মন চলো জগন্নাথ দর্শনে

লেখক : মিত্রা হাজরা

“রথে চ বামনম্‌ দৃষ্টা পুনর্জন্ম না বিদ্যতে।” রথে আসীন বামনদেবকে দর্শন করলে ইহলোকের মায়া থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। জীবন রূপ এই রথের সারথি হল বুদ্ধি,রথের লাগাম মন, অহং কে বলি দিয়ে মন,প্রাণ, উৎসর্গ করতে হবে মহাপ্রভু জগতের নাথ জগন্নাথ দেবের চরণে।

জগন্নাথ তত্ত্ব খুব ই কঠিন তত্ত্ব, কারো কাছে তিনি নীলমাধব,শবর জাতির উপাস্য, আবার ঋকবেদের দশম সুক্তে তিনি বিগ্রহ সেবা, বেদ যেমন অপৌরষেয়,এই বিগ্রহ তেমনি অপৌরষেয় বা স্বয়ংপ্রকাশ।
রথযাত্রার তাৎপর্য বিভিন্ন জন, বিভিন্ন ভাবে উপলব্ধি করেছেন। কারো মতে আত্মারাম রূপ মানবের দেহরথে ত্রিপাদভূমি আশ্রয় করে অবস্থান করেন। ব্যাখ্যা হলো–মূলাধার,অনাহত,ও সহস্রার।মূলাধারে মন,অনাহতে প্রাণ, সহস্রারে জ্ঞান অবস্থান করে। মূলাধারে ব্রহ্ম, অনাহাতে বিষ্ণু, সহস্রারে শিবের অবস্থান। এই ত্রিপাদের অভিব্যক্তি হয় ত্রয়ী বিগ্রহে। তাই এই রথযাত্রার সময় রথের দড়ি ছুঁলে ভববন্ধন কাটে, সর্ব পাপ মুক্ত হয় মানব।

বৈশাখে শুক্লা একাদশী তিথিতে জগন্নাথ দেবের চন্দন যাত্রা হয়। প্রভু জগন্নাথ কে চন্দনে লিপ্ত করে নৃত্য গীতাদি পরিবেশন করে ভ্রমণ করানো হয়। আর ঐ দিন থেকেই রথের প্রস্তুতি শুরু হয় ।জ্যৈষ্ঠের পূর্ণিমা তিথিতে জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। আর আষাঢ়ের শুক্লা দ্বিতীয়া তে দারুব্রহ্ম জগন্নাথ এর রথযাত্রা শুরু হয়। প্রভু জগন্নাথ এর সাথে থাকেন বলভদ্র ও দেবী সুভদ্রা। প্রভু জগন্নাথ পিতামহ ব্রহ্মা কর্তৃক পূজিত,দেব শিল্পী বিশ্বকর্মা দ্বারা নির্মিত ও অন্যতম রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত।

এই রথযাত্রা উৎসব এর অনেক নাম ও আছে। নবযাত্রা, পতিত পাবন যাত্রা, গুন্ডিচা যাত্রা,নন্দীঘোষ যাত্রা,মহাবেদী যাত্রা প্রভৃতি। রথ নির্মাণ থেকে পুনর্যাত্রা পর্যন্ত নানা স্তরে চলে এই উৎসব। জগন্নাথ মন্দিরে র পূর্বদিকে আছে অরুণ স্তম্ভ। এই অরুণ স্তম্ভ থেকে গুন্ডিচা মন্দির পর্যন্ত যে বিস্তৃত রাজপথ তার নাম বড়দান্ড। এই রাজপথেই রথ নির্মাণ হয় ও এখানেই প্রভু ভাইবোনের সাথে রথে আরোহণ করেন। প্রভু জগন্নাথ এর রথের নাম নন্দীঘোষ, এর উচ্চতা ৪৫–ফুট। জগন্নাথের রথকে রক্ষা করেন শ্রী নৃসিংহ নাথ এবং সারথি মাতলি। সাদা রঙের চারটি ঘোড়া ,নাম—রেচিকা,মোচিকা,সূক্ষা,অমৃতা। রথের শীর্ষে যে পতাকা তার নাম ত্রৈলোক্য মোহিনী,রথের দড়ি শঙ্খচূড়।

বলরামের রথের নাম তালধ্বজ, হলধ্বজ ও বলা হয় । এর উচ্চতা ৪৭–ফুট । শেষাবতার এই রথকে রক্ষা করেন,রথের সারথি সুদ্যুম্ন,রথের ঘোড়া কালো রঙের। নাম–স্থিরা,ধূতি,স্থিতা,সিদ্ধা। দড়ির নাম বাসকি।

সুভদ্রার রথের নাম পদ্মধ্বজ, দেবী দলন ও বলা হয়। সুভদ্রার রথ রক্ষা করেন বনদুর্গা, সারথি হলেন অর্জুন। চারটি কালো ঘোড়া, নাম অধর্ম, অজ্ঞান,অপরাজিতা ও জ্যোতিনী। রথের পতাকার নাম নাদম্বিকা ও রথের দড়ি স্বর্ণচূড়।

রথযাত্রার সময় প্রভু জগন্নাথ দেবের সিংহাসন থেকে অবতরণ উৎসব কে বলা হয় পান্ডুবিজয় বা পহান্ডি বিজয়। সমগ্র অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন বিশ্ববসু বংশীয় শবরেরা। পূজার কাজ করেন দয়িতাপতিরা। গজপতি রাজা রথ পরিস্কার করেন সোনার ঝাঁটা দিয়ে, একে বলা হয় ছেরাপহরা। আর রথের রশি টানেন ভক্তেরা। প্রশস্ত রাজপথ ধরে জয় জগন্নাথ ধ্বনি দিতে দিতে ভক্তরা টেনে নিয়ে যায় এই তিন দেবদেবীকে। মাঝে বিশ্রাম দেওয়া হয় তিন বিগ্রহের স্বস্তি ও আরামের জন্য। এই জায়গার নাম বলগন্ডি। এখানে পঞ্চামৃত ও সুবাসিত চন্দন কর্পূরে আয়নায় অভিষেক হয়। পরে নানা মিষ্টি,পানীয়,খেজুর আখ,কলা,নারকেল পান দিয়ে ভোগ দেওয়া হয়। বিকেলে আবার যাত্রা শুরু হয়ে সন্ধ্যায় গুন্ডিচা বাড়ি পৌঁছায়। সেখানে ভোগরাগের ব্যবস্থা।এখানেই আটদিন প্রভু জগন্নাথ দেবের পূজা ও ভোগরাগের ব্যবস্থা। এর আটদিন পরে প্রভুর পুনর্যাত্রা সম্পন্ন হবে। বিশ্বাস,লোককথা,আচার,রীতি সবার উপরে আনন্দ এই রথযাত্রার মহান অনুভুতি। এ উৎসব প্রাণের উৎসব। প্রভুর চরণে প্রার্থনা —আমাদের জীবনরথ যেন এভাবেই চলমান থাকে, পরমানন্দে মোক্ষধামে পৌঁছাতে পারি প্রভু।
জয় জগন্নাথ।

*তথ্য সংগ্রহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে।*


লেখক পরিচিতি : মিত্রা হাজরা
আমি মিত্রা হাজরা, ঝাড়খণ্ডের চাইবাসায় থাকি। ডিএ ভি পাব্লিক স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষিকা, আকাশবাণী চাইবাসা কেন্দ্রের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন উপস্থাপিকা। অবকাশে গল্পের বই,কবিতা পড়ে সময় কাটাই। টুকটাক লেখালিখি করি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা আহ্বান - বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন