ফলেন পরিচীয়তে

লেখক : জয়দীপ চক্রবর্তী

“পঞ্চাশ কেজি দই নিয়ে সামনের রবিবার তোদের বাড়ি যাচ্ছি। তোরা সকলে বাড়ি থাকিস।”

বন্ধু অনিকেতের হোয়াটস-অ্যাপ মেসেজটা পড়ে বেশ অবাক হল কাঁঠাল খান।  নর্থ বেঙ্গল থেকে হঠাৎ পঞ্চাশ কেজি দই নিয়ে আসার কারণটা বোধগম্য হল না খান সাহেবের।

“আমাদের বাড়িতে তো কোনও বিয়ে লাগেনি। আর বিয়ে লাগলেও আমাদের এখানে মিষ্টির দোকানের আকাল লাগেনি যে নর্থ বেঙ্গল থেকে দই আনাতে হবে। “

অল্পক্ষণের মধ্যেই কাঁঠাল খানের মুঠোফোনে অনিকেতের উত্তর ভেসে উঠলো।

“তোদের বাড়িতে যাতে তাড়াতাড়ি বিয়ে লাগে সেই ব্যবস্থাই করছি। তোর ছেলের উপযুক্ত পাত্রীর সন্ধান পেয়েছি। সেই কারণেই আগামী রবিবার তোদের ওখানে যাওয়া। “

“আরে তাই নাকি? মেয়েটি কোথায় থাকে,? কি করে? সমস্ত বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে ছবি পাঠা।”

“একটু ধৈর্য ধর। সাক্ষাতে সব কথা হবে।“

এই মেসেজটা লিখেই অফলাইনে চলে গেল অনিকেত।

তবে খান বাবু এতদিন অপেক্ষা করতে রাজি নয়। তাই সে হোয়াটস-অ্যাপ মেসেজ করা ছেড়ে বন্ধুকে ফোন করল। ফোনে রিং হয়ে গেল। অপর প্রান্ত থেকে কোন সাড়া পাওয়া গেল না। রাতের দিকে অনিকেত একটি হোয়াটস-অ্যাপ মেসেজ করে বলল, “ধীরে বৎস ধীরে। আগামী রবিবার তুমি তোমার সকল প্রশ্নের উত্তর পাবে। “

অগত্যা ধৈর্য ধরা ছাড়া আর কোন উপায় রইল না কাঁঠাল খানের। ওর ধৈর্যচ্যুত হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। সম্প্রতি ছেলে আখরোট খানের জন্য মেয়ে খুঁজতে খুঁজতে কাহিল হয়ে পড়েছে ভদ্রলোক।

কাঁঠাল খানদের সময়ে বেশিরভাগ মেয়েরা স্কুল কলেজের গণ্ডি পেরিয়েই বিয়ের বাজারে নাম লেখাতো। তাই বিবাহযোগ্য ছেলের জন্য উপযুক্ত পাত্রী খুঁজে পাওয়া তেমন কিছু দুষ্কর ছিল না। কিন্তু বর্তমানে প্রায় সকল মেয়েরাই আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী না হয়ে বিয়ে করছে না। স্কুল কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে চাকরিতে ঢুকছে তারা। শিক্ষা বা কর্মজীবনে অনেক মেয়েই তাদের জীবন সাথী খুঁজে নিচ্ছে। ফলস্বরূপ যে সমস্ত ছেলেরা নিজেরা নিজেদের পছন্দমত পাত্রীর সন্ধান করে উঠতে পারছে  না, তাদের পক্ষে উপযুক্ত পাত্রী খুঁজে পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আখরোটের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরও সমস্যার হয়ে দাঁড়িয়েছে ওর নামের জন্য। এমন অদ্ভুত নামের ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে কোন অভিভাবকই রাজি হচ্ছেন না।

কাঁঠাল খানদের পরিবারে সকলের নামই ফলের নামে। এমন অদ্ভুত সিদ্ধান্তটি কাঁঠালের বাবা শান্তি-রঞ্জনের। প্রচুর অর্থ ও সম্পত্তির মালিক ছিলেন উনি। অনেকটা জমি নিয়ে শান্তি-রঞ্জনের বেশ বড় বাড়ি ছিল। সেই জমিতে ছিল প্রচুর ফলের গাছ। বর্তমানে পরিবারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বাড়ির আয়তন বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বেশ কিছু ফলের গাছ কাটা পড়েছে।

ফলের প্রতি শান্তি-রঞ্জনের অগাধ ভালোবাসার ফল প্রকাশ পেয়েছে তার সন্তানদের নামকরণে। ওনার মতে পাখির নামে, ফুলের নামে, যদি মানুষের নাম হতে পারে তবে ফলের নামেই বা হবে না কেন? এই অভিনব চিন্তা মাথায় নিয়েই উনি ওনার চার ছেলের নাম রেখেছেন যথাক্রমে তরমুজ, সবেদা, কাঁঠাল আর পেয়ারা । আর দুই মেয়ের নাম কমলা ও বেদানা। শুধু সন্তানের নাম ফলের নাম রেখেই ক্ষান্ত হয়নি শান্তি-রঞ্জন। ছেলে মেয়েকেও বাধ্য করেছে তাদের সন্তানদের নাম ফলের নামে দিতে।

এই নামের জন্য শুধু স্কুল কলেজ নয়, চাকরি জীবনেও খান পরিবারের সকলকেই নানা রকম ঠাট্টা তামাশার শিকার হতে হয়েছে। স্কুলের পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন ওদেরকে বন্ধু বান্ধবরা বলত, “এই আজ তোদের পরিবার বের হবে।“

ছোটবেলা থেকেই শান্তি-রঞ্জনের বড় ছেলে গোল-গাল ও মোটাসোটা ছিল। এই কারণে তার নাম রাখা হয়েছিল তরমুজ। তরমুজ মোটা বলে স্কুল বা পাড়ার ক্রিকেট খেলায় তাকে ফিল্ডিংয়ে না পাঠিয়ে বরাবর উইকেট-কিপার বানানো হতো। একদিন ওর গায়ে বেশ জোরে একটা বল এসে লাগলে, সবাই মজা করে বলেছিল, “তরমুজে এত জোড়ে বল লাগলে তো তরমুজ ফেটে সব রস বেরিয়ে যাবে।” তরমুজ সেদিন রেগে গিয়ে ব্যাট হাতে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল।

তরমুজ একবার একটি বিয়ে বাড়িতে গিয়েও বেশ হাসির খোরাক হয়েছিল। তরমুজ তখন কলেজে পড়ে। বিয়েটা বৈশাখ মাসে ছিল। স্টার্টারে তরমুজের জুসের আয়োজন করা হয়েছিল। তরমুজ বিয়ে বাড়িতে ঢুকলেই ওর বন্ধুরা বলে উঠেছিল, “বেশ বড়-সড় একটা তরমুজ চলে এসেছে। এখন আর জুসের অভাব হবে না।“ এই রসিকতাতেও তরমুজ বেশ অসন্তুষ্ট হয়েছিল।

তরমুজের এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলের নাম তাল আর মেয়ের নাম পেঁপে। ছেলে মায়ের মতো রোগা, আর মেয়ে বাবার মতো স্থূলকায় হয়েছে। তালকে ওর বন্ধুরা তাল পাতার সেপাই বলত। ও  যখন মায়ের সাথে স্কুলে যেত তখন বন্ধুরা ওর মাকে মা-তাল বলতো। তাল ওর জন্মদিনে একবার কেক কাটছে। হঠাৎ এক বন্ধু পিছন থেকে বলল, তাল কাটিস না, তাল কাটলে বেসুরো শোনাবে। সেই কথায় সবাই হেসে উঠলেও তালের খারাপ লেগেছিল।

পেঁপের স্থূলকায় চেহারার জন্য ওর বন্ধুরা ওকে পেঁপে না ডেকে পিপে ডাকত। গরমে পেঁপে বেশ কষ্ট পেত। গরমকালে একদিন ক্লাসে পেঁপে দরদর করে ঘামছে। তাই দেখে এক বন্ধু বলল, এই পেঁপে কে তাড়াতাড়ি ফ্রিজে রেখে আয়। না হলে পেঁপে সেদ্ধ হয়ে যাবে। এমনই হাসি ঠাট্টা টিপ্পনী শুনতে শুনতে তরমুজের মতো তার ছেলে মেয়েরাও বড় হয়েছে। তাই শান্তি রঞ্জন এর মৃত্যুর পরও পরবর্তী প্রজন্মকে বাবার নিয়ম মেনে নাম রাখতে বাধ্য করেছে তরমুজ।

বন্ধু মহলে সবেদা সবু নামে পরিচিত। সবু নামেতে সবেদার কোনও আপত্তি নেই। তবে অফিসে নন-বেঙ্গলিরা ওকে সবু-জি বলে ডাকে। সবেদা তাদের বলেছে “আপনারা আমাকে সবু-জি বলুন, তাতে কোনও ক্ষতি নেই। তবে দেখবেন সবু-জি আবার না সবজি হয়ে যায়।

কথায় আছে “সবুরে মেওয়া ফলে”। তাই সবু তার একমাত্র মেয়ের নাম রেখেছে মেওয়া।

কাঁঠাল ছোটবেলায় ওর মামা বাড়ি গেলে, বড় গোঁফ ওয়ালা বড় মামা ওকে আমগাছে তুলে দিয়ে গোঁফে তেল দিতে দিতে বলতো, গাছে কাঁঠাল ঝুললে গোঁফে তেল দেওয়ার মজাই আলাদা। তাছাড়া আম গাছে কাঁঠাল ঝুলছে, দেখতে বেশ ভালো লাগে।

পেয়ারাকে ওর বন্ধুরা ভালোবেসে পেয়ার বলে ডাকে। এই নামে পেয়ারা বেশ খুশি । ও সর্বদা বুক ফুলিয়ে মাথা উঁচু করে চলে, আর বলে “পেয়ার ঝুকতা নেহি। তাই আমি কখনো মাথা নিচু করি না”। পেয়ারার এক ছেলে ও এক মেয়ে। নাম নিয়ে ছেলে মেয়েকে যাতে কোন সমস্যায় না পড়তে হয়, সেই জন্য পেয়ারা তাদের নাম বেশ ভেবেচিন্তে বুদ্ধি করে দিয়েছে। ছেলের নাম হিমসাগর। তবে কেউ ওর নাম জিজ্ঞাসা করলে, ও হিম গুম করে, সাগরটাই প্রকাশ্যে আনে। আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব সকলের কাছেই পেয়ারার ছেলে সাগর খান নামেই পরিচিত। ফলস্বরূপ, ফলের নামের কুফলে ওকে তেমন পড়তে হয়নি।

পেয়ারা ওর মেয়ের নাম রেখেছে সীতা-ফল। তবে তাকে সীতা বলেই ডাকা হয়। নামটি আধুনিক না হলেও এই ফলের পরিবারে ওকে ফলাও করে ব্যাখ্যা দিতে হয় না, সেটা স্বীকৃত।

কমলা একটি লেবুর নাম হলেও, নামটি অপরিচিত নয়। কমলা নামের অনেক মহিলা রয়েছে বঙ্গ সমাজে। তাই এই নামের জন্য কমলাকে কোনরকম অসুবিধায় পড়তে হয় নি কখনো। তবে ওর ছোট বোন বেদানা কে বেশ সমস্যাতেই পড়তে হয়েছে।  শুধু বন্ধু-বান্ধবরাই নয়, আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে অনেকেই বেদানাকে বেদনা বলে ডাকে। কেউ কেউ আবার ওকে দেখে গান ধরে “কি আশায় বাঁধি খেলাঘর বেদনার বালুচরে।” এমন ঠাট্টা ইয়ার্কিতে বেদানা মনে মনে অসন্তুষ্ট হলেও তা কখনো মুখে প্রকাশ করেনি ও।

শান্তি-রঞ্জনের আর্থিক জোর থাকার কারণে, এবং তার ছেলেরা যথেষ্ট উপযুক্ত হওয়ার জন্য ছেলেদের বিয়ে দেওয়াতে তেমন কোনও অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয়নি ওনাকে। তবে কাঁঠালের বিয়ের সময় ওর নামের জন্য শ্বশুর-বাড়ি থেকে হালকা প্রতিবাদ উঠেছিল। মেয়ের বাবা শান্তি-রঞ্জনকে বলেছিলেন, আপনি আর ছেলের নাম খুঁজে পেলেন না। আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবদের জামাইয়ের নাম বলতেই তো আমার লজ্জা লাগবে।

উত্তরে শান্তি-রঞ্জন বলেছিলেন, কেন কাঁঠাল নামে অসুবিধে কোথায়? কাঁঠাল তো প্রেমের প্রতীক। কথায় বলে “পিরিতি কাঁঠালের আঠা লাগলে পরে ছাড়ে না”। আর আপনার মেয়েদের নামই বা কি এমন ভালো। সব নদীর নামে নাম রেখেছেন। যমুনা, পদ্মা, ভাগীরথী, যদি মানুষের নাম হতে পারে, তবে কাঁঠাল, তরমুজ সবেদাতে সমস্যা কোথায়?

আসলে আমার নাম দামোদর আর বউয়ের নাম সরস্বতী, তাই মেয়েদের নামও নদীর নামে রেখেছি। ঠিক আছে ছেলে যখন আমাদের পছন্দ হয়েছে। তখন আর নামের জন্য বিয়ে আটকাবে কেন?

কাঁঠাল ও যমুনার বিয়েটা নির্বিঘ্নেই হয়ে গিয়েছিল। যমুনার একটু আপত্তি থাকলেও, কাঁঠালের অন্যান্য গুনাগুণের মধ্যে অপছন্দের কিছু না পাওয়ায়, এবং বাবার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস না থাকায়, বিয়েতে সম্মতি দিয়েছিল ও।

তবে এখন যুগটা অনেকটাই বদলে গিয়েছে। বাবা মা এখন তাদের সিদ্ধান্ত কখনোই সন্তানদের উপর চাপিয়ে দিতে পারেন না। আখরোট চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট। নিজস্ব ফার্মের সুনাম ও উপার্জন রয়েছে যথেষ্ট। তবে ও যতই গুণবান ও রোজগেরে হোক না কেন, আখরোট নাম শুনে কোন পাত্রীপক্ষই আর অগ্রসর হচ্ছে না। একজন কন্যার বাবা কাঁঠালকে ফোনে বলেছিল, “আপনার আখরোটের জন্য কাঠ-বাদাম নামের কোনও মেয়ে খুঁজুন”শুধু পাত্রী-পক্ষ থেকেই নয়, আখরোট ওর নামের জন্য স্কুল কলেজেও নানা রসিকতার শিকার হয়েছে। আখরোট তাদের বলেছে, আমি শুধু নামেই আখরোট নই, স্বভাবেও আখরোটের মতো শক্ত। কোনও আঘাত সহজে গায়ে লাগে না। আর আখরোটের আকৃতি মানুষের মস্তিষ্কের মতো। আমাদের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলো মস্তিষ্ক দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়।  তবে মুখে যাই বলুক না কেন, আখরোট নিজের এই নামের জন্য বেশ ক্ষিপ্ত ও অসন্তুষ্ট।

যমুনা এমন ভবিতব্য অনুমান করেই, ছেলের নাম ফলের নামে রাখতে কখনোই চায়নি। তবে স্বামী ও বড় ভাসুরের কথা রক্ষার্থে ছেলের নাম ফলের নামে রাখতেই হয়েছিল। যমুনা জাম, লিচু, কলা প্রভৃতিতে নাম না রেখে ছেলের নামের মধ্যে একটু অভিনবত্ব খুঁজেছে। তাই নাম দিয়েছে আখরোট।

আখরোটের বিয়ে নিয়ে যখন পরিবারের সকলেই বেশ চিন্তিত, বেশ কিছুদিন ধরে পাত্রী সন্ধান করেও যখন উপযুক্ত কোন পাত্রীর খোঁজ পাওয়া গেল না ঠিক তখনই জলপাইগুড়ি নিবাসী কাঁঠালের বন্ধু অনিকেতের হোয়াটস-অ্যাপ মেসেজ পায় কাঁঠাল। আর তার সপ্তাহ খানেক পরেই সশরীরে কাঁঠালের বাড়িতে হাজির হয় অনিকেত। তবে অনিকেত একা আসে না, সঙ্গে নিয়ে আসে ওর সহকর্মী এবং তার মেয়েকে। বছর পাঁচেক আগে নর্থ বেঙ্গল বেড়াতে গিয়ে অনিকেতের সাথে শেষ দেখা হয়েছিল কাঁঠালের।

এত বছর পর আবার বন্ধুকে দেখে কাঁঠাল বেশ খুশি। তবে ও আরও খুশি অনিকেতের সঙ্গে আসা মেয়েটিকে দেখে। মেয়েটি একটু স্বাস্থ্যবতী হলেও যথেষ্ট সুন্দরী। অনেকটা পথ ট্রেন জার্নি করে হাওড়া স্টেশন থেকে ক্যাব বুক করে সরাসরি ওরা এসেছে এখানে। তাই প্রথমে লাগেজ রেখে একটু ফ্রেশ হয়ে নিলো ওরা। তারপর চলল প্রাথমিক আপ্যায়ন ও সাধারণ কথাবার্তা। তবে কাঁঠাল এবং ওর পরিবারের সকলেই অনিকেতকে খালি হাতে ঢুকতে দেখে বেশ অবাক হয়েছে।  গাড়ি থেকে ওরা নামার পরেই সকলের নজর গেয়েছে গাড়ির লাগেজের দিকে। না সেখান থেকে কোন দইয়ের হাড়ি বের হয়নি। দীর্ঘদিন পরে বন্ধুর বাড়িতে আসতে হলে যে কিছু নিয়ে আসতেই হবে এমন কোন কথা নেই। কাঁঠাল তো অনিকেতের বাড়ি খালি হাতেই গিয়েছিল। তবে অনিকেত যেখানে নিজের থেকেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে পঞ্চাশ কেজি দই নিয়ে সে আসবে, সেক্ষেত্রে ওর খালি হাতে বন্ধুর বাড়ি ঢোকাতে সকলের অবাক হওয়া খুবই স্বাভাবিক।

কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে বন্ধুকে কথাটা বলেই ফেলল কাঁঠাল।

কিরে তোর পঞ্চাশ কেজি দইয়ের কি হল?

“হ্যাঁ বলেছিলাম পঞ্চাশ কেজি আনবো। কিন্তু পঞ্চাশ কেজি হল না রে। ষাট কেজির উপরেই হয়ে গেল।” বেশ গম্ভীর হয়ে কথাটা বলল অনিকেত। ওর পাশে বসে থাকা ভদ্রলোক এবং তার কন্যা মুখ চেপে হাসি রোধ করার চেষ্টা করছে।

“এই হেঁয়ালি ছেড়ে একটু ঝেড়ে কাশবি?” কাঁঠালের কথায় একটু বিরক্তির প্রকাশ পেল।

“বেশ তাহলে সব কথা খুলেই বলছি। তবে তার আগে তুই বল, আমার এই সহকর্মীর কন্যাটিকে তোদের কেমন লাগছে?” কথা বলতে বলতে মেয়েটির কাঁধে হাত রাখল অনিকেত।

“ভালই তো লাগছে। তা মা তোমার নাম কি? আর তুমি এখন কি করছ? ” অনিকেতের প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে সরাসরি মেয়েটিকে প্রশ্ন করে কাঁঠাল।

“আমি জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বিটেক পাস করে কলেজ ক্যাম্পাসিং-এ একটি চাকরি পেয়েছি। আগামীকাল সেখানে জয়েনিং।“

মেয়েটির কথা শেষে ওর বাবা বলল, মেয়ে কলকাতায় চাকরি পেয়েছে। তাই শ্বশুরবাড়ি কলকাতায় হলেই ওর অফিসের যাতায়াতের সুবিধে হবে। ওর জয়েনিং-এর জন্য আমাদের কলকাতায় আসতেই হত। সেই কথা শুনে অনিকেত আপনাদের সাথে সম্বন্ধ করার একটি প্রস্তাব রাখল। আখরোট সম্পর্কে আমি যেটুকু শুনেছি তাতে ওর নাম ছাড়া অপছন্দের কিছু খুঁজে পাইনি। আর নাম নিয়ে আমি বা আমার মেয়ে কেউ বেশি মাথা ঘামাই না। কারণ আমাদের নাম যতই মিষ্টি হোক না কেন সেটা যে লোকের পছন্দ হবে এমন কোন কথা নেই।

“দেখুন আপনার মেয়েকে আমাদের সকলেরই বেশ পছন্দ হয়েছে। তাছাড়া আপনার কথাবার্তাও বেশ ভালো। তবে এতক্ষণ ধরে আপনাদের সাথে কথা বলছি আপনাদের নামটাই জানা হয়নি।”

কাঁঠালের কথার উত্তরে অনিকেত বলল, হ্যাঁ এবারের নামের প্রসঙ্গে আসি। তোদের পরিবারের সবার নাম যেমন ফলের নাম দিয়ে, ঠিক তেমনি আমার এই সহকর্মীর পরিবারের সকলের নামই মিষ্টির নামে। আমার এই সহকর্মীর নাম চমচম দে আর ওর ভাইয়ের নাম পায়েস দে। চমচমের মেয়ে দই। পায়েসের ছেলে লাড্ডু। দইয়ের ওজন পঞ্চাশ কেজির মতোই ছিল। তবে সম্প্রতি বাড়িতে বসে খাওয়া দাওয়া করে ওজন প্রায় দশ কেজির মত বাড়িয়ে ফেলেছে। অফিসে যাতায়াত শুরু করলে আশা করি আবার সেটা কমে যাবে।

“আপনার নাম চমচম! আর আপনার মেয়ের নাম দই! ” কথাটা বলেই কাঁঠাল ফিক করে হেসে ফেলল।

“একদম হাসবেন না। আপনার নাম কাঁঠাল আর আপনার ছেলের নাম আখরোট শুনেও আমি এবং আমার মেয়ে হাসি থামাতে পারছিলাম না। পরে ভাবলাম রবীন্দ্রনাথ তো বলেছেনই “নামে কি এসে যায়।”

“কথাটা রবীন্দ্রনাথ নয় শেক্সপিয়ার বলেছিলেন।” চমচমদের ভুল সংশোধন করে দিল কাঁঠাল খান।

“ওই একই হল। নামে কি আর এসে যায়।” হাসতে হাসতে বললেন চমচম বাবু। ওনার কথাতে বাড়ির সকলেই হেসে ফেলল।

এরপর একটি শুভ দিন দেখে আখরোট ও দইয়ের বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ে বাড়ির সামনে “আখরোট ওয়েডস দই” কথাটি লেখা দেখে সকলে শুধু অবাকই হয়নি, কত লোক যে সেই ছবি তুলে ফেসবুক ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করেছে তা গুনে শেষ করা যাবে না।

তবে লোকে যাই বলুক, আর যত হাসাহাসিই করুক না কেন, বিয়ের পরে আখরোট দই মাখামাখি হয়ে ভালোই আছে।


লেখক পরিচিতি : জয়দীপ চক্রবর্তী
লেখক জয়দীপ চক্রবর্তী প্রতিলিপিতে একটি পরিচিত নাম। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়ে চলেছে তার লেখা। আকাশবাণী কোলকাতায় সম্প্রচারিত হয়েছে তার লেখা নাটক। পেশাদারী থিয়েটার দল “অবেক্ষণ” তার লেখা নাটক মঞ্চস্থ করছে কোলকাতার নামকরা কিছু মঞ্চে। তার কাহিনী চিত্রনাট্যে তৈরি সর্ট ফিল্ম, অডিও স্টোরি, প্রচারিত হয়ে চলেছে ইউটিউব চ্যানেলে। প্রতিলিপি এফ.এমেও প্রচারিত হয়েছে তার লেখা অডিও-স্টোরি। ২০১৮-এর কলকাতা বইমেলায় তার লেখা হাস্য রসাত্মক বই “রাশি রাশি রসিকতা” প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিলিপি আয়োজিত প্রতিযোগিতা গুলিতে অংশগ্রহণ করে বহুবার জিতে নিয়েছে নানা প্রকার পুরষ্কার। লেখকের “লাল-গোলাপ” উপন্যাসটি প্রতিলিপি পুস্তক আকারে মুদ্রিত ও প্রকাশিত করেছে। লেখকের সাথে মোট চৌত্রিশটি গল্প নিয়ে বাণিজ্যিক চুক্তিবদ্ধ হয়েছে প্রতিলিপি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।