লেখক : অভীক সিংহ
মফঃস্বলে বড় হওয়ার দরুণ ছোটবেলাতেই আমার পরিচয় হয়ে গিয়েছিল ভারতের অন্যতম মহান ধর্মের সাথে, যার নাম হ’ল “ক্রিকেট”। বিকেলে ঘড়ির কাঁটা চারের ঘরে পৌঁছলেই হাতে ব্যাট আর পকেটে হালকা সবুজ রঙের টেনিস বল নিয়ে একছুটে মাঠে। তারপরে চপ্পল দিয়ে নন-স্ট্রাইকার এণ্ডে উইকেট বানিয়ে, এর-ওর বাড়ির জানালার কাচ ভেঙে, নর্দমার পাঁক থেকে বল তুলে, ধুলো-কাদা ঘেঁটে, কনুই আর হাঁটুর নুনছাল তুলে বাড়ি ফেরা হত। রোজ রাতে শুয়ে পড়ার পরে মাথার মধ্যে ঘুরত ক্রিকেটের ঝিঁঝিঁপোকাগুলো – “শটটা ওইভাবে কি জন্য যে নিতে গেলাম,” “বলটাকে আরেকটু বাউন্স করাতে হবে,” অথবা “কাল থেকে স্লিপেই ফিল্ডিং করব, ডিপ মিড উইকেটটায় তেমন বল আসে না।” এইসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়া পরের দিন বিকেলের ম্যাচে জয়ের স্বপ্ন দেখতে দেখতে। এইভাবেই দিনগুলো চলছিল। তারপর হঠাৎ করেই একদিন ধূমকেতুর মতই উদয় হ’ল আমাদের এই ধর্মের ঈশ্বরের – টিভির স্ক্রীনে হাঁ করে দেখলাম লর্ডসের সবুজ গালিচায় বাংলার দামাল ছেলের যুদ্ধজয়। সচিনের ঠিক পাশেই সব বন্ধুদের বিগ ফান বাব্লগামের ক্রিকেট কার্ড কালেকশনের নতুন শিরোমণি হয়ে বসলেন আমাদের ক্রিকেটের প্রতিমূর্তি, আমাদের দাদা, “সৌরভ গাঙ্গুলী”। তখনও পর্যন্ত গর্ব কথাটার অর্থ অনেকটাই পাঠ্যপুস্তকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু স্কুল কেটে পাড়ার ভিডিও হলে দাদার স্টেপ আউট করে ছক্কা হাঁকানো দেখতে দেখতে অজান্তেই নিজের মুখ দিয়ে বেরিয়ে যেত “জিও দাদা, এই না হলে বাঙালী।” গর্ব, স্বাজাত্যবোধ, জাত্যাভিমান – এই কথাগুলোর সারমর্ম সেই কাঁচা বয়সে অনেকটাই হয়ত আমরা শিখেছিলাম দাদাকে দেখেই। তারপরে তো সময়ের কাঁটার চলমান গতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চলতে ব্যাটবলের জায়গা হ’ল চিলেকোঠার তাকের ঝুলকালির আড়ালে, কত ক্রিকেটারদের অগণিত স্মৃতিমাখানো সেই কার্ডগুলো কখন যেন চুপিচুপি কিলোদরে বিক্রি হয়ে গেল পুরনো খবরের কাগজের তাড়ার সাথে, আর বুঝতে পারার আগেই খেলার মাঠের দৌড়টা কখন যেন জীবনের দৌড়ে বদলে গেল। সময়ের রিমোটটা যেন টিভিতে ক্রিকেটের চ্যানেলটাকে বদলে দিল শুকনো সংবাদের চ্যানেলে, এবং খবরের কাগজে খেলার খবরগুলো বদলে গেল বাণিজ্যিক আর রাজনৈতিক খবরে। ঘরছাড়া, শিকড়ছাড়া হয়ে পড়াশুনো এবং চাকরির সূত্রে ঘুরতে ঘুরতে ক্রিকেটের ব্যাটের সাথে উড়ে আসা বলের ছোঁয়ার শব্দটা যেন স্মৃতির মণিকোঠায় রয়ে গেল বিথোভেনের “ফার অ্যালিস”-এর মতই, সযত্নলালিত। এইসব কথাগুলো হয়ত মনেও হত না। কিন্তু কলেজে ক্লাস শেষ করে নিজের খোঁয়াড়ে ফেরার পথে দৃষ্টি চলে গেল কলেজের খেলার মাঠটার দিকে। আজ থেকেই শুরু হয়েছে ইন্ট্রা-কলেজ ক্রিকেট টুর্নামেণ্ট। ছাত্ররা সব হইহই করে সাদা জামাপ্যাণ্ট পরে নেমেছে মাঠে, হাতে গ্লাভস, পায়ে প্যাড, মাথায় হেলমেট, আর সাথে ক্রিকেট ব্যাট আর বল। কাঁধের ব্যাগটাকে পাশে রেখে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম মাঠের পাশে একটা গাছের নিচে। ম্যাচ শুরু হয়েছে। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছি, আর অ্যাকশন রিপ্লের মত মনে পড়ে যাচ্ছে ছোটবেলার সেই স্মৃতিগুলো। এমন সময় কাঁধে কেউ একটা হাত রাখল। পিছন ফিরে দেখি সান্যালদা, সাথে আরেকজন প্রফেসর। আমাকে দেখে সান্যালদা বলে উঠল, “কি অভীক, ম্যাচ দেখছ?”
“হ্যাঁ গুরু, আজ থেকে শুরু হ’ল। ভাবলাম ফেরার পথে একটু দেখেই যাই।”
“ভালই করেছ। আমিও ভাবছিলাম দেখব। কিন্তু তোমার কেবিনে গিয়ে দেখি তুমি নেই।” তারপরে সাথের প্রফেসরকে দেখিয়ে বলল, “তাই ভাবলাম ওনাকে সাথে নিয়েই চলে আসি। আর এসে দেখি তুমি এখানেই দাঁড়িয়ে।”
“তা ভাল করেছ গুরু। দু’-তিনজন মিলে ম্যাচ দেখতে বেশ ভালই লাগে। একা একা ঠিক জমে না।”
“তা গতিক কেমন বুঝছ?”
“পিচে বেশ বাউন্স আছে গুরু, আর বল স্যুইংও করছে। যারা ব্যাটিং করছে, তাদের কিন্তু শুরুতে বেশ ভোগাবে।” আমি কথাটা বলতে বলতে ব্যাটিং দলের প্রথম উইকেটটি পড়ল। স্যুইং সামলাতে না পেরে স্লিপে লোপ্পা ক্যাচ দিয়ে ফিরে আসছে।
“ইম্প্রেসিভ!” সাথের প্রফেসর বলে উঠলেন। “তুমি অর্থনীতির বাইরে ক্রিকেটও এইভাবে বিশ্লেষণ করতে পার, সেটা তো একেবারেই জানা ছিল না।”
“কী আর করি বলুন, ছোটবেলাটা তো এই ব্যাটবলের সাথেই কেটে গেল।”
“তুমি যে ক্রিকেটের ভক্ত, সেটা তো জানতাম না।”
সান্যালদা পাশ থেকে বলে উঠল, “ভক্ত কি বলছেন, ও তো ক্রিকেটের পোকা।”
“তাই নাকি?” প্রফেসর বললেন, “তা এবারের আইপিএল দেখছ নাকি?”
“কিছু মনে করবেন না, আমি আইপিএল বা টোয়েণ্টি-টোয়েণ্টি একেবারেই দেখি না। আমার দৌড় ওই কেরি প্যাকারের পাজামা ক্রিকেট অবধি।”
“মানে ওয়ান ডে ম্যাচ, তাই তো?”
“হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন।”
“বাহ বাহ, বেশ বেশ। তা তোমার প্রিয় ক্রিকেটার কে?”
আমি মৃদু হেসে উত্তর দিলাম, “সৌরভ গাঙ্গুলী।”
উত্তরটা শুনে প্রফেসর আমার দিকে একটু ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন। তারপরে একটু তির্যক ব্যঙ্গের সুরেই বললেন, “ও, গাঙ্গুলী। মানে আমাদের দাদা, তাই তো?”
“হ্যাঁ।”
“হমম, সে ঠিক আছে। তবে যাই বলো, দাদার খেলা আমি দেখেছি। অফসাইড ছাড়া কিন্তু একেবারেই কানা।”
আমি মুখ তুলে সোজা তাকালাম ওনার দিকে। আড়চোখে একবার সান্যালদার দিকে তাকিয়ে দেখি সান্যালদার মুখটা ফ্যাকাশে মেরে গিয়েছে। আমার দাদা নিয়ে দাদাগিরির খবর সান্যালদা একটু হলেও রাখে। আমি একটু থেমে শান্তস্বরে উত্তর দিলাম, “ও হ্যাঁ, কানা বলতে মনে পড়ল, আপনি চোখের বীমাটা করিয়ে রেখেছেন তো?”
প্রফেসর আমার উত্তর শুনে এবারে একটু থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ইয়ে…না…মানে ঠিক বুঝলাম না।”
আমি মুচকি হেসে বললাম, “দেখুন আমি একেবারে অহিংস প্রকৃতির পাবলিক। হিংসা, রক্তপাত – এইসব থেকে দূরেই থাকি। তাই দাদাকে নিয়ে আমার সামনে এইসব ফালতু কথাগুলো না বললেই আর বীমা করানোর দরকারটা পড়বে না।”
পাশ থেকে সান্যালদা হো-হো করে হেসে উঠে বলল, “আরে, অভীককে দাদার নামে কিছু বলতে যাবেন না। ওটা ওর কাছে খুবই স্পর্শকাতর জায়গা।”
“ঠিকই বলেছ গুরু,” আমি বলে উঠলাম, “দাদাকে নিয়ে কোনরকম চ্যাংড়ামি আমি বরদাস্ত করি না। আগেও পাবলিককে মোক্ষম দিয়েছি, আজও দিতে ভয় লাগবে না। দাদাকে কেউ স্পর্শ করলে তাকে সটান কাতর করে দেব।”
“বলো কী হে, এর আগেও কি কাউকে বীমা করানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলে নাকি?”
“সে তো বটেই, নইলে আর বলছি কী।”
“তুমি তো মাইরি ডেঞ্জারাস চিজ হে। কী করেছিলে শুনি একটু।” সেই প্রফেসর বললেন।
“ওই দেখুন,” আমি মাঠের বাউণ্ডারি লাইনের বাইরে একটা ছোট্ট চায়ের স্টলের দিকে হাত দেখিয়ে বললাম, “এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই শুনবেন? নাকি এক কাপ করে চায়ের সাথে?”
“আরে, এখানে চা আছে? আগে বলবে তো। আসুন দেখি।” বলে সান্যালদা আমাকে আর সেই প্রফেসরকে একরকম টানতে টানতেই নিয়ে গেল সেই চায়ের স্টলটার দিকে। অর্ডার দেওয়া মাত্রই চলে আসল তিনটে ধূমায়িত চায়ের কাপ। চায়ের কাপটা তুলে একটা চুমুক দিয়ে সান্যালদা বলল, “আহহ, একটু চা না হ’লে গল্প জমে নাকি? গল্পের সাথে গরম চা হ’ল যাকে বলে দাদার সিগনেচার স্কোয়ার কাট, এক ছোবলেই ছবি।”
“আহা, উপমাটা কী দিলে গুরু! দিল খুশ করে দিলে।” আমি চায়ের কাপটা তুলে চুমুক দিতে দিতে বললাম।
“তাহলে এবারে শুরু করো। তোমার মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে বেশ জবরদস্ত লেভেলের কিছু একটা করেছিলে।”
“সে তো বটেই। তাহলে শুনুন।” বলে আমি মুচকি হেসে চায়ের কাপে আরেকটা চুমুক দিয়ে শুরু করলাম।
সে আজ থেকে অনেক বছর আগের কথা, ২০০৬ সাল। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পরে চাকরিবাকরি না পেয়ে কতকটা বাধ্য হয়েই তখন বিড়ালের গলায় ঘণ্টি বেঁধে এমবিএ পড়তে চলে এসেছি মুম্বাইতে। নতুন শহর, নতুন কলেজ, আর ততোধিক নতুন বিষয় “ম্যানেজমেণ্ট” নিয়ে পড়তে শুরু করেছি। তো উপরওয়ালার দয়ায় প্রথম ট্রাইমেস্টারে বেশ ভালই ফল করলাম। পরীক্ষার কয়েকদিন পরেই দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টার শুরু হয়েছে। আর তখন সদ্য সদ্য ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভও হয়েছি, বেশ জামার কলার তুলে বলে বেড়াবার মত ব্যাপার স্যাপার আর কি। বেশ চনমনে মেজাজ নিয়ে শুরু করলাম দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টার। কিন্তু একেবারে ওপেনিং করতে নেমেই যে সবুজ পিচে শোয়েব আখতারের বাউন্সার সামলাতে হবে, এই ধারণা আমার অতি বড় দুঃস্বপ্নেও ছিল না।
সবে প্রথম সপ্তাহ চলছে, শুরু হল মুম্বাইয়ের বৃষ্টি। কলকাতা থেকে গিয়েছি, মুম্বাইয়ের বৃষ্টি সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই। তো যথারীতি পড়লাম জ্বরে, আর বেবাক একটা ক্লাস চলে গেল সেই জ্বরের ভোগে। তো সন্ধ্যেবেলার দিকে ওষুধ কিনতে বেরিয়েছি, দেখা হ’ল কিছু সিনিয়রদের সাথে। একজন জিজ্ঞাসা করল, “কী রে অভীক, তুই ওষুধের দোকানে – সব ঠিক তো?”
“আর বলো না দাদা, এই বৃষ্টির চক্করে জ্বর বাধিয়ে বসলাম।”
“হমম, বুঝতে পেরেছি। একটু সাবধানে থাক।”
“তোদের এই ট্রাইমেস্টারে কোন সাবজেক্ট এসেছে রে?” অন্য একজন সিনিয়র জিজ্ঞাসা করল।
“ফাইন্যান্স, মার্কেটিং, আর অপারেশনস ম্যানেজমেণ্ট।”
“আচ্ছা। তা অপারেশনস ম্যানেজমেণ্টটা কে পড়াচ্ছে? কোন পাঞ্জাবী ভদ্রলোক কি?”
“তা তো জানি না দাদা। আজ ক্লাস ছিল, শরীর খারাপ বলে যেতে পারলাম না।”
শুনে সিনিয়রের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। “যদি কোন পাঞ্জাবী ভদ্রলোক পড়ায়, তার ক্লাস কিন্তু ভুলেও মিস করিস না। কোন এক বিদেশী কোম্পানির উচ্চপদস্থ অফিসার, খুব ডেঞ্জারাস লোক। মুখে কোন লাইসেন্স নেই। ওই মালটার কথা ভাবলেই আমাদের তো এখনও আতঙ্ক লাগে রে।”
“বিপদ করেছে। বলো কী!”
“পরের দিন ক্লাসে যাবি, চুপচাপ খিস্তি খেয়ে নিস। কিচ্ছু বলিস না। তাহলেই বেঁচে যাবি।”
আমি মনে মনে প্রমাদ গণলাম। এ কোন গ্যাঁড়াকলে ফাঁসালে প্রভু। এ তো স্ট্রাইকার এণ্ড থেকে অ্যালান ডোনাল্ড আর নন-স্ট্রাইকার এণ্ড থেকে মুত্তিয়া মুরালিধরন। ভেবে লাভ নেই, নেমে যখন পড়েছি, খেলতে তো হবেই। দেখাই যাক।
মানুষের কপাল শুনেছি মাঝে মাঝে খারাপ হয়। কিন্তু কপাল যে আমার সাথে হ্যারল্ড লারউডের মত বডিলাইন সিরিজ খেলার তালে আছে, তা কে জানত। দু’দিন পরে ক্লাসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি, প্রথম ক্লাসটাই অপারেশনস ম্যানেজমেণ্টের। যথারীতি অনিশ্চিত ভবিতব্যের কথা ভেবে বেরনোর সময় একটু চিন্তাতেই ছিলাম। কিন্তু হস্টেলের ঠিক সামনেই রাস্তার উপরে কেউ যে পিচ খুঁড়ে দিয়ে গিয়েছিল, সেটা আমার দৃষ্টিগোচর হল রাস্তার মধ্যে শুয়ে পড়বার ঠিক আগের মুহূর্তে। এমনিতে আমার যে রাস্তার মধ্যে শুয়ে থাকার বিশেষ কোন ইচ্ছে ছিল, তা নয়। কিন্তু আমার কপাল যে পিচের গর্তের মতই হাঁ করে আমার চপ্পলের ফিতেটাকে চিবিয়ে দেবে, সেটা তো আর আমার চিন্তাভাবনার পরিসরে ছিল না। ফলতঃ হাতে ফাটা চপ্পল নিয়ে দৌড়তে দৌড়তে যখন কলেজে গিয়ে পৌঁছেছি, ততক্ষণে ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে। দু’-তিন মিনিট দেরি হয়েই গিয়েছে। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইষ্টনাম জপ করতে করতে এসে দাঁড়ালাম ক্লাসের দরজার সামনে। তখনই চোখে পড়ল সেই কুখ্যাত পাঞ্জাবী ভদ্রলোকটিকে। দশাসই চেহারা, টকটকে গায়ের রঙ, উচ্চতা প্রায় ছ’ফুটের উপর, চোখে শ্বাপদের দৃষ্টি, আর তার সাথে বাজখাঁই গলার স্বর। আমাকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই ভদ্রলোক তো একেবারে রাগে অগ্নিশর্মা। ধীরপদে এগিয়ে এলেন আমার দিকে। তারপরে আমার উদ্দেশ্যে উচ্চৈঃস্বরে প্রয়োগ করতে শুরু করলেন একের পর এক চোখা চোখা বিশেষণ – “অকর্মার ঢেঁকি”, “দায়িত্বজ্ঞানহীন”, “নির্লজ্জ” জাতীয় অনেককিছু। প্রায় দেড়-দু’মিনিট পরে তিনি গায়ের ঝাল মিটিয়ে ক্ষান্ত এবং শান্ত হলেন। আমি দরজার সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে। রাগে, অপমানে কান পর্যন্ত গরম হয়ে গিয়েছে। এরপরে তিনি আমাকে ইশারায় ক্লাসে গিয়ে বসতে বললেন। আমি চুপচাপ মাথা নিচু করে সামনের বেঞ্চে গিয়ে বসলাম, আর উনিও ফিরে এসে পড়াতে শুরু করলেন।
ক্লাস বেশ চলছিল। হঠাৎ করেই পাঁচ-সাত মিনিট পরে তিনি জিজ্ঞাসা করে বসলেন, “তোমাদের ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভ কে?”
আমি এদিক-ওদিক তাকিয়ে একটু দ্বিধার সাথে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, “আমি, স্যার।”
তিনি একমুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে হো-হো করে একটা চরম বিদ্রূপের হাসি হেসে বললেন, “এটা? এটা তোমাদের ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভ?”
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে। কিন্তু আমার ততক্ষণে মাথার ভিতরে উত্তাপ বাড়তে শুরু করে দিয়েছে, শুধু মুখে কিছু প্রকাশ করছি না। বেশ কয়েক সেকেণ্ড ক্লাসের সামনে এইরকম টিটকিরি চলতে চলতে তিনি হঠাৎই আমার দিকে ফিরে আদেশের ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করলেন, “Where are you from?”
আমি মুখ নিচু করেই উত্তর দিলাম, “I am from West Bengal.”
তিনি যেন আমার উত্তরের অপেক্ষাতেই ছিলেন। আমি কথাটা বলা মাত্রই তিনি এবারে হাসির মাত্রাটা বাড়িয়ে দ্বিগুণ তাচ্ছিল্যের সাথে মন্তব্যটা ছুঁড়ে দিলেন, “Oh, I see. So, you are from the state of the World Cup losing Captain?”
কথাটা কানে যাওয়া মাত্র মনে হ’ল কেউ যেন আমাকে একটা হাজার ভোল্টের চাবুক দিয়ে পিঠে সপাং করে মারল। চোখের সামনে এক লহমায় ভেসে উঠল ছোটবেলার ক্রিকেট কার্ডগুলোয় জ্বলজ্বল করতে থাকে দাদার নাম, গ্লেন ম্যাকগ্রাথকে স্টেপ আউট করে ছক্কা, লর্ডসের ব্যলকনিতে উড়ন্ত শার্ট। আমার ধৈর্য্যের বাঁধ গেল ভেঙে। দাদাকে আর বাঙালিদের নিয়ে এইরকম চ্যাংড়ামি বরদাস্ত করে নেব? কভি নেহি। মাথায় বিদ্যুতের মত একটা উত্তর খেলে গেল। আমি শান্তভাবে সরাসরি চোখ তুলে তাকালাম সেই পাঞ্জাবী ভদ্রলোকের চোখের দিকে। একটু হেসে গর্বের সাথেই উত্তর দিলাম, “Indeed Sir. I am from the state of the same World Cup losing Captain, who gave a chance to Harbhajan Singh.”
উত্তরটা যেন ক্লাসের মধ্যে পড়ল একটা নিউক্লিয়ার বোমার মত। পুরো ক্লাসের মধ্যে এক যুদ্ধোত্তর হিরোশিমা-নাগাসাকির নীরবতা। আমার পাল্টা উত্তর শুনে সেই ভদ্রলোকের মুখ থেকে হাসি মুছে গেল এক মুহূর্তের মধ্যেই। আমরা দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে, কারও মুখে একটাও কথা নেই। কয়েক সেকেণ্ড আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থেকে তিনি মাথা নিচু করে আমাকে বসতে বললেন, আর তারপরে আবার শান্তগলায় শুরু করলেন পড়াতে। ক্লাস শেষে নিঃশব্দে মাথা নিচু করেই বেরিয়ে গেলেন ক্লাসরুম থেকে। তারপর থেকে সেই ভদ্রলোক আমায় আর ঘাঁটানোর সাহস করেননি। আর শুধু আমাকে নয়, অন্য কোন ক্লাসেও নাকি আর প্রাদেশিকতা নিয়ে মজা করবার সাহস দেখান নি। সেই দিনটার পর থেকে তিনি চুপচাপ ক্লাসে আসতেন, আর পড়িয়ে চলে যেতেন।
চা শেষ হয়ে গিয়েছিল। সাথের সেই প্রফেসর স্পিকটি-নট। আমি ফাঁকা কাপটা নিয়ে ডাস্টবিনের দিকে এগোচ্ছি, সান্যালদা মুখ খুলল, “কী শোনালে হে অভীক। এ তো একেবারে বিদেশের মাঠে টেস্ট সিরিজ জয়।”
“নইলে আর বলছি কী,” কাপটা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে বললাম, “দাদার ভক্ত বলে কথা গুরু, বিনা যুদ্ধে হার মেনে চলে আসা কি আমার সাজে?”
“তবে উত্তরটা কিন্তু ভয়ানক দিয়েছিলে। ধরো, যদি কলেজ থেকে বের করে দিত?”
“গুরু, স্টেপ আউট না করলে কি আর ছক্কা মারা যায়?”
বলতে বলতে মাঠে ব্যাটসম্যান ক্রিজে এগিয়ে এসে স্পিনারকে সপাটে হাঁকিয়ে দিল একটা ছক্কা। ছাত্রের দল হইহই করে উঠল। আমরাও হাততালি দিতে লাগলাম। হাততালি দিতে দিতে সঙ্গী প্রফেসরের দিকে ফিরে বললাম, “এই জন্যেই বলি, দাদাকে নিয়ে আমার সামনে মুখ খোলার আগে একটু ভেবে নেবেন, তারপরে মুখ খোলার আইডিয়াটা ডাস্টবিনে ফেলে দেবেন। বলা কি যায়…”
সান্যালদা এগিয়ে এসে আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, “শাবাশ বেটা, জিতে রহো।”
লেখক পরিচিতি : অভীক সিংহ
গল্পটির লেখক ডঃ অভীক সিংহের জন্ম পশ্চিমবঙ্গে। পেশায় অর্থনীতির অধ্যাপক এবং গবেষক, যুক্ত আছেন লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে, বর্তমান বাসস্থান চীন। তবে ভালবাসাটা আজও লেখালিখি, পেন্সিল স্কেচ, যন্ত্রসংগীত, এবং নিত্যনতুন রান্নাবান্নার সাথেই রয়ে গিয়েছে। প্রথম বই "R.E.CALL: এক Recollian-এর গল্প" প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। দাদুর হাত ধরে কবিতা দিয়ে লেখালিখির সূত্রপাত হলেও এখন প্রবন্ধ এবং গল্পতেই মনোনিবেশ করেছেন।
দুর্দান্ত। গল্পের বাঁধুনি টা চমৎকার।
অনেক, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে শিখা কাকিমা 😊😊😊