লেখক : রানা চক্রবর্তী
জামাই ষষ্ঠীর দিনটিতে বঙ্গদেশের জননীরা তাঁর চঞ্চল ছেলেমেয়েদের শীতলপাটিতে বসিয়ে শোনাতেন, কী ভাবে মা ষষ্ঠী সমস্ত শিশুদের মঙ্গল করেন, তাদের দীর্ঘ জীবন দেন। তাঁরা কয়েকটি মন্ত্র পড়ে একটা অদ্ভুত দেখতে দূর্বাঘাসের ছোট্ট চামর দিয়ে তাঁর সন্তানদের গায়ে মাথায় পুণ্যবারি ছিটিয়ে আশীর্বাদ করতেন, মুঠো ভরে ফলমূল দিতেন। ওদিকে, পূর্ববঙ্গের বেশিরভাগ মানুষের কাছে জামাই ষষ্ঠী একেবারেই জামাইয়ের দিন। কব্জি ডুবিয়ে খাবার দিন।
কিন্তু একই বঙ্গদেশের একই অনুষ্ঠানের দুই ধারা কেন? বঙ্গদেশের সামাজিক ইতিহাস ও ধর্মীয় রীতি সম্পর্কে গবেষণা করলে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, পোশাকি হিন্দুধর্মের গভীরে একটা প্রবল লোকরীতি কী ভাবে বেঁচে থাকে। সবচেয়ে বিচিত্র বিষয় হল, মা ষষ্ঠী নিছক বাংলার এক গ্রামদেবী নন, শীতলা ও মনসার মতোই তিনিও ভারতের নানা অঞ্চলে নানা নামে ও রূপে পূজিত হন। এক শতাব্দী আগে গবেষক উইলিয়ম ক্রুক লিখেছিলেন,
“লোকসমাজে প্রচলিত নানা প্রথা ও রীতি নিয়ে যত চর্চা করা যায়, ততই হিন্দুধর্মের উৎসের কাছে পৌঁছনো যায়।”
ষষ্ঠীদেবী বা ষষ্ঠীঠাকুর হলেন বাংলার একজন লৌকিক দেবী। ইনি মূলত প্রজননের দেবী; তাঁর কৃপায় নিঃসন্তান সন্তানবতী হয় এবং তিনিই সন্তানের রক্ষাকর্ত্রী মাতৃকা, মঙ্গলদায়িনী প্রকৃতি — এই বিশ্বাস বাঙালি হিন্দু সমাজে প্রচলিত।রাঢ়াঞ্চলের এক শক্তিশালী ব্রতের দেবী ষষ্ঠী।
হিন্দু বর্ষপঞ্জীর প্রতিমাসের শুক্লাষষ্ঠী তিথিতে বিভিন্ন নামে ষষ্ঠীদেবী পূজিতা হন (জৈষ্ঠ মাসে: অরণ্যষষ্ঠী, শ্রাবণ মাসে: লুণ্ঠন বা লোটনষষ্ঠী, ভাদ্র মাসে : চাপড়া বা মন্থনষষ্ঠী, আশ্বিন মাসে: দুর্গাষষ্ঠী বা বোধনষষ্ঠী, অগ্রহায়ণ মাসে: মূলাষষ্ঠী, পৌষ মাসে: পাটাইষষ্ঠী, মাঘ মাসে : শীতলষষ্ঠী, চৈত্র মাসে: অশোকষষ্ঠী এবং নীলষষ্ঠী; বৈশাখ, আষাঢ়, কার্তিক ও ফাল্গুন মাসের ষষ্ঠী অপ্রচলিত)। এছাড়া, শিশুর জন্মের দু’দিন পর ‘সূতিকাষষ্ঠী’ , ষষ্ঠ দিনে ‘ঘাটষষ্ঠী’, একুশদিনে ‘একুশে’ এবং শিশুর বারো বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি জন্মতিথিতে ‘জলষষ্ঠী’ দেবীর পৃূজা হয়ে থাকে। ছট তার এবং সূর্যের (সূর্য দেবতার) সম্মানে বিহারে, বছরে দুইবার (কার্তিকের চন্দ্র মাসগুলিতে, আরও বিশিষ্টতা চৈত্র মাস অন্য মাসগুলিকে দেওয়া হয়) পালন করা হয়। বেশিরভাগ পণ্ডিত বিশ্বাস করেন যে ষষ্ঠী দেবীর শিকড় হিন্দু লোক ঐতিহ্যগুলিতে চিহ্নিত হতে পারে। এই দেবীর উল্লেখ হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলিতে ৮ম ও ৯ম শতকে বা খ্রিস্টপূর্বাব্দে পাওয়া যায়, যার মধ্যে তিনি শিশুদের নিয়ে হিন্দু যুদ্ধ-দেবতা স্কন্দের সাথে যুক্ত। প্রাথমিক রেফারেন্সগুলি তাকে স্কন্দের বিমাতা হিসাবে বিবেচনা করে, কিন্তু পরে গ্রন্থে তিনি স্কন্দপত্নী দেবসেনাতে পরিণত হন। কিছু প্রাথমিক গ্রন্থে যেখানে তিনি স্কন্দের একজন পরিচারক হিসাবে আবির্ভূত হন, তিনি মা এবং সন্তানের রোগের কারণ বলে মনে করা হয়, এবং এজন্য জন্মের ৬ষ্ঠ দিনে প্রসূতির প্রয়োজন হয়। সময়ের সাথে সাথে, এই দেবী সন্তানের উপকারী ত্রাণকর্তা এবং উপদেষ্টাতে পরিণত হন।
এই দেবীর নির্দিষ্ট অবয়ব নেই। মঙ্গল ঘটে আঁকা মূর্তি, শিল, পিটুলি দিয়ে তৈরি মূর্তি, ঘটে পোঁতা বটগাছের ডাল ইত্যাদিতে ষষ্ঠীদেবীর প্রতিমা কল্পনা করা হয়। দেবীর বাহন কালো বিড়াল। তবে তাঁর সম্পর্কে ধ্যানমন্ত্রগুলির সার কথা হল-গৌরবর্ণা দ্বিভূজা দেবী। উত্তম বসন ও অলঙ্কার পরিহিতা। চন্দ্রাননা ও কৃষ্ণমার্জার বাহনা।পীনোন্নত পয়োধরা। কোলে একাধিক শিশুপুত্র। অনেকের মতে দেবীর বিড়াল বাহনার মূলে রয়েছে দেবী জগদ্ধাত্রীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কেননা বিড়াল বাঘ না হলেও ‘বাঘের মাসি’ বলে সুপরিচিত। স্বামী নির্মলানন্দ তাঁর ‘দেব-দেবী ও তাদের বাহন’ গ্রন্থে লিখেছেন যে, বিড়াল হলো প্রজনন শক্তির প্রতীক। আর বিড়ালির দুগ্ধ নাকি স্ত্রীরোগের আরোগ্যলাভের অন্যতম ঔষধ। এমন প্রাচীন লোকবিশ্বাসের সূত্র ধরেই নাকি ষষ্ঠীর বাহন বিড়াল।
ষষ্ঠীদেবীর পূজা সাধারণত বটগাছতলায়, বাড়ির আঙিনায়, নদী বা পুকুরের ধারে হয়ে থাকে। অনেক গ্রামে বট-অশ্বত্থ বৃক্ষমূলে ‘ষষ্ঠীতলা’ বলে নির্দিষ্ট স্থানে বিভিন্ন ষষ্ঠীদেবী নির্দিষ্ট তিথিতে পূজিতা হন। মূলত গৃহস্থ নারীরা তেল-হলুদ-দই, ঘট, বটের ডাল ইত্যাদি উপকরণের মাধ্যমে পূজা নির্বাহ করে থাকেন, পূজাশেষে ‘ব্রতকথা’ শ্রবণ করে স্নান সেরে বাড়ি ফিরে ফলাহার করেন। বটতলাই হলো ষষ্ঠীর আটন। এই কারণে তাঁকে বটবিটপবিলাসী বলা হয়েছে। বর্ণহিন্দু নবশাখ গোষ্ঠীর মহিলারা ষষ্ঠীর ব্রত করলেও তথাকথিত অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের রমণীরা শুধুমাত্র অরণ্য ও শীতলা ষষ্ঠী ব্রত পালন করেন। তবে সন্তান প্রসব করার ছয় দিন পরে ষেটেরা বা ষষ্ঠীপুজো গ্রামাঞ্চলের হিন্দুমাত্রই পালন করে থাকেন। মধ্যযুগীয় বাংলাকাব্যে শিশুজন্মের পর ষেটেরা, আটকলাই, নর্তা, একতির্সা প্রভৃতি উৎসব পালন করার বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে। শিশু জন্মের ছয় দিনের মাথায় গো-ভাগাড় থেকে গো-মুন্ড নিয়ে এসে আঁতুরঘরের দরজায় পোঁতা হতো। এখন আর লোকাচারটি পালিত না হলেও এই দিনে প্রথম মায়ে-ছা’য়ে স্নান করার বিধি আছে। বারো মাসই ষষ্ঠীব্রত পালন করার বিধি। যেমন বৈশাখমাসে ধূলাষষ্ঠী। জষ্ঠিতে অরণ্য। আষাঢ়ে কোড়া। শ্রাবণে নোটন, ভাদ্রে মন্থন বা চাপড়া। আশ্বিনে দুর্গা ষষ্ঠী। কার্তিকে গোটা, অঘ্রানে মূলা, পৌষে পাটাই। মাঘমাসে শীতলা। ফাল্গুনে অশোক আর চৈত্রে নীলষষ্ঠী।
অরণ্যষষ্ঠীর পুজোর উপকরণ বিস্মৃত যুগের উপাচার। সাতটি সতেজ বাঁশপাতা, গোটা ফল ৫-৭ টি। তালেরপাখা একটি। একগুচ্ছ দূর্বাঘাস। দই-হলুদ-তেল। ষষ্ঠীর ডোর বা সুতো। যে সব মহিলাদের কন্যাসন্তান হয়েছে ও প্রথম ষষ্ঠী ব্রত পালন করবেন – তাদের লাগবে সাতটি ডালি। তাতে সাতটি গোটা ফল ও সাতটি তালের পাখা। আর পুত্রসন্তান হলে লাগবে ৯টি পাখা ও ডালি। পুজোর পর ঐ ডালিগুলি শিশুদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে। দই তেল হলুদের যাদু ফোঁটা দেবেন মা তাদের সন্তানের ও জামাতার কপালে। কেউ অনুপস্থিত থাকলে তার উদ্দেশে প্রতীকী ফোঁটা পড়বে বাড়ির বড়ঘরের দরজার বাজুর উপরে। এই পুজো যে প্রজননের ও সতেজ জীবনের কামনায় তা বোঝা যায় পুজোর উপকরণ দেখে। তবে তালপাখার বিষয়ে অন্য কাহিনি আছে। জষ্ঠি মাসের তাপ দগ্ধ দহনে পুড়ে খাক মাঠ-ঘাট বন-বাদাড়। মেয়েরা বৃষ্টি কামনায়, উত্তম ফসল প্রাপ্তির আশায় বনে গিয়ে গান গেয়ে আর পুজো দিয়ে বনদেবীকে সন্তুষ্ট করতো। যাতে নেমে আসে বৃষ্টি। নারী আর কৃষি যখন সমার্থক হয়ে উঠলো তখন থেকেই অরণ্যের দেবী হয়ে উঠলেন প্রজননের দেবী। নারীর ফসল অর্থাৎ সন্তান রক্ষয়িত্রী। রাঢ় অঞ্চলে তাই শুধু মায়েরাই ষষ্ঠীর ব্রত করেন না – কৃষি জমির ও ষষ্ঠীপুজো হয়। এর নাম গাবরষষ্ঠী। ভাদ্র সংক্রান্তিতে ধানের জমির এক কোনে এই গাবর ষষ্ঠীর পুজো আজও পালিত হয়। রঘুনন্দনের তিথিতত্ত্ব থেকে জানা যায় জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা তিথিতে মহিলারা অরণ্যে গিয়ে পাখা হাতে বিন্দ্যবাসিনী স্কন্দ ষষ্ঠীর পুজো করতেন। এ পুজো গ্রামের বা বাড়ির ভিতরে হতো না, বনভূমি বা অরণ্যের মধ্যেই সম্পন্ন হতো। এই কারণেই এর নাম অরণ্যষষ্ঠী। একসময় শ্বশুড়বাড়িতে অধিকাংশ নারীর কপালে জুটতো লাঞ্ছনা গঞ্জনা। তার উপর যদি তাঁর সন্তান না হতো অত্যাচারের মাত্রাটি কোথায় গিয়ে পৌঁছাত সহজেই অনুমান করা যায়। এই কারনেই জামাইকে তোয়াজ করার বিষয়টি এসে পড়ে। তাছাড়া শ্বশুড় শ্বাশুড়ির কাছে জামাতাও পুত্র। সারা বছরে ষষ্ঠী পুজোয় নিজের সন্তানদের মঙ্গল কামনাই হয়ে ওঠে মুখ্য। বেচারা জামাই থাকে বাইরে।তাই শুধু মাত্র অরণ্যষষ্ঠীতেই জামাইদের এই স্পেশাল খাতির। কোন কোনও গবেষক আবার মনে করেন জষ্ঠিমাসের কৃষ্ণপক্ষের সাবিত্রী চতুর্দশী তিথিতে স্ত্রীরা স্বামীদের দীর্ঘজীবন কামনা করে যমের আরাধনা করতেন। এই লোকাচারটির সূত্র ধরেই কলকাতার বাবু সংস্কৃতিতে নাকি জামাই ষষ্ঠীর অনুপ্রবেশ। বাল্যবিবাহ – সতীদাহ ইত্যাদি ঘটনার অনুষঙ্গ ধরেই হয়তো এক সময় খুব স্বাভাবিক ভাবেই শ্বাশুড়িমাতা জামাইবাবাজীবনের দীর্ঘজীবন কামনা করতেন।
দেবী ষষ্ঠী সন্তান দায়িনী। সন্তান পালিনী দেবী। আবার শুধু পৌরাণিক দেবী নন; মান্ধাতার আমলের লোকদেবী। আরও প্রাচীন; ব্রতের দেবী। প্রত্নযুগের এই দেবীকে পৌরাণিক রূপ-সাগরে স্নান করিয়ে নতুন রূপে উপস্থাপিত করা হয়েছে। দেবী দুর্গার সঙ্গে একীভূত করা হয়েছে। মহাষষ্ঠীর সকালেই তো দেবী দুর্গার সংকল্প। দেশি বিদেশি পন্ডিতেরা দাবি করেছেন হিন্দু ধর্মের বারোয়ানাই অ-বৈদিক কালচার থেকে গৃহীত। পুজোপাঠ, ভূত-প্রেতে বিশ্বাস, পূর্বপুরুষপুজো, পরজন্মে বিশ্বাস, আত্মা এ সব ধারণাগুলি এসেছে অস্ট্রিক-দ্রাবিড় ইত্যাদি মিশ্র সংস্কৃতি থেকে। ষষ্ঠীও একইভাবে ছাড়পত্র পেয়েছে। প্রখ্যাত লোকসংস্কৃতিবিদ আশুতোষ ভট্টাচার্য মনে করেছেন, সুদূর প্রাচীন কাল থেকেই সমাজে শিশুরক্ষক দেবীর অস্তিত্ব ছিল। হরপ্পা সভ্যতায় কতকগুলি ক্ষুদ্রাকৃতি মাতৃমূর্তি পাওয়া গেছে। এই দেবীরা ছিলেন মূলত গৃহদেবী। অন্যদিকে নবজাত শিশুর রক্ষয়িত্রী। পরবর্তীকালে এই সমস্ত মাতৃকামূর্তি থেকেই ষষ্ঠীর উদ্ভব। তবে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসাবে ষষ্ঠীর মূর্তি বিশেষ একটা মেলেনি। কবি কৃষ্ণরাম দাসের ষষ্ঠীমঙ্গলকাব্যের ভূমিকা লিখতে গিয়ে ড.সত্যনারায়ণ ভট্টাচার্য জানিয়েছেন – উড়িষ্যায় বালেশ্বর জেলা থেকে একটি ষষ্ঠী মূর্তি মিলেছে। দেবীর কোলে শিশুসন্তান।বাঁকুড়ার পাঁচমুড়ো কিম্বা সোনামুখিতে স্থানীয় কুম্ভকারেরা এক ধরণের মাটির পুতুল তৈরী করেন। নাম ষষ্ঠীপুতুল বা যো পুতুল। এগুলি ষষ্ঠীতলায় মানত হিসাবে দেওয়া হয়। পুতুলগুলি স্রেফ আঙুল টিপে তৈরি। ষষ্ঠীর কোলে এক বা দুই কিম্বা দশের অধিক শিশু থাকে। কালো বা লাল দু’রঙেরই হয়। চোখে মুখে গড়নে প্রত্ন পুতুলের মায়াবি বিন্যাস। আদিমতার ছাপ। সুতরাং ষষ্ঠীর উপস্থিতি সেই সুপ্রাচীনকালেই। আজও যার অস্তিত্ব টিকে আছে বাংলার বিলীয়মান পুতুল শিল্পে। অনেকেই আবার বৌদ্ধ হারিতীর সঙ্গে ষষ্ঠীকে একাকার করে দিয়েছেন। কিন্তু হারিতী বড়ো ভয়ংকরী শিশু নিধনকারী যক্ষিণী। তাকে পুজো না করলে রেহাই নেই।যাকে বলে ভয়ে ভক্তি -তাই আদায় করে হারিতী। আর ষষ্ঠী হলেন শিশু রক্ষয়িত্রী।কল্যাণকারী মাতৃমূর্তি। শিশুকে যদি কেউ আঘাত করে, অপমান করে তাতেই তিনি ভয়ংকর রেগে উঠবেন। জৈনধর্মের শিশুরক্ষক দেবী ‘নৈগমেসা’র সঙ্গে অদ্ভুত মিল রয়েছে ষষ্ঠীর। ইনিও শিশুর কল্যাণকারী দেবী। ব্রতের দেবী হিসাবে ষষ্ঠী আরও আরও পুরানো। এই দেবী এসেছে আমাদের আদিমাতৃতান্ত্রিক সমাজ থেকে। এই কারণে ষষ্ঠীকে বুড়ি বলা হয়। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁর চন্ডীমঙ্গল কাব্যে ষষ্ঠী সম্পর্কে লিখেছেন:
“দুয়ারে বান্ধিল জাল বেত্র উপনাদে।
ফেড়িয়া চালের খড় জ্বালিল আঁতুরি।
গো-মুন্ডে থুইয়া দ্বার পূজে ষষ্ঠী বুড়ি।।”
পশ্চিমরাঢ় অঞ্চল প্রাচীন জনবসতির অন্যতম কেন্দ্র। এখনো সেখানে বুড়ি নামাঙ্কিত সুপ্রাচীন লোকদেবীর পুজো হয়। যেমন খুনিয়াবুড়ি, মেলা বুড়ি, ভাঁড়রা বুড়ি।আর আসানসোলের জাগ্রতা ঘাঘরবুড়ির নাম আশাকরি অনেকেই শুনেছেন।
এবার আসি ব্রত কথায়। ব্রত-এমন এক ধরণের মেয়েলি আচার-কৃত্য,পুজো অনুষ্ঠান যা নির্দিষ্ট তিথি মেনে পালিত হয়। এই পুজো মূলত প্রজনন শক্তির। গুহ্য যাদু শক্তির। সব ধরণের বিপদ আপদ থেকে মুক্ত হবার জন্য পুজো। এছাড়া সাংসারিক সুখ স্বাছন্দ্য কামনাতো আছেই। আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে। পরিণত বয়সে স্বামীর কোলে মাথা রেখে স্বর্গ লাভের দুর্মদ বাসনা। ব্রত আর ব্রাত্য শব্দদু’টি বৈদিক সাহিত্যের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। মেয়েলি এই ব্রতের সঙ্গে বৈদিক বা পৌরাণিক ধর্মের কোন মিল নেই। পন্ডিতেরা অনুমান করেছেন অনার্য মহিলাদের ধর্মীয় সংস্কৃতি ব্রতের মধ্যেই টিকে আছে। আর্যরা এই ধর্মটিকে বিশেষ পাত্তা দিতেন না। হয়তো আর্য সমাজের একাংশ বা অনার্যরা এই ব্রতধর্ম পালন করতো বলে তাদেরকে ব্রাত্য বলা হতো। ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় মন্তব্য করেছেন –
“ঋগবেদীয় আর্যরা ছিলেন যজ্ঞধর্মী।যজ্ঞধর্মী আর্যদের বাহিরে যাহারা ব্রতধর্ম পালন করিতেন, ব্রতের গুহ্য যাদু শক্তি বা ম্যাজিকে বিশ্বাস করিতেন তাহারাই হয়তো ছিলেন ব্রাত্য”।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে, দেবীর ভক্ত রাজা প্রিয়ব্রতের কথা। তিনি ষষ্ঠী পুজো করে মৃত সন্তানদের জীবিত অবস্থায় ফিরে পেয়েছিলেন। আর সেই থেকেই নাকি হিন্দু সমাজে প্রতি মাসের শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে ষষ্ঠীপুজো প্রচলিত হয়েছে। অরণ্যষষ্ঠী উপলক্ষ্যে বহুল প্রচলিত লোকগল্পটি হল বেণেবাড়ির ছোট বউকে নিয়ে। খাবার জিনিষে তার বড়ো লোভ। খুবই নোলা আর খাই খাই বাই। ষষ্ঠী পুজোর আয়োজন চলছে। নানা লোভনীয় ফল-মূল মিষ্টি ইত্যাদি। লোভ আর সংবরণ করতে পারলেন না ছোট বউ। ফাঁকা নির্জন দেখেই কয়েকটা মন্ডা মেঠাই টপাটপ মুখে পুরে নিলেন। আর দোষ চাপিয়ে দিল ঐ মিশকেলে বিড়ালটার উপর। বিড়াল গেল বেজায় চটে। সে তো যে সে বিড়াল নয়। মা ষষ্ঠীর বাহন। অতএব সেও ফন্দি আঁটতে লাগলো। ছোট বউ সন্তান প্রসব করেই একটু খানি ঘুমুতেই বিড়াল ছেলে মুখে করে বনে দিল চম্পট। এমনি করে সাত ছেলে গেল হারিয়ে। ছোট বউ তখন হাহাকার করে বনে বনে বেড়াতে লাগলো। মা ষষ্ঠীর বড়ো দয়া হলো। বামনির বেশ ধরে এসে বউকে জিজ্ঞেস করে জানলেন সব কথা। বিড়ালের উপর দোষ চাপিয়ে সে ঠিক করে নি তাও জানালেন। নিজের পরিচয় দিয়ে পুজো করার পরামর্শ দিলেন বনের মধ্যে। চালু হয়ে গেল ষষ্ঠীপুজা। যা হল আজকের জামাই ষষ্ঠী। মা ষষ্ঠীর কিংবদন্তী মঙ্গল-কাব্য গ্রন্থে, বিশেষ করে এর ষষ্ঠী -মঙ্গল ভাগে রয়েছে। মঙ্গল-কাব্য এবং বাঙালি লোক কাহিনীগুলোতে তাকে মনসার ঘনিষ্ঠ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। মনসার নাগ পঞ্চমী উৎসবের সময় ষষ্ঠীর কার্যক্রম বর্ণনা করা হয়েছে বিখ্যাত লোকক্যেছে। যাতে তিনি মনসার সহযোগী হিসেবে আবির্ভূত হন।
ষষ্ঠীদেবীর মাহাত্ম্য প্রচারের জন্য সৃষ্ট ‘ষষ্ঠীমঙ্গল’ পালার গীতিনাট্যাভিনয় অনেক সন্তানহীনের গৃহে সন্তানের কামনায় বা সন্তানলাভের পর মানসিক পূরণের পর অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের উড়িষ্যা-সন্নিহিত মেদিনীপুরের বিভিন্ন জায়গায় এই পালার প্রচলন আছে।
আশুতোষ ভট্টাচার্য লোকায়ত ধর্ম নিয়ে বিস্তর কাজ করেছিলেন। তাঁর মতে, ষষ্ঠী হলেন প্রসূতি এবং শিশুর রক্ষয়িত্রী। অন্য দিকে, নৃতত্ত্ব ও ইতিহাসের পণ্ডিত সুধীর রঞ্জন দাস এই অভিভাবক দেবীর জনজাতীয় উৎসের সন্ধান করেছিলেন। আবার হরপ্পাতেও প্রাগৈতিহাসিক এমন দেবীমূর্তি পাওয়া গেছে, যা দেখে নৃতত্ত্ববিদরা মনে করেছেন, সিন্ধু সভ্যতাতেও ষষ্ঠীর আরাধনা চলত। এটা মানলে তো আমরা সোজা চার হাজার বছর পিছিয়ে যেতে পারি এবং সে ক্ষেত্রে আমাদের মতো লোভী জামাইদের এই গ্রাম্য দেবীটিকে আর একটু শ্রদ্ধার চোখে দেখা উচিত। তবে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, সন্তান জন্মের সঙ্গে প্রাচীন লোকবিশ্বাসে ‘ম্যাজিক’-এর যে যোগাযোগ ছিল, ষষ্ঠীর পুজো তার অনুসারী। জন মারডক, সি এইচ বাক-এর মতো গবেষকরা দেখিয়েছেন, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কী ভাবে মেয়েরা ষষ্ঠী বা তাঁর অনুরূপ দেবীর আরাধনা করতেন। উইলিয়ম জোনস নাকি এই রীতির সঙ্গে প্রাচীন ইউরোপের লোকাচারের মিল দেখে চমৎকৃত হয়েছিলেন।
মা ষষ্ঠীর বহন কালো বিড়ালের কাহিনী ওপরেই বর্ণনা করেছি। ভারতবাসীর তাই কালো বেড়ালকে অশুভ মনে করার কোনও কারণ নেই। প্রধানমন্ত্রীকে যাঁরা পাহারা দেন, তাঁদেরও তো ব্ল্যাক ক্যাট বলা হয়!
কেউ যাতে নিজের প্রাপ্যের বেশি ভাগ না নেয়, যৌথ পরিবার ধরে রাখার পক্ষে সেটা খুব জরুরি। মা ষষ্ঠীর কাহিনি সেই শিক্ষা দেয়। ভারতে এই লোককাহিনিগুলি কী ভাবে অনেক শতাব্দী ধরে তাদের পুরনো চেহারায় বেঁচে রইল, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম তাদের বিনাশ করল না, সেটা সত্যিই অবাক করে দেয়। ব্রাহ্মণ্য ধর্ম মা ষষ্ঠীকে আত্মসাৎ করতে চায়নি তা নয়, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে হিন্দু যুদ্ধদেবতা স্কন্দ ও তাঁর সহযোগী যৌধেয়র সঙ্গে ষষ্ঠীকে জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। খ্রিস্টীয় প্রথম থেকে তৃতীয় শতকের মধ্যে বিভিন্ন শাস্ত্রে, বিবরণে এবং মুদ্রায় তাঁর ছ’টি মাথা দেখানো হয়েছে। পঞ্চম-ষষ্ঠ শতাব্দীতে গুপ্তযুগেও এই মূর্তির বর্ণনা পাই। পঞ্চম শতকের বায়ুপুরাণে ষষ্ঠী ৪৯টি দেবীর অন্যতম, আর একটি পুরাণে তাঁকে ‘সমস্ত মাতৃদেবীর মধ্যে আরাধ্যতমা’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। চতুর্থ-পঞ্চম শতাব্দীর যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতিতে তিনি স্কন্দদেবের পালিকা-মা ও রক্ষয়িত্রী, কিন্তু পরবর্তী রচনায় তাঁর সঙ্গিনী, পদ্মপুরাণেও তিনি স্কন্দের স্ত্রী। ষষ্ঠীর কাহিনিগুলি পাওয়া যায় বাংলায় মঙ্গলকাব্যে, বিশেষ করে ষষ্ঠীমঙ্গল-এ, যেখানে সর্পদেবীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখানো হয়েছে। বিহারে সন্তানজন্মের পরে ছ’দিনের অনুষ্ঠানটিকে ছ’ঠী বলা হয়, ষষ্ঠী সেখানে ছ’ঠী মাতা, সন্তানহীনা দম্পতিরা তাঁর আরাধনায় ব্রত পালন করেন, ষষ্ঠী ব্রত। ওডিশায় সন্তানজন্মের ছ’দিন এবং একুশ দিনে এই দেবী পূজিত হন। উত্তর ভারতের কোথাও কোথাও বিয়ের সময়েও ষষ্ঠীর পুজো করা হয়।
ষষ্ঠীকে দেখি সাধারণত জননী রূপে: মার্জারবাহিনী, কোলে এক বা একাধিক শিশু। তাঁর নানান প্রতীক: মাটির কলসি, বটগাছ, বটগাছের নীচে লাল পাথর, ইত্যাদি। খোলা আকাশের নীচে কোনও একটা জায়গা তাঁর পুজোর জন্য নির্দিষ্ট হয়, তার নাম ষষ্ঠীতলা। মনে রাখতে হবে, এই সে দিন পর্যন্ত শিশুমৃত্যুর হার খুব বেশি ছিল। নবজাতককে রক্ষা করার জন্য মানুষ তাই ষষ্ঠীর শরণ নিত। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক হিন্দুধর্ম তাঁকে পৌরাণিক দেবীতে রূপান্তরিত করতে চাইল, লোকধর্ম চাইল পুরনো আচার বজায় রাখতে, ফলে টানাপড়েন চলল। টানাপড়েনের আর একটা চেহারাও দেখা গেছে। ষষ্ঠীকে বলা হয়েছে অমঙ্গলের দেবী, তিনি কুপিত হলে মা ও শিশুদের দুঃখ দেন। পঞ্চম শতকের কাশ্যপ সংহিতায় ষষ্ঠীকে বলা হয়েছে ‘জাতহরণী’, যিনি মাতৃগর্ভ থেকে ভ্রূণ অপহরণ করেন, সন্তান জন্মের ছ’দিনের মধ্যে তাকে ভক্ষণ করেন, তাই শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে ষষ্ঠ দিনে তাঁকে পুজো করা বিধেয়।
কিন্তু এ-সবের মধ্যে জামাই ঢুকল কী করে? জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণপক্ষে সাবিত্রী চতুর্দশীতে স্ত্রীরা স্বামীর দীর্ঘজীবন কামনা করে যমের আরাধনা করেন। মনে হয়, এই লোকাচারটির সূত্র ধরেই কলকাতার বাবু সংস্কৃতি এই ষষ্ঠীটি জামাইকে নিবেদন করেছিল। আঠারো-উনিশ শতকে বাংলার সচ্ছল শ্রেণির মধ্যে বাল্যবিবাহ এবং বহুবিবাহের ব্যাপক প্রচলন হয়, ফলে অগণিত বালবিধবার যন্ত্রণাময় জীবন, বিস্তর সতীদাহ। এই অবস্থায় জামাই ও স্বামীর দীর্ঘ জীবনের প্রার্থনা বাঙালি মা এবং মেয়ের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। অন্তত কলকাতা ও চার পাশের এলাকায় সন্তানের মঙ্গলকামনার চেয়ে এর গুরুত্ব বেশি ছিল।
যখনই নতুন সংকট আসে, তার মোকাবিলার নতুন চেষ্টাও দেখা যায়। ইতিহাসে বার বার দেখেছি, যুগের প্রয়োজনে সমাজ কী ভাবে পুরনো আচার-অনুষ্ঠানগুলি সংশোধিত করে নেয়। ষষ্ঠী সন্তানের কল্যাণের জন্য পালনীয় একটি ব্রত, কন্যার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন বাঙালি মা অন্তত একটি ষষ্ঠীকে পালটে নিয়েছেন, জামাইয়ের জন্য ভূরিভোজের আয়োজন করেছেন।
(তথ্যসূত্র:
১- শ্রী জহর সরকার লিখিত প্রবন্ধ, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৪শে মে ২০১৫ সাল।
২- ড. বরুণকুমার চক্রবর্তী সম্পাদিত বঙ্গীয় লোকসংস্কৃতিকোষ (১৯৯৫)। কলকাতা: অপর্ণা বুক ডিস্ট্রিবিউটার্স। পৃষ্ঠা ৪২৪–৪২৬।
৩- Encyclopaedia of Hinduism (1st edition) by Nagendra Kr. Singh. New Delhi: Centre for International Religious Studies. ১৯৯৭।
৪- Physical Disability and Human Behavior by JAMES W. McDANIEL (1976), page 34 – 55.
৫- উইকিপিডিয়া।
৬- এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটেনিকা।)
লেখক পরিচিতি : রানা চক্রবর্তী
রানা চক্রবর্তী পেশায় সরকারী কর্মচারী। নেশা ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা আর লেখালিখি। নিজেকে ইতিহাসের ফেরিওয়ালা বলতে ভালবাসেন।