বনানীর কাহিনী

লেখক : আলো রাণী ভট্টাচার্য্য ঘোষ

সকাল থেকেই শুরু হয়েছে হাঁকডাক হৈচৈ। বিয়ে বাড়ি বলে কথা। বনানীর দিদি বানীর বিয়ে। বাড়ি ভর্তি আত্মীয় কুটুম্ব। বাড়ি যেন গমগম করছে। নব্বই দশকের শুরুতে তখনও এত ক্যাটারিং এর ছড়াছড়ি হয়নি, বিশেষতঃ মফস্বল অন্চলে। তখন রান্না করতো বামুন ঠাকুর। হালুইকর আসতো, বাড়িতে ভিয়েন বসতো। গরম পান্তুয়া, দরবেশ কড়াই থেকে নামলেই কাকা, মামারা বাড়ির ছোটোদের ডেকে এনে টেস্ট করাতেন। সে এক মজার দিন ছিল।

যাইহোক বনানী সকাল থেকেই খুব ব্যস্ত। মা এর শরীর ভালো নয়। তাই সব দিক দেখা ছুটোছুটি করা সব একা বনানী সামলাচ্ছে। বনানী এম এস সি পড়ছে। গায়ের রং শ্যামলা হলেও মুখশ্রী খুব সুন্দর। সবচেয়ে সুন্দর তার কোমর ছাপিয়ে যাওয়া একঢাল চুল। কুটুম্বদের জলখাবারের পাট মিটিয়ে বনানী চলে গেছে রান্নার জায়গায়। প্রচুর পরিমাণে মাছ এসেছে। লোক কম। ব্যস্ কোমরে কাপড় জড়িয়ে বনানী যারা মাছ কাটছে তাদের পাশে বসে গেল। ঝপ্ ঝপ্ হাত চলছে তার। মাছ কেটেই স্নান করতে যাবে, তাই সাধারণ একটা ছাপা শাড়ি পরে সে কাজে লেগেছিল। হঠাৎ শাঁখ, উলুধ্বনি শুরু হয়ে গেল। বরের বাড়ি থেকে গায়ে হলুদ এসে গেছে। বনানীর হাত আরও জোরে চলতে থাকে। বরের বাড়ি থেকে মাছ এসেছে, সেটা নিয়ে সে বাড়ির কাজের মাসীটি ঠাকুররা যেখানে রান্না করছিল সেখানে চলে এসে বেশ জাঁকিয়ে বসলো। কীরকম জোগাড়যন্ত্র সব খবর বাড়ি গিয়ে গিন্নি মাকে দিতে হবে না! কাপড়ের খু্ঁট খুলে একটা পান মুখে দিয়ে চিবোতে চিবোতে হঠাৎ তার চোখ পড়ল বনানীর দিকে। সে বেশ মুরুব্বির মতো বলে উঠলো, “হ্যাঁ গা মেয়ে তোমার হাত তো খুব চটপট চলে। তুমি বুঝি এই ঠাকুরদের দলে কাজ করো। আহা, এই পোড়া গাঁ গঞ্জে আর কত টাকাই বা পাও!”, তার পর একটু চোখ মটকে বললে , “আমি তোমাকে গিন্নি মার কাছে নিয়ে যাবো। রাজার হালে থাকবে। আমাদের মা-টি একেবারে মাটির মানুষ। কিছু এদিক ওদিক করলেও কিচ্ছুটি বলে না। তা কি গা, তুমি বোবা না কি? রা কাড়ো না কেন?”

বনানীর মাথা হেঁট, লজ্জায়, অপমানে গাল দুটো লাল হয়ে উঠেছে, দু’চোখে জল চলে আসছে। কিন্তু তার হাত থামছে না। বড়ো ঠাকুর বনানীকে চেনে, তার গুণ, তার মেজাজ সবটাই সে জানে। সামনেই যে একটা ঝড় আসতে চলেছে সেটা সে বুঝতে পারে। হঠাৎ বনানী তীরের বেগে উঠে ভেতর বাড়িতে ঢুকে পড়ে এবং স্নান সেরে নিজের ঘরে খিল দিয়ে বসে পড়ে। অনেকক্ষণ তাকে দেখতে না পেয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মা চিৎকার করে ডাকতে থাকেন, “বনা, বনা, বনানী”! কোথাও তার কোনো সাড়া নেই। বড়োরা ভেতরে হৈচৈ শুনে চলে এসে মাকে আসল কাহিনীটি বলে। মা এর মাথায় হাত। এবার এই মেয়ের রাগ সামলাবে কে? শেষ পর্যন্ত দিদি এসে দরজায় ঘা দিয়ে কাকুতি মিনতি করতে থাকলে অবশেষে বনানী বাইরে আসে। আবার স্বাভাবিক ভাবেই কাজ কর্ম করে। এদিকে হয়েছে কি বড়ো ঠাকুরের নাতিটি যে আবার বনানীর কাছে পড়ে। সে পুরো ঘটনাটা দেখেছে ও শুনেছে। দিদির অপমানের একটা বদলা নিতেই হবে সে ঠিক করলো। সেই মাসী তখন বরের বাড়ির লোকেদের সাথে খেতে বসেছে। নাতিটি পরিবেশন করছিলো গরম ডাল। মাসীর কাছে আসতেই তার পা পিছলে গেল এবং সব ডাল সেই মাসীর গায়ে পড়লে মাসী তখন ডালে স্নান করে এক বিকট মূর্তি ধারণ করে পরিত্রাহি চিৎকার করতে লাগলো। নাতিটি টুক করে তার কানের কাছে বলে গেল, “যা যা তোর গিন্নি মার কাছে যেয়ে বল।”

এই রকম ডামাডোলের মধ্যে দিয়ে বিয়ে, বাসি বিয়ে কাটলো! বৌভাত এর দিন কন্যাযাত্রীদের মধ্যে বনানীও ছিল। সাউথ ইন্ডিয়ান শাড়ির সাথে গলায়, কানে, হাতে সোনার অলঙ্কারে সজ্জিতা, মাথায় ফুলের মালা এ বনানীকে চেনাই দায়। দিদির সাথে দেখা, কথা বলার পর বনানী তক্কে তক্কে ছিল। হ্যাঁ ঠিক, সেই মাসীকে দেখতে পেয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, ভাগ্যক্রমে তার গিন্নি মা ও সেখানে উপস্থিত। বনানী মাসীকে তার সুর নকল করে বলে উঠলো, “কি গা আমার চাকরির কিছু হলো? তোমার গিন্নি মা কতো ট্যাকা দেবে বলছে গা?” গিন্নিমার চোখ কপালে, তিনি তো বনানী কে চেনেন। এই সময় তাঁর ছেলে সামনে এসে মাকে সরিয়ে নিয়ে এর পেছনের গল্পটা যা সে বানীর কাছে শুনেছিল সেটা বলে। এদিকে গিন্নিমার মন গলানোর জন্য সেই মাসী পানের কৌটো এনে বললো, “মা, পানটা খাও গো।” গিন্নি মা বলেন, “যা দূর হ এখান থেকে।” গিন্নিমার এই আগুন ঝরানো চোখ আর কঠিন গলা শুনে মাসী তখন পগারপার। তিন দিন পর বনানীর মুখে আবার হাসি দেখা গেল।

বিয়ে বাড়ি মিটে গেল। বনানী আবার ইউনিভার্সিটি যাওয়া শুরু করলো। সামনেই পরীক্ষা। একদিন স্টেশন যাওয়ার পথে সাইকেল রিকশার চেন পড়ে গেল, বনানী অস্থির, রিকশাওয়ালা চেন ঠিক করে পৌঁছে দিল যখন তখন ট্রেন প্লাটফর্মে ঢুকে গেছে। বনানী দৌড় দৌড়, কোনক্রমে একটা জেনারেল কামরায় উঠে পড়ল। পড়ল তো বটে তবে ভিতরে অসম্ভব ভিড়, অফিস যাত্রীদের ভিড়ে বনানী একেবারে চিঁড়ে চ্যাপ্টা।

শীতকাল হলে কি হবে দৌড়নো আর ভিড়ের জন্য বনানী দরদর করে ঘামছে। উত্তরপাড়া পেরনোর পর থেকে ভিড় যেন আরও বেড়ে গেল। হাওড়া ও লিলুয়ার মাঝে ট্রেন যথারীতি দাঁড়িয়ে পড়ল কিছু সময়। হাওড়ায় নামার সময় আবার এক কান্ড।

বনানী ভিড়ের ধাক্কায় সামনে এগোতে থাকে এবং নেমে পড়ে ঠিকই কিন্তু সামনে এগোতে গিয়ে বিপত্তি, মাথার চুলে ভীষণ টান লাগছে। কী হলো! দেখে তার চুলের বিনুনি এক যুবকের সোয়েটারের বোতামের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। যুবক হাঁ হাঁ করে ওঠে, সে ঐ বোতাম থেকে বিনুনি ছাড়াতে যাওয়ায় বনানীর মাথায় টান লাগে। কিন্তু আপ আর ডাউনট্রেনের যাত্রীদের জনস্রোতের ঠেলায় তারা দাঁড়াতে পারে না। যুবক গজ্গজ করতে থাকে। বনানী বলে, “দাদা থামবেন না, চলুন, চলুন। লেট হলে আমি আর ক্লাসে ঢুকতে পারবো না।” যুবক চেঁচিয়ে বলে, “আর অফিসে লেট হলে আমার বস আমাকে ছেড়ে দেবে?” বনানী বলে, “অমন সোয়েটার পরেন কেন?” বাগ্ যুদ্ধ চলতে থাকে। সাবওয়ে শেষ বনানী হাজরা যাওয়ার বাসের সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হয়। যুবক বলে, “এ কি, আমার বাস তো এদিকে।” বনানী বলে, “গুলি মারুন আপনার অফিসে। এস সি স্যার আমাকে ঢুকতে দেবে না।” এভাবেই তারা হাজরার বাসের সামনে পৌঁছে যায়। বিনুনি তখনও বোতামে জড়িয়ে পেঁচিয়ে। বনানীর বরাত ভালো সেই সময়ই তার সহপাঠিনী কাকলী বাসে উঠতে আসে। সে সবটা দেখে তাজ্জব। তার প্রচেষ্টাতেই বোতাম ও বিনুনি আলাদা হলো। যুবক যাওয়ার সময় বলে গেল , “অমন বিনুনি রাখার কি দরকার, কেটে ফেলেন।” সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেই চিৎকার শুরু করে, “মা, মা তোমার বড় কাঁচিটা দাও এখুনি।” মা কাঁচিটা দিলেও তাঁর মনে কীরকম সন্দেহ হয়। তিনি পিছনে এসে দেখেন বনানী তার বিনুনি কাটতে চলেছে। মা আঁতকে উঠে বনানীর হাত থেকে কাঁচিটা ছিনিয়ে নিয়ে বলেন, “কী সর্বনাশ! বনা, পরীক্ষার পরই তোর বিয়ে। পাত্র তোর চুল দেখে মুগ্ধ হয়েছে আর তুই এই কান্ড করছিলি! আমার দিব্যি রইল, চুল কাটা চলবে না।” মার হস্তক্ষেপে বনানীর বেণীসংহার সে যাত্রায় রক্ষা পেল।


লেখক পরিচিতি : আলো রাণী ভট্টাচার্য্য ঘোষ
আলো রাণী ভট্টাচার্য্য ঘোষ। রিষড়া উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা। হুগলি জেলার কোন্নগরের বাসিন্দা। বই পড়া, পড়ানো আমার নেশা আছে এতেই তিনি আনন্দ পান। মাঝে মাঝে নিজের মতো করে কিছু কিছু লেখেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।