্য মনের ভেতর এক, বলতে গেলে দশ, লিখতে গেলে শত, কলহে সহস্র, তিনিই বাবু।

এমন আরো কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, স্থানাভাবে উল্লেখ করা গেল না।

◆ ঠাকুরবাড়ির বাবু ~

ঠাকুরবাড়ির সংস্কৃতি নিয়ে মন্তব্য করা ঝুঁকিপূর্ণ, তাতে অনেক সংস্কৃতির মিশেল রয়েছে। বাইজিসঙ্গ যেমন পরম কাম্য ছিল কারোর, যৌন শাসনের মাধ্যমে নিষ্কাম হতেও চেষ্টা করেছেন কেউ কেউ। বাংলা সংস্কৃতির দুই প্রধান পিতৃপুরুষ দ্বারকানাথ ঠাকুর ও রামমোহন রায় স্ত্রী যথেষ্ট যৌবনবতী থাকা অবস্থায় বাইজি সঙ্গসুখ লাভে অনীহ হননি। এটি দোষ বা গুণের কিছু নয়, এটি বাবু সংস্কৃতিরই অংশ ছিল।

বাবু হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পূর্বশর্তই ছিল বাবুগিরি। বাবুগিরি ফলানোর কায়দা লোক দেখানো অমিত ব্যয় ও অমিতাচারও।

ছাতু বাবুদের বাবুগিরির জয়ঢাক যখন চারদিকে বাজছে, দ্বারকানাথ ঠাকুর তো আর বসে থাকতে পারেন না। লবণের এজেন্সি, জমিদারি, ব্যবসা, নীলকুঠি, রেশমকুঠি, ব্যাংক, বীমা, কয়লা খনি ইত্যাদির ব্যবসা, পরে প্রকাশনাও— যে টাকা আসছে তা দিয়ে তাক লাগানো বাবুগিরি করে, বিলেতিদের দেশে খাইয়ে ও পান করিয়ে এবং কালাপানি পার হয়ে বিলেতে গিয়েও তাদের দেদার খাইয়ে ও পান করিয়ে, অমূল্য সব উপহার দিয়ে প্রিন্স উপাধি অর্জন করেছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর।

বাবুরা হয় আগে থেকেই বাবু নতুবা হয়ে ওঠা বাবু। নব্য ধনীর সংখ্যা যখন বাড়তে থাকে, খানদানি বাবুরা বিব্রত বোধ করতে থাকেন। মূল বাবুও বাবু আবার তার একদা গোমস্তা, হালে টাকাওয়ালা ভৃত্যও বাবু। কলিকাতা শহরে ইস্টক নির্মিত বাড়িতে যদি কেউ বসবাস করেন এবং সে বাড়ি যদি দ্বিতল হয়, তিনি অচিরেই বাবু খ্যাতি পেয়ে যান (অবন্তীকুমার সান্যালের ‘বাবু’)।

দ্বারকানাথ ঠাকুর তার লিবারেল দৃষ্টিভঙ্গিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে ঢাকঢোল পিটিয়ে গোমাংস ভক্ষণ করতেন, ফিরিঙ্গি ইয়ার-বক্সিদের নিজ বাড়িতে ডেকে এনে তাদের সঙ্গে মদ্যপান করতেন, তিনি বাইজিসঙ্গ ভালোবাসতেন, তার বাগানবাড়িতে রাতের আসরে বাইজিনৃত্য সেকালের এলিটদের অনেকেই উপভোগ করতেন। ধর্ম ছিল অন্দরমহলে, তা পরম নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতেন দ্বারকানাথের স্ত্রী দিগম্বরী দেবী। উত্তরাধিকারসূত্রে বাবুগিরি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত পৌঁছেছিল। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য বাবু সংস্কৃতিতে আত্মসমর্পণ করেননি। শুরুতে তার নামের আগে কখনো বাবু, কখনো শ্রী বসানো হতো। তার মেজদার ‘নটি বিনোদিনী’তে সমর্পণ কাহিনী কারো অজানা নেই— কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যার প্ররোচনা হয়তো সেখানেই।

দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (রবীন্দ্রনাথ চেয়ে বয়সে ১৯ বছরের বড়, আপন দাদা) ছোট ভাইয়ের প্রথম বিলেত গমন উপলক্ষে লেখেন ‘ইঙ্গবঙ্গের বিলাতযাত্রা’।

“বিলাতে পালাতে ছটফট করে নব্য গৌড়ে
অরণ্যে যে জন্যে গৃহগবিহগপ্রাণ দৌড়ে।
স্বদেশে কাঁদে সে, গুরুজনবশে কিচ্ছু হয় না –
বিনা হ্যাটটা কোটটা ধুতি পিরহনে মান রয় না।”

বাবু রবীন্দ্রনাথ সে রকম বাবু হয়ে উঠতে পারেননি।

◆ সুকুমার রায়ের বাবু ~

বাবুকে খুব ভালো করে চিনেছেন সুকুমার রায় এবং বাবু কেমন তা বেশ রসিয়ে চিনিয়েছেন আমাদের—

“অতি খাসা মিহি সুতি
ফিনফিনে জামা ধুতি
চরণে লপেটা জুতি জরিদার।
এ হাতে সোনার ঘড়ি,
ও হাতে বাঁকানো ছড়ি,
আতরের ছড়াছড়ি চারিধার।
চকচকে চুল ছাঁটা
তায় তোফা টেরিকাটা
সোনার চশমা আঁটা নাসিকায়
ঠোঁট দু’টি এঁকে বেঁকে
ধোঁয়া ছাড়ে থেকে থেকে
হালচাল দেখে দেখে হাসি পায়।”

এ পর্যন্ত বাবুটিকে বেশ স্মার্টই মনে হয়। কিন্তু সুকুমারের মন যে বাবুদরদি নয়, এটাও তো প্রকাশ করা চাই। আর তা করতে গিয়ে ফিটফাট বাবুটিকে ঠেলে দুটো দুর্ঘটনায় ফেললেন— ওপর থেকে একটি মেয়ের ফেলা পানের পিক লাগল তার চাদরে, আর ছ্যাকড়াগাড়ি কাদাজলের ওপর দিয়ে চলার সময় তার জামায় ছিটিয়ে দিল ঘোলা জল।

“ঘোষেদের ছোট মেয়ে
পিক ফেলে পান খেয়ে
নিচু পানে নাহি চায় হায়রে।
সেই পিক থ্যাপ করে
লেগেছে চাদর ভরে
দেখে বাবু কেঁদে মরে যায়রে।
ওদিকে ছ্যাকড়াগাড়ি
ছুটে চলে তাড়াতাড়ি
ছিটকিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি ঘোলাজল
সহসা সে জল লাগে
জামার পিছন বাগে
বাবু করে মহারাগে কোলাহল।”

সুকুমার রায়ের আরেকজন নাগরিক বাবুর কথা স্মরণ অনিবার্য। এ বাবু যথেষ্ট বিদ্বান। সূর্য কেন ওঠে, চাঁদ কেন বাড়ে-কমে আর জোয়ার কেন আসে— এসবের জবাব দিতে ব্যর্থ হওয়ায় বাবু বললেন, মাঝির জীবন চার আনাই মিছে। পাহাড় থেকে কেমন করে নদী নেমে আসে, সাগরের পানি কেন নোনা— এও না জানায় তার জীবন আট আনাই মিছে। আর চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণের কারণ বলতে না পারায় বাবু রায় দিলেন, মাঝির জীবন বারো আনাই মিছে।

“খানিক বাদে ঝড় উঠেছে, ঢেউ উঠেছে ফুলে
বাবু দেখেন, নৌকাখানি ডুবলো বুঝি দুলে!

মাঝিরে কন, “একি আপদ! ওরে ও ভাই মাঝি,
ডুবলো নাকি নৌকা এবার? মরব নাকি আজি?”

