লেখক: হৃদয় হক
মনে করুন, আপনি স্পেইসশিপ করে নানার বাড়ির গ্রহে বেড়াতে যাচ্ছেন। এমন সময় মাঝপথে আপনার মনে হোল যে, ওনার জন্য কিছু নেওয়া হয় নি। আপনি একটি নক্ষত্রের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এখন সমস্যা হল যে, দোকানের গ্রহগুলোতে এত বড় স্পেইসশিপ নিয়ে প্রবেশ নিষেধ। তাই এটি কোথাও রেখে যেতে আপনি বাধ্য। মনিটরে দেখলেন যে, আরও ১০০ কিলোমিটার দূরে একটি পার্কিং স্পট আছে। এখান থেকে দোকানের গ্রহ কাছে। মাত্র ২০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। কিন্তু যথা স্থানে পার্কিং করে দোকানে গেলে আপনাকে ২ বার অতিরিক্ত ১০০ কিলোমিটার অর্থাৎ বাড়তি ২০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে। এ কথা ভাবতেই আপনার পেট গুরগুর করে। কিছুক্ষণ ভাবার পর মাথায় আসে, আপনিতো আর গ্রহে নেই যে ট্রাফিক পুলিশ আসবে আর আপনার শিপ নিয়ে যাবে। তাই ভাবলেন, অযথা বাড়তি খরচ কেন বাড়াবেন! কিপ্টেমি করে এখানেই স্পেইসশিপ রেখে ২০০ কিলোমিটার যাওয়া-আসার অর্থাৎ ৪০০ কিলোমিটার পথের জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন ও জ্বালানি স্পেসস্যুট এর পেছনের রকেটে ভরে বেরিয়ে গেলেন দোকানে কিছু কেনার উদ্দেশ্যে। ঘণ্টা খানেক ওখানে ঘোরাঘুরি করলেন, নানা-নানির জন্য অনেক কিছুই কিনলেন। কিন্তু তারপর দোকান থেকে এসে দেখেন, আপনার স্পেইসশিপ আগের জাগায় নেই!
সে আরও ১০০০ কিলোমিটার দূরে সরে গিয়েছে; মানে, আপনি আজ শেষ। কিপ্টেমিটা না করলেই পারতেন। ওই যে কথায় বলে, “একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না।” আসলে পাশের নক্ষত্রের মহাকর্ষীয় বলের কারনেই আজ এ দশা। তবে আপনার দোষও আছে। এখন প্রশ্ন হল পার্কিং স্পটে এর আকর্ষণ থাকা সত্ত্বেও, বিশেষত্ব কী? তাছাড়া পার্কিং স্পটটি নক্ষত্রটির আরও কাছে। এখানেই যদি এমনভাবে সরে যায়, ওখানে তো নক্ষত্র এটাকে খেয়েই ফেলবে!!
আসলে ওই নক্ষত্র সিস্টেমের একটি গ্রহ ও সেই নক্ষত্রের মহাকর্ষীয় বল সমান থাকায় ওই জাগাগুলোর পয়েন্টে পার্কিং স্পট বানানো হয়েছিল। আর এরূপ অবস্থানগুলোর নাম হল “Lagrange Point”। বিজ্ঞানী যোসেফ লুইস ল্যাগ্রাঞ্জ এর নামে নামকরণ করা হয় এবং এ পয়েন্টগুলোকে “L” দ্বারা প্রকাশ করা হয়। বস্তুত, এমন ৫টি পয়েন্ট রয়েছে। ১৭৭২ সালে বিজ্ঞানী যোসেফ লুইস ল্যাগ্রাঞ্জ (Joseph-Louis Lagrange) “Three-body problem” সমাধানের মাধ্যমে এই পয়েন্টগুলো আবিষ্কার করেন।
এখানে ৫টা পয়েন্ট থাকে তার মধ্যে প্রথম ৩টে ( এল -১,২,৩) পয়েন্ট বিজ্ঞানী লিওনার্দ ইউলার (Leonhard Euler) বিজ্ঞানী ল্যাগ্রাঞ্জ- এর কয়েক বছর আগে আবিষ্কার করেন। বাকি দুটো করেন বিজ্ঞানী ল্যাগ্রাঞ্জ এবং এই ২টো পয়েন্ট এল-৪ ও এল-৫। এসব পয়েন্টগুলোতে মহাকর্ষ বল স্থিতিশীল অর্থাৎ নক্ষত্র যে বলে আপনার স্পেইসশিপ কে আকর্ষণ করত গ্রহটিও দূরত্বের কারণে ঠিক একই পরিমান বলে আপনার স্পেইসশিপটাকে আকর্ষণ করবে। ফলে, আপনার স্পেইসশিপ জায়গা মতোই থেকে যেত।
এই ৫টি পয়েন্টের মধ্যে প্রথম ৩টি আপেক্ষিক ভাবে কম স্থিতিশীল ও বাকি ২টো মানে- L4 এবং L5 আপেক্ষিক ভাবে বেশি স্থিতিশীল। বাস্তবে, এ পয়েন্ট গুলোর সুবিধা হল যে এখানে নানা স্পেসক্রাফট ও কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়ে মহাকাশের নানা বিষয় দেখা বা তার উপর গবেষণা করা বা অনুসন্ধান চালানোর জন্য এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর এসব পয়েন্টে আটকা পড়া যেকোনো বস্তু “ট্রোজান” নামে পরিচিত যা হতে পারে কোনো গ্রহাণু আথবা চাঁদ। যেমন : শনির ৪ টি ট্রোজান মুন বা চাঁদ আছে। আবার জুপিটারের ট্রোজান গ্রহাণু।
এজন্যই বলি এখন থেকেই ট্রাফিক আইন মেনে চলার চেষ্টা করুন। এখানে না হয় ঘুষ দিয়ে বা অন্য কোনো উপায়ে বেঁচে যাবেন; কিন্তু এ বিরাট মহাশূন্যে ঘুষটা নেবে কে?
[যোসেফ লুইস ল্যাগ্রাঞ্জ ডিফারেন্সিয়াল ইকুয়েশন, এনালাইসিস, নাম্বার থিউরি, এনালাইটিক্যাল ও সেলিস্টিয়াল মেকানিক্স বিষয়ে বেশ বড় ধরণের অবদান রাখেন। এছাড়াও তিনি নিউটনের ইউনিভার্সাল ল অব গ্র্যাভিটেশন প্রমাণে বিশেষ ভূমিকা রাখেন]
তথ্যসূত্র:
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Lagrangian_point
লেখকের কথা: হৃদয় হক
নাম: মো. সাজেদুল হক। ছদ্মনাম: “হৃদয় হক”। বর্তমানে চট্টগ্রাম নগরীর নাসিরাবাদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। প্রধানত জ্যোতির্বিজ্ঞান ভিত্তিক লেখালিখি পছন্দের। লিখি, বাংলায় জ্যোতির্বিজ্ঞান ভিত্তিক লেখার সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য।