লেখক : ইচ্ছেমৃত্যু
।। মর্টেম।।
ছ’ ফুট দু’ ইঞ্চির শরীরটা যেন কুঁকড়ে ছোট হয়ে আসতে চাইছে। ডায়েরিটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বুকটা চেপে ধরে। হঠাৎ এই ব্যথার কোনো যুক্তি খুঁজে পায় না সে। এর আগে বুকের কাছে পিন ফোটানো ব্যথা দু-একবার অনুভব করলেও এরকম অসহ্য কোনদিন বোধ হয়নি। সারাদিনে খাওয়া দাওয়া বা অন্য কোনও অনিয়ম অন্তত আজ হয়নি – তাই এই অসহনীয়তার কারণ বোধগম্য হয় না তার। বাঁ হাতে বুক চেপে ধরে ডান হাত বাড়িয়ে টেবিলে রাখা জলের বোতলটা নেওয়ার চেষ্টা করে – পারে না, ছ’ ফুট দু’ ইঞ্চির শরীরটা যেন গুটিয়ে ছোট হয়ে আসছে – কুঁকড়ে যাচ্ছে ক্রমশ আর তাই নাগাল পাচ্ছে না সাধারণে হাতের নাগালে থাকা জলের বোতল। দমবন্ধ করে সহ্য করার চেষ্টাও বৃথা যায়, একটা ভয় চেপে বসে – সে কি মরে যাচ্ছে! একথা মনে হওয়া মাত্রই মোবাইলের কথা মনে পড়ে। কাওকে একটা ফোন করে বলতে হবে ডাক্তার ডেকে আনার জন্যে। আবার ডান হাত বাড়ায় বিছানার এক কোণে রাখা মোবাইলের দিকে এবং অস্বাভাবিক ভাবে এবারেও নাগাল পায়না মোবাইলের। সে কি সত্যি সত্যি ছোট হয়ে যাচ্ছে আকৃতিতে! বুক চেপে ধরে, মোবাইলটা নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেও নিতে পারে না, বরং আরও কুঁকড়ে ছোট হয়ে আসতে থাকে তার শরীর। মোবাইল বা জলের বোতল হাতে পাওয়ার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে নিস্তেজ হয়ে আসে ক্রমশ… সাড়ে ছ’ ফুটের সিঙ্গেল বেডে ছ’ ফুট দু’ ইঞ্চির সৌজিত বুক চেপে ধরে কুঁকড়ে শুয়ে থাকে।
।। প্রি-মর্টেম।।
সেদিন সন্ধ্যায় দেখা হয়েছিল বুবলির সাথে। একথা সেকথার মাঝে তাদের প্রিয় বিষয় কবিতা নিয়েও অনেক কথা হয়েছিল। সৌজিতের কাছে তার কবিতার ডায়েরি সব সময় থাকে, সৌজিতের কথায় – কবিতা তার ‘মোস্ট কনসিস্টেন্ট প্রেমিকা – প্রেম আসে, প্রেম যায় — কবিতা পাশে রয়’। বিশেষ করে প্রেম অন্য পথ নিলে কবিতাই হয়ে ওঠে তার মেঠোপথের একমাত্র সহযাত্রী, প্রেমিকারা সেই মেঠো পথে বেশিদূর হাঁটতে পারে না। আর বুবলিও কবিতার পোকা – পড়া বা শোনার। রাজযোটক এই মিলের ফলশ্রুতি সৌজিতের সমস্ত এক্সপেরিমেন্টাল লেখার প্রধান এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একমাত্র পাঠক বুবলি।
– অনেক লেখা তো শুনেছিস, আজ অ্যাক্রসটিকস নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট শোন, তবে হ্যাঁ লেখাটা শুনে মন খারাপ করলে চলবে না।
– অ্যাক্রসটিকস? সেটা আবার কি জিনিস?
– সে এক জিনিস! আমি যেটা দাঁড় করিয়েছি সেটা হল কবিতার প্রতি লাইনের প্রথম অক্ষর জুড়ে দিয়ে কারোর নাম হবে যাকে উদ্দেশ্য করে লেখা। সাধারণত এগুলো আট লাইনের হয়, আমাদের ভাষায় আট অক্ষরের নাম বাড়াবাড়ি হওয়ায় আমি একটু নিজের মতো করে নিই, প্রথম অক্ষরগুলো দিয়েই একটা মেসেজ পুরে দেওয়ার চেষ্টা করি। জানি না, ট্রাডিশনাল অ্যাক্রসটিকস কি বলে!