মাঝি শুধায়, “সাঁতার জানো?”- মাথা নাড়েন বাবু,

মূর্খ মাঝি বলে, “মশাই এখন কেন কাবু?
বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে,
তোমার দেখি জীবনখানা ষোল আনাই মিছে।”

◆ হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাঙালি বাবু ও বিবির সাজ ~

“বাঁকা টেরি, হাতে ছড়ি, এক মেটে গড়ন
কামিজ আঁটা নধর বাবু, নাগর কোন জন
কেহ বা দোমেটে গাঁদা, কেহ ঘেঁটুরাজ
মাথা ছাঁটা মেইদি কেহ, কেহ সিমুল ভাঁজ
গাড়ী গাড়ী নামে বাবু বণিক, কেরাণী
কাঁড়ি কাঁড়ি ক্যান্ডিডেট, ফ্রেন্ডের কোম্পানি
কেহ চড়ে জুড়ি ফেটিন, কেহ আপিস যানে
কেরাঞ্চি কাহারো ভাগ্যে কারো বা ঠনঠনে।

ব্ল্যাক হ্যাট ফেল্ট টুপি, বোম্বেয়ে লণ্ঠন
লাইন বাঁধা সারি সারি লাইন কেমন
বাঙ্গালী বাবুর সাজ আমার চোখে বালি
নকলে মজবুৎ বঙ্গ আসলে কাঙালী।”

হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ‘সাবাস হুজুক আজব শহরে’ নামের দীর্ঘ কবিতাটিতে স্বজাতিকে অনুকরণপ্রিয় হুজুগে জাতি বলেই বর্ণনা করেছেন। বেঙ্গল কাউন্সিলের ১৮৭৬ সালের চার নম্বর আইন— ক্যালকাটা, মিউনিসিপ্যাল অ্যাক্ট পাস হলে হেমচন্দ্র বাবু সংস্কৃতি ও

বাঙালি মানসিকতা নিয়ে কবিতাটি লেখেন। সেখানে তিনি বিবিদেরও ছাড় দেননি—

“রুজ মাখা মুখখানি, পাখা নিয়ে হাতে
গরবে গজেন্দ্রগতি ঘুরিছেন ছাতে।”

হেমচন্দ্র বাবুদের ধরতে গিয়ে বাংলা গদ্যচর্চার পথিকৃৎ ক্লার্ক মার্শম্যানকেও ছাড় দেননি। তাকে নিয়ে লিখেছেন, ‘বাবাজান বুড়ো শিবের স্তোত্র’—

“ধর্ম্মতলা ধর্ম্মহীন – গোহত্যার ধাম।
‘ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া’ সেরূপ তব নাম
বিশেষ মহিমা আমি কি কহিব আর
ফ্রেন্ড হয়ে ফ্রেন্ডের খেয়েছ তুমি রাম (RUM)।”

◆ বটতলার চটি সাহিত্যে কলিকাতার বাবু সংস্কৃতি ~

কলিকাতার বাবুদের হলিডে সংস্কৃতি বেশ দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। ১৮৬৩ সালে শ্রী চন্দ্রকান্ত শিকদার ৩১৯ নং চিত্পুর রোডের চৈতন্যচন্দ্রোদয় যন্ত্রে মুদ্রণ করেছেন তার ‘কি মজার শনিবার’।

“ধন্য কল্কেতার সহর ধন্য শনিবার।
বোতল ধরে আচ্ছা করে দিচ্ছে ক্যাবাহার
সোনাগাজী উড়ছে ধ্বজা, বড় ধুম পুড়ছে।
গাঁজা মদ খেয়ে করছে মজা, মেছুয়া বাজার
হাড়কাটা হেসে খেলে, গ্ল্যাস ধরে মুখে ঢেলে।
অবশেষে বলছে বুলি, ক্যায়সা মজাদার

প্রথমেতে মদ্যরস, করি আস্বাদন।
প্রেমরসে ভাসে শেষে অসাধ্য বর্ণন।
দুঃখের না আশে লেশ, পুলকিত চিত
সোনায় সোহাগা যেন, হয়েছে মিশ্রিত
মদ্যপানে বাবু বিবি কেহ নন কাবু
বাবু ঢালে বিবি খায়, বিবি ঢালে বাবু

কোথাও বিবিরা সব বাবুদের লয়ে
মাতিয়াছে মদ খেয়ে দিগম্বরী হয়ে
কিছুতেই নাহি ভয়, নাহি পায় লাজ
তাই বলি কি মজার, শনিবার আজ।”

‘কি মজার শনিবার’ প্রকাশিত হওয়ার আগে অজ্ঞাতনামা লেখকের ‘ইয়ং বেঙ্গল ক্ষুদ্র নবাব’ ৯২ আজিরীটোলার হিন্দু প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। এতে তরুণ বাবুরা তাদের প্রবীণ পূর্বসূরিদের মদ ও নারীর উত্তরাধিকার ধরে রাখলেও ন্যাস্টি ভাষা বেঙ্গলিকে কেয়ার না করার সিদ্ধান্ত নেন, আর জানিয়ে দেন বেঙ্গলিতে লেখা বইগুলো সব রাবিশ ও ছাই।

◆ হরিদাস হালদারের বাবু বিশ্লেষণ ~

১৩২৮ বঙ্গাব্দে ১২ নং কালীঘাট লেন কলিকাতা থেকে প্রকাশিত বারো আনা দামের গ্রন্থ (লেখকের ভাষায় সামাজিক ও রাজনৈতিক রঙ্গপুস্তক) ‘বক্কেশ্বরের বেয়াকুবি’-তে গ্রামের বক্কেশর চাকরির জন্য কলিকাতার ধনী বাবুর দ্বারস্থ হয়ে ‘এমবেজলমেন্ট’-এর মতো কঠিন একটি শব্দ উচ্চারণ করতে পারায় বাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি আগে কী (কাজ) করতে?’

বক্কেশ্বর চাষী, কামার, কুমার, ছুতার, ধোপা, নাপিত, কুলি-মজুর সবার কাজই করতে পারে। কিন্তু কী কী কাজ সে জানে না, তার একটি ফর্দ তুলে ধরল:

‘আজ্ঞে এই ভদ্র বাবুলোকদের ফাঁকিদারী কার্য্যগুলি আমার জানা নেই। বাবুরা ওকালতি, ব্যারিস্টারী, হাকিমী, ডাক্তারী, ইঞ্জিনিয়ারী, জমিদারী, তেজারতি প্রভৃতি হরেক রকম কাম করে আর দেশের যত গরীব চাষাভুসা আর খাটিয়ে লোকদের মাথায় হাত বুলিয়ে নিজেরা বড়লোক হন।’

বাবু ব্র্যান্ডির প্রভাবে বক্কেশ্বরের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাকে কেরানির চাকরি দিতে চান। বক্কেশ্বর নিজেকে অনুপযুক্ত মনে করে। অতঃপর একজন বড় উকিল বাবু তাকে ছোট বাবু নিয়োগের নিশ্চয়তা দিয়ে পত্র লিখলেন: ‘বক্কেশ্বর! আমি তোমাকে আমার মামলা জোগাড় করিবার জন্য Catching clerk অর্থাৎ টাউট নিযুক্ত করিতে ইচ্ছা করি। কিছুদিন এই কার্য করিলে তোমার সকল বেয়াকুবি ঘুচিয়া যাইবে। তখন আদালতের মাটিতে যে কত রস আছে তাহা বিলক্ষণ বুঝিতে পারিয়া তাহাতে একেবারে মজিয়া যাইবে।’

◆ গোবিন্দচন্দ্র দাসের বাবু ~

গোবিন্দচন্দ্র দাস স্বদেশের বাবুদের জন্য বড্ড করুণা করেছেন। বাবুদের আস্ফাালন ভুয়া, বাবুদের পায়ের তলায় মাটি নেই, বাবুরা পরজীবী, করুণায় বেঁচে থাকা মানুষ। গোবিন্দ দাস লিখছেন:

