হপ্তা উশুল

লেখক : অভীক সিংহ

“হ্যালো, হ্যালো… আরে বলছি তো পরশু দিয়ে দেব, এনইএফটিটা ফেল করেছে… আপনাদেরই তো সার্ভার ডাউন, সেটা কি আমি গিয়ে তুলে দিয়ে আসব?… আগের সতেরোটা ইনস্টলমেণ্ট তো সময়মতই পেয়ে গিয়েছিলেন, কোন গাফিলতি হয়েছিল কি?… আরে বাবা, বলছি তো সোমবার সকালে পেয়ে যাবেন… হ্যাঁ রে বাবা, চিন্তা করবেন না, আপনার পয়সা মেরে দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছি না… হ্যাঁ, ম্যানেজারের সাথে কথা বলে একটু অ্যাডজাস্ট করুন… হ্যাঁ হ্যাঁ, দেখুন একটু…” বলে সান্যালদা ফোনটা টেবিলের উপরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। আমি খবরের কাগজটা নামিয়ে রেখে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী ব্যাপার, সান্যালদা? কিছু ঝামেলা হয়েছে নাকি?”
“আরে গাড়ির একটা ইএমআই ফেল করেছে,” সান্যালদা বিরক্তির সাথে বলল, “ব্যাঙ্কের সার্ভারটা কাল থেকে ডাউন, তাই দিতে পারিনি। তাই শালা সকাল থেকে জ্বালিয়ে যাচ্ছে।”
“নিজেদের সার্ভার ডাউন, আর তোমার উপরে চোটপাট করছে?” আমিও একটু রাগের সাথেই বললাম।
“কী আর বলব এদের, যত্তসব…” বলে সান্যালদা চেয়ারে উঠে বসল। “এই অভীক, একটু চা বলে দাও না। মাথাটা ঘেঁটে দিয়েছে এক্কেবারে।”
“জো হুকুম মেরে আকা,” বলে আমি বেয়ারাকে ডেকে দু’টো চা দিতে বলে দিলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যেই গরমাগরম চা এসে হাজির। ধূমায়িত চায়ের কাপটা তুলে একটা সপ্রেম চুমুক দিয়ে সান্যালদা “আহহ্‌” করে একটা শান্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, “সক্কাল সক্কাল এই এক কাপ গরম চা শান্তি করে গলা দিয়ে না নামলে দিনটা কেমন মেঘলা মেঘলা মনে হয়।”
“তা যা বলেছ সান্যালদা,” আমিও চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে একটা চুমুক দিলাম। “তবে সকালে এইসব কল আসলে মটকা গরম হয়ে যায় মাইরি।”
“সে আর বলতে,” সান্যালদা চায়ে আরেকটা চুমুক দিয়ে বলল, “শালা, গত সতেরোটা ইএমআই একেবারে ঠিক সময়ে দিয়েছি। এবারে নিজেদের সার্ভার ডাউন, সেদিকে নজর নেই। আর কিস্তি না পেয়ে আমায় খিস্তি করছে।”
“তবে সান্যালদা, একটা জিনিস কিন্তু তোমাকে মানতেই হবে।”
“কী জিনিস?”
“রিকভারি এজেণ্ট হতে কিন্তু ভারি দম লাগে।” আমি একটু মুচকি হেসে বললাম।
“কিসের দম হে? কিসের দম?”সান্যালদা একটু উত্তেজিতস্বরে বলল, “রিকভারি মানে বাংলায় তো পাতি হপ্তা উশুল করা। ওটা তো গুণ্ডাগিরি। ওতে আবার দমের কী আছে?”
“আচ্ছা, তাহলে তোমাকে যদি এখন কোথাও হপ্তা উশুল করতে পাঠাই, তোমার কি মনে হয় তুমি পারবে?” আমি চায়ের কাপে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে বললাম, “আমি বলি? ঘণ্টা পারবে। পাবলিক কেলিয়ে মুড়িঘণ্ট বানিয়ে দেবে। ওসব কাজের জন্য অন্য ধাতুর গড়ণ লাগে, ও তোমার-আমার কম্ম নয়।”
সান্যালদা একটু চুপ থেকে মাথা নেড়ে বলল, “তা খুব একটা ভুল কিন্তু বলনি অভীক। তুমি-আমি হপ্তা উশুল করতে গেলে ঠ্যাং খুইয়েই আসতে হবে।”
“তা আর বলতে।” বলে আমি চায়েক কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে কাপটা নামিয়ে রেখে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে একটা সিগারেট ধরালাম। “তবে কী জানো তো,” বলে আলগোছে একটা ধোঁয়ার রিং ছেড়ে সান্যালদার দিকে সোজা তাকিয়ে একটু রহস্যময় হাসি হেসে বললাম, “হপ্তাটা যদি ঠিকভাবে উশুল করতে পারো, তার মজাটাই কিন্তু আলাদা। ওটা একটা নেশার মত, একবার পারলে বারবার করতে মন চাইবে।”
সান্যালদা এবারে চা শেষ করে কাপটা টেবিলে রেখে একটু সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে বলল, “গতিকটা তো ঠিক সুবিধের লাগছে না অভীক। একটু ঝেড়ে কাশো তো।”
“গল্প আছে সান্যালদা, গল্প আছে,” আমি চেয়ারে মাথাটা এলিয়ে সিগারেটে টান দিয়ে বললাম, “একটা সময় আমিও এই ধান্দায় ছিলাম।”
“অ্যাঁ, কী বলছ?” সান্যালদা রীতিমত চমকে উঠল। “তুমি? হপ্তা উশুল? কবে? কেন? বলো বলো।”
আমি সিগারেটের ছাইটা ফেলে একটু কবি মধুসূদনের ঢংয়ে বললাম, “দাঁড়াও সান্যালদা, রয়েছ যেথা মোর সঙ্গে, তিষ্ঠ ক্ষণকাল। সব প্রশ্নের উত্তর পাবে। তার আগে একটু গলাটা ভিজিয়ে নিই মাইরি। আর এক কাপ করে চা বলব ভাবছি, চলবে তো?”
“ছি ছি, এ কি জিজ্ঞাসা করার মত কথা? চা কে না বলতে নেই। তাহলে পিছনে ফুসকুড়ি হয়,” সান্যালদা হাসতে হাসতে বলল, “নির্দ্বিধায় বলে দাও।”
আমি সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে বেয়ারাকে ডেকে দু’টো চা দিতে বললাম। কয়েক মিনিটের মধ্যেই চলে আসল গরম গরম চা। আমি সিগারেটটা ফেলে চায়ের কাপটা তুলে একটা সশব্দ চুমুক দিয়ে গল্প শুরু করলাম।

সে অনেকদিন আগেকার কথা, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছি, থার্ড ইয়ার। আর জানোই তো, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে প্রেমের সন্ধান পাওয়া আর হাতিবাগানে হাতি খুঁজে পাওয়া প্রায় একই জিনিস। আমরা, মানে আমি এবং আমার বন্ধুরা প্রায় সকলেই ছিলাম ফসলা, অর্থাৎ “ফ্রাস্ট্রেটেড ওয়ান সাইডেড লাভার্স অ্যাসোসিয়েশন”-এর সদস্য। সোজা কথায় বললে আমরা ছিলাম গরুহীন ষাঁড়ের গোত্রের প্রাণী। ক্লাসের বালাই নেই, সকাল বিকেল চায়ের দোকানে বা ক্যাণ্টিনে আড্ডা, রাতে হস্টেলের ছাদে বসে সস্তা মাল গেলা, আর মাঝে নিজেদের রুমে বসে তাস অথবা দেদার ভাট। মানে একদম লাগামছাড়া লক্ষ্যহীন ষাঁড় বললেও অত্যুক্তি হবে না। মাঝেমধ্যে ষাঁড়েদের মত নিজেদের মধ্যে গুঁতোগুঁতিতেও জড়িয়ে পড়তাম। কিন্তু আমরা ষাঁড় হলে কি হবে, কলেজে কী প্রেমের কলাগাছে মোচা ধরেনি? অবশ্যই ধরেছিল। কিছু অবিস্মরণীয় ক্ষমতাসম্পন্ন উঁচুদরের পুরুষসিংহদের গলায় ভাগ্যদেবী মাল্যদান করেছিলেন। সেই সিংহের দল বিকেল হলেই নিজেদের সিংহীদের নিয়ে গোপন অভিসারে বেরিয়ে পড়তেন, আর আমরা ষাঁড়ের দল দূর থেকে সেই দৃশ্য দেখে মনেমনে তাদের মুণ্ডপাত করতাম আর ল্যাজ দোলাতে দোলাতে নিজেদের খোঁয়াড়ে গিয়ে ঢুকে পড়তাম। এইভাবেই দিন চলছিল।

প্রসঙ্গতঃ বলে রাখি, সেই সময়ে আমরা হাতখরচা বাবদ বাড়ি থেকে বেশি কিছু পেতাম না। মেসের মাসিক খরচা মেটানোর পরে হাতে যা পড়ে থাকত, তাতে মাসের বাকি দিনগুলো চালানোটা ছিল অনেকটা রুমাল দিয়ে আলখাল্লা বানানোর শামিল। অতএব আমাদের মাঝেমাঝেই বিভিন্ন জায়গা থেকে একটুআধটু অর্থোপার্জনের চেষ্টা করতে হত। টিউশন পড়িয়ে বা বিভিন্ন কোচিং সেণ্টারের খাতাপত্র চেক করে সেই ব্যবস্থাটা মোটামুটি হয়ে যেত। কিন্তু সেই কাজও তো আর সবসময় থাকত না। আর এই সবের মধ্যে আমরা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারতাম না, পাবলিক প্রেম করার জন্য এত পয়সা পায় কোত্থেকে? বাড়ি থেকে তো নিশ্চয়ই প্রেমটা স্পনসর করবে না। অনেক ভেবেও আমরা এর কোন সদুত্তর পাই নি। সেই নিয়েই একদিন রাতে একটা ঘটনা ঘটল। আমি এক বন্ধুর হস্টেলের ঘরে সিগারেট খুঁজতে গিয়েছি। তার দরজায় টোকা দিতেই সে উঠে এসে দরজা খুলল। “কী বে? কী হয়েছে?”
“সিগারেট আছে? আমারটা শেষ হয়ে গেছে রে। হাগতে যাব, একটা দে।”
“সিগারেট চাই? আজ সাতাশ তারিখ। পকেট শালা স্পিনিং ট্র্যাক হয়ে বসে আছে বে। মাটি আছে, ঘাস নেই। সিগারেট কোত্থেকে আসবে?”
“যাঃ শালা, মারিয়েছে রে। আমারও তো একই কেস।”
আমাদের গলার আওয়াজ শুনে পাশের ঘর থেকে আরেক মক্কেল বেরিয়ে এসে বলল, “কী বে? মালকড়ি আবার শেষ নাকি বে?” তারপরে আমার দিকে ফিরে বলল, “সিগারেট নাই, বিড়ি আছে। চলবে?”
আমি গদগদ হয়ে বললাম, “চলবে কি বলছিস বে? উড়বে। এক-দু’পিস দে, জোর প্রেসার এসেছে।”
সে দু’টো বিড়ি এগিয়ে দিতেই আমি সোজা দৌড় লাগালাম টয়লেটের দিকে। বিড়ি ধরিয়ে শান্তিতে পেট পরিষ্কার করতে মিনিট দশেক লাগল। টয়লেট থেকে বাইরে বেরিয়েই দেখি বারান্দায় একটা ছোট জটলা। “কী কেস হল আবার?” ভাবতে ভাবতে এগিয়ে যেতেই ঘটনাটা বুