চমকানি

লেখক : অভীক সিংহ

সবে গরমাগরম চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়েছি, সামনে রাখা চেয়ারটায় এসে ধপাস করে বসে পড়ল সান্যালদা। মুখে-চোখে একরাশ চিন্তামিশ্রিত বিরক্তি। এসেই বেয়ারাকে তেতো মুখে একটা চায়ের অর্ডার দিয়েই একটা সিগারেট ধরাল। সান্যালদাকে সচরাচর সিগারেট খেতে দেখিনি, তাই আজ হঠাৎ খেতে দেখে মনে হ’ল নিশ্চয়ই একটা কিছু ঘটেছে। আমি চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে একটু সাবধানতার সাথেই জিজ্ঞাসা করলাম, “কী ব্যাপার সান্যালদা? সব ঠিক আছে তো?”
সান্যালদা একটু ঝাঁঝিয়ে উঠল, “কচু ঠিক আছে। চাকরিটাই ছেড়ে দেব শালা।”
এবারে আমার একটু চিন্তা হল, কেস সিরিয়াস। আবার জিজ্ঞাসা করলাম, “কী হয়েছে বলত গুরু? সক্কাল সক্কাল এত তিরিক্ষি মেজাজ কেন? কিছু বাওয়াল-টাওয়াল হয়েছে নাকি?”
প্রশ্নটায় সান্যালদার মাথার আগুনে যেন ঘৃতাহুতি হ’ল। সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে চেয়ারে সোজা হয়ে বসে উচ্চৈঃস্বরে হাত-পা নেড়ে পরের দশ মিনিট ধরে যেটা বলে গেল, সেটার সারমর্ম করলে দাঁড়ায় – বছরের শেষে সান্যালদা যে পারফরমেন্স বোনাসটা পেয়েছে, সেটা তার প্রত্যাশার থেকে অনেকটাই নীচে। কলেজের অনেকেই অপেক্ষাকৃত কম কাজ করেও বেশি বোনাস পেয়েছে, আর সেটা সান্যালদার একচোখামি বলে মনে হয়েছে। সেখান থেকে দুঃখ, দুঃখ থেকে রাগ। সান্যালদার জন্য আমারও খারাপ লাগল। সারাবছর মানুষটা কলেজের জন্য যথেষ্ট কাজ করে। তাই বছরের শেষে ন্যায্য প্রত্যাশায় এইভাবে কেউ জল ঢেলে দিলে রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমি ব্যাপারটা বুঝে সান্যালদাকে একটু শান্ত করার চেষ্টা করলাম, “এই সান্যালদা, একটু শান্ত হও। এত রাগ করো না, প্রেসার বেড়ে যাবে।”
“আরে রাখো তোমার প্রেসার,” সান্যালদা উত্তেজিত স্বরে বলল, “সারা বছর কুত্তার মত কাজ করে এই তার প্রতিদান। শালা মালটাকেই প্রেসার কুকারে পুরে দু’টো সিটি দিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।”
“হ্যাঁ, ঠিকই তো,” আমি সায় দিলাম, “আমারও তো বোনাসে কাঁচি পড়েছে।”
“তোমারও?” সান্যালদা আমার দিকে চাইল।
“আবার কি,” আমি চায়ের কাপটা রেখে বললাম, “উপরওয়ালা নিজের পেয়ারের লোকেদেরকেই তোয়াজ করেছেন, আর কি।”
“ধুর শালা, সক্কাল সক্কাল মেজাজটাই বিগড়ে গেল।” সান্যালদা বিরক্তির সাথে বলল।
“তার চেয়ে চল, ক্যাণ্টিনে কিছু খেয়ে আসি।” আমি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালাম। “আমারও মনটা ভাল নেই, তোমারও তাই। ক্যাণ্টিনে গিয়ে কিছু খেলে একটু মাথাটা শান্ত হবে।”
“তাই চল। আজ কাজের নিকুচি করেছে।” বলে সান্যালদাও চেয়ার থেকে উঠে পড়ল।
দু’জনে মিলে এগোলাম ক্যাণ্টিনের দিকে। আজ দেখি সকালে সিঙাড়া আর জিলিপি বানিয়েছে। দু’প্লেট নিয়ে আমরা দু’জনে একটা টেবিল দখল করে বসলাম। পেটে গরমাগরম সিঙাড়ার সাথে উপরওয়ালাকে বেশ কয়েক রাউণ্ড খিস্তি দেওয়াতে মাথাটা একটু শান্ত হ’ল। খেতে খেতে সান্যালদা হঠাৎ বলে বসল, “এটা নিজের এলাকা হলে, হুঁ-হুঁ বাওয়া, একেবারে ঘোল খাইয়ে ছেড়ে দিতাম। আমি যে কী চিজ, সেটা বাই বোন ম্যারো বুঝিয়ে দিতাম।”
“আমি তো অলরেডি বুঝিয়ে দিয়েছিলাম একবার।” আমি সিঙাড়ায় কামড় দিতে দিতে বললাম।
“কাকে?” সান্যালদা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল।
“কাকে আবার? আমার পুরনো বসকে।” আমি খেতে খেতে উত্তর দিলাম। “নিজের এলাকায় নিয়ে গিয়ে যা চমকেছিলাম না – আ হা হা, ভাবলেও রোমাঞ্চ লাগে। শুনলে তুমিও চমকে যাবে।”
“তাই নাকি? ইণ্টারেস্টিং কেস তো, বলো শুনি।” সান্যালদা একটু নড়েচড়ে বসল। “তাছাড়া আজ আর একদম কাজ করবার ইচ্ছে নেই। তোমার এই কেসটা আজ যে কোন কাজের থেকে অনেক বেশি ইম্পর্ট্যাণ্ট। উপরওয়ালাকে বাঁশ দেওয়ার কিছু আইডিয়া চাই। তুমি শুরু করো।”
“দাঁড়াও, আরও একপ্লেট করে সিঙাড়া আর জিলিপি নিয়ে আসি। খেতে খেতে বলব।”
যেমন ভাবা, তেমনই কাজ। আরও দু’প্লেট সিঙাড়া আর জিলিপি নিয়ে আমরা বেশ তরিবৎ করে টেবিলে জমিয়ে বসলাম। গরম জিলিপিতে একটা সপ্রেম কামড় দিয়ে আমি গল্প শুরু করলাম।

সে অনেকদিন আগের কথা। সদ্য এমবিএ করে বেরিয়েছি, চাকরি করছি মুম্বাইতে একটা আইটি কোম্পানিতে। আমাদের ক্লায়েণ্ট ছিল একটা সরকারী ব্যাঙ্ক। কিছু বিশেষ কারণে নামগুলো বলছি না, কারণটা পরে বুঝতে পারবে। তো প্রথম প্রথম ঢুকে কাজ বুঝতে একটু অসুবিধে হলেও শিখে নিতে বিশেষ সময় লাগল না। আস্তে আস্তে বস এবং অফিসের অন্যান্য সহকর্মীদের সাথেও বেশ জমে গেল, কাজকর্মও বেশ ভালভাবে চলতে লাগল। কিন্তু হায়! কে জানত যে রাজনীতি নামের বস্তুটি অফিসের মধ্যেও সম্পূর্ণরূপে স্বমহিমায় বিরাজমান, আর যেটা সম্পর্কে আমি একেবারেই আনাড়ি। আমার সাথেই আমার টিমে যোগদান করেছিল আরেকজন, নাম নিলয়। চাকরির প্রথমদিন থেকেই লক্ষ্য করছিলাম, নিলয় বসকে খুবই খাতির করে চলত। সময়ে-অসময়ে বসের কেবিনে গিয়ে পড়ে থাকা, মিটিংয়ে বসকে অনর্থক প্রশংসায় ভরিয়ে দেওয়া, পারলে নিজের হাগামোতার সময়টাও বসকে জিজ্ঞাসা করে ঠিক করা – এটা ছিল ওর রোজকার ব্যাপার। তার সাথে চলত যে কোন বিষয় নিয়ে অতি উচ্চমার্গের বাতেলা দেওয়া, যাতে সেটা বসের কান অবধি গিয়ে পৌঁছোয়। আর আমি রোজ সময়মত অফিসে আসতাম, আর রোজকার কাজ সামলে অফিস থেকে চলে যেতাম – বাতেলাবাজি অথবা বসকে তেল মারার ধারপাশ দিয়েও যেতাম না। নিজের কাজ নিয়েই থাকতাম, আর অন্যের কাজে নাকও গলাতাম না। ভেবেছিলাম এটা করলেই হয়ত অফিসের রাজনীতি নামক জিনিসটি থেকে দূরে থাকা যায়। কিন্তু আমার এই ধারণা যে বাঁশঝাড় হয়ে আমারই চেয়ারের নীচে ক্রমবর্ধমান, সেটা ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি।