“স্বদেশ স্বদেশ কচ্ছ কারে, এদেশ তোমার নয়,
এই যে জাহাজ, এই যে গাড়ি, এই পেলেস— এই যে বাড়ী
এই যে থানা জেহেলখানা— এই বিচারালয়,
লাট বড়লাট তারাই সবে, জজ ম্যাজিস্টর তারাই হবে,
চাবুক খাবার বাবু কেবল তোমরা সমুদয়—
বাবুর্চি, খানসামা, আয়া, মেথর মহাশয়।

যে সব বাবু বিলেত গিয়ে, বাবুনিদের সঙ্গে নিয়ে
প্রসবিয়ে আনছে তাদের শাবক সমুদয়,
‘বৃটিশ বরণ’ বলে দাবী কর্লে নাকি বিলাত পারি?
লজ্জাহীনের গোষ্ঠী তোরা নাইকো লজ্জা ভয়
এই যদি বে ‘বৃটিশ বরণ’ মরণ কারে কয়।”

◆ অমৃতলাল বসুর ‘বাবুবন্দনা’ ~

সরস গানে অমৃতলাল বসু বাবুদের বন্দনা করতে গিয়ে বলেন, তাদের ঘন ঘন বিলাত গমনং-এর কারণে তাদের বাবার গঙ্গাযাত্রা হয় না। হয় গৃহে মরণং। তাদের চলে মুরগী মটনং, মদ্য সদ্য শোধনং।

অমৃতলাল বসু বাবুয়ানা বিবিয়ানার দায় ফেলেছেন ইংরেজি শিক্ষার ওপর:

“একশ বছর সমান টানে
মাতাল ছিলে মদ্য পানে
বিলিতি বোতলে পোরা
গোরার চোলাই করা সে সুরা, নাম তার এডুকেশন
সঙ্গে সঙ্গে ছিল চাট্
পেন্ট কোর্ট টাই শার্ট
উঠিয়ে দিয়ে পূজা-পাঠ
ইংরেজি ঠাট, ইংরেজি নাট, ইংরিজি ফ্যাশন।
কেন তারা ছোটলোকের পাঠ্য রামায়ণ পড়বেন?
সংস্কৃত পড়তেন ম্যাক্সমুলার
নইলে কে এমন ফুল আর
(যখন) ইংরেজ আমাদের রুলার
তখন ভারনাকিউলার তো ভাদ্র-বৌয়ের মতন।”

◆ মুকুন্দ দাসের ‘বাবু’ ~

চারণ কবি মুকুন্দ দাস বাবুদের নিয়ে ভীষণ আক্ষেপ করেছেন:

‘বাবু বুঝবে কি আর ম’লে।’

যে বাবু বাবু হওয়ার আগে সোনার থালে ভাত খেত, এখন ‘স্যাটিসফাইড স্টিলের থালে’। বাবুর চোখে রঙিন চশমা আর নেশার ঘোর। মুকুন্দ আহ্বান জানিয়েছেন:

“ছিল ধান গোলাভরা
ইন্দুরে সব করল সারা
চোখের ঐ চশমাজোড়া দেখনা বাবু খুলে।
কুল নিয়েছে, মান নিয়েছে, ধন নিয়েছে কলে,
ডু ইউ নো ডিপুটি বাবু নাউ হেড ফিরিঙ্গির বুটের তলে।”

এ বি সি ডি বাবু হওয়ার নেশায় ফিরিঙ্গির মুখের ড্যাম ব্লাডি গাল খেয়েও পুলকিত সেকালের বাঙালি। আত্মসম্মান ও বাপ-দাদার সংস্কৃতিহারা এ প্রজন্মকে মুকুন্দ সতর্ক করে দিয়েছেন: ‘কাঁধে তোর সাদা ভূত চেপেছে’, শিগগির নামা, নতুবা দফা রক্ষা করে ছাড়বে।’

