ফ্রি কা খানা

লেখক : অভীক সিংহ

অর্থনীতির পরমপূজ্য প্রপিতামহ শ্রী শ্রী শ্রীমদ্ভাগতবৎ অ্যাডাম স্মিথ কোন এক পুণ্যপ্রভাতে হাতে নিমদাঁতন নিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে ডিম-টোস্টের গন্ধ পেয়ে পকেট হাতড়ে কোন খুচরো উদ্ধার করতে না পেরে মনের দুঃখে বলে গিয়েছিলেন, “There is no such thing as free lunch”। কিন্তু ভাবুন আপনি হায়দ্রাবাদের প্যারাডাইসে গিয়ে বসলেন, আর বেয়ারা এসে আপনার সামনে রাখল একপ্লেট গরমাগরম ধোঁয়া ওঠা সুবাসিত সানরাইজ চিকেন বিরিয়ানি, আর তার সাথে প্রেমময় স্বরে বলে উঠল সেই তিনটি যাদুকরী শব্দ, “পয়সা লাগবে না।” উফফ! ব্যাপারটা ভাবতেই পাকস্থলীর ভিতরে একপাল ছাগল যেন তারস্বরে ম্যা-ম্যা করতে শুরু করে দেয়। আসলে চাহিদা আর যোগানের সেই পুরনো খেলাটা খেলতে খেলতে সব জিনিসের দাম দিতে দিতে যখন আপনি ক্লান্ত, তখন পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনার মত একটু ফ্রি পেয়ে গেলে মন্দ কি? কিন্তু সবাই যেভাবে কাস্টমারদের “কষ্টে মার” বলে দাম বাড়িয়ে চলেছে, তখন বেহেস্তের খোঁজে রেস্ত ফুরোবেই। দাম চোকাতে চোকাতে হুইস্কির সাথে কাজু এসে দাঁড়িয়েছে কাঁচা বাদামে। তাই তো চায়ের সাথে চায়ের কাপ ফ্রি থাকলে বা প্রেমিকার কোন সুন্দরী সিঙ্গেল বান্ধবী থাকলে প্রথম নজর আগে দ্বিতীয়টির উপরেই যায়। আর আমাদের জীবনে তো এমন কোন রবিনহুড নেই, যে আঁধার রাতে হুডি চাপিয়ে মার্সিডিজওয়ালা মালিয়া-আম্বানিদের ট্যাঁক সাফাই করে আমাদের মত ট্যাক্সিচাপা ট্যাক্সদাতাদের মধ্যে হরির লুট করে দিয়ে যাবে। আমরা হলাম গিয়ে যাকে বলে খাস মধ্যবিত্ত, যারা না পাবে ট্যাক্সে ছাড়, আবার না দিতে পারবে ট্যাক্সে ফাঁকি। তাছাড়া আমাদের মত পেটরোগা মধ্যবিত্তরা তো আর “মানি হেইস্ট”-এর প্রফেসরের মত “বেলা চাও” গেয়ে ব্যাঙ্ক লুটে আসতে পারবে না, তাই আমরা আয়কর বিভাগের “কলা খাও” শুনতে শুনতে ঠিক দুক্কুরবেলা ডিম-টোস্ট চিবিয়ে চেয়ারে শুয়ে ভাতঘুম দেব। তো সেই ভাতঘুমের মধ্যে আমরা যদি একটু ভুল করে সাগর থেকে এক-দু’ মগ জল ঝেড়ে নিয়ে এদিক ওদিক দেখে চম্পট দেওয়ার স্বপ্ন দেখেই থাকি, তাতে ক্ষতিটা কী বলুন তো? যদিও স্বপ্নে এখনও পর্যন্ত ট্যাক্স লাগে না, কিন্তু সেই ফাইন স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে গেলে বড়সড় ফাইন লাগবার সম্ভাবনা কিন্তু থেকেই যায়। আবার দেখুন, সেই স্বপ্নের খাতিরেই “একটা ফাউ দে” বলতে ফুচকার দোকানে, “একটু ধনেপাতাও দিয়ে দে” বলতে সবজির দোকানে, “ওই ফ্লেভারটা এক চামচ দেবেন তো” বলার জন্য আইস্ক্রিমের দোকানে, আর “ওই পারফিউমের গন্ধটা কেমন একটু দেখান তো” বলে নিখরচায় নিজের বগল থেকে চাগিয়ে আসা ঘামের দুর্গন্ধ দূর করবার জন্য শপিং মলে। তাই মূল্যবৃদ্ধির সাথে মূল্য না বাড়লেও দাম যখন বেড়েই চলেছে, তখন একটু “ফ্রি” জিনিস খুঁজে দেখতে দোষটা কোথায়? আর নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ তো বরাবরই একটু বেশি, আর তার উপরে যদি সেই জিনিসটিকে পাওয়া যায় “ফ্রি”-তে। সকাল থেকে মাথার মধ্যে পোকাগুলো এইসব ডিম পেড়ে চলেছে, আর আমি লাউঞ্জের সোফাতে বসে আছি হাতে আমার সদ্যপ্রাপ্ত সবেধন চোখের মণি পে-স্লিপটি নিয়ে। জুলজুল করে তাকিয়ে দেখছি কীভাবে আমার উপার্জনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ আমাকে ল্যাবেঞ্চুষ দেখিয়ে ফ্যাতাড়ুর মত ফৎ-ফৎ করে উড়ে গেল। একে তো আমার কাছে ট্যাক্স নামক বস্তুটির সাথে হায়ারোগ্লিফিক্সের বিশেষ পার্থক্য নেই, তার উপরে অর্জুন কাপুর, থুড়ি, নেপোয় দই মেরে আমার হাতে চাটা হাঁড়ির বদলে ফাটা হ্যারিকেন ধরিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছে। আমি আর আমার পে-স্লিপ – আমরা একে অপরের দিকে দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গের শাহরুখ খান আর অমরিশ পুরীর মতই তাকিয়ে রয়েছি। এমন সময় গলার আওয়াজ পেলাম, “কী অভীক, ওরকম হাঁ করে কী দেখছ? প্রেমপত্র-টেমপত্র পেয়েছ নাকি?”
মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি সাক্ষাৎ সান্যালদা এসে হাজির। আমি সান্যালদার দিকে তাকিয়ে মুখটা আবার নামিয়েই বললাম, “প্রেমপত্র নয় গুরু, তবে শেমপত্র বলতে পার।”
“সেটা আবার কী?” সান্যালদা আমার সামনের সোফাটায় বসতে বসতে বলল।
“আমি আমার পে-স্লিপ দেখে লজ্জা পাচ্ছি, নাকি ও আমাকে দেখে লজ্জা পাচ্ছে, সেটাই বোঝার চেষ্টা করছি।”
“আচ্ছা, বুঝলাম। তার মানে সক্কাল সক্কাল বেশ নির্মল আনন্দেই আছ।”
“ছাড়ো গুরু, মাথা-ফাথা একেবারে ঘেঁটে আছে।”
“ট্যাক্স কেটেছে নাকি?”
“এটাকে কাটা বলে না গুরু,” আমি একটু উত্তেজিত স্বরে বললাম, “একেবারে চিরে দু’ফাঁক করে দিয়ে চলে গিয়েছে।”
সান্যালদা মুচকি হেসে বলল, “তা তুমি হ’লে গিয়ে বাপু অর্থনীতির অধ্যাপক, এসব বাতেলা না দিয়ে কিছু উপায় তো বাতলাও, ট্যাক্সটা আমিও একটু বাঁচাই। বাপুকে ছাপা রঙিন কাগজে দেখতে কার না ভাল লাগে।”
“ধুস, পকেটে অর্থই নেই, তার আবার অর্থনীতি।”
“হে হে, তা মন্দ বলো নি। চারিদিকে যে হারে সব জিনিসের দাম বাড়ছে, কিছু কিনতে গেলে তো ঘাম ছুটে যাচ্ছে।”
“আর দামের সাথে পাল্লা দিয়ে ট্যাক্স বাড়ছে, কিন্তু শালা মাইনে বাড়ছে না। কী আজব কেলো বলো তো গুরু। এইভাবে পারা যায়?”
“তাও ঠিক। এই যেমন সেদিন পিটার ইংল্যাণ্ডের দোকানে গিয়ে ভাবলাম একটা শার্ট কিনব। তার দাম দেখে তো মনে হ’ল এর থেকে কলাপাতা মুড়ে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো ভাল।”
“বোঝো কাণ্ড। ওখানে তো সেল চলছিল, তাতেও এই অবস্থা?”
“নইলে কি আর আমি ওখানে এমনি এমনি গিয়েছি নাকি?”
“হমম। শালা লাইফে কিছু জিনিস ফ্রি-তেও তো দিতে পারত।”
“দিচ্ছে তো, আছোলা, এক্কেবারে ফ্রি। যত চাইবে, তত পাবে।”
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, “ভাবো তো গুরু, যদি দুনিয়াতে বিরিয়ানি ফ্রি হত?”
সান্যালদার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল, “আরে অভীক, সক্কাল সক্কাল এই সব কথা বলো না মাইরি। সারাদিন আর কাজে মন বসাতে পারব না।”
“হে হে, খুঁজলে ঈশ্বর পাওয়া যায়, আর ফ্রি বিরিয়ানি পাওয়া যাবে না বলছ?”
“তোমাকে কে ফ্রি-তে বিরিয়ানি খাওয়াবে বলো দিকিনি।”
“খাওয়াতে যাবে কেন, খেয়ে আসতে হবে।”
“মানে?”
“মানে বিরিয়ানি, তার সাথে মটন চাপ – যাব, খাব, পালিয়ে আসব। কি বলো?”
“এ কি মগের মুলুক পেয়েছ নাকি! পাবলিক ধরতে পারলে কেলিয়ে কাঁঠাল পাকিয়ে দেবে।”
“আরে সেটাই তো আর্ট, গুরু। হিচকক সাহেব তো বলে গিয়েছিলেন –”
“এই কথার মধ্যে হিচকককে এক্কেবারে আনবে না। যখনই কিছু উত্তর খুঁজে পাবে না, একটা নাম এনে গুঁজে দেবে।”
“হে হে হে তা ঠিক। তবে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি কিন্তু গুরু, ফ্রি বিরিয়ানির সাথে একটা অদ্ভুত রোমাঞ্চও কিন্তু ফ্রি-তে পাওয়া যায়।”
“অভিজ্ঞতা? মানে তুমি এই রকম কেস আগে করেছ নাকি?”
“নাহলে আর বলছি কেন গুরু? শুধু কি বিরিয়ানি? তার সাথে কচি পাঁঠার চাপ, স্যালাড, কোল্ড ড্রিংকস, আর শেষ পাতে মৌরি।”
“কবে? কোথায় করলে? আর করলেই বা কীভাবে?”
“সেটাই তো গল্প গুরু।” বলে হাতে রাখা পে-স্লিপটা টেবিলে রেখে সোফায় ঠেস দিয়ে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে একটা সিগারেট ধরালাম। “বেশ পুরনো পাপের গল্প।”
“এই দাঁড়াও, আগে একটা করে চা বলে দিই। একদম খেয়াল ছিল না।” বলেই সান্যালদা বেয়ারাকে ডেকে দু’টো চায়ের ফরমায়েশ করতেই মিনিট পাঁচের মধ্যে আমাদের টেবিলে চলে আসল দু’টো ধূমায়িত চায়ের কাপ। চায়ের কাপটা তুলে একটা স্বস্তির চুমুক দিয়ে সিগারেটে একটা টান মেরে শুরু করলাম আমার গল্প।

সালটা ২০০১, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ফার্স্ট ইয়ার। জীবনে প্রথমবার বাড়ি থেকে একা একা বেরিয়ে দূরে এসে থাকা শুরু করেছি। তো আমাদের অবস্থাটা আন্দাজ করতেই পারছ। যদি চিড়িয়াখানার জন্তুদের খাঁচা থেকে বের করে বাইরে ছেড়ে দাও, তাহলে কী হতে পারে? ঠিক সেটাই হয়েছিল আমাদের সাথে। জীবনে প্রথমবার স্বাধীনতার স্বাদ – টাকা খরচ করা থেকে শুরু করে যা মন চায় করতে পারার স্বাধীনতা। কেউ বকা দেওয়ার নেই, না আছে কেউ বাধা দেওয়ার। পাখনা গজানোর সবথেকে প্রশস্ত সময় তো সেটাই। আর পাখনা গজিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই আমরা দেদার সেই সব কাণ্ডকারখানা শুরু করলাম, ঠিক যেগুলো করতে বাড়ি থেকে পইপই করে বারণ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যতই নিষিদ্ধ কাজকম্ম করে নাও, পকেটে একটা সময়ের পরে তো টান পড়বেই। তাই ইচ্ছে থাকলেও সবসময় উপায় হয়ে উঠত না। সিগারেট থেকে নেমে আসতে হত বিড়িতে, ম্যাকডয়েলের রামের বদলে বাংলা চুল্লু, আর কলেজ ক্যাণ্টিনের চিকেন চাউমিনের বদলে মেসের ভাত আর ডালের জল। মোটামুটি মাসের পনের তারিখ আসতে আসতেই পকেটের হাল হয়ে যেত জটায়ুর টাকের মতই। ফলতঃ আমাদের অন্য উপায় খুঁজে বের করতে হত। আর ঠিক এই সময়গুলোতেই আমাদের মাথায় উদয় হত সবচেয়ে উদ্ভট, বিকট, এবং চরম মর্কটমার্কা বুদ্ধির। কথায় বলে, ইঞ্জিনিয়ারদের যে কোন সমস্যার সামনে ফেলে দিন, উপায় তারা নিজেরাই ঠিক বের করে নেবে। কথাটা কিছুমাত্র ভুল নয়। হস্টেলের ওই সময়গুলোতে আমরা যে যে ধরণের উপায় বের করতাম, তা দেখে উপরওয়ালাও হয়ত নিজের মাথা চাপড়াতেন, “হায় হায়, এ আমি কোন ক্যাটেগরির জন্তু সৃষ্টি করেছি?” তো সেই সময় থেকেই আমরা আস্তে আস্তে জীবনে ফ্রি বস্তুর মাহাত্ম্য বুঝতে শুরু করলাম। হাতেখড়িটা হ’ল বিনাটিকিটে ট্রেনযাত্রা দিয়ে। সময় এগোনোর সাথে সাথে মেইন লাইন লোকাল থেকে শুরু করে রাজধানী এক্সপ্রেস অবধি কোন ট্রেনই আমাদের হাত থেকে মুক্তি পেল না। বুঝে গিয়েছিলাম, পর্যবেক্ষণ, সুযোগসন্ধান, এবং সাহস – এই তিনটি গুণ থাকলে জগতে বেশ কিছুই ফ্রি-তে অর্জন করা যেতে পারে। অতএব আমরা আদাজল খেয়ে লেগে পড়লাম নিজ নিজ কাজে।

আমাদের কলেজ থেকে দু’-আড়াই কিলোমিটার দূরেই ছিল বেনাচিতি বাজার। প্রায় রোজই আমরা কলেজ থেকে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যেতাম সেই বাজারটিতে। কোনরকম কেনাকাটি নয়, স্রেফ ঘুরে বেড়ানোর জন্যই। তো সেই বাজারে ঘুরতে ঘুরতে প্রায়শই আমাদের চোখ চলে যেত একটি রেস্তোঁরার দিকে। ওই বাজার, তথা শহরের অন্যতম সেরা রেস্তোঁরা ছিল সেটি, আর সেখানকার মটন বিরিয়ানি – আহা! কথায় বলে, কান টানলে মাথা আসে, আর আমরা বলতাম, নাক টানলে গন্ধ আসে। তা পকেটে রেস্ত না থাকায় রেস্তোঁরার বাইরে দাঁড়িয়েই সেই বিরিয়ানির প্রাণকাড়া গন্ধ শুঁকে একঠোঙা ঝালমুড়ি নিয়ে চেবাতে চেবাতে আমরা হস্টেলে ফিরে আসতাম। আর প্রতিবার নিয়ম করে ক্যালেণ্ডার ধরে প্রাণটা বিরিয়ানি-বিরিয়ানি করত ঠিক মাসের পনের তারিখের পরেই, যখন বিরিয়ানি দূরে থাক, বিড়ি কেনার পয়সাতেও টান পড়ত। কিন্তু কাঁহাতক এইরকম চলতে পারে? ঘামাচি, আমাশা, এবং বিরিয়ানিপ্রেম তো আর বেশি চেপে রাখা যায় না। তাই একদিন হস্টেলে গল্প করতে করতে আমি বলেই ফেললাম, “একদিন গিয়ে বিরিয়ানিটা খেয়েই আসতে হবে রে।”
“খাবি যে বলছিস, পাইসা কে দেবে?” সামনে থেকে একজন বলে উঠল।
“আরে সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে’খন।” আমি বলে উঠলাম।
“কোত্থেকে? ব্যাঙ্ক থেকে লোন দেবে বিরিয়ানি খাওয়ার জন্য?” আরেকজন বলে উঠল।
“লোন-টোন নয়, একটা প্ল্যান আছে।”
“কী?”
“কাল থেকে রেস্তোঁরাটাকে একটু ওয়াচ করতে হবে।”
“আচ্ছা। তারপরে?”
“বাকিটা তখনই দেখতে পাবি।” আমি মুচকি হেসে বললাম।

পরের দিন বিকেল থেকেই আমরা সাত-আটজন মিলে রেস্তোঁরাটার বাইরে অপেক্ষা করা শুরু করলাম। যদিও কেউই ঠিকমত জানে না যে আমরা কিসের অপেক্ষা করছি, কিন্তু বিরিয়ানি বলে কথা। এখানে তো তর্ক চলবে না। তাই সবাই মুখে আর পেটে কিল মেরে অপেক্ষা করে চলেছি। দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে কয়েকটা দিন। আস্তে আস্তে আমাদের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটছে, উশখুশ করছি। বিকেল চারটে থেকে অপেক্ষা করতে করতে প্রায় সন্ধ্যে সাতটা বেজে গিয়েছে। হঠাৎই রেস্তোঁরাটার সামনে এসে দাঁড়াল একটা বড় গাড়ি, আর সেই গাড়ি থেকে নামল কাচ্চাবাচ্চা সমেত প্রায় জনা দশ-বারোর একটা বিশাল পরিবার। সুযোগ! আমরা ন্যাতানো অবস্থা থেকে সটান সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। পুরো পরিবারটা হইহই করতে রেস্তোঁরার ভিতরে ঢুকতেই আমি বললাম, “চ।” বলে হাঁটা লাগালাম রেস্তোঁরার দরজার দিকে। আমার দেখাদেখি বাকিরাও আমার পিছু নিল। ভিতরে ঢুকতেই বিরিয়ানির গন্ধে প্রাণটা একপাক নেচে উঠল, আর ক্ষিদেটা যেন ফুজিয়ামার মত জামার ভিতর থেকে ফেটে বেরিয়ে আসার উপক্রম করতে লাগল। কিন্তু এইসব ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো করতে নেই, নইলে বিপদ সমূহ। আমরা আড়চোখে পরিবারটা কোথায় বসেছে দেখে নিয়ে তাদের পাশের টেবিলটা দখল করে বসলাম। কয়েক মিনিট পরেই বেয়ারা এসে আমাদের সামনে মেনুকার্ড রেখে দিয়ে গেল। মেনুকার্ডটার উপর চোখ বোলাতেই আমাদের সকলের চোখ ছানাবড়া। আদ্ধেকের উপর খাবারের নামই জীবনে প্রথমবার দেখছি, খাওয়া তো দূরঅস্ত। বাকিদের মধ্যে মটন বিরিয়ানি আর মটন চাপ – এইদু’টোর নামই চেনা লাগল। এবারে চোখ পড়ল মেনুকার্ডের ডানদিকে। বুকটা ধড়াস করে উঠল। বিরিয়ানি আশি টাকা প্লেট, আর চাপ একশ কুড়ি। সত্যিই চাপ! আর এদিকে আমাদের সবার পকেটের খুচরো মিলিয়ে এই সাড়ে সাতাশ টাকা মত হবে। কিন্তু খাব বলে যখন ঢুকেই পড়েছি, তখন খেয়েই বেরোব। কুছ পরোয়া নেহি, যা হবে দেখা যাবে। সবাই একবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করে আর কিছু চিন্তাভাবনা না করে বেয়ারাকে ডেকে অর্ডার দিয়ে দিলাম পাঁচপ্লেট বিরিয়ানি, তিনপ্লেট চাপ, আর আটটা কোল্ড ড্রিঙ্কস। মিনিট দশের মধ্যেই আমাদের টেবিলে নেমে এল স্বর্গ। খরা হয়ে যাওয়া মাটিতে কখনও জল ঢেলে দেখেছেন? দেখবেন, মাটিটা কেমন চোঁ করে জল টেনে নেয়। চড়া পড়ে যাওয়া পেটেতে বিরিয়ানি আর চাপ যে সেই একই প্রভাব ফেলতে পারে, সেটা সম্পর্কে একেবারেই ধারণা ছিল না। টেবিলে রাখামাত্রই আমরা একেবারে আজন্ম হাঘরের মত হামলে পড়লাম বিরিয়ানি আর চাপের উপর, আর তারপরে আমাদের টেবিল থেকে শুধুই হুপ-হাপ শব্দ। বেয়ারা বেচারা ঠিক সময়ে হাত সরিয়ে না নিলে হয়ত ওর হাতেও একটা কামড় পড়ে যেতে পারত। সে আমাদের ঠিক কত জন্মের ভিখারি বলে আন্দাজ করেছিল, সে সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণা হয়নি। কিন্তু আমাদের সে সব তুচ্ছ জাগতিক দিকে আর কোন নজর নেই। আমাদের ধ্যানজ্ঞান তখন বিরিয়ানি আর চাপের উপরেই কেন্দ্রীভূত।
“কী বানিয়েছে রে কাকা! উফফ! স্বর্গ, স্বর্গ।”
“মাংসটা কী নরম রে!”
“মাইরি, কোন কথা হবে না। এ জিনিস আগে কেন খাইনি রে?”
“আজ খেয়ে আমি হাত ধুচ্ছি না। নেক্সট এক সপ্তাহ হাতের গন্ধ শুঁকেই কাটিয়ে দেব।”
কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও আমাদের আড়চোখে নজর কিন্তু পাশের টেবিলের উপরেই। আমার পাশের জন বেশ তরিবৎ করে পাঁঠার হাড় চুষছিল। সে আমার কাছে ধমক খেল, “অ্যাই, জলদি খা, অত আরাম করে খেতে হবে না। আমি পাশের টেবিলে দেখছি।”
“আরে এখনও সময় আছে রে। একটু শান্তিতে খেতে দে।”
“কী মনে হচ্ছে রে? ওদের আর কতক্ষণ লাগতে পারে?”
“ঠিক বুঝতে পারছি না। চল, আগে খেয়ে তো নিই, তারপরে দেখছি।”

এইভাবে প্রায় মিনিট কুড়ি কেটে গিয়েছে। আমাদের প্লেটগুলো দেখলে হয়ত পাঁঠাগুলো নিজেদের বলিদান সার্থক বলেই মনে করত, কারণ কয়েকপিস হাড় আর এক-দেড় চামচ ঝোল ছাড়া আর বিশেষ কিছু বাকি নেই। এবারে অপেক্ষা। আমার পাশের জন এখন একটা অন্য হাড় নিয়ে চুষে যাচ্ছে। এবারে হঠাৎই আমার নজর পড়ল পাশের টেবিলের উপর। আইসক্রিম এসে গিয়েছে। তার মানে আর তো বেশি দেরী নেই। আমি সবাইকে ইশারায় বললাম তৈরি থাকতে। তিন-চার মিনিটের মধ্যেই পাশের টেবিলের পরিবারটি আইসক্রিম খাওয়া শেষ করে উঠে এগোচ্ছে বেসিনের দিকে। মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত। আমরা সবাই তৈরি। পরিবারটি উঠে গিয়ে দাঁড়িয়েছে বিল কাউণ্টারে, একটা ছোট্ট ভিড়ের মত তৈরি হয়ে গিয়েছে। এবার! আমরা চেয়ার ছেড়ে উঠে এগোতে লাগলাম বিল কাউণ্টারের দিকে। একবার চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম, কেউ দেখছে না তো? নাহ্‌, কেউ খেয়াল করেনি। বিল কাউণ্টার থেকে ভেসে আসা কাচ্চাবাচ্চা আর বড়দের চেঁচামেচিতে সবার নজর ওই দিকেই। আমরা বিল কাউণ্টারের কাছে গিয়ে পরিবারটির সাথে মিশে গিয়ে দাঁড়ালাম, আর তাদের চেঁচামেচিতেও গলা মেলালাম। কয়েকটা মুহূর্ত। তারপরেই একটু একটু করে দরজার দিকে একে একে এগোতে লাগলাম। তারপরে দরজাটা খুলে সবাই মিলে একলাফে রাস্তায়। মিশন সাক্সেসফুল! ফ্রি-তে বিরিয়ানি আর চাপ – মনের মধ্যে একটা বিজয়ের উল্লাস। হঠাৎ আমাদের সবার খেয়াল পড়ল, আমার পাশের পাবলিকটাকে তো দেখছি না। ভিতরে ফেঁসে গেল নাকি? সব্বোনাশ করেছে রে। আমরা সাহস যুগিয়ে দরজার দিকে এগোতে যাব, দেখি দরজা ঠেলে সে বেরিয়ে আসছে। সে রাস্তায় নেমে আসতেই আমরা তাকে ঘিরে ধরলাম।
“কী রে, ভিতরে আটকে গিয়েছিলি নাকি?”
“ধরতে পারেনি তো?”
“এতক্ষণ ভিতরে কী করছিলি?”
সেই পাবলিক একটা অদ্ভুত প্রশান্তির সাথে হাসিমুখে আমাদের দিকে চাইল। তারপরে আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোদের সাথেই তো বেরিয়ে এসেছিলাম রে। তারপরে মনে হ’ল, এত ভাল খেলাম, একটু মৌরি খেলে বেশ হত। তাই আবার ভিতরে ঢুকে বিল কাউণ্টারে ওই পাবলিকগুলোর মাঝখান দিয়ে হাত ঢুকিয়ে এক খাবলা মৌরি তুলে নিয়ে চলে এসেছি। এই নে, তোরাও নে।” বলে আমাদের সামনে ধরল একমুঠো মৌরি। আমরা হাঁ করে একে অপরের মুখ দেখতে লাগলাম।

সিগারেটটা শেষ হয়ে গিয়েছিল। ফিল্টারটাকে অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে চায়ের কাপটা তুলে নিলাম। সান্যালদা এতক্ষণ হাঁ করে বসে শুনছিল। গল্পটা শেষ হয়ে গিয়েছে বুঝতে পেরে জিজ্ঞাসা করল, “তা তোমাদের কেউ ধরতে পারল না?”
আমি চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললাম, “রেস্তোঁরাটা থেকে বেরনোর রাস্তাটা ছিল একটু সরু, আর সেখানটাতেই ছিল ভিড়। তাই আমাদের দেখার বা ধরার সম্ভাবনাটা ছিল খুবই কম।”
“আচ্ছা। তারপরেও কি এরকম আবার করেছ নাকি?”
“অনেকবার। ওটা তো ছিল হাতেখড়ি।”
“বলো কী হে! তুমি তো গুরুদেব মানুষ।”
“বয়েস হয়েছে গুরু, কিন্তু ধার কমেনি। তা বলি কী, কালকেই একবার হবে নাকি?”
“কাল? ফ্রি কা খানা?” সান্যালদার চোখ চকচক করে উঠল।
“একদম। কী বলো? হয়ে যাক?” আমি মুচকি হেসে জিজ্ঞাসা করলাম।
“হয়ে যাক, হয়ে যাক।” সান্যালদা হো-হো করে হেসে উঠল।


আগের ও পরের পর্বের লিঙ্ক<< দাদাগিরি

লেখক পরিচিতি : অভীক সিংহ
গল্পটির লেখক ডঃ অভীক সিংহের জন্ম পশ্চিমবঙ্গে। পেশায় অর্থনীতির অধ্যাপক এবং গবেষক, যুক্ত আছেন লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে, বর্তমান বাসস্থান চীন। তবে ভালবাসাটা আজও লেখালিখি, পেন্সিল স্কেচ, যন্ত্রসংগীত, এবং নিত্যনতুন রান্নাবান্নার সাথেই রয়ে গিয়েছে। প্রথম বই "R.E.CALL: এক Recollian-এর গল্প" প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। দাদুর হাত ধরে কবিতা দিয়ে লেখালিখির সূত্রপাত হলেও এখন প্রবন্ধ এবং গল্পতেই মনোনিবেশ করেছেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা জমা দিতে ছবিতে ক্লিক করুন