দেখতে দেখতে কয়েকমাস পরই চলে আসল বার্ষিক মূল্যায়নের সময়, যেটাকে বলে পারফরমেন্স অ্যাপ্রেইসাল। গোটা বছরে বেশ কয়েকটা ভাল কাজ প্রায় একাই নিজের দায়িত্বে নামিয়েছি, তাছাড়া ছোট্ট একটা টিমও বানিয়েছি, আশা করছিলাম পারফরমেন্স বোনাসটা হয়ত ঠিকঠাকই আসবে। কিন্তু আমার সেই গুড়ের হাঁড়িটা কেউ যে তুড়ি মেরে সাহারা মরুভূমি বানিয়ে দিতে পারে, সেটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। বোনাসের লিস্টে আমার নাম দেখি একটু তলানির দিকে, আর নিলয়ের নাম বেশ উপরের দিকেই। আমি তো দেখে হাঁ। সহকর্মীদের প্রায় সকলেই জানত কাজের নিরিখে নিলয় আমার থেকে বেশ পিছিয়ে, কিন্তু বোনাসের লিস্টে এইরকম একুশে আইনমার্কা অবস্থা দেখে তারাও একটু অবাক। শুধু অবাক হলেন না আমার একজন বয়ঃজ্যেষ্ঠ সহকর্মী, অনিলাভ – সবাই ওনাকে অনিলাভদা বলেই ডাকত। আমার তো তখন মাথায় ভিসুভিয়াস, বসকে সামনে পেলে সাক্ষাৎ রঞ্জিত মল্লিকের অবতার হয়ে যাব। নিজের টেবিলে গুম মেরে বসে আছি, কারও সাথে কোন কথা বলছি না। কেউও আমায় ঘাঁটাতে বিশেষ সাহসও পাচ্ছে না। শেষে অনিলাভদা ধীরপদে আমার কাছে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে মৃদু হেসে বললেন, “কী রে, মাথা গরম বুঝি?”
“এখন প্লিজ ঘাঁটিও না অনিলাভদা, ছেড়ে দাও।” আমি মাথা নীচু করেই উত্তর দিলাম।
“জীবনে প্রথমবার এই লেভেলের ধাক্কা খেলি তো, আমি তোর দুঃখটা বুঝি।” অনিলাভদা হালকা হেসে বললেন, “ছেড়ে দে, ওঠ, আমার সাথে আয়। আজ আর কাজ করতে হবে না।”
“কোথায়?” আমি মাথা তুলে জিজ্ঞাসা করলাম।
“ফ্রাস্ট্রেশন কাটানোর ক্লিনিকে যাব, চল চল, ওঠ,” এই বলে অনিলাভদা অন্য সহকর্মীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বসকে বলে দিবি, আমি অভীককে নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছি। ফোন যেন না করে।”
সেদিনের মত কাজ করার ইচ্ছেটা চলেই গিয়েছিল। তাই আমিও আর কথা না বাড়িয়ে চেয়ার থেকে উঠে অনিলাভদার পিছু নিলাম। অফিস থেকে বেরিয়ে সামনে একটা বারে গিয়ে ঢুকলাম দু’জনে। একটা টেবিল দখল করে দুটো বিয়ারের অর্ডার দিয়ে অনিলাভদা শুরু করলেন, “জীবনে প্রথমবার কাজ করতে ঢুকেছিস তো, তাই তোকে একটা গুরুমন্ত্র শিখিয়ে দিই। যে বাচ্চা কাঁদে না, সে কিন্তু মায়ের দুধও পায় না। এই মন্ত্রটা মনে রাখবি, দেখবি জীবন একেবারে মাখন হয়ে গিয়েছে।”
“বাহ, কথাটা খুব ভাল বলেছ কিন্তু অনিলাভদা। কিন্তু তবুও, এটা কি আমার সাথে অন্যায় হল না? শালা সারা বছর খাটলাম আমি, আর ওই নিলয় মালটা জাস্ট ফোঁপরদালালি করে বেরিয়ে গেল। এটা কি মেনে নেওয়া যায়?” আমি আক্ষেপের সুরে বললাম।
“ধুর পাগলা, এই তো সবে শুরু রে, এখনও কত কিছু বাকি। এই সব দেখে দেখেই তো চুল পেকে গেল রে। এইটুকু অন্যায়তেই ধৈর্য্য হারালে চলবে? এই ঢ্যামনা মালগুলোকে ড্রিবল করেই তো গোল করতে হবে রে।” অনিলাভদা হাসতে হাসতে বললেন।
“সেটা অবশ্য সত্যি কথা। জগৎ তো এই রকম মালেদের দিয়েই ভরা। তবে ওই বসটাকে যেদিন নিজের এলাকায় পাব, সেদিন বুঝবে আমি কী জিনিস।” আমি বিয়ারের বোতলটা হাতে চেপে ধরে বললাম, “এই চিল্ড বিয়ারের দিব্বি গেলে বলছি মাইরি, পিছনে পুরো বাঁশঝাড় গুঁজে দেব।”
“লেটস্‌ চিয়ার্স টু দ্যাট।” বলে হাসতে হাসতে অনিলাভদা নিজের বিয়ারের বোতলটা তুলে ধরলেন।
দুজনে মিলে বোতলে টুং করে বিয়ারে চুমুক দিলাম। খেয়াল করলে দেখতে পেতাম, সেদিন আমার ভাগ্যদেবতাও হাতে সোমরসের পেয়ালা নিয়ে আমাদের সাথেই চিয়ার্স করছিলেন। সেটা বুঝতে পারলাম পরে।

দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে প্রায় দেড় বছর। এই দেড় বছরে অফিসে বেশ ঘাঁটি গেড়ে বসেছি। কাজকর্মে আমার বেশ নাম হয়েছে, টিমে আরও নতুন জনতা যোগ দিয়েছে, দায়িত্বও বেড়েছে। এমনই এক সময় একদিন সকালে হঠাৎ বসের জরুরি তলব। “শোন অভীক, একটা জরুরি কাজ আছে। তোকে এপ্রিল মাসে কলকাতায় যেতে হবে রে, এ’বছরের অ্যানুয়াল ক্লোজিংয়ের কাজটা তোকেই দেখতে হবে।”
“আমাকে?” আমি একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করলাম, “ওটা তো প্রত্যেক বছর অনিলাভদাই দেখেন। কিছু সমস্যা হয়েছে নাকি?”
“না না, আসলে ও একটা পারিবারিক সম্পত্তিগত ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছে। কোর্টে হাজিরা আছে এপ্রিলের ওই সময়টা করেই। তাই ও যাবার আগে তোর নাম প্রস্তাব করে দিয়ে গিয়েছে।”
“ঠিক আছে, নো প্রবলেম, সামলে দেব। কবে যেতে হবে?”
“এই এপ্রিলের দশ তারিখ নাগাদ। টিকিট আমরাই কেটে দেব, আমিও যাব তোর সাথে।”
বসের শেষ কথাটায় মাথার ভিতর অনেকদিনের ঘুমিয়ে থাকা পোকাটা একটু নড়ে উঠল। ‘নিজের এলাকা’, ‘বদলা’, ‘বাঁশঝাড়’ – সব এক এক করে মাথার মধ্যে জেগে উঠল। তাহলে কি এতদিনে উপরওয়ালা মুখ তুলে চেয়েছেন? মনের উত্তেজনাটাকে যথাসাধ্য চেপে রেখে বললাম, “আপনিও কলকাতা যাবেন?”
“হ্যাঁ। প্রথমবার ক্লোজিং করতে যাচ্ছিস তো, তাই তোকে একটু গাইড করে দেব।”
“তাহলে তো খুবই ভাল হয় স্যার।”
আমার মাথার পোকাটা ততক্ষণে নাচানাচি শুরু করে দিয়েছে। মনের মধ্যে সযত্নলালিত পাশবিক প্রতিশোধস্পৃহাটা একেবারে দন্তবিকাশ করে অট্টহাস্য করতে লেগেছে। দেড় বছর অপেক্ষার পরে শিকার নিজের এলাকায় আসতে চলেছে। উফফ, ভাবতেই রোমাঞ্চকর লাগছে। একবার হাতের নাগালে পেলে মালটাকে ছাল ছাড়িয়ে, নুন মাখিয়ে রোস্ট করব, না তেলে-ঝোলে কষব, সেইসব ভাবতে ভাবতেই যাত্রার দিন চলে আসল।

সক্কাল সক্কাল কলকাতা নেমে বসকে পার্ক হোটেলে গুঁজে দিয়ে নিজের বাড়ি পালালাম। পরের দিন সকালে ব্যাঙ্কে হাজিরা দিতে হবে, তারপরে কাজ শুরু। আজকের দিনটা বিশ্রাম। সারাদিন বাড়িতে বসে আকাশপাতাল ভেবেও বসকে বাঁশ দেওয়ার জন্য একটা ঠিকঠাক প্ল্যান খাড়া করে উঠতে পারলাম না। কিছুটা মনমরা হয়েই পরের দিন ব্যাঙ্কে গিয়ে হাজির হলাম। ব্যাঙ্কের অফিসটা পার্ক স্ট্রীটে, ট্রিঙ্কাস থেকে একটু এগিয়ে। বস আসল কয়েক মিনিট পরেই। তো ব্যাঙ্কে পৌঁছে সিনিয়র ম্যানেজারের সাথে কিঞ্চিৎ খেজুরে আলাপ সেরে ক্লোজিংয়ের কাজ শুরু করলাম। বেশ লম্বা কাজ, প্রায় ৩-৪ দিন লাগবে। প্রথম দিনের কাজ শুরু হয়ে এগোতে এগোতে সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এল। সেদিনকার মত কাজ স্থগিত রেখে আমি আর আমার বস – দু’জনে মিলে ব্যাঙ্কের বাইরে বেরিয়ে আসলাম। এপ্রিলের দিকটায় কলকাতায় বেশ গরম পড়তে শুরু করেছে। তাছাড়া সারাদিন এয়ার কণ্ডিশনারের ভিতরে বসে কাজ করার কারণে বাইরে বেরনো মাত্র গরমটা যেন আরও বেশি লাগছিল। ফুটপাতের উপরে আমরা দু’জনে দাঁড়িয়ে। আমার তবুও কলকাতার গরমের অভ্যেসটা আছে, কিন্তু বস তো দাক্ষিণাত্যের মানুষ, কলকাতার প্যাচপেচে গরমের অভ্যেস নেই। গরমের চোটে সে তো কুলকুল করে ঘামছে। এমন সময় বস ঘাম মোছার জন্য পকেট থেকে একটা ডিজাইন করা রঙিন সিল্কের রুমাল বের করেছে। বসের হাতে রুমালটা দেখে আমার মাথায় পোকাটা সটান দাঁড়িয়ে গেল। এই তো মালটাকে চমকানোর সুবর্ণ সুযোগ এসে গিয়েছে! আমি খপ করে বসের হাতটা চেপে ধরে বললাম, “কী করছেন স্যার?”
বসও একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কেন? কী হয়েছে?”
বসের গলার আওয়াজটা শুনে পেটের মধ্যে হাসিটা একেবারে ভসভসিয়ে উঠে আসছিল। কোনমতে সেটাকে চেপে একটু সন্দিগ্ধদৃষ্টিতে চারিদিকে তাকিয়ে বললাম, “স্যার, এই এলাকায় আপনি সন্ধ্যেবেলায় পকেট থেকে রঙিন রুমাল বের করছেন?”
বস আরও ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “তো ঘাম মুছতে রুমাল বের করব না?”
আমি সেই একই সন্দিগ্ধদৃষ্টিতে এদিক ওদিক চেয়ে বসের কানে কানে নীচুগলায় বললাম, “এই এলাকায় ভর সন্ধ্যেবেলায় হাতে রঙিন রুমাল রাখার মানে জানেন?”
বস এবারে একটু শুকনো গলায় ফ্যাঁসফেসে স্বরে জিজ্ঞাসা করল, “কী?”
আমি প্রাণপণে গলার কাছে উঠে আসা হাসিটা আটকে বসের দিকে বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে ভীতকণ্ঠে বললাম, “স্যার, এই এলাকায় সন্ধ্যেবেলায় জিগোলোরা হাতে এইরকম রঙিন রুমাল নিয়ে দাঁড়ায়।”
বস এবারে প্রায় বিষম খাওয়ার স্বরে বলল, “অ্যাঁ? জিগোলো? বল কী?”
আমি আবার নীচুগলায় বললাম, “নইলে আর বলছি কি স্যার। এখানে হাতে এইরকম রুমাল নিয়ে দাঁড়ালে আপনাকে লোকে জিগোলোই ভাববে। তারপরে কোন গাড়ি এসে আপনাকে তুলে নিয়ে –”
বস ঢোক গিলে কোনমতে বলেছে, “কি সব বলছ! আমার বাড়িতে বউ-বাচ্চা আছে –” এমন সময় ঘটে গেল সেই সন্ধ্যের মোক্ষম ঘটনাটা। আমার বদলার চূড়ান্ত ক্লাইম্যাক্স! কপালবশতঃ ঠিক সেই সময়েই আমাদের সামনে দিয়ে দু’জন কলগার্ল আসছিল। বস কথা বলতে বলতে তাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়েছে। বসকে তাকাতে দেখে তাদের মধ্যে একজন বসের কাছে এসে মৃদু হেসে চোখ টিপে আদুরে গলায় বলল, “আসবি নাকি?”
ব্যাস, আর যায় কোথায়। কথাটা কানে যাওয়া মাত্র বস লাগাল পাঁইপাঁই করে ছুট। মাইরি, উশেইন বোল্টও লজ্জা পেয়ে যাবে সে দৃশ্য দেখলে। আগে আগে ভুঁড়ি, পিছনে ঘর্মাক্তকলেবর বস। একটা নেড়ি কুকুরের লেজ মাড়িয়ে, চা ওয়ালার সাথে ধাক্কা খেয়ে, কলার খোসায় প্রায় আছাড় খেতে খেতে এক ছুটে সোজা পার্ক হোটেলে। তারপরে হাঁপাতে হাঁপাতে আমাকে ফোন, “এই অভীক, শোন, তুই ক্লোজিংটা ম্যানেজ করে নিতে পারবি তো?”
আমি যথাসাধ্য হাসি চেপে একটু উৎকণ্ঠার সাথে বললাম, “হ্যাঁ স্যার, তা পারব। কিন্তু কেন? আর আপনিই বা কোথায় এখন?”
“আমি হোটেলে চলে এসেছি। ব্যাগপত্র গোছাতে হবে।”
“ব্যাগপত্র? কোথাও যাবেন নাকি?” আমি হাসি চাপতে নিজের হাতের কবজি প্রায় কামড়ে ধরেছি।
“আমি কালকেই মুম্বাই পালাচ্ছি। উফ, এখানে থাকা অসম্ভব, আমার দ্বারা হবে না।” বসের গলা রীতিমত কাঁপছে।
“কেন স্যার? কি হ’ল?” হাসি প্রায় আমার জিবের ডগায় চলে এসেছে।
“শালা ডেঞ্জারাস জায়গা মাইরি এই কলকাতা। তুই-ই সামলা, আমি আর নেই। আমি কাল সকালেই কাটছি।”
“আচ্ছা স্যার, নো প্রবলেম। আমি সামলে নেব। আপনি সাবধানে মুম্বাই যাবেন।”
বলে ফোনটা রেখে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে হো-হো করে হাসতে শুরু করে দিলাম। চমকানি দিয়ে বদলা কমপ্লিট।

সান্যালদা এতক্ষণ হাঁ করে শুনছিল। গল্পটা শেষ হতেই হাসতে হাসতে বলল, “মাইরি, কী ভয়ানক লেভেলের ট্রিটমেণ্ট। একেবারে সোজা জিগোলো বানিয়ে দিলে?”
“আবার কি? যে যেমন মাল, তার পিছনে গুঁজব তেমন ঝাল,” সিঙাড়াটা শেষ করে আঙুল চাটতে চাটতে বললাম।
“অফিসে গিয়ে আর জ্বালায়নি মালটা?”
“বাঙালির কাঠির বড় মহিমা গুরু,” আমি হাসতে হাসতে বললাম, “একবার ঢুকলে জ্বালিয়ে এমন শিক কাবাব বানাবে, সে আর অন্য কাউকে জ্বালানোর সাহস পাবে না। দেশদুনিয়ার একআনি-দু’আনি, আর বাঙালির চমকানি।”
সান্যালদাও হো-হো করে হেসে উঠল, “ঠিক ঠিক, হক কথা।”


আগের ও পরের পর্বের লিঙ্ক<< টা

লেখক পরিচিতি : অভীক সিংহ
গল্পটির লেখক ড: অভীক সিংহের জন্ম পশ্চিমবঙ্গে। পেশায় অর্থনীতির অধ্যাপক এবং গবেষক, যুক্ত আছেন লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে, বর্তমান বাসস্থান চীন। তবে ভালবাসাটা আজও লেখালিখি, পেন্সিল স্কেচ, যন্ত্রসংগীত, এবং নিত্যনতুন রান্নাবান্নার সাথেই রয়ে গিয়েছে। প্রথম বই "R.E.CALL: এক Recollian-এর গল্প" প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। দাদুর হাত ধরে কবিতা দিয়ে লেখালিখির সূত্রপাত হলেও এখন প্রবন্ধ এবং গল্পতেই মনোনিবেশ করেছেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা আহ্বান - বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন

দীপায়ন