লেখক : মিত্রা হাজরা
“শ্রীরামচন্দ্র কৃপালু ভজমন হরণভবভয়দারুণ্
নবকঞ্জলোচন কঞ্জমুখ করকঞ্জ পদকঞ্জারুণম্।” – তুলসীদাস।
হে মন! কৃপালু শ্রীরামচন্দ্রজীর ভজনা করো। তিনি সংসারের জন্মমৃত্যুরূপী দারুণ ভয়হারী। তাঁর নেত্র নববিকশিত কমলের অনুরূপ। তাঁর মুখমন্ডল হস্তচরণদ্বয় লালকমল সদৃশ। এই রামচন্দ্রস্তুতি গোস্বামী তুলসীদাস বিরচিত বিনয় পত্রিকার অন্তর্গত একটি প্রারম্ভ স্তুতি।ষোড়শ শতাব্দীতে সংস্কৃত ও অবধী ভাষায় এটি রচিত।
“কন্দর্প অগণিত অমিত ছবি নবনীলনীরদ সুন্দর
পটপিতমানহু তাড়িত রুচি শুচি নৌমিজনকসুতাবরম্।” – তুলসীদাস।
অগণিত কামদেবও তাঁর সৌন্দর্যচ্ছটায় ম্লান। তাঁর শরীর নবীন নীল সজল মেঘের মত সুন্দর বর্ণ। সে শরীরে মেঘের মত বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এই পাবনরূপ জানকীপতি শ্রীরামকে প্রণাম।
তমসা নদীর তীরে মিথুনরত ক্রৌঞ্চের একটিকে ব্যাধের শরবিদ্ধ দেখে শোকাকুল বাল্মীকির উচ্চারিত বাক্যই রামায়ণের মূল উৎস। রামায়ণ আমাদের মহাকাব্য। ঋষি বাল্মীকি রামচন্দ্র কে মহাকাব্যের বীরনায়করূপে বর্ণনা করেছেন। মহর্ষি বাল্মীকি নারদ কে প্রশ্ন করেন, অধুনা এই ভূমন্ডলে এমন কে আছেন যিনি গুণবান, বীর্যবান, ধর্মজ্ঞ, কৃতজ্ঞ, সত্যবাদী, দৃঢ়ব্রত, সদচরিত্র, সকল প্রাণীর হিতৈষী?
নারদ উত্তর দেন, এতগুলি গুণের সমাহার একজন ব্যক্তিরই আছেন এই ভূমন্ডলে – অযোধ্যার রঘুপতি রাম। এই প্রশ্নোত্তরের মধ্যেই রামচন্দ্রের সুমহান চরিত্রের প্রকাশ ঘটেছে। রামচন্দ্র নিজেকে অবতার বলে উল্লেখ করেননি কখনও। মহর্ষি বাল্মীকিও কখনও সুস্পষ্টভাবে লেখেন নি। কিন্ত রাম সাধারণ মানব নন। তাঁর প্রতিটি কাজই ঐশী ভাবনার প্রকাশ।
রামায়ণ কতটুকু সত্য ঘটনা আর কতটুকু রূপক, বাল্মীকি রামের সমকালীন কিনা – এই নিয়ে বিভিন্ন সময়ে অনেকের মনেই অনেক প্রশ্ন এসেছে। তবে রাম বিষয়ক গাথা ও জনশ্রুতি অতি প্রাচীন, এবং সেই অবলম্বনে বিভিন্ন কালে বিভিন্ন কবি ও লেখক নিজরুচি অনুযায়ী তার বর্ণনা করেছেন। তুলসীদাস, কৃত্তিবাস প্রভৃতি কবিরা বাল্মীকির যথাযথ অনুসরণ করেন নি। আখ্যানের অনেকাংশই পুরাণাদি থেকে নিয়েছেন। বাল্মীকি রামকে সুখদুঃখের অধীন মানুষ হিসাবে চিত্রিত করেছেন। কিন্তু কৃত্তিবাস আদি রামচরিত্রে ঐশী শক্তি জুড়ে দিয়েছেন, তাঁকে মর্যাদা পুরুষোত্তম বলেছেন, তাঁকে বিষ্ণুর সপ্তম অবতার রূপে চিত্রিত করেছেন। তিনি পিতৃসত্য পালনের জন্য চোদ্দ বছর বনবাসে কাটিয়েছেন, বিলাসব্যসন ত্যাগ করেছেন, অসাধারণ ধৈর্য্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু প্রজার জন্য বিনাদোষে নিজের প্রিয়তমা স্ত্রীকে ত্যাগ করেছেন। এখানেই প্রশ্ন থেকে যায়, এই কি রামোচিত কাজ? তিনি শম্বুক হত্যা, বালি হত্যার মত হীন কার্যও করেছেন। রামরাজত্বে বিদ্যাশিক্ষার কোন অধিকার শুদ্রের ছিল না, ছিল না জ্ঞানচর্চা, শাস্ত্রচর্চা, তপস্যা করার অধিকার। এই রামচন্দ্র কিভাবে ভগবানের অংশ হতে পারেন? ভগবানের কাছে কি ছোট বড়, জাতপাত ভেদাভেদ থাকে? তাহলে রামরাজত্ব কি শুধুই কথার কথা?
লেখক পরিচিতি : মিত্রা হাজরা
মিত্রা হাজরা, বাসস্থান ঝাড়খণ্ডের চাইবাসায়। ডিএভি পাবলিক স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষিকা, আকাশবাণী চাইবাসা কেন্দ্রের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন উপস্থাপিকা। অবকাশে গল্পের বই, কবিতা পড়ে সময় কাটান।