আর্টিস্ট

লেখক : ঋষা ভট্টাচার্য

 

আর্ট কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র চন্দ্রচূড়। খুবই সাদামাটা স্কুল থেকে পাশ করে মামার কাছ থেকে পাওয়া একটা নীল রঙের শার্ট পরে কলেজে আসে। দ্বিতীয় বর্ষের দাদা-দিদিদের হম্বিতম্বি একেবারেই সহ্য করতে পারে না সে। মফস্বল বলে তো আরোই রেহাই নেই। আজ এই শাস্তি, কাল ধুলোয় গড়াগড়ি এই সব চলছিল। ছোটবেলা থেকে আঁকার হাত ভাল বলে স্কুলে একটা খ্যাতি ছিল। জীবনে আর্ট মাস্টার হতেই আর্ট কলেজে আসা। বাবা কাজ করেন একটা খুব সামান্য বেতনের চাকরি, তাই শহুরে হাওয়া গায়ে লাগাতে ইচ্ছে হলেও উপায় নেই। একটা মেস খুঁজে সেখানে ভাড়া মেটাতেই পকেট খালি। শহরে এমন কেউ নেই যার কাছে মাথা গোঁজার জায়গা পাবে, তাতে থাকার খরচ অন্তত বাঁচাতে পারবে।

 

যেকোনো জায়গার ছবি হুবহু এঁকে দেবার ক্ষমতা ছিল চন্দ্রচূড়ের। তাই মাঝেমধ্যে ওকে গলিতে কিংবা রাস্তার  ধারে খাতা পেন্সিল নিয়ে বসতে দেখা যেত। একদিন কলেজ চত্বরের একেবারে বাইরে এদিক সেদিক ঘুরতে ঘুরতে একটা পুরোনো বাড়ি দেখতে পেয়ে গেটের বাইরে বসে পড়ে। এইখানে অন্তত দাদাদিদিদের কোনো উৎপাত থাকবে না। প্রথমদিন সেই বাড়ির কেউ বিরক্ত করেনি। যদিও বিরক্ত করার মতো কোনো দারোয়ান ছিল না। পরদিন আবার আসে। বসে পড়ে খাতা পেন্সিল রঙ নিয়ে। আশেপাশে কোনো দোকান না থাকায় জল খুঁজতে গেট খুলে ভেতরে ঢোকে। অনেক ডাকাডাকির পরেও বাড়ির ভেতর থেকে কোনো সাড়া শব্দ নেই। এক পা, দু’পা করে গেট ছেড়ে বাড়ির দরজার কাছে আসে। না তখনও কাউকে দেখতে পেল না। কৌতূহলবশত দরজা একটু ঠেলা দিতেই, ফাঁক হয়ে গেল। মাথা ঢুকিয়ে ভেতরটা দেখে চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসার জোগাড়।

তরে পুরোপুরি ঢুকে দেখে পেল্লাই পেল্লাই সব আসবাব। ঠিক মাথার ওপর বিরাট কাঁচের শার্সি, যেখান দিয়ে সূর্যের আলো ঢুকে অন্দরমহল এমন আলোকিত করে রেখেছে যে দিনের বেলায় কোনোরকম বৈদ্যুতিক আলো নিষ্প্রয়োজন। খানিকক্ষণ তাক লাগার মতো তাকিয়ে থেকে চোখ ঘুরতে থাকে চারদিকে। একটা ওয়াটার ফিল্টার জার দেখতে পেয়ে কল ঘুরিয়ে দেখে জল নেই। স্বাভাবিক, যে বাড়িতে লোকের টিকি নেই, সেখানে জলই বা থাকবে কেন। এদিকে মাথায় অন্য বুদ্ধি খেলছে।

বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই যে ভেতরে এত সরঞ্জামের পাহাড়। এদিক সেদিক ঘুরতে ঘুরতে রান্নাঘর খুঁজে পায়, কল খুলে দেখে জল নেই। বুদ্ধি করে কলের চাবি ঘোরাতেই খানিক বাদে জল বেরিয়ে আসে। জল তো হলো, কিন্তু খুব খিদে পেয়ে গেছে। মাথায় যে বুদ্ধিটা খেলছে সেটা করতে পারলে মন্দ না। ভাবতে ভাবতে সোফায় গা এলিয়ে থাকে, কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ে। কিসের একটা শব্দে ঘুমটা ভাঙল, তখন সন্ধ্যে। মেসে ফিরতে আর ইচ্ছে করছে না। কিন্তু কেউ আসছে ভেবে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে যায়। সেখানে গিয়ে তো চক্ষু ছানাবড়া! পরপর চারটে ঘর, সবকটা খোলা। ভেতরে ঢুকে জীবনের সব দুঃখ কষ্ট কোথায় উবে যায়। আর কিছু চাই না। সব সখ আহ্লাদ এ বাড়িতেই মিটবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। ঠিক করে ফেলল এখানেই থাকবে। ভাড়া মিটিয়ে সোজা এখানে আসবে। খাওয়া দাওয়ার খরচটুকু শুধু বাবাকে দিতে বলবে, ব্যস। কিন্তু আওয়াজটা কোথা থেকে এল ব্যাপারটা বুঝতে নীচে নেমে আসে।

সান্ধ্যবাজার পত্রিকার খবর –

শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী অমূল্যরতন রত্নকারের বাড়ী থেকে উদ্ধার হয় চোর ও আততায়ী। মাত্র কুড়ি বছর বয়সী চন্দ্রচূড় নামের এক যুবক ছাত্র বলে নিজের পরিচয় দিয়ে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে। নিজেকে কলেজ পড়ুয়া ও আর্টিস্ট বলে পরিচয় দেয়। কিন্তু ব্যবসায়ীর বাড়ীতে ফাঁদ পেতেছিল পুলিশ। একেবারে হাতেনাতে ধরা পড়ে যায় চন্দ্রচূড়। অনেকদিন ধরেই অমূল্যবাবুকে প্রাণের হুমকি দিচ্ছিল কেউ। পরিবারের কোনো সদস্যকে সন্দেহ করে বাড়ি একেবারে খোলা রেখে পুলিশের হাতে চাবি দিয়ে অন্যত্র চলে যান তিনি। মাত্র দু- তিনদিনের মাথায় ধরা পড়ে সেই ব্যক্তি। বাড়ি ফিরে আসেন অমূল্যবাবু।  এখন তিনি নিশ্চিন্ত বোধ করছেন।সঠিক পরিচয়পত্র দেখাতে না পেরে চন্দ্রচূড় এখন পুলিস হেফাজতে।

দিন পনেরর মধ্যেই আরেকটি খবর সান্ধ্যবাজার পত্রিকায়-  শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী অমূল্যরতন নিজগৃহে খুন হন।

আর্টিস্টের মাথায় এখন জেলের ছাদ।

 
 


লেখক পরিচিতি : ঋষা ভট্টাচার্য
বাংলায় স্নাতক, একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে (ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি) কর্মরত। লেখালেখির পাশাপাশি গান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চর্চার মধ্যে পড়ে। বিভিন্ন সঙ্গীত গুরুর কাছে তালিমের পাশাপাশি লাইভ স্টেজ পারফরমেন্স করার অভিজ্ঞতা অর্জন। ২০১৩ সালে সপ্তর্ষি প্রকাশনা থেকে ভ্রমরের জন্য দু এক পশলা এবং ২০২৪ সালে রা প্রকাশনী থেকে প্রেমের মতো আর কিছু নয়, এই বই দুটিতে জীবনের এক বিরাট অধ্যায় ধরা আছে। বহুদিন নাট্যচৰ্চা ও অভিনয়ের সাথে যুক্ত থেকে অনেক নাট্য ব্যক্তিত্বের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা জীবনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।জীবনের ওঠা পরা নিয়েই একান্তে লেখালেখি পর্ব চলতে থাকে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।