লেখক : দীলীপ ব্যানার্জী
সালটা ছিল ২০১৮। বিয়ে বাড়ির পার্টি ছিল স্বভূমিতে। একলা গিয়েছিলাম তাড়াতাড়ি ফিরে আসার তাগাদা ছিল।
রাত সাড়ে আটটা বাজতেই খাওয়া সেরে ফেরার জন্য ব্যাস্ত হয়ে পড়ে ওলা বা উবের বুক করার চেষ্টা করতে লাগলাম। কোন আ্যপ ক্যাব পাচ্ছিলাম না। সেদিন সম্ভবত কলকাতায় কয়েক হাজার কি লাখ খানেক বিয়ে বৌভাতের অনুষ্ঠান ছিল। চেষ্টা করতে করতেই স্বভূমি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে গাড়ির জন্য চেষ্টা করতে হঠাৎ একটা ওলা শেয়ার পেলাম। তখন করোনা আসেনি শেয়ার ক্যাব পাওয়া যেতো।
বাদ বিচারের অবকাশ ছিলনা। মোবাইলে দেখলাম কাছেই আছে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে এসে যাবে। দশ মিনিট পর ফোন করাতে চালক জানালেন একদম কাছেই আছে জ্যামে একটু আটকে পড়েছে।
ক্যাব যখন এলো তখন আধ ঘন্টা পেরিয়ে রাত ন’টার ঘরে ঘড়ির কাঁটা।
সামনের ড্রাইভাররে পাশের সিটে একটি মেয়ে বসে আছে কোলে বছর তিনেকের এক বাচ্চা। পেছনে বসে আছেন এক ষাট পইষট্টি বছর বয়স হবে এক ভদ্রলোক। আমি পেছনের সিটে বসলাম।
ক্যাব একটু গিয়েই দাড়িয়ে পড়ল জ্যামের জন্য। তখনও বাইপাসে পৌছই নি। ন’টা পনেরো গাড়ি নড়ছেনা। ড্রাইভার সহ সবাই চুপ উসখুস করছে।
হঠাৎ সামনের সিটে বসা মেয়েটি ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল তখনই বলেছিলাম শেয়ার ক্যাব না নিতে। সাতটায় উঠে এখন ভিআইপি ও এলো না। পেছনের ভদ্রলোক বলে উঠলেন অনেকটা রাস্তা তোকে আরও আগে বেরোতে বলেছিলাম।
মেয়েটি প্রায় মুখ ঝামটা দিয়ে বলল বিয়ের গিফ্ট কিনে বাড়ি এসে সাজগোজ করে এর আগে বার হওয়া যায়না।
চুপ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে সব শুনছিলাম। কথা শুনে বুঝলাম বাবা ও মেয়ে। বাবা চুপ। মেয়েটি ঝাঁঝিয়ে বলল কটা টাকা বাঁচানোর জন্যে শেয়ার নিতে বললে! বাবাও উষ্মা প্রকাশ করে বলল এমনি ক্যাব পাঁচশোর ওপরে ভাড়া দেখাচ্ছিল। বড্ড বেশি ছিল এত টাকা…..
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর গিফ্টের জন্যে তো আমি পুরো টাকা দিলাম তুমি ক্যাব এর খরচাটাও দিতে চাওনা।
বুঝলাম বাবা মেয়ে খরচাপাতি ভাগাভাগি করে নেমতন্ন বাড়ি যাচ্ছে। কোথা থেকে উঠেছে আর ঠিক কোথায় যাবে তখনও জানিনা।
পরক্ষণেই মেয়েটি বলে উঠল গড়িয়া থেকে এতটা রাস্তা শেয়ার ছাড়া পাঁচশো এমন কিছু বেশি নয় এই সময়। এখন শেয়ারে বাসের মত লোক নামানো আর তুলতে তুলতে চল। অর্থাৎ গড়িয়া থেকে উঠেছে।
দশটা বাজতে চলল এখানেই। কটায় পৌছব আর কটায় ফিরবো? মেয়েটা বলেই চলেছে।
ভিআইপি দিয়ে গাড়ি চলছে দশটা বেজে গেছে। এয়ার পোর্ট এক নম্বর গেটের কাছে ড্রাইভার গাড়ি দাঁড় করিয়ে বলল আপনাদের লোকেশন এসে গেছে।
মেয়ে বাবা চুপ ভাড়া মেটাচ্ছে না গাড়ি থেকে নামছেও না। ড্রাইভার গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে একদম চুপ।
আমি হতভম্ব। বাবা বলল এবার এখান থেকে যাবি কি করে? আর এয়ারপোর্ট অবধি কেন বুক করেছিলি?
মেয়েটা চেঁচিয়ে বলল তুমিই তো বললে এয়ারপোর্ট অবধি কর বাকিটা অটো তে চলে যাব। এখন এত রাত হোলো অটো পাব? ড্রাইভার অদ্ভূত ভাবে একদম চুপ। আমি হতবাক।
কয়েক মিনিট এভাবে চলতে থাকার পর আমার মনে হোলো আমি নিজেই কখন বেলঘরিয়া পৌছবো কে জানে! ক্যাব চালক মেয়েটি বাবা সবাই চুপ। মিনিট চলে যাচ্ছে কারও নামার কোন ইচ্ছে দেখছিনা।
না পেরে মুখ ফস্কে ভদ্রলোক কে জিজ্ঞাসা করলাম কোথায় ঠিক যাবেন? সামনে থেকে মেয়েটি উত্তর দিল বিরাটি। বাপ মেয়েতে কথাকাটির মাঝে ড্রাইভার নিঃশব্দে গাড়ির ইঞ্জিন চালু করলেন গিয়ার পাল্টে কাউকে কিছু না বলে সামনের দিকে মানে যশোর রোড দিয়ে বিরাটির দিকে চললেন।
বাবা মেয়ে চুপ। ড্রাইভারের অভিব্যক্তি নেই। আমি যেন নাটকের এক অতিরিক্ত চরিত্র। কিছুক্ষণ পরে বিরাটির মোড় এল।
ভাবলাম যাক ওরা নিশ্চয়ই এখানে নেমে যাবে আমি এবার বেলঘরিয়া যাব এখান দিয়ে বিরাটি মধুসুদন ব্যানার্জী রোড ধরে। চালক আস্তে করে বললেন বিরাটির মোড় এসেছে।
কিন্তু বাপ মেয়ে নামছেনা। ভাড়া নিয়েও মুখে কুলুপ। বাবা বলল এবার কি করবি? মেয়ে খিঁচিয়ে উঠে বলল করব আমার মাথা আর মুন্ডু। আমরা যখন পৌছব বিয়ে বাড়িতে আর লোকজন কেউ থাকবে না।
নামো এখানে দেখ কোনও অটো পাও কিনা। বাবা নামলনা। আমি এবার চিন্তিত কিছুটা বিরক্ত।
এমন পরিস্থিতিতে আগে কখনও পড়িনি। শেয়ার ক্যাব কিছু বলতেও পারছিনা।
জিজ্ঞাসা করলাম আপনারা ঠিক কোথায় যাবেন? বাবা বলল বাঁকড়া। আমি বাঁকড়া কোথায় জানিনা। কতদুর সেটা জিজ্ঞাসা করাতে ড্রাইভার নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে বলল দশ পনেরো মিনিট লাগবে এখান থেকে। ইন্জিন বন্ধ করে চালক চুপ একদম। বাবা মেয়ে চুপ।
হঠাৎ কোন কথা এবারেও কাউকে কিছু না বলে নিঃশব্দে গাড়ির ইন্জিন চালু করে চালক মধ্যমগ্রামের দিকে গাড়ি নিয়ে চলল যশোর রোড ধরে। আমার গন্তব্যের উল্টো পথে।
বাবা মেয়ের কোন হেলদোল নেই। প্রায় দু কিলোমিটার আরো যাওয়ার পর চালক বলল এটা বাঁকড়া মোড়। মেয়েটি বলে উঠল হ্যাঁ হ্যাঁ এখানেই নামব। এখান থেকে অটো মিনিট চারেক লাগবে। বাবাকে তাড়া দিল নামো নামো এসে গেছি।
রাত তখন এগারোটা বেজে পনেরো। চালক ভাবলেশহীন বসে আছেন ইঞ্জিন বন্ধ করে। মেয়েটি জিজ্ঞাসা করল কত ভাড়া দিতে হবে চালক বলল ওই এয়ারপোর্ট এক নম্বর গেট অবধি যা ছিল দুশো বাইশ।
বেশি লাগবেনা কিছু?
চালকের উত্তর না আর কিছু লাগবেনা। আমি চালকের কথায় খানিকটা বিস্মিত হলাম।
চুপ করে ভাবছি এবার আশা করি বাড়ির দিকে চলবে গাড়ি। পেছন থেকে নেমে আমি সামনের সিটে গিয়ে বসলাম। দেখছি মেয়ে বাবা অটো ধরার চেষ্টা করছে। ক্যাব চালক হঠাৎ নেমে গিয়ে ওদের জন্যে অটো ধরার সাহায্য করতে লাগলেন।
এই মোড় থেকে কাছাকাছি কোথাও যাবে এটা বুঝলাম। রাত এগারোটা পার করে বারোটার দিকে ঘড়ির কাটা এগিয়ে চলেছে জানিনা কখন ওরা বিয়ে বাড়ি সেরে গড়িয়া ফিরতে পারবে! আমি ভেবেই বা কি করবো!
ক্যাব চালকই একটা অটো দাঁড় করিয়ে কথা বার্তা বলে ওদের অটোতে তুলে দিয়ে গাড়িতে ফিরে এসে কয়েক মূহুর্ত চুপ করে থেকে আমাকে বললেন।
আপনার দেরি হয়ে গেল ক্ষমা করে দেবেন। আমি চুপ। আমাকে চুপ দেখে বললেন আপনি খুব বিরক্ত হয়েছেন বূঝতে পারছি এমনিতেই দেরি হয়েছে তার ওপর রুটের বাইরে এভাবে গাড়ি নিয়ে এসে আপনার আরো বেশি দেরি করিয়ে দিলাম।
ক্ষুব্ধ ছিলাম ঠিকই কিন্তু ওই ক্যাব চালকের কথার মধ্যে একটা অন্যরকম অনুভুতি বোধ করলাম।
বললাম না না ঠিক আছে। গাড়ি আবার উল্টো পথ ধরে যশোর রোড দিয়ে বিরাটির দিকে ফিরে চলেছে। বিরাটি মোড় হয়ে যাবে বেলঘরিয়া।
খানিকটা নিরবতার পর বললাম আপনি এতটা অতিরিক্ত পথ এলেন সময় তেল এত খরচ হোলো আর টাকাও তো পুরো নিলেন না। অতিরিক্ত টাকাও তো কিছু নিলেন না!
বললেন এয়ারপোর্ট এক নম্বর গেটেই আ্যপ জিপিএস বন্ধ করে দিয়েছিলাম ওটা করা যায়। আবার বিরাটিতে বেলঘরিয়ার রাস্তায় উঠলে চালু করে দেবো। আপনার লোকেশানে গিয়ে বন্ধ করব।
চালক এর পরে যেটা বললেন সেই কথায়
মরচে পড়া সভ্যতার মাঝে এই রাত জন্ম দিল বিশুদ্ধ স্বরলিপিতে গেয়ে চলা এক ঝরনার গান।
বললেন সাধারণ মধ্যবিত্তের সাধ অনেক সাধ্য কম। বাবা এবং ওই মেয়ে নিতান্তই সাধারণ মধ্যবিত্ত বেশি টাকা দিয়ে গাড়ি ভাড়া তার সঙ্গে উপহার দেওয়ার ক্ষমতা নেই। আমি অবাক বিস্ময়ে তাকালাম মধ্য বয়স্ক চালকের দিকে।
কয়েক মুহূর্তে পিন পতনের শব্দ ভেঙ্গে ওই বছর পঞ্চাশ কি পঞ্চান্ন বছরের চালকের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হোলো রাস্তার আলোয় যেন কোন জ্যোৎস্নালোকিত স্থিরচিত্র দেখছি।
স্তব্ধতা ভেঙ্গে বলতে লাগলেন আমার এক মেয়ে আছে ওই রকমই আর আছে ওইরকমই এক নাতনী। সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত আমি ক্যাব চালাই। জামাই ছোটখাটো একটা কাজ করে। আমার আর কেউ নেই। আমি মেয়ের কাছেই থাকি। মেয়ে জামাই আমি বাড়িতে না ফেরা অবধি রাতের খাওয়া খায়না। দশটায় ফিরি আজ একটু দেরি হোলো। গাড়ি চালাই তাই ওরা ফোন করেনা। খালি মেসেজ করছে কোথায় কত দেরি?
আমার মনের উপত্যকা জুড়ে বিষ্ময়।
ক্যাব চালকের হৃদপাখি ডানা খুলে উড়ে যেতে থাকে। শান্ত স্বরে বললেন।
ওই মেয়েটি ওর বাবা আর ওই ছোট্ট বাচ্চাটিকে দেখে ওদের কথা শুনে আমার নিজের মেয়ে নাতনীর কথা মনে আসছিল। ওদেরও আজ একটা বিয়ে বাড়িতে যাওয়া ছিল। এদের কিছুটা সাহায্য করলাম মাত্র!
এই অন্ধকারের আলোতে তাকিয়ে রয়েছি এক ক্যাব চালকের মুখের দিকে। প্রতিনিয়ত আমরা নিজেদের অস্তিত্বের কাছে হেরে যাই তবু এই সুন্দর পৃথিবীতে অন্ধকারের মধ্যেও রং আছে।
আপনার লোকেশান এসে গেছে। বাইরে তাকিয়ে দেখলাম আমার বাড়ির সামনে এসে ক্যাব দাঁড়িয়েছে। আমি টাকা মেটাতে মেটাতে জিজ্ঞাসা করলাম এখন বাড়ি ফিরবেন?
চালক স্মিত স্বরে বললেন হ্যাঁ আজ একটু দেরিই হোলো। মা মরা মেয়েটা বসে থাকবে বাবার জন্যে।
মেঘ চমকানো বিদ্যুৎের আলোয় যেন দেখতে পেলাম এক মেয়ের মুখ সেই মেয়ে যেন এত রাতেও ভুবন ডাঙার মাঠে ছড়িয়ে দিচ্ছে শিউলি ফুলের শুভ্র সকাল। মনে মনে প্রার্থনা করলাম বেঁধে থাকুক ধরে থাকুক এই বাবা মেয়ের বন্ধন।
চালক এবার গিয়ার পাল্টে গাড়ি স্টার্ট করলেন। পেছনের লাল আলোটা ছোট হতে হতে ছোট্ট বিন্দু হয়ে মিলিয়ে গেল।
আমার পা তখনও রাস্তায় আটকে রয়েছে। এক অদ্ভূত ঘোরের মধ্যে মনে হোলো এখনও এখানে ডাক দিলে জাগে শহর নগর। এখনও রাতের অন্ধকারেও এই শহরে শোনা যায় পাখির কলকাকলী। এখনও এই শহর থেকে দেখা যায় সুমেরু কুমেরু তারা নক্ষত্র। মানুষ বলতেও বুকটা ভরে ওঠে। এটাই আমার ভারতবর্ষ।
লেখক পরিচিতি : দীলীপ ব্যানার্জী
প্রথিতযশা নাট্য সংস্থা "সুন্দরম" এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। প্রখ্যাত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান "গীতবাণী" র সম্পাদক তথা আবৃত্তি ও নাট্য বিভাগের প্রশিক্ষক। পেশাগত ভাবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর স্নাতক।