লেখক : রুবাই শুভজিৎ ঘোষ
।।১।।
“তাহলে অবশেষে হল বল্?”, অ্যাবির চোখে উপচে পড়া আনন্দ। বাইরে আকাশে চাঁদটা বেশ বড় হয়ে উঠেছে আজ। চাঁদের আলোয় জলটা লাগছে অন্যরকম, তার পাড়ে বালির ওপর জ্যোৎস্নার আলো পরে পুরো ব্যাপারটাকেই অন্যরূপ দিয়েছে। এ পরিবেশ যেন প্রকৃতি তাদের দুজনের জন্যই সাজিয়ে দিয়েছে। এ জায়গাটা একেবারেই আলাদা, চুপচাপ, শান্ত আর অদ্ভুত সুন্দর। সাধারণত সমুদ্রে ঘুরতে এলে যে সৌন্দর্য দেখা যায়, এটা নিঃসন্দেহে সেগুলোর থেকে আলাদা। তবে মনের কাছে এখন সবচেয়ে সুন্দর হল অ্যাবি, সেইদিনটার মত যেদিন সে প্রথম বার কৌতূহলের বশে দেখতে চেয়েছিল অ্যাবিকে।
“কি দেখছিস?” জিজ্ঞেস করল অ্যাবি।
“তোকে!” উত্তর দিল মন, “দেখছি আর ভাবছি! আমরা কি সত্যি এখানে না এটা আমার কল্পনাই?”
“নারে!” মনের ডান গালে নিজের বাঁহাতটা বুলিয়ে বলল অ্যাবি, “আমরা সত্যিই এখানে।”
দুজনে আবার রুমের বাইরে প্রকৃতির দিকে তাকাল। দূরে সমুদ্রটাকে দেখার চেষ্টা করল। আসলে চাঁদের আলোয় যেটা চকচক করছে সেটা নদী না সমুদ্র সেটা কেউই বুঝতে পারছিল না। না বোঝার কারণও আছে। বিছানার সামনে রাখা ছোট টেবিলটায় বসানো অ্যালকোহলের বোতলটা প্রায় শেষ। গ্লাসে যেটুকু অ্যালকোহল পড়ে ছিল, সেটা পান করল মন।
“আচ্ছা মন!”, জিজ্ঞেস করল অ্যাবি, “তোর মনে হচ্ছে না তোর বউকে চিট করছিস তুই?”
“না”
“তাহলে ওকে আনলি না কেন?”
“কোন্ বউ তার বরের এত কাছের একটা বন্ধুকে মেনে নেবে যে মেয়ে? তুই মেনে নিতিস?”
“জানি না” জানলার দিকে তাকাল অ্যাবি, দূরে ঐ সমুদ্রের মধ্যে রবিকে খোঁজার চেষ্টা করল সে।
“কেন এত মন খারাপ করিস?” ওর পিঠে হাত রাখল মন, “এখন তো আমার সাথে আছিস। কেন এত ভাবছিস?”
অ্যাবি মনের দিকে মুখ ফেরায়, “আচ্ছা কোনদিন প্রমা যদি তোকে বলে আমার সাথে কথা না বলতে?”
“হয়ত আর বলব না।”
“বাঃ! আজ ও যদি বলে তুই আমাকে দূরে সরিয়ে দিবি? মনে রাখবি আমি কিন্তু শুরু থেকে আছি। ওর অনেক আগে থেকে আমি আছি।”
মুচকি হাসল মন, তার ওপর অ্যাবির এই অধিকারবোধ তাকে খুব মজা দেয়।
“কি হল?” মনকে ধাক্কা দিল অ্যাবি, “কি ভাবছিস? আমায় ছেড়ে দিবি? আমায় ছেড়ে শুধু বউকে নিয়ে থাকতে পারবি?”
“না! ওর জায়গা আলাদা, তোর জায়গা আলাদা। তুই তুলনাই করছিস কেন? প্রেম বিয়ে এসব হলেই যে বন্ধুর দরকার ফুরিয়ে যায় কে বলেছে, আমার তো অ্যাট লিস্ট তোকে দরকার।”
“আমারও!”
“তাহলে এত কিছু ভাবছিস কেন? আর প্রমা কখনও বলবে না তোর সাথে না মিশতে। অ্যাট লিস্ট যাতে না বলে তাই জন্যই তো ওকে বলিনি যে আমি তোর সাথে। তুইই বল্ না ও কি ভালো মনে মেনে নিত সেটা? ও যদি মেনেও নিত সোসাইটি কি বলতো?”
“ফাক সোসাইটি!”, অ্যাবি কথাটা রাগের সাথে বললেও হেসে ফেলল মন। অ্যাবির মাথার পিছন দিকটা নিজের ডানহাতে ধরে মন বলল, “আমি তোকে কখনও ছেড়ে যাবো না। বুঝলি?”
সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল অ্যাবি।
“তাহলে কেন এত ভাবছিস? আমাদের এই মোমেন্টটা এনজয় কর্ না!”
ঠোঁট উল্টে অ্যাবি বলল, “কারণ আমি স্যাড।”
“কি হয়েছে?”
বোতলের অবশিষ্ট অ্যালকোহল শেষ করে অ্যাবি উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়, “কিছু না!”
অ্যাবির পাশে শুয়ে পড়ল মনও। তারপর অ্যাবিকে নিজের দিকে পাশ ফিরিয়ে শোয়াল মন।
অ্যাবির মুখটা তুলতে গিয়ে মন বুঝল যে অ্যাবির চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে।
“কি হল অ্যাবিসোনা?”, মন জিজ্ঞেস করতে প্রায় কেঁদেই ফেলল অ্যাবি, মনকে জড়িয়ে ধরল সে। অনেকক্ষণ অবধি ওইভাবেই জড়িয়ে রইল তাকে। অবশেষে যখন ছাড়ল তখন আগের থেকে একটু শান্ত হয়েছে সে।
“আমায় ছেড়ে যাবি না কখনও বল্?” অ্যাবি আদুরে আর জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করল মনকে।
“ধুর বোকা! কোথায় যাবো আমি?”
“তোর বউ বারন করলেও না?”
“নারে! বারণ করবে না।”
“তুই এভাবেই আমার পাশে থাকবি তো সারাজীবন? রবি তো সারাবছর ঘুরেই বেড়ায়! আমায় কি দেখবে! তুই না থাকলে আমায় কে দেখবে?”
অ্যাবির মাথায় হাত বোলাতে থাকে মন। যখনই অ্যাবি ভেঙে পড়ে, তখনই মন এরকম করেই হাত বোলায়। যখন রবির সাথে ঝগড়া হত অ্যাবির, তখন তো রবির ওপর রাগ করে মনের কাছেই চলে আসত সে। এভাবেই মন তখন হাত বোলাত ওর মাথায়। তবে ওর রাগ ভাঙত, দুঃখ কমত। আজও তাই করছে মন। কিন্তু আগের থেকে অনেক আবেগপ্রবণ অ্যাবি। হঠাৎ সে তার ঠোঁটদুটো নিয়ে এগিয়ে আসে মনের দিকে, বাধা দেয় মনের হাত, “কি করছিস?”
“কিস” অ্যাবি চোখ বুঝিয়ে দাঁতগুলো সামনে জড়ো করে বলল।
“নো কিসিং”
“আচ্ছা!” অ্যাবি আহত হয়ে এবার জোরে বলল আরও, “এখন নো কিসিং! যখন আমার কাছে প্রথম কিস করার এক্সপেরিয়েন্স খুঁজতে এসেছিলিস তখন কোথায় ছিল তোর বউ? কোথায় ছিল তোর ইথিক্স? আমি তখনও তোর বন্ধু ছিলাম। এখনও তাই।” মনের ওপর রাগ করে তার দিকে পিছন ফিরে শুল অ্যাবি।
মনেরও মনে পড়ল সেই সময়টা। মনেদের বন্ধ গাড়ির ভেতর তারা দুজন, গাড়িটা মাঝরাস্তাতে দাঁড়িয়ে ছিল। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল চারদিকে। সেই বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে গেছিল গাড়ির কাঁচগুলো। বাইরেটা দেখা যাচ্ছিল না কিছু। তেমনইভাবে বাইরের লোকও নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছিল না ওদের। অন্তত দুজনের তাই মনে হয়েছিল। জেদ করেছিল মনই। অনেকদিন ধরেই জেদ করেছিল সে। কৈশোর আর যৌবনের সীমায় দাঁড়িয়ে বন্ধুর কাছে সে জেদ করেছিল প্রথম চুম্বনের অভিজ্ঞতার। অ্যাবি সম্মতি দিয়েছিল। কিন্তু তারা সুযোগ পায়নি আগে, সেদিন পেয়েছিল। ভর দুপুরবেলায় শহরের মাঝখানে বৃষ্টির সহায়তায় বন্ধ গাড়ির মধ্যেই প্রথমবার চুম্বনের অভিজ্ঞতা পেয়েছিল মন, অভিজ্ঞতা পেয়েছিল অ্যাবিও। দুজনে দুহাতে দুজনের মাথা চেপে ধরে দুই ঠোঁট দিয়ে অনেকক্ষণ কিছু একটা যেন খুঁজছিল অন্যজনের দুই ঠোঁটে। আরও খুঁজতে খুঁজতে প্রবেশ করছিল ভিতরে। তারপর তারা খুঁজে পেয়েছিল রোমাঞ্চ, তারা খুঁজে পেয়েছিল আনন্দ। কিন্তু আজ দ্বিতীয়বার অ্যাবি যখন মনের ঠোঁটে সেই আনন্দ খুঁজতে এলো আবার, তখন মনের বাধায় আঘাত পেল সে।
“অ্যাবি শোন্” মন ডাকতে গেলে কনুইয়ের ধাক্কায় তাকে সরিয়ে দিল অ্যাবি। যতবারই মন তাকে ডাকে, ততবারই সে মনকে সরিয়ে দেয় একইভাবে। শেষে জোর করে মন অ্যাবিকে ধরে তার দিকে ঘুরিয়ে আনে। অ্যাবির বাধা দেওয়া দুই হাত মন চেপে ধরে নিজের দুই হাতে। তারপর এগিয়ে আসে মনের দুই ঠোঁট।
বিছানায় মনের ফোনটা তখন কাঁপতে থাকে। প্রমা শুতে যাবার আগে একবার মনের সাথে কথা বলতে চায়, কিন্তু মন ফোন তোলে না। প্রমা আবার চেষ্টা করে, কিন্তু ফোন তোলে না মন। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে সে। ততক্ষণে মনের ঠোঁট সেই পুরনো আনন্দ আর রোমাঞ্চ পেয়ে ডুবে গেছে তাতে। অ্যাবিও সেই পুরনো রোমাঞ্চ আর আনন্দ পেয়ে দুহাতে মনের মাথাটাকে চেপে ধরেছে সেই পুরনো দিনটার মত। মনের হাতদুটো নেমে আসছে অ্যাবির বুকে। আস্তে আস্তে তারা বন্ধুত্বের গণ্ডী পেরোচ্ছে একসাথে। অ্যাবির পাতলা আবরণগুলো তার শরীর থেকে আলাদা হতে বেশি সময় লাগল না তাই। যৌবনের শুরুতে একবার কৌতূহলের বশে মন দেখতে চেয়েছিল অ্যাবিকে। এখন তার বেশ মনে পড়ছে সেটা। তাদের বন্ধুত্বটা, তাদের মধ্যে সম্পর্কটা অন্যদের থেকে একটু আলাদা, একটু বেশিই খোলামেলা। কিন্তু সম্পর্ক যাই হোক না কেন, শরীর যখন একটা বয়স অতিক্রম করে তখন সেটা আয়না ছাড়া অন্য কারও সামনে মেলে ধরতে সময় লাগে অনেক। অ্যাবিরও লেগেছিল। সেই সময়টা পেরনোর পর চোখ ভরে অ্যাবিকে দেখেছিল মন। তার আগে অবধি এত সুন্দর আর কিছু দেখেনি সে। সেদিনটা ছিল মনের কৌতূহল মেটানোর দিন। আজ আবার দেখল। সেই সৌন্দর্যে এতটুকু মেদ জমেনি, এতটুকু মরচে পড়েনি কোথাও। দুচোখ ভরে মন দেখতে থাকল অ্যাবিকে। আর আজ অ্যাবিও দেখতে চাইল তাকে। মনের জিন্সটা তার থেকে আলাদা হয়ে লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে। তবে আজ শুধু চোখের তৃষ্ণা মেটানোর দিন না। অ্যাবির জমে থাকা সব না পাওয়ার, আজ পাওয়ার দিন এটা। দুজনে দুজনের কাছাকাছি এল আরও।
“মন”,অ্যাবির গলা এখন আরও আবেগপ্রবণ, আরও নিচু। মনের কানের কাছে ঠোঁট এনে অ্যাবি বলে, “প্লীজ স্যাটিসফাই মি।”
“কিন্তু…” মন যেন একটু দ্বিধাগ্রস্ত।
“কি কিন্তু! আজ আট মাস হয়ে গেল, রবি এখনও আসেনি। ওর কিছু যায় আসে না। ও ওর চাকরি নিয়েই থাকে। তুই প্লীজ আমায় ছেড়ে যাস না। প্লীজ আজ রাতে আমায় ছেড়ে যাস না।” অ্যাবির নখগুলো মনের পিঠে খেলা করতে থাকে।
“দাঁড়া!” অ্যাবিকে ছাড়িয়ে উঠে আসে মন। নিজের ব্যাগ থেকে কনডমের একটা প্যাকেট বার করে আনে। হাসি ফুটে ওঠে অ্যাবির মুখে, হাসি ফুটে ওঠে মনের চোখেমুখেও। বন্ধুত্বের গণ্ডী পেরিয়ে অনেকটা এগিয়ে গেছে তারা। নিজের পৌরুষের সবটুকু মন উজাড় করে দেয় আজ অ্যাবির কাছে। সবরকমভাবে খুশি করতে থাকে তাকে। বিছানাটা কাঁপতে থাকে দুজনের উল্লাসে। বিছানায় রাখা মনের ফোনটা এত রাতেও কাঁপতে থাকে, কিন্তু মন সেটা খেয়াল করে না আর। দুজনের কেউই খেয়াল করে না জানলার বাইরেটাও, যেখানে সন্ধ্যের সময় ফুটফুটে চাঁদের আলোতে সমুদ্রসৈকতের বালি চকচক করছিল। এখন চাঁদটা আর আগের মত ফুটফুটে নেই, তার গায়ে কলঙ্কটা বেশ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে অ্যাবির কোমরের অনেকটা নীচের কালো তিলটাও।
।।২।।
অ্যাবি, ভালো নাম অবন্তিকা। মন, ভালো নাম মানস। দুজনে ছোটবেলার খুব ভালো বন্ধু। তাদের সেই বন্ধুত্বটা অটুট আছে এখনও। তারপর দুজনের জীবনে প্রেম আসে। অ্যাবির জীবনে আসে রবি, মনের জীবনে আসে প্রমা। কয়েক বছর প্রেম করার পর বিয়ে। কিন্তু বিয়ের পরও তাদের দুজনের বন্ধুত্বে ভাটা পড়েনি কখনও। ছোটবেলার সেই অবাধ মেলামেশাটাও খুব একটা কমেনি। অ্যাবি আর মন দুজনের জীবনেই প্রেম এবং বন্ধুত্ব চলতে থাকে সমান্তরালে। অ্যাবির বর রবি বা মনের বউ প্রমা কখনও তাদের বন্ধুত্বে বাধা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু সমাজ এরকম বন্ধুত্ব মেনে নেবে কেন? তাই চারদিক থেকে দু চার কথা উড়ে আসতেই থাকে ওদের দুজনের সংসারে।
একদিন প্রমা মনকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি আর অ্যাবি যেভাবে মেশো লোকে কি ভাবে বলতো?”
প্রমার মুখটাকে ধরে মন বলেছিল, “লোকে কি ভাবে কিছু যায় আসে না, কিন্তু তুমি কি ভাবো?”
তবে সেদিনের পর মন বুঝেছিল এই সমাজে তাদের বন্ধুত্বটা অত সোজা নয়।
অ্যাবির বর রবি নেভিতে চাকরি করে। বছরের তিন ভাগের দুই ভাগ সময়ই সে বাইরে থাকে। একদিন ফোনে কথা হবার সময় অ্যাবি বলেছিল সে মনের সাথে ঘুরতে যাবে কোথাও, একথা শুনে রবি বলেছিল, “এভাবে তোমরা ঘুরতে গেলে লোকে কি বলবে?”
“লোকে কি বলবে সেটা আমি কি করে বলব?” রাগের সাথে জবাব দিয়েছিল অ্যাবি, কিন্তু সেও সেদিন বুঝেছিল এই সমাজে তাদের বন্ধুত্বটা অত সোজা নয়।
তাই দুজনেই যখন ঘুরতে এলো সমুদ্রে, তখন দুজনেই বাড়িতে সত্যিটা জানাল না। অ্যাবির পছন্দ সমুদ্র আর মনের পছন্দ নিরিবিলি শান্ত জায়গা। যখন তারা উড়িষ্যার তালসারির খোঁজ পেল তখন তাদের দুজনের পছন্দই মিলে গেল। জায়গাটা উড়িষ্যায় হলেও দীঘার একেবারে কাছে। পশ্চিমবঙ্গের শেষ আর উড়িষ্যার শুরু এই সমুদ্রসৈকত। খুব নিরিবিলি আর শান্ত জায়গা। মানুষজন আসে কম। আর যেখানেই মানুষজন কম আসে, সেখানের পরিবেশ নোংরাও হয় কম। সেদিক থেকে তালসারি বেশ পরিষ্কার। হোটেলের যে রাস্তাটা আছে, সেই রাস্তার পরই বালি, নরম বালি দিয়ে কিছুটা হাঁটার পরে একটা নদী বয়ে গেছে মাঝখান দিয়ে। নদীটা সবসময় জলে ভরা থাকে না, কখনও কখনও জল এতটাই কমে যায় যে পায়ে হেঁটে পাড় হওয়া যায়। অন্য সময়ে নৌকো চলে তাতে। ট্যুরিস্টদের পাড় করায় নৌকোগুলো। নদী পেরিয়ে অনেকটা হাঁটলে পাওয়া যায় সমুদ্র। আর নদী বরাবর হাঁটতে থাকলে একসময় ঘন গাছের মেলা দেখা যায়। সব মিলিয়ে আলাদা একটা অনুভূতি।
দুজনেই একেবারে সকালে উঠেছে আজকে। কাল রাতের পর দুজনের মন আর শরীর একেবারে ঝরঝরে। অ্যাবির মাথাটা একটু ধরে থাকলেও সেটাও বেশ ভালো লাগছে তার। সে এখন মনের একটা হাত ধরে হাঁটছে বালির ওপর। নদী পার না করেই নদীর পাড় বরাবর চলছে তারা। মানুষজন খুবই কম। গুনতে গেলে হাতের কড়ে আঙুল বা অনামিকার গাঁটগুলোর মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। তারা দুজনে এগিয়ে চলছে আরও। একদিকে গাছের সারি, অন্যদিকে বয়ে চলা পাতলা নদী, যা এখন হেঁটে পার করা যায় সহজেই। বালির ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছে ছোট ছোট নাম না জানা পোকা আর ধূসর রঙের ছোট ছোট কাঁকড়া। কাঁকড়াগুলো ওদের দেখেই ঢুকে পড়ছে বালিতে। নরম বালিতে পা বসে যাচ্ছে ওদের।
“আমার খুব অবাক লাগে জানিস”, অ্যাবি বলল।
“কি?” ছোট্ট প্রশ্ন মনের।
“এই যে আমাদের ফ্রেন্ডশিপ! আমাদের রিলেশান। আমরা লাভারও নই, হাসবেন্ড-ওয়াইফও নই, তাও আমাদের রিলেশানটা যেন তার থেকে বেশি।”
“বেশি কিনা জানিনা, বাট অন্যরকম।” একটু থামল মন, “চ’ এবার বরং সমুদ্রের কাছে যাই।”
কথায় কথায় তারা নদীর পাড়ে এসে গেছে, এখন নদীতে জল খুব কম, পায়ে হেঁটে পার হবার মত। নদীর জলে পা রাখল দুজনে।
“আচ্ছা মন!” জিজ্ঞেস করল অ্যাবি।
“হুম?”
“আমায় নিয়ে অন্য ভাবনা আসেনি কখনও?”
“না”
“কিন্তু আমার মনে হয়েছিল জানিস”, অ্যাবি যেন নিজের মধ্যে নেই। তাকে হাত ধরে মনই পার করাচ্ছে, আর সে কথা বলেই চলেছে।
তার কথার উত্তরে পাল্টা প্রশ্ন করল মন, “কি?”
“যখন প্রথম প্রথম প্রেম করতিস, খুব রাগ হত আমার”
“সে তো আমারও হত।”
“নারে। এ রাগ বন্ধুর ওপর রাগ নয়। অন্যরকম রাগ।” যেন সেই পুরনো রাগটা মনে পড়ল অ্যাবির, গলার স্বরে সেই রাগটা এনে বলল সে, “কিন্তু তুই তো আমাদের সম্পর্কটাকে অন্যভাবে ভাবতেই চাসনি!”
থেমে দাঁড়াল মন। তার ভেতরেও যে অন্য একটা রাগ এতদিন সে পুষে রেখেছিল, সেটা তার গলায় স্পষ্ট হয়ে গেল এবার। অ্যাবির দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল, “তুই চেয়েছিলিস? আমাদের দুজনের মধ্যে প্রথম প্রেমে কে পড়েছিলো? কার জীবনে প্রথম প্রেম এসেছিল? আমার না তোর?”
অ্যাবি কোনও উত্তর দিল না। আসলে তার কাছে কোন উত্তর ছিলও না। ততক্ষণে নদীর জল পেরিয়ে নদীর অন্যপাড়ে উঠে এসেছে তারা। দূরের সৈকত দেখে অবাক হয়ে অ্যাবি বলে উঠল, “ঐ দ্যাখ্! কি সুন্দর!”
দূরে যতখানি বালি দেখা যাচ্ছে, তার রঙ নদীর অপরপাড়ে দেখে আসা বালির মত নয়, এই রঙ পুরো লাল। দুজনেই এই দৃশ্যে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর একপা এগোতেই হঠাৎ সেই লাল রঙ চোখের নিমেষে গায়েব হয়ে বালির যেমন রঙ হয়, তেমন রঙ হয়ে গেল। বালির রঙ লাল দেখে যতটা অবাক হয়েছিল তারা, রঙ পরিবর্তন দেখে ততোধিক অবাক হয়ে গেল। এগোতে এগোতে তারা বুঝল নদীর এইপাড়ের বালি ঐপাড়ের চেয়েও বেশি নরম। পা অনেকটাই বসে যাচ্ছে তাদের।
“চোরাবালি নয় তো?” অ্যাবি মনের হাতটা চেপে ধরে বলল।
“কাঁকড়া!” দূরে কয়েকটা লাল কাঁকড়া দেখিয়ে বলল মন। কাঁকড়াগুলো ওদের পায়ের কম্পন বুঝতে পেরেই ঢুকে যাচ্ছে বালির ভেতর। এতক্ষণে লাল বালির রহস্যটা বোঝা গেল। তখন একসাথে অতগুলো কাঁকড়া বালির ওপর দেখে মনে হয়েছিল সমুদ্রসৈকতটাই যেন লাল। আসতে আসতে এগিয়ে চলল তারা সমুদ্রের দিকে। এখানে চারদিকটা একেবারেই ফাঁকা। কেউ কোথাও নেই। এতদূর হয়ত হেঁটে আসার ধৈর্য বা ইচ্ছা খুব বেশিজনের নেই। অনেকটা এগিয়ে তারা অবশেষে দেখতে পেল সমুদ্র। শুনতে পেল তার আওয়াজ। এক পা এক পা করে তারা এগিয়ে গেল সমুদ্রের দিকে। পিছনে দূরে ঘন গাছের সারি, সামনে অসীম সমুদ্র আর তারা দুজন। অ্যাবি হাত দুটো ছড়িয়ে পুরো কয়েক পাক খেয়ে মনকে বলল, “সারাদিন সমুদ্রে ঘুরতে ঘুরতে এই মজাটাই রবি পায় না, এই অনুভবটাই ও করতে পারে না। এটা তুইই বুঝবি!”
।।৩।।
সন্ধ্যাবেলায় তারা আবার এল এই সৈকতে। নদী পেরিয়ে সমুদ্রের ধারে এল সূর্যাস্ত দেখবে বলে। কিন্তু জোয়ার ভাটা কখন আসে, সে খোঁজ না নিয়েই তারা এসেছিল নদী পেরিয়ে সমুদ্রের ধারে। অ্যাবি সমুদ্রের জলে একটুখানি পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ দুজনেরই খেয়াল হল অ্যাবির পা জলের মধ্যে যতটা ছিল, তার থেকে বেশি ডুবে গেছে যেন। আর মন তো জল থেকে বেশ দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল। এখন ওর পায়ের চেটো ডুবে গেছে জলে।
“জোয়ার!” মন বলল, “চ’ এবার ফিরতে হবে।”
অ্যাবি জল থেকে উঠে এলো। তারপর কি মনে হল হঠাৎ সে জোরে দৌড়তে শুরু করল, “কে আগে যায়? আমি না তুই?”
অনেকটা এগিয়ে গেল সে মনের থেকে। মনও ছুটতে চালু করল জোরে। কিছুদূরে এসেই হোঁচট খেয়ে বালির ওপর ছিটকে পড়ল অ্যাবি। ভাগ্যিস বালিটা নরম, তাই অ্যাবির লাগল না। মন এবার অ্যাবির কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। মনের পায়ে এক ধাক্কা দিতে সে অর্ধেক বালিতে অর্ধেক অ্যাবির ওপরে পড়ল। এই নরম বালি আর অ্যাবির নরম বুকের স্পর্শে তার ভালো লাগল। তারপর অ্যাবির দিকে চেয়ে দেখল সে। অ্যাবির শরীরে কোনও আবরণ নেই, কোমরের নীচেটুকু ছাড়া।
অ্যাবির ঠোঁটদুটো এগিয়ে আসছে মনের দুই ঠোঁটের দিকে। দুজনের ভারে নরম বালিটা বসে গেল কিছুটা। শরীরে শুধু বালির চাদর জড়িয়ে কাল রাতের মতই মেতে উঠল তারা অন্য এক রোমাঞ্চে, অন্য এক আনন্দে। একজনের শরীর অপরজনের শরীরে জোয়ারের মত বইতে লাগল।
কিছুক্ষণের মধ্যে সমুদ্রের জোয়ারের জল তাদের পা ছুঁয়ে গেল। মন চেয়ে দেখল সমুদ্র এগিয়ে এসেছে তাদের কাছে অবধি। আর এখানে অপেক্ষা করা উচিত না। উঠে দাঁড়াল দুজনেই। কিন্তু কিছুদূর এগিয়ে এসে তারা বাধা পেল নদীতে। জোয়ারের জলে পুষ্ট হয়ে নদী এখন ফুলে উঠেছে বেশ। পায়ে হেঁটে এ নদী পেরনো অসম্ভব। তার ওপর এই নদীতে নাকি ঘূর্ণি আসে জোয়ারের জলে। তখন কেউ জলে পড়লে তাকে ফিরে পাওয়া অসম্ভব। হোটেলে আসবার সময় ভ্যানওয়ালার কাছে এই গল্পটা শুনেছিল সে। পিছনে তাকিয়ে দেখল সমুদ্রও এগিয়ে আসছে বেশ দ্রুতই। হঠাৎ দেখল পাশে অ্যাবি নেই, এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল তার থেকে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে আছে সে।
“অ্যাবি” আশ্চর্য এবং বিরক্তির সাথে মন অ্যাবির দিকে হাত বাড়াল। তাকে ডাকল। কিন্তু অ্যাবি এল না। এক পা এগোনোর চেষ্টা অবশ্য করল। আর তখনই… তখনই তার শরীরটা হঠাৎ বালি হয়ে মিশে যেতে থাকল বালিতেই।
“অ্যাবি!” চেঁচিয়ে উঠল মন। কিন্তু একটু একটু করে অ্যাবির শরীরের সবটুকু মিশে গেল বালিতেই। মন হতভম্ব হয়ে গেল। আর হঠাৎ করেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হল তার কাছে।
বালির হলদে রঙ আস্তে আস্তে বদলে গিয়ে অ্যাবির গায়ের ফর্সা রং পেয়েছে এখন। একমুঠো বালি তুলে দেখল মন, এ যেন অ্যাবির শরীরের মত নরম। অজানা ভয়ে ফেলে দিল সেটা। সামনের নদীটা ফুলে উঠছে সমুদ্রের জলে। প্রমা রেগে গেলে ঠিক এইরকম ভাবেই নাক ফুলিয়ে তাকায়। হতভম্বের মত চেয়ে দেখল মন। কিছু বুঝতে পারছে না সে, আবার যেন অনেককিছু বুঝতে পারছে। পিছনে চেয়ে দেখল সমুদ্রটা এগিয়ে আসছে। কিন্তু মন আটকা পড়েছে বালিতে, হোটেলে যাবার কোনও পথ নেই আর। আর কোন মুখেই বা সে ফিরবে? সে যে তার আর অ্যাবির মধ্যের বন্ধুত্বের গণ্ডীটা পাড় করে, এই নদীটাকে পাড় করে অনেকদূর চলে এসেছে। এখান থেকে ফিরলেও প্রমা কি মেনে নেবে তাকে? তবু সে শেষ চেষ্টা করল। ছুটে গেল নদীর দিকে, ঝাঁপ দিল নদীর জলে। আর তখনই ঘুমটাও ভেঙে গেল তার। নদীর জল কোথাও নেই, কিন্তু ঘামে সে ভিজে গেছে পুরো। একইসঙ্গে একইভাবে অ্যাবিরও ঘুমটা ভেঙে গেল। দুজনেই দুজনকে দেখল, একই প্রশ্ন যেন দুজনের চোখে। তারপর চারপাশে অন্য কাউকে খুঁজতে থাকল তারা, কিন্তু পেল না।
আগামী পর্ব – পড়ুন এখানে
ছবি – লেখক
লেখকের কথা: রুবাই শুভজিৎ ঘোষ
লেখকের জন্ম পশ্চিমবাংলায়। পেশায় একটি বহুজাতিক সংস্থার তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। নেশায় লেখক এবং পরিচালক। বাঙালির জনপ্রিয় ওয়েবসাইট সববাংলায় এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। কবিতা থেকে শুরু করে গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, চিত্রনাট্য সবকিছুই লিখতে ভালবাসেন। লিটিল ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক বিভিন্ন ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখেছেন। স্রোত থেকে প্রকাশিত তাঁর কবিতার সংকলন দৃষ্টি এবং বালিঘড়ি। এছাড়া তথ্যচিত্র, শর্ট ফিল্ম বা অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের ভিডিও পরিচালনা করেন। ধর্ম এবং বিজ্ঞান তাঁর প্রিয় বিষয়। ভ্রমণ তাঁর অন্যতম শখ। অন্যান্য শখের মধ্যে রয়েছে স্কেচ, ফটোগ্রাফি, ছবি ডিজাইন করা।