লেখক : শাশ্বতী মুন্সী
ইনভিটেশন কার্ডটা বাড়িয়ে ধরলেন সমীরণ বসু, “আমার স্ত্রীর স্কুলে রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষ্যে ফাংশান আছে। আপনি এলে ভাল লাগবে।”
আয়তকার টেবিলের ওপারে বসা উচ্চপদস্থ অফিসারের উদ্দেশে কথাটা বললেন। কার্ডটা হাতে নিয়ে প্রিয়ম জিজ্ঞেস করল, “আপনার স্ত্রী স্কুলের সেক্রেটারি?”
“না না, আমার মিসেস অ্যাসিস্টেন্ট টিচার।”
খাম খুলে কার্ডে চোখ বোলাতে বোলাতে বলল, “লিটল বাড স্কুল। নামটা তো বেশ সুন্দর।”
আলগা হেসে সমীরণ বললেন, “ঐ স্কুলে আমার দুই ছেলে পড়েছে। ইংলিশ মিডিয়াম হলেও বছরের বিশেষ কয়েকটা দিনে বাঙালি কালচারে এ’রকম অনুষ্ঠান হয়। খুদে স্টুডেন্টরা নাচ-গান-আবৃত্তি-নাটকে দারুণ পারফর্ম করে; সবাই অবাক হয়ে দেখে। স্কুলের টিচাররাই রিহার্সাল করান, ড্রেস-মেকআপের জন্য পেরেন্টদের কোনও টাকা দিতে হয় না।”
“তাই নাকি! খুব ভাল কথা। ফাংশান কি স্কুল কমপাউন্ডের ভেতরে হয়?”
“না না, কমপাউন্ডে অত জায়গা কোথায়! স্টুডেন্টদের বাড়ির লোকেরা-সহ স্কুলের তরফে আমন্ত্রিত গেস্টরা আসেন। কাছাকাছি অডিটোরিয়ামে প্রোগ্রাম হয়, একটা সিটও খালি থাকে না। আপনার জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দেব।”
প্ৰিয়ম বলল, “তার দরকার নেই। ঠিকানা আছে, রাস্তায় কাউকে জিজ্ঞেস করে চলে যেতে পারব। থ্যাংকস ফর ইনভাইটিং মি।” ভদ্রতাসুলভ ভঙ্গিতে সমীরণবাবুর দিকে ডানহাত বাড়িয়ে দিলে সৌজন্যতাবোধে উনিও হাতে হাত ঠেকিয়ে করমর্দন করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
প্ৰিয়মদের মাল্টিন্যাশান্যাল কোম্পানি উত্তরবঙ্গে নতুন ব্রাঞ্চ খুলেছে। সেখানের কাজকর্ম কেমন চলছে, কর্মীদের সুবিধে-অসুবিধে দেখাশোনার জন্য প্ৰিয়মকে পাঠানো হয়েছে। সমীরণ বসু ব্রাঞ্চ হেড। ওঁর দু’ধাপ উপরে প্রিয়মের পোস্ট। কাজকর্মের ব্যাপারে বিশদে জানতে ওঁর সঙ্গে আলাপচারিতা এগিয়েছে। সেই সূত্রে আমন্ত্রণ করলেন।
কোচবিহারে প্রথমবার এসেছে প্ৰিয়ম। দুপুরের পর অফিসের কাজ কিছু থাকে না। গেস্ট হাউসে ফিরে টিভির চ্যানেল সার্ফ করে সময় কাটাতে হয়। এই শহরে অনেক দর্শনীয় স্থান আছে, দেখতে চাইলে কোম্পানি গাড়ি দেবে। কারও সঙ্গ পেলে বেরিয়ে পড়া যেত, কিন্তু অচেনা জায়গায় কাউকে তো বলা যায় না বেড়ানোয় ওর সঙ্গী হতে! স্থানগুলো দেখার সময়-সুযোগ থাকলেও একলা বেড়াতে ভাল লাগে না। চার-পাঁচটা দিন থাকতে হবে। কালকের দিনের আমন্ত্রণ পেয়ে ভাবল অফিসের পরে অনেকটা সময় কেটে যাবে।
অফিস ট্যুরে উত্তরবঙ্গে যাবে শুনে প্ৰিয়মের মা হৈমন্তী বলেছিলেন বৌকে সঙ্গে নিয়ে যেতে। কিন্তু সে আনতে চায়নি, আর বিশাখারও আসার তেমন ইচ্ছে দেখেনি। বাড়ি থেকে অনেক দূরে অফিসিয়াল কাজের বাইরে সময় যাপনে নিজের সঙ্গে একা থাকতে চেয়েছে। একাকী যাপনে প্রেয়সীর সঙ্গে কাটানো সুখের মুহূর্তগুলো স্মৃতির পাতা উল্টে একান্তে অনুভব করতে চায় সে। সেই অবসরে তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশ নিষেধ। মন জুড়ে এখনও সেই বিশেষ মানুষটির অস্তিত্ব বিদ্যমান। ভালবেসে তার সাথেই ঘর বাঁধতে চেয়েছিল। যৌবনের মাঝপথে দুজনের রাস্তা আলাদা হয়ে কোথায় যে হারিয়ে গেল…
বাবা-মায়ের নির্বাচন করা ব্রাহ্মণ পরিবারের পাত্রীকে বিয়ে করে বছর তিনেক বিদেশে গিয়েছিল প্ৰিয়ম। বিশাখা মেয়েটা ভাল, খুব বেশি চাহিদা নেই। কিন্তু ওর সঙ্গে মানসিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। বেডরুমের চার দেওয়ালের ভেতর দাম্পত্যের স্বাভাবিক মেলামেশায় জৈবিক আকর্ষণের ছন্দ ছিল না, তবু চেষ্টা করে যাচ্ছিল। ডাক্তার টেস্টে জানতে পারে বিশাখার গর্ভ সন্তানধারণে অক্ষম, এর জন্য ওকে দোষ দেয় না প্রিয়ম। রাতে ওদের মাঝে বিছানার ফাঁকা জায়গা ভরাট করতে কেউ আসেনি। আসবেও না।
শিক্ষিত, সংস্কারমুক্ত, আধুনিক মনস্ক প্রিয়মের বাবা-মা কিন্তু প্রাচীনপন্থী মনোভাবে বিশ্বাসী। বংশমর্যাদার অপলকা ধ্বজা তাঁরা এ’যুগেও মহাদর্পে ওড়ান। মা হৈমন্তীর বদ্ধমূল ধারণা, বেজাতের মেয়ের রক্তের সঙ্গে ব্রাহ্মণ বংশের রক্ত মিশলে রক্তের শুদ্ধতা থাকবে না, বংশ অধোগামী হবে। প্রিয়মের বাবা অখিলেশবাবুও একই ধারণা পোষণ করেন। কায়স্থের মেয়ের গর্ভের সন্তান চ্যাটার্জী বাড়ির বংশগৌরবকে কালিমালিপ্ত করবে, জীবিতকালে তা কখনোই হতে দেবেন না।
শ্রমণার সঙ্গে সম্পর্কের কথা বাড়িতে প্রথমবার জানাতে একবাক্যে নাকচ করে দিয়েছিলেন ওর বাবা-মা। নিরুপায় প্রিয়ম তখন বলেছিল, “তোমার বাবা-মা প্রেমের বিয়ে মানবেন না, আর আমার বাড়ির লোকের কুসংস্কার যখন আমাদের এক হওয়ার পথে বাধার সৃষ্টি করছে, তখন একটাই পথ খোলা, পালিয়ে বিয়ে করব।”
বিস্মিত কণ্ঠে শ্রমণা প্রশ্ন করল, “পালিয়ে বিয়ে! আর তোমার চাকরি?”
“ওটা কোনও ব্যাপার নয়। আমার যা কোয়ালিফিকেশন, তাতে ইন্টারভিউ দিয়ে ভিনরাজ্যে চাকরি পেতে অসুবিধা হবে না, বরং স্যালারি এখানকার চেয়ে বেশিই হতে পারে।”
“হুম, তা বুঝলাম। কিন্তু কষ্ট করে লেখাপড়া শিখে নিজের যোগ্যতায় পাওয়া স্কুলের সরকারি চাকরির নিশ্চয়তা ছেড়ে তোমার সঙ্গে যাই কী করে বল! তাছাড়া আমরা দু’জনেই বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান, বয়সকালে ওঁদের দেখভাল করাও যে কর্তব্য।”
“তাহলে বলছ বাবা-মাকে দেখভাল করাটাই আমাদের অবশ্য কর্তব্য? নিজেরা একসাথে ভাল থাকার গুরুত্বই নেই তোমার কাছে?”
শ্রম বলেছে, “আমার চাওয়াটা তো সব নয়। নিয়তি চায় না আমরা একসাথে হাঁটি।”
এরপর শেষ দিন দু’জনের দেখা হয়েছিল তাজপুরে। গোটা একটা দিন-রাত নিবিড়ভাবে প্রিয়মের সঙ্গ-যাপন করেছিল শ্রমণা। হয়ত শেষবার। নোনা হাওয়ায় স্নাত শরীরে মেখে নেয় স্পর্শসুখের নরম উষ্ণতা। ফিরে এসে বিচ্ছেদের বাধ্যতায় অনড় সিদ্ধান্ত। ভারী পাথর-সম কষ্ট বুকে চেপে খিল দিয়েছিল মনের দরজায়।
ইতিহাসে মাস্টার্স ডিগ্রি করে পার্মানেন্ট চাকরিতে স্বাবলম্বী হওয়ার পর শ্রমণার বাবা-মা চেয়েছিলেন মেয়েকে সংসারী করতে। দু’-একটা সম্বন্ধ দেখেও ছিলেন। কিন্তু মেয়েকে সেকথা জানাতে শ্রমণার স্পষ্ট জবাব ছিল, “বিয়ে, বর, সন্তান… এই সরলরেখায় জীবন কাটাব না আমি। তবে সিঙ্গেল মাদার হতে চাই, ওর আধো-আধো স্বরে মা ডাক অন্যরকমের পূর্ণতা দেবে আমায়।“
ভারতীয় সমাজে একলা মায়ের জীবনযাপন এখনও তেমন চলতি প্রথা নয়। তাই মেয়ের এহেন মনোভাবে বাবা তপেনবাবু এবং মা প্রমীলা স্তম্ভিত হয়ে যান! “বিয়ে না করে মা হবি?”
দু’জোড়া কুঞ্চিত ভ্রু’র দিকে তাকিয়ে শ্রমণা স্পষ্ট বলেছিল, “এতে অবাক হওয়ার তো কিছু নেই মা! বৈবাহিক সম্পর্কে না গিয়ে মাতৃত্বের স্বাদ পেতে বিদেশে এর প্রচলন হয়েছে বহু দিন। গত কুড়ি বছরে বেড়েছে একক মায়ের সংখ্যা। এখন এদেশেও ধীরে ধীরে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হচ্ছে।”
“তা হলে তুই কি দত্তক নিতে চাস?” প্রশ্ন করলেন তপেনবাবু।
“না, নিজের গর্ভজাত সন্তানের মা হব।”
এবার যুগপৎ চমকিত ও বিস্মিত হলেন তাঁরা! কৃত্রিম উপায়ে গর্ভধারণের প্রক্রিয়ার ব্যাপারটা বিস্তারে জানাল বাবা-মা’কে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় অসন্তোষ দেখালেন প্রমীলা।
“চেনা নেই, জানা নেই, একজন অপরিচিত পুরুষের বাচ্চাকে জন্ম দিয়ে মা হবি?”
“বিয়ে করে মা হতে গেলে যে সেই পুরুষটির আদ্যোপান্ত চিনে, জেনে থাকি এমন তো নয়, বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্বামী নামক পুরুষটিকে আমরা ঠিকমত চিনতেই পারি না! আর এক্ষেত্রে আমি কার ঔরসজাত সন্তানের মা হচ্ছি, সেটা জানা বেআইনি। আর আমি চাইও না গর্ভজাত সন্তানের ওপর অন্য কারও অধিকার থাকুক। ও একান্ত আমার হবে।”
বিয়েতে মেয়ের যথেষ্ট আপত্তি বুঝে জোর করেননি ওঁরা। ‘মা’ ডাক শোনার প্রবল ইচ্ছার পথে বাধা দেওয়ার যুৎসই কারণ না পেয়ে মত দেন।
দেশের সর্বোচ্চ আদালত একক মাতৃত্বকে সম্মান দেয়, অথচ অবিবাহিত একলা মা’কে ভারতীয় সমাজব্যবস্থা একটু দূরে ঠেলে রাখে। তাকে ঘিরে তৈরি হয় আশপাশের লোকের কল্পনাপ্রসূত ধ্যান-ধারণা। যদিও লোকজনের কটূক্তি, অশালীন মন্তব্যের পরোয়া কোনওদিন করে না শ্রমণা। অকারণ পলায়নপ্রবৃত্তি তার স্বভাববিরুদ্ধ। কিন্তু সামাজিকতার ভদ্র মুখোশধারী লোকের বাঁকা চাহনির ব্যঙ্গাত্মক কথাবার্তায় যাতে আগত সন্তানের মনে নানা প্রশ্ন উঁকি না দেয়, তাই নির্দেশ আসার আগেই ব্যক্তিগত তাগিদে সরকারি চাকরিতে বদলি নিয়ে কোচবিহারের একটি স্কুলে জয়েন করেছিল।
“দেখ মনা, রজনীগন্ধা ফুলের গাছটা বড় হয়েছে, কিন্তু এখনও ফুল ধরল না!” বললেন প্রমীলা। কোয়ার্টার সংলগ্ন জমিতে বাগান করেছেন, নানান রকম ফুল ও কিচেন সবজির। পরিচর্যার দায়িত্ব সকালে তপেনবাবুর এবং বিকেলে ওঁর।
বিশেষ অনুরোধে একতলা সেপারেট কোয়ার্টার পেয়েছে শ্রমণা। আগাম মাতৃত্বকালীন ছুটিতে আছে। বাগান লাগোয়া বারান্দায় বেতের সোফায় বসে আনমনা দৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েছে অপরাহ্নের স্নিগ্ধ আলোয় সটান দাঁড়িয়ে থাকা পুষ্পহীন রজনীগন্ধা গাছটির দিকে। মায়ের কথায় চকিতে ভাবনা অতীতমুখী হল। মনের পর্দায় ভেসে উঠল স্বপ্নাবেশ-মাখা এক দৃশ্য…
প্রেমপর্ব চলাকালীন একটি পার্কে দেখা করত দু’জনে। তেমনই একটি শীতের দুপুরে পলাশ গাছের নিচে ঘাসের গালিচায় বসে প্রেমালাপে মগ্ন প্রণয়ী যুগল। গাছগাছালি ঘেরা পরিবেশে ভালোলাগার অনলস মুহূর্ত যাপন করত সুখের আবর্তে। শ্রমণার কোলে মাথা রেখে শুয়ে ওর ডানহাতের কোমল তালু দুই করতলবদ্ধ করেছিল। রঙিন চোখে ভবিষ্যত-স্বপ্নের জাল বুনতে বুনতে প্রিয়ম বলেছিল, “আমাদের সন্তান সে ছেলে হোক বা মেয়ে, তার এমন নাম দেব, যা সচরাচর শোনা যায় না। বেশ ইউনিক টাইপের।”
“তা, সে’রকম নাম ভেবে রেখেছ?”
“হুম, ভেবেছি বৈকি, মেয়ের নাম রাখব যোজনগন্ধা।”
যোজনগন্ধা! শ্রমণার অবাক চাহনির জবাবে বুঝিয়ে বললে, “মিলন ঋতুর শেষে পুরুষ হরিণের পেটের কাছ নাভি থেকে সুগন্ধি গ্রন্থিটি খসে পড়ে যায়। আমাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু আলাদা… মিলনের পরে আমাদের ভালোবাসার ফসল রূপে ভূমিষ্ঠ হওয়া নবজাতিকার গায়ের সুমিষ্ট আতর-গন্ধ ‘কস্তুরী’র মতো বহু যোজন দূর থেকে পাব আমি, সে পৃথিবীর যেখানেই থাকি…।”
রিলেশনশিপে ভেঙে চলে আসার আগে শ্রমণার জন্মদিনে উপহার হিসেবে রজনীগন্ধার চারা দিয়েছিল প্রিয়ম। গর্ভস্থ ভ্রূণের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চারাগাছটিও বেড়ে উঠেছিল। সেই গাছটি সাদা-হালকা সবুজে মেশা শরীরে বেড়ে উঠে বাগানের শোভা বর্ধন করছে।
ছোট্ট শিশুর আগমনে পরিবারে খুশির আবহাওয়া। নতুন সদস্যকে নিয়ে সারাদিন কেটে যায় শ্রমণার বাবা-মায়ের। চিন্তনেও এসেছে বিস্তর পরিবর্তন। মেয়ের মাথায় হাত রেখে তপেনবাবু বলেছেন, “তোর সাহসী সিদ্ধান্তের জন্য প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে ব্যতিক্রমী দৃষ্টিভঙ্গিতে জীবনকে দেখতে শিখলাম। আশীর্বাদ করি, একার অভিভাবকত্বে সন্তানকে লালন পালন কর।”
নির্ভীক মনের লড়াকু মানসিকতাই শ্রমণার মূলধন। বছর দুয়েক আগে জন্ম দিয়েছে এক ফুটফুটে শিশুর। কাঙ্ক্ষিত কন্যাসন্তান, নাম রেখেছে “যোজনগন্ধা”। ওকে ঘিরে তৈরি হয়েছে নিজস্ব এক দুনিয়া। সবচেয়ে আশ্চর্য্যের ব্যাপার সেদিনই প্রথম রজনীগন্ধার গাছে ফুল ফোটে! স্বহস্তে গাঁথা চির-অদর্শনের প্রাচীরের ওপারে থাকা মানুষটির আজ অবধি কোনও খোঁজ রাখেনি শ্রমণা। কিন্তু চোখের আড়াল করলেও মনের আড়াল করার সাধ্য কোথায়? মোবাইলের সিক্রেট ফাইলে সযত্নে রক্ষিত একত্রে মধুর সময়যাপনের অ্যালবাম-বন্দি ছবিগুলোই ওর বিগত জীবনে প্রিয়মের উপস্থিতির মূল্যবান স্মৃতি-সম্বল।
রজনীগন্ধার সুমিষ্ট গন্ধ প্রতি রাতে বাগান পেরিয়ে ঢোকে সম্মুখবর্তী ঘরে। সেই গন্ধবিধুর বাতাবরণে জ্বর নামে শ্রমণার চেতনার গহীনে। ঘোর-লাগা চোখের দৃষ্টি স্থির হয় ঘুমন্ত মেয়ের মুখের দিকে। তখন মনের বালুতটে চোরাস্রোতের ঘূর্ণিতে শুধু একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খায়, “সার্থকনামা হবে কি মেয়ের পিতৃদত্ত নামকরণ?”
“গানটা ভাল করে প্র্যাকটিস করেছিস তো?”
শ্রম জিজ্ঞেস করলে জুনি বলে, “হ্যাঁ মা, পুরো গান মুখস্থ।”
“ভাল। কিন্তু গাইতে গিয়ে যদি কোন লাইন ভুলে যাস…”
নিশ্চিত ভঙ্গিতে জুনি ঘাড় নাড়ল, “মিস তো আমায় অর্ধেক গাইতে বলেছেন। একটা লাইনও ভুলব না। তুমি সঙ্গে যাবে তো?”
“আমার স্কুলেও তো অনুষ্ঠান হবে। তু্ই দাদু -দিদুনের সঙ্গে চলে যাবি। আমি ঠিক সময়ে পৌঁছে যাব।”
“সামনের সিটে বসবে যেন আমি দেখতে পাই।” আলগা হেসে জুনি বলল, “বাগান থেকে কয়েক গোছা রজনীগন্ধা ফুল নিয়ে রবি ঠাকুরের ছবির সামনে রাখব।”
“আচ্ছা। দাদুকে বলিস ফুলের তোড়া বানিয়ে দেবে।”
অনুষ্ঠান শুরুর আগেই প্ৰিয়ম পৌঁছে গেল। সমীরণবাবুকে ফোনে ধরতে উনি বাইরে এসে ভেতরে নিয়ে গিয়ে সামনের সারিতে গেস্টদের সিটে বসালেন। “এক মিনিটে আসছি,” বলে মঞ্চের পেছনে গিয়ে তখুনি ফিরে এলেন স্ত্রী মীনাক্ষীকে সঙ্গে নিয়ে। আলাপ করিয়ে দিতে পরস্পর নমস্কার জানাল। বললেন, “আমাদের স্টুডেন্টদের অনুষ্ঠান আশা করি ভালো লাগবে।”
প্ৰিয়ম বলল, “হ্যাঁ, সেই জন্যই দেখতে এলাম।”
সন্ধে পৌনে ছ’টায় মঞ্চের পর্দা সরে গেল। বড় ফ্রেমে বাঁধানো রবি ঠাকুরের প্রতিকৃতিতে গোড়ের মালা পরানো, দু-ধারের ফুলদানিতে পুষ্পগুচ্ছ রাখা। উদ্বোধনী সঙ্গীতে দুজন ছাত্রী গাইল,
“হে নুতন দেখা দিক আর বার
জন্মের প্রথম শুভক্ষণ।”
এরপর দুজন ছাত্র বীরপুরুষ কবিতাটি পাঠ ও অভিনয়ের যুগলবন্দিতে চমৎকার পরিবেশনা করল।
মিউজিক টিচার গাইলেন “আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে।”
এরপর স্টেজে এল বছর সাত কি আটেকের একটি স্টুডেন্ট। হাতে ধরা পুষ্পস্তবক ছবির নিচে রেখে প্রণাম করল। তারপর মাইক্রফোনের সামনে এসে, “নমস্কার, আমি যোজনগন্ধা রায়।” বলে গান ধরল,
“তুমি খুশি থাক আমার পানে চেয়ে চেয়ে
তোমার আঙিনাতে বেড়াই যখন গেয়ে গেয়ে”
খুব পছন্দের নামটা শুনে প্রিয়ম চমকে উঠল! কে রেখেছে এই নাম? কচি গলায় গান শুনতে শুনতে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল শিশুটির মুখের দিকে; বাচ্চা বয়সে কী সুরেলা গাইছে…
ডানদিকের সামনের সারিতে বসে শ্রমণা মুগ্ধতায় ভরে শুনছিল। পাশে বসা খুশি চোখে ওর বাবা-মা।
নানা বয়সী স্টুডেন্টদের অভিনীত ‘তাসের ঘর’ নাটক মঞ্চস্থ হয়ে অনুষ্ঠান শেষ হল। প্রেক্ষাগৃহ ছেড়ে সবাই বেরিয়ে যাচ্ছে। ভিড় একটু পাতলা হলে যোজনগন্ধা নামের ছোট্ট মেয়েটির সঙ্গে আলাপ করার অধীরতায় বেরোল প্রিয়ম। কতকটা আন্দাজে বুঝল কোন মেয়েটি যোজনগন্ধা। বয়স্ক দুজন ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলার সঙ্গে একজন যুবতীর হাত ধরে সে হাঁটছে। প্রায় দৌড়ে ওদের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “এই যে ছোট্ট মামনি, খুব সুন্দর গান গেয়েছ তুমি।”
জুনি নরম হাসল, “থ্যাংক ইউ আঙ্কেল। আমি আরও গান শিখেছি।”
হাঁটা থামিয়ে যুবতীর দিকে তাকাতে প্ৰিয়ম বিস্মিত হল। “শ্রমণা! তুমি এখানে?”
জুনি উত্তর দিল, “এটা তো আমার মা।”
প্রমীলা বললেন, “মনা, ইনি কে? তু্ই চিনিস?”
“হ্যাঁ, মা। একসময়ের পরিচিত মানুষ।”
“যাক, তবু চিনতে পারলে।” ম্লান স্বরে বলল, “সেই যে ছেড়ে গেলে… কোনও যোগাযোগ রাখতে দাওনি।”
ফিরতে রাত হচ্ছে বুঝে তপনবাবু বলেন, “মেয়ের চেনা মানুষ যখন, কাল আমাদের বাড়ি আসুন, কথা হবে।”
বাড়ি যাওয়ার ডাইরেকশন জেনে প্রিয়ম ফেরার পথে এগোল।
এতগুলো বছর পর অপ্রত্যাশিত ভাবে শ্রমণার সঙ্গে দেখা হওয়ার আনন্দে রাতে অনেকক্ষণ জেগে রইল প্ৰিয়ম। পরদিন তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পৌঁছে গেল নির্দিষ্ট ঠিকানায়। জুনি ভারি মিশুকে। অল্পেই ওর সঙ্গে ভাব জমিয়ে নিল। একটা গানও শোনাল।
আলাদা করে শ্রমণার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে শূন্য সিঁথি দেখে প্রিয়ম জিজ্ঞেস করল, “অঘটনটা কীভাবে ঘটল?”
শ্রমণা অবুঝ চোখে তাকাতে বলল, “তোমার স্বামী মারা যাওয়ার কথা বলছি…”
“বিয়েই করিনি…তো স্বামী!”
“মেয়েকে দত্তক নিয়েছ?”
“না, জুনিকে আমি জন্ম দিয়েছি। ও আমার একার সন্তান।”
“তোর একার ছিল, এখন আর নয়।” ঘরে ঢুকে বললেন প্রমীলা। নাতনির মুখের আদলে এই যুবকটির মুখের সঙ্গে খানিক মিল পেয়ে উনি বুঝে গেছেন জুনির জন্মদাতা কে!
সেদিন নৌকার ছই-য়ের ভেতর বসে প্রেয়সীর ইচ্ছাপূরণের অঙ্গীকার করেছিল প্রিয়ম। মিলন রাতের সেই চিহ্ন শ্রমণার ভবিষ্যত জীবনের গতিপথকে ঘুরিয়ে দেয় প্রচলিত প্রথার বিপরীতে। সিঙ্গল মাদারের কথা জানাতে গিয়ে এটুকু সত্য গোপন করেছিল বাবা-মায়ের কাছে।
“ওর জানার অধিকার নেই মা।”
“একশ বার আছে। বাবার সামনে মেয়েকে চেনাবি না! এমনটা অন্যায়। শোনো প্রিয়ম, জুনি তোমাদের সন্তান। অবশ্য জুনির বাবার পরিচয় কেন লুকিয়ে রেখেছিল, আমরা জানি না।”
প্রবল বিস্ময়ে প্ৰিয়ম হতবাক! তপনবাবু নাতনিকে নিয়ে এসে বললেন, “দিদিভাই, এই আঙ্কেল হল তোর বাবা।”
জুনি অবাক, “কিন্তু মা যে বলেছে বাবা আমাদের সঙ্গে থাকে না…”
“এখন এসেছে। বাবার কাছে যাও।”
ঈশ্বর তাকে বাবা হওয়ার সুখ থেকে বঞ্চিত করেননি। প্ৰিয়ম উঠে এগিয়ে জুনিকে কোলে তুলে নিল। “তুমি আমার বাবা!” বলে দু’গালে হামি দিতে দিতে আত্মজাকে আদরে ভরিয়ে দিল।
“আমার স্ত্রী সন্তান দিতে পারেনি, তা ব’লে ওকে ডিভোর্স দিয়ে তোমার সঙ্গে নতুন করে জীবন শুরু করা সম্ভব নয়। তবে মাঝে মাঝে তোমাদের দেখতে আসব, আপত্তি করবে না তো?”
শ্রমণা বাবা-মা’র দিকে তাকালে ওঁরা চোখের ইশারায় সায় দিলেন। সে বলল, “হ্যাঁ, আসবে। আর ক’টা দিন থেকেও যাবে।”
প্রমীলা মেয়েকে প্ৰিয়মের পাশে দাঁড় করালে তপনবাবু মোবাইল ক্যামেরায় তিনজনের ছবি তুলে এই সুন্দর মুহূর্তটি ধরে রাখলেন।
লেখক পরিচিতি : শাশ্বতী মুন্সী
ফেসবুক গ্রুপগুলোয় নানা ইভেন্টে লিখেই গল্প লেখার শুরু। ঋত্বিক, অমলতাস, বৃত্তের বাইরে, সাহিত্য বিবর্তন, মেঘমুলুক, বলাকা, শরণ্য, উড়োজাহাজ ইত্যাদি পত্রিকার পুজো সংখ্যায় গল্প প্রকাশিত হয়েছে। এ বছর বইমেলায় প্রথম একক গল্পগ্রন্থ বেরিয়েছে। লেখার সাথে বিভিন্ন রকমের গল্প, উপন্যাস পড়তে খুব ভালবাসি।