জলছবি

লেখক : আলী ইব্রাহিম

মিরা,
আজ এই জলট্রেনে আমার আর বসার কোনো জায়গা নেই।
দাঁড়িয়ে আছি পিরামিড হয়ে।একা। তুমি কাছে নেই।
জলের ওপর তোমাকে দেখছি। তোমার সাদা কালো ছবি আঁকছি।
সেখানে এই আলী ইব্রাহিমের কবি হওয়ার গল্প লিখছি।
কিন্তু সাদা কালো ছবিতে তোমাকে আজ চিনতে পারছি না।
না! না! চিনতে পারছি না! সেদিন তোমার মন’টা এরকম ছিল না।
সেদিন তোমার চাহনি এরকম ছিল না। কপালের টিপ এরকম ছিল না।
এই নাক, এই চোখের মানুষটি সেই তুমি নও। না! না! এই ছবিটি তুমি নও!
তোমাকে আজ অবিকল আঁকতে পারছি না! আঁকতে পারছি না!
সেই স্বপ্ন! সেই অনুভূতি! সেই আকাঙ্খা! আঁকতে পারছি না!
সেই রংধনু মন! সেই কুয়াকাটা মুখ! আঁকতে পারছি না!
তোমার ডান চোখে তিল ছিল। আঁকতে পারছি না।
তোমার হাসিতে টোল পরতো। আঁকতে পারছি না।
তোমার চিন্তায় দার্শনিক অরুণ ছিল।আঁকতে পারছি না।

সামনে পোড়াগ্রাম। চারদিকে বিভ্রান্তির উত্তাপ। মুখচোরা পাখিদের চাওয়াচাওয়ি;
সেখানে নিরুত্তর প্রশ্নবানে কেবলি ক্ষত বিক্ষত করছি তোমাকে ও আমাকে।
আজ সেখানে কিছুতেই সেই তোমাকে আঁকতে পারছি না!

মিরা,
একবার এক জলপাখির সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল।
তার আগমনে কিঞ্চিৎ হৃদয় নেচে উঠেছিল। জলঘরে প্রজাপতি বসেছিল।
কিন্তু আমি কেবল ছুটে গেছি তোমার অধরে! তোমার ফাগুনঘরে!
সেই পাখিটা আমার জন্যে অপেক্ষা করেছিল। আমি তার জন্যে এক পা’ও এগোয়নি।
তুমি চাওনি। তাই তার ডানায় উড়িনি। তুমি চাওনি। তাই প্রজাপতি ধরিনি।
তুমি আমাকে কবি হতে বলেছিলে। তাই কবি হয়েছি।মানুষ হইনি।

মিরা,
গতকাল বন্ধু আসিফ ফোন করেছিল।
ওর গ্রামের মানুষজন ওকে মিরাজ নামেই চেনে।
বললো, কি রে কবি! কী খবর তোর?
বউ মেয়ে নিয়ে আছিস কেমন? বাড়ি গাড়ি কিছু হলো!
আরও বললো, রাজিব ঢাকায় জায়গা কিনেছে।
মুরাদও বাড়ি করেছে সেখানে। আমিও ঢাকায় স্থায়ী হবো।
বাছেদ এখন আমেরিকায়। ওদের একটা মেয়ে আছে। একটা ছেলেও।
দিলিপ, টুটুল, মামুন; সবাই ভালো আছে। বিয়ে করেছে।
তোর খবর কী?

মিরা,
সেদিন কমলাপুর স্টেশনে তোমার বন্ধু বিথির সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
বললো, এই যে কবি! তা তোমাদের গল্পটা কী শেষ হলো!

আমি বিথিকে কিছুই বলিনি। বলতে পারিনি। কথার আড়ালে এড়িয়ে গেছি।
আমি আসিফকেও আমাদের কোনো খবর দিতে পারিনি। দেইনি।
যে বন্ধুদের একসময় বলতাম, মিরা আমার বউ হবে। ছোট্ট একটা ঘর হবে।
আমাদের ঘরে আগে মেয়েই হবে।মেয়ে হলে নাম রাখবো ইসরাত জাহান ইরা।
সেইসব বন্ধুদের অপেক্ষায় রেখেছি। কিছুই বলতে পারছি না আজ। কিছুই না।

মিরা,
তুমি আমাদের বন্ধুদের বলে দাও, আমাদের আর দেখা হবে না।
সেই দিন! সেই স্বপ্ন! আর আসবে না। ছোট্ট ঘরে বাবা বলে কেউ ডাকবে না।
আজ এই জলজমিনে পাথর হয়ে গেছি! কাউকে কিছুই বলতে পারছি না।
এখন শব্দ সাজাতে গিয়ে ধ্বনিগুলো এক এক করে পালায়।
এখন শরীর থেকে মাংস খসে পরে পোকা হয়ে মাটিতে লুটোপুটি খায়।

মিরা,
আজ সকালে বন্ধু রফিক ফোন করেছিল।
বললো, দোস্ত! এক হাজার টাকা ধার দিতে পারবি?
রফিক রাজনীতি করে। এখন রাষ্ট্রদ্রোহী মামলার আসামি।
শুনেছি আদালতে হাজিরা দিতে দিতে চাকরিটাও চলে গেছে।
এখন কী করছে জানতে চাইনি।
তবে এইটুকু বুঝলাম নিদারুণ কষ্টে আছে।
আমার অক্ষমতায় সেও কষ্ট পেলো বোধ হয়।
ভাগ্গিস রফিক তোমার সম্পর্কে কিছু জানতে চায়নি!

মিরা,
তোমাকে ভালোবেসে আজও আমার সমুদ্রে যাওয়া হলো না।
তোমাকে ভালোবেসে আজও আমার আকাশ ছোঁয়া হলো না।
তোমাকে ভালোবেসে আজও আমার বৃষ্টি দেখা হলো না।
তবে তোমার কথামতো আজ আমি কবি হয়েছি। কবি!
আজ আমার শরীরের একেকটি সুখের নাম কবিতা।
আজ আমার শরীরের একেকটি অসুখের নাম কবিতা।

মিরা,
আজ এই জলের ওপর তোমার দাঁত এঁকেছি। নখ এঁকেছি। আগুন এঁকেছি।
কিন্তু তোমার জলছবিটা কিছুতেই আঁকতে পারছি না! তোমাকে আঁকতে পারছি না!


লেখক পরিচিতি : আলী ইব্রাহিম
সহসম্পাদক, দৈনিক করতোয়া, চকযাদু রোড, বগুড়া।

2 Comments

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা আহ্বান - বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন