লেখক : দামিনী সেন
নিজের মহলেরই পিছনের ছোট্ট অংশটায় দাঁড়িয়েছিল সে। মহলের একমাত্র গবাক্ষটি এখানেই। উঁচু প্রাসাদের পিছনের অংশ ঢালু হয়ে নেমে গেছে নিচের দিকে। অনেকটাই নিচে। ওখানেই ইউরোটাস নদীতীরে শহরের মূল বন্দর। এদেশের অন্যান্য অনেক বসতির মতো এ’ বন্দরের অবস্থান সমুদ্রের বুকে নয়। বরং কিছুটা ভিতরের দিকেই।
সূর্যদেব হেলিওসের চার ঘোড়ায় টানা রথ যখন সারাটা আকাশ পাড়ি দিয়ে নেমে আসে পশ্চিমে, সন্ধ্যে নামার সেই একটু আগের সময়টিতেই সে একবার উঁকি দিয়ে যায় এই গবাক্ষ পথে। সারা দিনে এই একটিবারই। অন্তিম সূর্যের সেই নম্র লালিমা মুখে একটু মেখে নেবার লোভ সে আজও সামলাতে পারে না, এমনকি এই প্রৌঢ়ত্বের সীমানা ছুঁয়ে ফেলা বয়সেও। তাই প্রতিদিনই দিনের এই সময়টিতে সে এসে দাঁড়ায় প্রাসাদের পিছন দিকের এই গবাক্ষের কাছে।
আজও দাঁড়িয়েছিল সে এখানে। তাকিয়েছিল অনেক নিচে সেই নদী ও বন্দরটারই দিকে। আশৈশব কত স্মৃতি তার এই নদী জুড়ে। সেই তার জন্ম থেকেই। পেফনোস দ্বীপে জন্মের পর তার মা লেডা সশঙ্ক চিত্তে তাকে বুকে আঁকড়ে ধরে এই পথেই তো এসে পৌঁছেছিল এখানে, প্রাসাদে। এই নদী দিয়েই। তারপর কিশোরী বয়স – কত স্মৃতি, এখনও যেন ভাসে তার চোখের সামনে। দুই ভাই কাস্টর ও পলিডেউকেসের সাথে হুল্লোড়, নদীতীরের বালিতে কুস্তি অনুশীলন, ঘোড়ায় চড়া শেখা, বল্লম ছোঁড়া, শিকার করা – মেয়ে বলে ছাড় ছিল না কিছুতেই। তার বাবা – হ্যাঁ, বাবাই তো, দীর্ঘদিন পর্যন্ত তাই তো জানত সে, বাকি তিন ভাইবোনের সাথে নিজের কোনও পার্থক্য তো বোঝেনি কখনও তার সেই শৈশব-কৈশোরের স্বপ্নের দিনগুলোতে – দেশের নিয়ম মেনে দুই ভাই’এর সাথে তার জন্যও সবরকম শিক্ষা ও শরীরচর্চার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। মেয়ে বলে আলাদা করে রাখেননি ভাইদের থেকে।
কিন্তু আজ তারা কোথায়? আপনার বলতে স্মৃতিতে ভেসে ওঠে যে ক’টা নাম, কেউই আর বেঁচে নেই এই পৃথিবীতে। এমনকি দিদি ক্লাইটেমনেস্ট্রা – এই দিদির সাথেই তার কিছুটা দূরত্ব ছিল – তারা আবার এই প্রাসাদে ফিরে আসার কিছুদিন আগেই সেও ছেড়ে গেছে তাকে চিরতরে। নিজেরই ছেলের হাতে মরতে হয়েছে তাকে।
সূর্যদেব হেলিওসের রথ দিগন্ত অতিক্রম করে নেমে যাচ্ছে ধীরে ধীরে পৃথিবীকে ঘিরে থাকা সমুদ্র ওসেনাস’এর বুকে। তার রক্ত লাল রং ছড়িয়ে পড়েছে সারা পশ্চিম আকাশে। উফ্, কী প্রচণ্ড লাল, ঠিক যেন রক্ত। রক্ত, রক্ত – আর কত রক্ত দেখতে হবে তাকে এই এক জীবনে !
পিছনে পোশাকের সামান্য খসখস শব্দে ছেদ পড়ে তার চিন্তায়। এতদিন – এত-দিন ধরে এতরকম অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে পাড়ি জমাতে জমাতে আসলে আজ তার ইন্দ্রিয়গুলো যেন একটু বেশিই সতর্ক। অথচ আজ তার এই মৃতকল্প জীবনে এই সতর্কতার আর প্রয়োজন কোথায় !
পিছনে এসে দাঁড়িয়েছ ফাইলোস, নতমুখী নম্র কিশোরী, তার অন্যতমা খাস ভৃত্যা। মিশরের বুক থেকে তুলে আনা। একটু চাপা, গলিত মধুর মতো রং, মুখটাও ঠিক তেমনই মিষ্টি। তার প্রিয়। আচ্ছা, ওও তো ছেড়ে এসেছে ওর বাবা, মা, পরিবার – ওর সব কিছু। একা একা ওর মনেও কি তবে এমনই উথাল-পাতাল চলে? নাকি এ’ রোগ শুধু তার একান্তই নিজস্ব। এত এত রক্তের দাগ আর কারই বা লেগে থাকে সারা অস্তিত্ব জুড়ে।
– কিছু বলবি?
– হ্যাঁ মহামান্যা, অতিথি।
অতিথি ! তার কাছে। এখনও। এই সর্বজনঘৃণ্যার কাছে কার আবার আজ এমন কী প্রয়োজন পড়ল যে দেখা করতে আসে? আশ্চর্য মোলায়েম মুখে ভুরু দু’টো সামান্য শুধু কুঁচকে উঠল তার – “কে?”
– জানি না, মহামান্যা। মহারাজের মহল থেকে এটোনেউস এসে খবর দিল – পাইলোস থেকে দুই অতিথি এসে আজ রাজ-আতিথ্য গ্রহণ করেছেন। তাঁদেরই মধ্যে একজন মহামান্যার সাক্ষাতপ্রার্থী।
– আচ্ছা, নিয়ে আয়।
ক্লান্ত পদক্ষেপে ভিতরের ঘরের দিকে পা বাড়ায় সে। তার সেই রাজকীয় চলনবিভঙ্গের দিক থেকে চোখ ফেরাতে না পেরে নির্নিমেষ নয়নে সেদিকে চেয়ে থাকে ফাইলোস – কী সুন্দর।
একটু পিছন দিকে হেলানো একটা আরামপ্রদ আসনে এসে বসেছিল সে। বসার আসনে তড়িঘড়ি মোলায়েম মখমলসদৃশ মসৃণ কাপড়টা বিছিয়ে দিয়ে পা রাখার জন্য ছোট্ট টুলটা এগিয়ে দিয়েছিল আদরাসতে – এখানে তার অপর খাস ভৃত্যা। মধ্যবয়সী মহিলা। কিন্তু তার কাছে একেবারেই নতুন। আসলে প্রায় দু’ দশক তো আর কম সময় নয়। তার শৈশব-কৈশোরের অতি পরিচিত প্রাসাদ, নগরী, লোকজন – সবই কতই না বদলে গেছে এর মধ্যে।
সামনের কারুকার্য করা পাথরের স্তম্ভদু’টোর মাঝে ঝোলানো হাল্কা রঙিন কাপড়ের পর্দাটা ঠেলে ভিতরে এসে ঢুকলো প্রথমে ফাইলোস, তারপর তাকে অনুসরণ করে এক নিতান্তই তরুণ। বয়স বোধহয় এখনও কুড়িও পেরোয়নি। পিঙ্গলবর্ণ একরাশ চুল, কাঁধ পর্যন্ত তার বিস্তার। তার অবিন্যস্ত দু’এক গোছা ঝুলে এসেছে কপালেও। কিন্তু তরুণের মুখে কেমন এক বিষণ্ণতার ছোঁয়া। তার বিহ্বল দৃষ্টি দেওয়ালের সোনা-রূপা-তামার কারুকার্য আর দেওয়ালের ধারে ছোট ছোট বেদীতে রক্ষিত নানা আকারের ব্রোঞ্জ ও মাটির পালিশ করা চিত্রিত পাত্রগুলোর উপর ঘুরতে ঘুরতে তার মুখের উপর এসে স্থির হলে কেমন চমকে উঠল সে। সে চোখে যেন কোনও এক অতি পরিচিতের ছোঁয়া !
– বোসো, তরুণ। এই হতভাগ্যার আতিথ্য গ্রহণ কর।
তার চোখের ইশারার পাঠোদ্ধার করতে দেরি হল না বুদ্ধিমতী ফাইলোসের। সাথে সাথেই রুপোনির্মিত একটি বেসিন অতিথির কাছে স্থাপন করা হল। তারপর সোনার জল করা ব্রোঞ্জের উজ্জ্বল পাত্র থেকে অতিথির হাতে ধীরে ধীরে ঢেলে দেওয়া হল ফুলের পাপড়ি ভাসা সুগন্ধি জল। হাত ধোওয়া শেষ হতেই অতিথির পাশ থেকে বেসিনটা সরিয়ে নিয়ে আনা হল একটি ছোট টেবিল। ফাইলোস আর আলসিপে সেখানে সাজিয়ে দিল রেকাবিতে করে ফল, রোস্টেড মাংস, রুটি। সোনার পানপাত্রে পরিবেশিত হল পানীয়।
– বল তরুণ। শুনেছি তুমি পাইলোস থেকে এসেছ, মহান নেস্টরের কাছ থেকে। বল, কী তোমার পরিচয়? কেন তোমার আগমন এই হতমানার কাছে?
– নিজেকে এভাবে হতমানা বলবেন না মহামান্যা। আমি এসেছি সেই সুদূর ইথাকা থেকে – ইজিয়ান সাগরের বুকে তুচ্ছ এক দ্বীপ। আপনার প্রাসাদের এই অতুল ঐশ্বর্য আমার কল্পনাতীত।
তা বটে। উত্তরে মুখে শুধু অল্প হাসি ফুটে ওঠে তার। আর মনে মনে ভাবে, লুটপাটের কোনও বড় ঐতিহ্য তার মানে তোমাদের নেই তরুণ। আর গত আঠারো বছর ধরে ওটাই এ’ প্রাসাদের অধিপতির একমাত্র ইতিহাস। ঐশ্বর্যের ঝকমকানিতে চোখ তো তবে তোমার ধাঁধাবেই।
– ইলিয়াম নগরী থেকে ফিরে এসেছেন প্রায় সব আখাইয়ান বীর। শুধু সামান্য দু’ একজন যাঁরা আজও ফিরতে পারেননি, আমার বাবা তাঁদেরই একজন। আমি জ্ঞানীবৃদ্ধ, রাজা নেস্টরের কাছে এসেছিলাম, তাঁরই খোঁজে। তাঁর পরামর্শেই তাঁর পুত্র পিসিস্ট্রাটুসের সাথে আমি আজ আপনাদের শরণার্থী। আমি বীর ওডিসিয়ুসপুত্র তেলেমাখুস। রাজা মেনেলাওস আমাদের যথোপযুক্ত অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। এখন আমি আপনার কাছে এসেছি। আমার পিতা সম্পর্কে যেটুকু যা জানেন, অনুগ্রহ করে বলুন মহামান্যা আমাকে।
কী বলবে সে? তরুণের কথা শুনতে শুনতে, তার করুণ কিন্তু অনিন্দ্যসুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে যে খালি মনে পড়ে যাচ্ছে, তার বাবার কথাই। সেই ওডিসিয়ুস – সামান্য যে কয়েকজনের জন্য এখনও শ্রদ্ধার আসন রক্ষিত তার বুকে, তারই একজন। এই যে এত রক্তপাত, ধ্বংস – তারপর আজও যে সে অক্ষত দেহে বেঁচে আজ রানির বেশে এখানে বসে আছে, সেও কি সম্ভব ছিল ঐ ওডিসিয়ুস না থাকলে? জানোয়ারটা তো প্রচাণ্ড আক্রোশে তুলেই ধরেছিল তলোয়ার, তাকে কেটে ফালা ফালা করবে বলে। চারিদিকে জড়ো হওয়া সবক’টি কণ্ঠেরও তো তখন ঐ জ্বলন্ত মুহূর্তে ঐ একটাই ছিল দাবি – ছিঁড়ে ফেল, কেটে টুকরো করে ফেল ডাইনিটাকে। পাশেই পড়েছিল ডেইফোবুস’এর রক্তাক্ত দেহ। ঘুম ভেঙে ধড়ফড় করে উঠে এমনকি নিজ বর্শাটুকুও খুঁজে পায়নি সে। ব্রোঞ্জের বর্শাফলক এসে বিদীর্ণ করে দিয়েছিল তার বুক, শয্যাতেই।
অবশ্য একদিক থেকে নিজের কাজের সঠিক প্রত্যুত্তরই পেয়েছিল সে। নগরপ্রাকারের বাইরে তার মাত্র ক’দিন আগেই তার নিজের দাদা, সারা নগরীর একমাত্র আশাভরসা, মহাবীর হেক্টর নিজের বর্শাটা ছুঁড়ে মেরে যখন ফিরে তাকিয়েছিল ভাই ডেইফোবুসের দিকে, অস্ত্রের প্রত্যাশায়, সাক্ষাত-মৃত্যু উন্মত্ত আকিলিসের সামনে নিরস্ত্র দাদাকে ফেলে পালিয়ে গিয়েছিল এই ডেইফোবুস। সেদিক থেকে ভাগ্যের সঠিক বিচারই জুটেছিল তার। কিন্তু তার নিজের? আগুন, রক্ত, কালো ধোঁয়া, হাজার হাজার মানুষের মরণ আর্তনাদ আর লুটেরাদের উন্মত্ত উল্লাসের সেই নারকীয় রাতে তখন ঐ ডেইফোবুসের দেহটারই পাশে বিহ্বল অবস্থায় পড়েছিল সে। সামনে উদ্যত-তলোয়ার সাক্ষাত-মৃত্যু এক প্রবল আক্রোশের প্রতিমূর্তি – মেনেলাওস ( ‘মেনেলাওস’ নামটির আদত অর্থও তো তাই – আক্রোশ, ক্রোধ)। ঠিক সেই মুহূর্তে বিচক্ষণ ওডিসিয়ুসই তো –
– হ্যাঁ, তরুণ তেলেমাখুস। তোমার বাবার বিচক্ষণতা আমাকে বহুবার রক্ষা করেছে বিপদের হাত থেকে। সেই আমার বিয়ের সময় – সে আজ থেকে প্রায় তিন দশক আগের কথা। আমার পাণিপ্রার্থনা করতে হাজির হয়েছিল সারা আখাইয়া থেকে ৩৫ জন বীর। আমার বাবা রাজা টিন্ডারেউস ভয় পেয়েছিলেন, তাদের মধ্যে কোনও একজনকে আমি বেছে নিলে তাই নিয়েই না বাকিদের সাথে শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ। সমাধান জুগিয়েছিলেন ওডিসিয়ুসই। তাঁরই প্রস্তাব অনুযায়ী উপস্থিত সকলে শপথ নেয়, যে আমার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হিসেবে মেনে নেওয়া হবে। শুধু তাই নয়, আমাকে যদি কেউ তার কাছ থেকে কখনও ছিনিয়ে নেয়, তার বিরুদ্ধে তারা সবাই জোটবদ্ধ হয়ে যুদ্ধে যেতে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবে।
কথাগুলো বলতে বলতে নিজেরই অজান্তে ঠোঁটদু’টো একটু বেঁকে আসে তার। খুবই বিচক্ষণ সমাধান। এত এত যে রক্তপাত তারপর, এত যুদ্ধ, ধ্বংস, রাহাজানি – সবেরই তো গোড়ার কথাটুকু লুকিয়ে এখানেই।
– হ্যাঁ, মহামান্যা। আমি মা’র কাছে শুনেছি। আমার বাবা ছিলেন গরিব, তাঁর সাধ্য ছিল না আপনার উপযুক্ত পণ দেওয়ার। তাছাড়া তাঁর হৃদয় অধিকার করে ছিল আপনারই সম্পর্কিত এক বোন, পেনিলোপে – আমার মা। তাই তিনি রাজা টিন্ডারেউসের সমস্যা অনুধাবন করে তাঁকে এই পরামর্শ দেন।
– পেনিলোপে, আমার প্রিয় বোন। কতদিন দেখিনি তাকে। কেমন আছে সে?
– আজ প্রায় দু’ দশক যাঁর স্বামীর খোঁজ নেই, কতটা ভালো তিনি থাকতে পারেন, মহামান্যা?
তরুণও কি তবে তার মায়ের বিরহদুর্দশার জন্য তাকেই দায়ি করছে? অবশ্য দোষ কী তাতে। সবকিছুর জন্যই সব দায় তো এখন তারই – শুধুই তার। এত এত দায় বহন করতে করতে তার কাঁধদু’টো এখনও কেন যে ভেঙে পড়ে না কিছুতেই কে জানে।
– কিন্তু মহামান্যা, আপনি শেষপর্যন্ত যাঁকে বেছে নিয়েছিলেন, সেই মেনেলাওস তো সেখানে সেদিন উপস্থিতই ছিলেন না !
তরুণের কৌতুহল তাকে আবার ফিরিয়ে আনে বাস্তবের মাটিতে। কিন্তু এই প্রায় নাবালককে সে কী করে বোঝায় – সে’দিনের সভায় সিদ্ধান্ত শুধু নামেই ছিল তার। মেনেলাওস সেখানে উপস্থিত না থাকলেও তার হয়ে সেখানে উপস্থিত ছিল তার দাদা মহা পরাক্রান্ত অ্যাগামেমনন – সেই অ্যাগামেমনন, যে তার ঠিক আগেই মাইকিনি থেকে রাজা থিয়েস্টেসকে বিতাড়িত করে দখল নিয়েছে সে দেশের, পিসার রাজা টান্টালুসকে তার সদ্যোজাত সন্তানসহ হত্যা করে দখল নিয়েছে তার বিধবা স্ত্রী, দিদি ক্লাইটেমনেস্ট্রাকে। কার ঘাড়ে তখন ক’টা মাথা – সেই অ্যাগামেমননের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়।
তার ম্লান স্মিত হাসির মধ্যেই নিশ্চয় উত্তর খুঁজে নেয় বুদ্ধিমান তরুণ। কিন্তু তার জিজ্ঞাসু নয়ন আবার ফিরিয়ে আনে তাকে তরুণের বাবার প্রসঙ্গে।
– দু’বার, আরও দু’বার তাঁর সাথে দেখা হয়েছিল আমার, ট্রয় নগরীতে। প্রথমবার তিনি গিয়েছিলেন দৌত্যে – আমাকে ফিরিয়ে দেবার প্রস্তাব নিয়ে। স্বভাবতই সে’ প্রস্তাব নাকচ হয়েছিল রাজা প্রায়ামের দরবারে। আমার সম্মতি নিয়েই।
– কেন, মহামান্যা ! আপনি তো হয়েছিলেন অপহৃতা। সেখানে আপনার সম্মতির প্রশ্ন আসে কোথা থেকে !
এত, এত বছর পরও তরুণের এই বিস্মিত প্রশ্নের সামনে পড়ে গালদু’টো তার কিছুটা যেন গরম হয়ে ওঠে। বেশ বুঝতে পারে সে। বুঝতে পারে না প্রথমে – কী বলবে। তার নামে তো ইতিমধ্যেই চালু কত গল্প, কত গাথা। কিন্তু সত্য তার মধ্যে কতটুকু? তারও তো কিছু কথা আছে। কোথাও, কোনও একটা জায়গায় তো অন্তত সে’ কথাগুলো বলে যাওয়া দরকার তারও। এই তরুণকে দেখে তার মনে হয় বেশ বিচক্ষণ, ভরসা করে অন্তত কিছু কথা বলা যায় তাকে। তারপর একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছায় সে। মনের ক্ষোভ, অভিমান, দুঃখ, লজ্জার অনুভূতি আর সেদিনের সেই সম্মান ও ভালোলাগার স্মৃতিটাকে জোর করেই পাশে ঠেলে সরিয়ে রেখে ধীরে ধীরে উচ্চারণ করে –
– বিজয়ীর কথা দিয়েই ইতিহাস লেখা হয়। তাদের কথাই প্রচার পায় সত্য হিসেবে। কিন্তু বিজিতদেরও কিছু কিছু কথা থাকে তেলেমাখুস। অপহৃত তো আমি হয়েছি জীবনে অনেকবারই। সেই নেহাত কিশোরী বয়সেই প্রথম। থেসেউস তুলে নিয়ে যায় আমাকে, নিয়ে গিয়ে রাখে এথেন্সে তার মা, এথ্রার কাছে। সেখানেই প্রথম অভিজ্ঞতা বলাৎকারের। আমার দুই ভাই সেখান থেকে গিয়ে উদ্ধার করে আমায়। ফিরে আসি আমি এই প্রাসাদে, আমার বাবা রাজা টিন্ডারেউস ও মা লেডার কাছে। সঙ্গে সেই বলাৎকারের ফল – সদ্যোজাত শিশু ইফিগেনেয়া। কই, বাবা তো তখন ফেলে দেননি আমাকে। বুকে টেনে নিয়েছিলেন মাও। কেনই বা নেবেন না? ধর্ষণজাতা কন্যা আমি, আমার মা লেডার প্রতি দেবরাজ জিউসের লালসার ফল। আমিও তেমনই শিকার হয়েছি অন্য একজনের লালসার। তাতে আমার কী দোষ !
– ইফিগেনেয়া আপনার কন্যা ! তবে যে শুনি –
– না, তেলেমাখুস। যা জানো, তা ভুল। ইফিগেনেয়া আমারই কন্যা। দিদি ক্লাইটেমনেস্ট্রা তাকে বুকে তুলে নেয় সেদিন শুধু আমার কিশোরীবেলাকে ভারমুক্ত রাখতে, অসময়ের মাতৃত্বের ভারে যাতে আমি ন্যুব্জ না হয়ে পড়ি। আর সেই কারণেই ট্রয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার আগে দেবতাদের সন্তুষ্টির নামে তাকে হত্যা করতে দাদা অ্যাগামেমননকে উদ্বুদ্ধ করে মেনেলাওস। একটি সুন্দর নিষ্পাপ ফুলকে তার ফুটে ওঠার মুহূর্তেই সরে যেতে হয় পৃথিবীর এই রঙ্গমঞ্চ ছেড়ে।
– কিন্তু যখন আলেকজান্দার আপনাকে অপহরণ করে –
– অপহরণ ! কে বলেছে? আমি স্বেচ্ছায় গিয়েছিলাম। অনিন্দ্যকান্তি ঐ যুবক, প্যারিসের মধ্যে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম এমন একজনকে – যার নরম মন আমাকে বুঝতে চায়, আমার ইচ্ছে-অনিচ্ছেকে মর্যাদা দেয়; ক্রোধন্মত্ত রক্তের নেশায় সে শুধু খুন করে বেড়ায় না, বীণা হাতে সঙ্গীতে খুঁজে পায় আনন্দ। সঙ্গিনী যার কাছে নেহাতই দৈহিক ক্ষুধা মেটানোর এক মাধ্যম নয়, একজন মানুষ – যার মন আছে, অনুভূতি আছে, আছে যার নিজস্ব ইচ্ছে-অনিচ্ছে, ভালোলাগা, মন-খারাপ। ট্রয় নগরীতে ঐ দশটি বছরই জেনো – আমি পেয়েছি প্রকৃত সম্মান। একজন মেয়ে বাড়ির বধূ হিসেবে যে আদর, যে সম্মান আশা করে – রাজা প্রায়াম, রাজপুত্র হেক্টর, তাঁর স্ত্রী আন্দ্রোমাখে, প্রত্যেকের কাছ থেকে আমি ঠিক তাই পেয়েছি। কেন আমি তবে সম্মতি দেব, এই ক্রোধন্মত্ত জানোয়ারটার কাছে ফিরে আসার?
– কিন্তু মহামান্যা, আপনি যখন ছেড়ে গিয়েছিলেন এই পুরী, আপনার কন্যা হারমিয়োনে তো তখন মাত্র নয় বছর –
– হ্যাঁ, প্রতিরাতে এক উন্মত্ত যৌনক্ষুধার কাছে বাধ্যতামূলক আত্মসমর্পণের ফল। তাছাড়া, তার সাথে আমার সম্পর্ক ছিল কতটুকু? এ’ পুরী তখন তার পুরনো সব ঐতিহ্য ছেড়ে নতুন রাজার বেঁধে দেওয়া নিয়মে এক দমবন্ধ প্রাসাদ। রানির হাতে শিশু সেখানে নেহাতই সভাস্থলের শোভা, দৈনন্দিকতায় স্থান তো তার অন্য ভৃত্যাদেরই হাতে। ফলে আমার থাকা না থাকায় সেখানে পার্থক্য কতটুকু?
– কিন্তু রাজা টিন্ডারেউস তো মেয়েকে ভালোবেসেই তাঁর রাজ্য ও এই প্রাসাদ তুলে দিয়েছিলেন তাঁর জামাতার হাতে –
– লোকে তাই জানে বটে। কিন্তু জামাতা যখন হয় মেনেলাওসের মতো ভয়ঙ্কর কেউ, এবং শ্বশুরের ভার লাঘব করার উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছায় তাঁর দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিতে চায়, স্বেচ্ছায় রাজত্বদান করে অন্যত্র চলে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে কি?
– আপনি যে বলছিলেন, বাবার সাথে আরও একবার আপনার দেখা হয় ট্রয় নগরীতে?
– হ্যাঁ, তখন যুদ্ধ চলছে। নগরীর ভিতরের সংবাদ জানতে ছদ্মবেশে ওডিসিয়ুস প্রবেশ করেছিলেন প্রাকার অভ্যন্তরে। ছেঁড়া পোষাক, ধূলি-ধূসর শরীর। আর সবার চোখকে ফাঁকি দিতে পারলেও আমার কাছে ধরা পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। ইচ্ছে করলেই ধরিয়ে দিতে পারতাম। দিইনি। ভিতরের বন্ধুত্ব ও শ্রদ্ধা বাদ সেধেছিল বোধহয়। গোপনে ডেকে নিয়েছিলাম ঘরে। নিজহাতে গাত্রমার্জন করে খেতে দিয়েছিলাম ক্লান্ত মানুষটিকে। তারপর গোপনে পার করে দিয়েছিলাম নিরাপদে নগর প্রাকার। কিন্তু তারপর সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া খবরকে ভিত্তি করেই যখন আক্রমণে নিহত হয়েছিল শতশত ট্রয়যোদ্ধা, তাদের রমণীদের কান্না – নিজেকে সেই একটিবার সত্যিসত্যিই ভারি অপরাধী মনে হয়েছিল, জানো।
– সেইকারণেই কি ট্রয়ের ঘোড়াকেও সন্দেহ করেছিলেন আপনি? তার চারপাশে ঘুরে ঘুরে –
সেই স্মিত ম্লান হাসিটা ফিরে আসতে দেখে সসম্ভ্রমে থেমে যায় তরুণ। আসলে কী জবাব সে দেবে তাকে। ট্রয় নগরীতেও ততদিনে সে সম্পূর্ণ ব্রাত্য। হেক্টর নেই। প্যারিসও নিহত ফিলোকটেটেসের বিষাক্ত তিরে। বৃদ্ধ রাজা প্রায়ামের সাধ্য কি – পুত্রবধূকে রক্ষা করে নগরবাসীর সম্মিলিত ক্রোধের হাত থেকে। এতদিনের ভয়ঙ্কর যুদ্ধ ও এত মৃত্যুর জন্য সবারই অভিযোগের আঙুল তখন তারই দিকে। শেষ চেষ্টা হিসেবে রাজা প্রায়াম রীতি অনুযায়ী নিহত প্যারিসের ছোটভাই ডেইফোবুসের হাতে তুলে দেয় তাকে – সেই ডেইফোবুস, যার বিশ্বাসভঙ্গের জেরেই হেক্টরকে খালি হাতে অসহায় মৃত্যুবরণ করতে হয় আকিলিসের হাতে।
তবু ট্রয়ের কাছে তার অনেক ঋণ, অনেক কৃতজ্ঞতা। নগরপ্রাকারের মধ্যে নিয়ে আসা কাঠের ঘোড়াটাকে দেখেই সন্দেহ হয় তার। এগিয়ে যায় সে ঘোড়াটার দিকে। ডাকতে থাকে গ্রিক বীরদের নাম ধরে ধরে, তাদের দীর্ঘদিনের না দেখা স্ত্রীদের গলা নকল করে। আজ সে জানে, অনুমান ঠিকই ছিল তার। কাজও হয়েছিল তার কৌশলে। গ্রিকরা ধরা দিয়ে ফেলেছিল প্রায়। কিন্তু উৎসবমত্ত ট্রয়বাসী আর সময় দেয়নি তাকে, উদ্ধত ডেইফোবুসও বোকার মতোই তাকে টেনে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।
– আমি যতটা জানি সবই তোমায় বললাম তেলেমাখুস। তোমার বাবা অত্যন্ত বিচক্ষণ মানুষ। যেখানেই থাকুন, যত দূরেই, ঠিক তিনি ফিরে আসবেন তোমার মা পেনিলোপের কাছে। এ’ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
হাত বাড়িয়ে পাশের রূপার ঝুড়ি থেকে সোনার তৈরি একটি চুল বাঁধার কাঁটা তুলে আনে সে। তুলে দেয় তা তরুণের হাতে। বলে –
– মিশরের ধনি পলিবুসের স্ত্রী আলকান্দ্রের আমায় দেওয়া এই উপহারটা নিয়ে যাও তেলেমাখুস। তোমার মাকে দিও। বলো তার হতভাগ্য বোনের এ এক সামান্য উপহার।
– মহারাজ মেনেলাওস আমাকে অপূর্ব দু’টি ঘোড়াসহ একটি রথ উপহার দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের ছোট্ট জাহাজের সে রথ বহনের ক্ষমতা নেই। আর আমাদের ইথাকার জমিও পাথুরে। ছাগল চড়াবার মাঠ সেখানে থাকলেও, এত সুন্দর ঘোড়া পালন করা সেখানে মুশকিল। তাই আমি তাঁর উপহার নিতে পারিনি। কিন্তু আপনার এই দান আমি সসম্মানে মাথা পেতে গ্রহণ করলাম।
তরুণ তেলেমাখুসের অপসৃয়মান পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দৃষ্টিটা কেমন ঝাপসা হয়ে এল তার। তার বাবার সাথে তার আরও একবার দেখা হয়েছিল তো। সে কথাটা কিছুতেই যে সে আর বলে উঠতে পারেনি তেলেমাখুসকে। সেই ভয়াল রাতে, যেদিন ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, মুছে গিয়েছিল রাজা প্রায়ামের গর্বের নগরী ইলিয়াম পৃথিবীর মানচিত্র থেকে – ঐ ক্রোধন্মত্ত দানবটা যখন তলোয়ার তুলে ধরেছিল তাকে ফালা ফালা করে কাটবে বলে, চারিদিকে উল্লাস – কেটে ফেল এবার ডাইনিটাকে, সাক্ষাত মৃত্যুর সেই পূর্ব মুহূর্তে, ঠিক সেই সময় সেখানে এসে দাঁড়িয়েছিল বিচক্ষণ ওডিসিয়ুস। হাতের ধারালো তলোয়ারটা দিয়ে সে শুধু কেটে দিয়েছিল তার পোশাকের কাঁধের নটটুকু। সমস্ত পোশাক খুলে পড়েছিল তার দেহ থেকে। চারিদিকে থেমে গিয়েছিল মুহূর্তে সব কোলাহল; খসে পড়েছিল উদ্যত তলোয়ার বিহ্বল মেনেলাওসের হাত থেকে। সেই ধোঁয়া, রক্ত আর আগুনের নরকের মাঝে তাদের সামনে নিজের সমস্ত সৌন্দর্যকে উন্মুক্ত করে দাঁড়িয়ে যে এক স্বর্গীয় সৌন্দর্য – হেলেন। আচ্ছা, বারে বারে এত বিচক্ষণতার কোনও দাবি কি কখনও সে করেছিল ওডিসিয়ুসের কাছে !
লেখক পরিচিতি: দামিনী সেন
গত শতাব্দীর শেষ পাদে জন্ম। ছেলেবেলা কেটেছে মফস্সলে। সেখানেই পড়াশুনো — স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন। ঘুরতে ভালোবাসেন, আর ভালোবাসেন পড়তে। জানেন একাধিক বিদেশি ভাষা। আগ্রহ বহুমুখী, কলমের অভিমুখও। কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস — সাবলীল তাঁর কলমের গতি। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ইতিমধ্যেই প্রকাশিত বেশ কিছু কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প। কাব্যগ্রন্থ “ভাঙা সে সাম্পান” প্রকাশের পথে। ধারাবাহিক উপন্যাস “ভাঙা মঞ্চের মঞ্চিনী”-র মধ্য দিয়েই ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ।
খুব ভালো লাগলো।