– বা:, দারুণ তো। শোনাও একটা।
ডায়েরির পুরনো লেখা থেকে সৌজিত পড়তে শুরু করে –
অসংখ্যবার তোকে ভুলতে চেয়ে
নিদ্রাহীন বহু বহু রাত
নতজানু হয়ে তোর ছবির সামনেতে
দিনে দিনে জমা হওয়া পাপ…পাপক্ষয়
তারপর কোনোমতে বেঁচে নেওয়া ক্যাকটাস জীবন
তোকে, শুধু তোকেই ভালোবেসে
মায়াবী ভালোবাসাহীন মাতাল জীবনে
কেন, কেন এক ফোঁটা বৃষ্টি পেল না ক্যাকটাস।
– দেখি দেখি একবার লেখাটা, ব’লে সৌজিতের ডায়েরিতে ঝুঁকে পড়ে বুবলি – ‘অ-নি-ন-দি-তা তো-মা-কে… বা: দারুণ; এটা তোমার সেই অনিন্দিতাকে নিয়ে লেখা?’
– হ্ম্ম, তবে লেখাটা ভাল না, আসলে প্রথম অক্ষরগুলোতে নজর দিতে গিয়ে অনেক সময়ই তাল কেটে যায়।
– সে যাই হোক, এটা বেশ হয়েছে। আমকে নিয়ে একটা অ্যাক্রসটিকস লেখো না প্লিজ।
– না।
– না কেন?
– না বলছি না। আমি অ্যাক্রসটিকস লেখা ছেড়ে দিয়েছি।
– কেন না? কেন ছেড়েছো?
– আসলে আমি যাকে নিয়েই অ্যাক্রসটিকস লিখেছি তাদের কারোর সঙ্গেই আমার এখন কোনো রকম সম্পর্ক নেই। হয় কেউ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আমার অ্যাক্রসটিকস হয়ে রয়ে গেছে, কেউ বা অ্যাক্রসটিকস হয়ে ছেড়ে চলে গেছে।
– আমি ছেড়ে যাবো না, দেখো।
– তৃষাও এরকম বলেছিল!
– ওওও তৃষা! হ্ম্ম হ্ম্ম ওর জন্যে তো লিখবেই। তা কি লিখেছিলে ওর জন্যে?
– তৃষা… লিখেছিলাম। পুরনো ব্যাপার, মনে করে বলতে হবে। দাঁড়া ভাবি।
একটু ভেবে সৌজিত বলতে শুরু করে –
তৃণ দিয়ে সাজিয়েছি ঘরদোর
ষাট বছর বয়সের কথা ভেবে
মেঘে মেঘে বাড়ছে বেলা বাড়ুক
টান-টান হয়ে থাকবো অপেক্ষাতে…
ওষ্ঠে তোমার রাখবো আমার ওষ্ঠ
পিপাসা মেটেনি আবাল্য যন্ত্রণা
পান করবো, গ্রহণ করবো তোমাকে
সাতপাকহীন শুকনো তৃণের ঘরে…
বলা শেষ করে সৌজিত বুবলির দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসে, বুবলিও কোনও কথা খুঁজে পায় না। আসলে প্রেমিকের পুরনো প্রেমিকাদের কথা শুনতে কারই বা ভালো লাগে!
নীরবতা ভাঙ্গতে সৌজিতই আবার বলে, ‘আমি প্রায় চার-পাঁচ জনকে নিয়ে এরকম অ্যাক্রসটিকস লিখেছি, কেউ বন্ধু, কেউ প্রেমিকা এরকম। অনিন্দিতা আর বিভাসের কেসটা আলাদা হলেও এদের কারো সঙ্গেই আমার আর কোনও সম্পর্ক নেই’।
– বিভাস বলতে তোমার সেই বন্ধু যে সুইসাইড করেছিল?
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সৌজিত বলে, ‘লেখাটা যদিও আমি ওর মৃত্যুর পরে লিখেছিলাম…’
সন্ধ্যের অন্ধকার আর নীরবতা ক্রমশ ঘিরে বসতে থাকে ওদের মধ্যে। এই ভাবে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর সৌজিত বলে, ‘নারে চল আজ উঠি’। এই বলে উঠে দাঁড়ায় সে, বুবলিও দাঁড়ায়। গঙ্গাকে পিছনে ফেলে বাড়ির পথ ধরার সময় সৌজিতের হাত নিজের হাতের মধ্যে তুলে নিয়ে বুবলি প্রায় ফিস্ফিস্ করে বলে – ‘আমাকে তোমার অ্যাক্রসটিকস ক’রো, দেখো আমি তোমায় ছেড়ে কোথাও যাবো না’।
।। পোস্ট মর্টেম।।
পরদিন সকাল। নিয়মমত রান্নার মাসি এসে, রান্না এবং অন্যান্য কাজ শেষ করেও দেখে সৌজিত ওঠেনি। এর আগে দু’একবার ডাক দিয়েও কোনও সাড়া পায়নি, গজগজ করতে থাকে – ‘কী ছেলেরে বাবা! এখনও পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে! অফিস-টফিস যাবে না নাকি! মোবাইলটাও বেজে চলেছে থেকে থেকেই তবু উঠছে না…’ কাজ সেরে চলে যাওয়ার আগে ঘরে ঢুকে ডেকে দিতে গিয়ে দেখল সৌজিত তার অভ্যাস মতই কুঁকড়ে এঁকেবেঁকে শুয়ে আছে। কাজের মাসি তার স্বভাবসিদ্ধ বাজখাঁই গলায় বলে ‘কি গো উঠবে না? অফিস টফিস নেই?’ কোনও উত্তর পায় না। আবার ডাকে, শেষে শরীর ধরে ঠেলা দেয়, তবু চুপ করে থাকে সৌজিত। ভয় পেয়ে যায় কাজের মাসি, এমন সময় ফোনটা আবার বেজে ওঠে – মাসি ফোনটার সবুজ সুইচটা টিপে কানের কাছে নেয়, ওদিক থেকে একটা মেয়ে কথা বলে ওঠে – ‘কি ব্যাপার তোমার, ফোনই ধরছো না?’
– হ্যালো, আমি সৌজিতের কাজের লোক বলছি। ও উঠছে না। তুমি কে বলছো?
– উঠছে না মানে?
– আমি ডাকছি, নাড়াও দিলাম ওকে ধরে কিন্তু উঠছে না। আমার ভয় লাগছে। তুমি আসতে পারবে?
– অ্যাঁ কি বলছেন, আমি আসছি। মিনিট পনেরো কুড়ির মধ্যেই আমি আসছি ওখানে।
বুবলি এসে পৌঁছানোর মধ্যেও কাজের মাসি বেশ কয়েকবার ওঠানোর চেষ্টা করে সৌজিতকে কিন্তু কোনও ফল হয় না। বুবলি আসার পথে তার ডাক্তারকাকুকে সঙ্গে নিয়ে আসে। ডাক্তারকাকু পরীক্ষা করে বোঝেন সৌজিত মৃত। বুবলিকে সান্ত্বনা দিয়ে ওকে সৌজিতের বাড়িতে খবর দিতে বলেন, এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজের দায়িত্ব নিজে নেন। বুবলি সৌজিতের গ্রামের বাড়িতে খবর দেয়, মিথ্যে বলে – সৌজিত অসুস্থ, ওনারা যেন তাড়াতাড়ি আসেন। ফোন সেরে নিয়ে বুবলি সৌজিতের নিথর দেহের পাশে এসে বসে, চোখ পড়ে সৌজিতের খোলা ডায়েরির দিকে, কাল কিছু লিখছিল সৌজিত, তুলে নিয়ে পড়ার চেষ্টা করে, ঝাপসা হয়ে আসে চোখ তবু পড়তে শুরু করে –
– “অ্যাক্রসটিকস লেখা ছেড়ে দিয়েছিলাম। কুসংস্কারাচ্ছন্ন নই তবু কেন জানি বারবার মনে হয় যাকে নিয়েই লিখি সে চলে যায় দূরে, তাই আর অ্যাক্রসটিকস লিখতাম না। আমি চাই না তুই-ও দূরে চলে যা, কিন্তু তোকে আঘাতও দিতে চাই না। তোর কথায় বিশ্বাস রেখে তোর জন্যে একটা অ্যাক্রসটিকস –
বুদ্ধ হেসেছেন…হাসেন…হাসবেন
বড় বোকা এই বুদ্ধ…তিনবার হাসেন
লিখিত থাক বা না থাক তোমার তেজস্ক্রিয়তায় আমি বিপন্ন
তুলকালাম করিনি তবুও, ক’রে কোনো লাভ নেই তাই
মিটমিটে আগুনের মতো নিজেই নিজেকে পুড়িয়ে নিচ্ছি
তোলপাড় হতে চাওয়া স্বপ্নগুলো তেজস্ক্রিয়তায় পঙ্গু
জানি একদিন ধ্বংস হয়ে যাব আমি – আমরা…আর তুমি
নোয়ার নৌকায় প্রাণী নয়…এবার কিছু স্বপ্ন তুলে নিও…”
সৌজিতের শেষ অ্যাক্রসটিকস সামনে খুলে রেখে স্থির হয়ে বসে থাকে অ্যাক্রসটিকসের উপলক্ষ্য।
লেখকের কথা: ইচ্ছেমৃত্যু
জন্ম বর্ধমানের বর্ধিষ্ণু গ্রামে। পেশায় নরম তারের কারিগর আর নেশায় – রীতিমত নেশাড়ু, কী যে নেই তাতে – টুকটাক পড়াশোনা, ইচ্ছে হলে লেখা – সে কবিতা, গল্প, রম্যরচনা, নিবন্ধ যা কিছু হতে পারে, ছবি তোলা, বাগান করা এবং ইত্যাদি। তবে সব পরিচয় এসে শেষ হয় সৃষ্টিতে – পাঠক যেভাবে চিনবেন চিনে নেবেন।
লেখাটি খুব ভালো লাগলো । খুব অভিনব বিষয় এবং খুব সংক্ষিপ্ত ভাবে লেখা হয়েছে। লেখাটি আর একটু বড় হলে হয়তো আরো ভালো লাগতো বা আরো কিছুক্ষণ লেখকের ভাবনার সঙ্গে থাকার সুযোগ হতো ।