একালের কবি দলদাস্যবৃত্তি বেছে নিয়ে কর্তার চৌদ্দ পুরুষের কীর্তন করেন, সেকালের মুকুন্দ দাস ‘বাবু বুঝবে কি আর ম’লে’— এ বাবুনামা লিখে তিন বছর কারাদণ্ড ভোগ করেছেন। মুকুন্দ দাসের গান বাবু সংস্কৃতির সঙ্গে মাঠের ও ঘাটের মানুষদের পরিচয় করিয়েছে, এমনই একটি গানের পুরোটাই উদ্ধৃত হলো:

“বাবুদের পায়ে নমস্কার—
দেখলেম ভাই ঘোর কলিতে এ জগতে
ভাল-মন্দের নাই বিচার
যায় মা উপোসী ভগ্নি দাসী বাবুর বাড়িতে
সেই ছেলে হয় টিকপ্দার বেশ্যা বাড়িতে
বাবু বিদ্যার নাম নব ডঙ্কা –
গুড নাইট গুড মর্নিং স্যার
কলিতে বৌ হয়েছে রঙের বিবি স্বামী মানে না –
শাশুড়ি হন ময়নামাগী স্বামী খানসামা।
তারা ভাশুর-শ্বশুর কেয়ার করে না
বাপকে বলে মাই ডিয়ার
ছোট খাটো চুল ছাঁটা আর সিং তোলা টেরী
যুবক বন্ধুর চোখে চশমা এই দুঃখে মরি।
বাবুরা স্ফুর্তি করে বেড়ান ঘুরে
যেন ময়লা টানা গাড়ির ষাঁড়।

◆ কাজী নজরুল ইসলামের ‘বাঙ্গালী বাবু’ ~

কাজী নজরুল ইসলাম শিবনাথ শাস্ত্রীর আয়েশী, বেশ্যাবিলাসী বাবুদের নয়, বাঙালি কেরানি বাবুদের কথা লিখেছেন:

“নখ-দন্ত-বিহীন চাকুরী অধীন আমরা বাঙ্গালী বাবু
পায়ে গোদ, গায়ে ম্যালেরিয়া,
(বুকে) কাশি লয়ে সদা কাবু
ঢিলেঢালা কাছা কোঁচা সামলায়ে
ভুঁড়ি বয়ে ছুটি নিট পিটে পায়ে
আপিসে আসিয়া কলম পিশিয়া
ঘরে এসে খাই সাবু।”

কেরানি বাবু সপ্তাহে একদিন রোববার ছুটি পান। সপ্তাহের ব্যস্ততা এড়িয়ে সেদিন বাড়িতে থাকেন বলেই রক্ষে, সেজন্য ছেলেপিলে জানতে পারে কোন পুরুষ মানুষটি তাদের বাবা। বাবু সেদিন খুব করে ঘুমান অথবা ঘরে বসে খেলেন ‘গ্রাবু’।

“একজামিনের লাঠি ধরে ধরে
দাঁড়াই আসিয়া আপিসের দোরে
মাইনে যা পাই তাই দিয়ে খাই
কলমী আর আলাবু।

গোলামের কুঁড়ি ফোটার এ বোঝা
নামায়ে কোমরে হ’তে দাও সোজা
বাতে আর হাড়-হাভাতে ধরেছে—
বাপ্পুরে কনে যাবু।”

যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্যের প্যারোডিতে কলমপেষা বাবু এভাবে উঠে এসেছেন:

“কোথায় ডাকে বৌকে ‘মাগী’
কেউ বা রাখে বুকে মাথে!

কোথায় ‘বাবু’ খেটেই কাবু
পিষছে কলম দিনে রাতে!

নারীরা কোথায় ভোগের জিনিস,
‘প্রভুরা’ মজা মারছে রে!

সে আমাদের বাংলা দেশ
আমাদেরি বাংলা রে।”

◆ হারানচন্দ্রের বিবি ~

বাঙালি যুবক বিলেত ঘুরে এসে পুরোদস্তুর সাহেব। তার স্ত্রীকে তো সনাতন ভারতীয় ভার্যা হয়ে থাকলে চলবে না, তাকে বিবি হতে হবে। বাবু জিদ ধরেছেন, স্ত্রী যদি বিবি না হয়, তার মানসম্মান আর থাকছে না। কিন্তু স্ত্রী বিবি হতে রাজি নয়:

“আমি ত হব না বিবি থাকিতে এ প্রাণ
কেমনে হোটেলে যাব
কেমনে টেবিলে খাব?
কেমনে সহিব বল পিঁয়াজের ঘ্রাণ?
হায়, বাবু তুমি বড় কঠিন প্রাণ।”

স্ত্রীর পরনে ঢাকাই শাড়ি। এ শাড়ি পরনে আর যা-ই হোক, বিবি তো হওয়া যাবে না। কিন্তু স্বামীর চাপ— বিবি হতেই হবে। স্ত্রীর জবাব:

“আমি ত হব না বিবি তোমার পীড়নে
আপনি সেজেছ বেশ
পরেছ ফিরিঙ্গি বেশ
ফিরিঙ্গিনি আমি কভু হব না জীবনে,
এমন ঢাকাই শাড়ী ভুলিব কেমনে?”

স্বামীর চাপে মাথা নোয়াতে রাজি নয় এ বাঙালি বধূ। স্বামীর কথায় ঘোমটা খুলে লাজলজ্জা সব ভুলে পরপুরুষের সঙ্গে সে আলাপ করতে মোটেও রাজি নয়। সে কি ব্যঞ্জন রাঁধতে জানে না যে তাকে যবনের রান্না খেতে হবে? বেদ রচনা করতে গিয়ে ব্যাস মুনিকে গরু আর মদ খেতে হয়নি, ঠোঁটে জ্বলেনি চুরুট।

জানকীকে উদ্ধার করতে রামচন্দ্র রাবণ বধ করতে লঙ্কা অবরোধ করেন। তাকে তো সল্ট-বিফ খেতে হয়নি? মাছে-ভাতে যেখানে বাঙালির পেট বেশ ভরে, সেখানে এ নারী কেন ফাউলকারি কিংবা কাটলেট খেতে যাবে?

“সিঁতায় সিন্দুর নাই— অলক্ত চরণে,
টিপশূন্য যে ললাট
দেখিতে গড়ের মাঠ,
রঞ্জে না সুওষ্ঠ দুটি তাম্বুল রঞ্জনে
খট্মট্ করে চলে সোয়ামীর সনে।”

কবি হারানচন্দ্র রাহা এ স্ত্রীকে কখনো বিবি হতে দেবেন না।

না, না, না।

◆ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘বাবু’ ~

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের আমলে এসে ‘বাবু’ আর ‘বাবু’ থাকতে চাননি, হতে চেয়েছেন মিস্টার-সাহেব। ততদিনে তারা নামের রায়কে বদলে করেছে রে, মিত্রকে মিটার।

“আমরা সাহেব সঙ্গে পঁটি
আমরা মিস্টার নামে রটি
যদি ‘সাহেব’ না বলে ‘বাবু’ কেহ বলে,
মনে মনে ভারি চটি।

আমরা ছেড়েছি টিকির আদর
আমরা ছেড়েছি ধুতি ও চাদর
আমরা হ্যাট বুট আর প্যান্ট কোট পরে
সেজেছি বিলাতি বাঁদর।

আমরা সাহেবি রকম হাঁটি
স্পিচ দেই ইংরেজি খাঁটি
কিন্তু বিপদেতে দেই বাঙালিরই মত
চম্পট পরিপাটি।”

 


লেখক পরিচিতি : রানা চক্রবর্তী
রানা চক্রবর্তী পেশায় সরকারী কর্মচারী। নেশা ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা আর লেখালিখি। নিজেকে ইতিহাসের ফেরিওয়ালা বলতে ভালবাসেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা আহ্বান - বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন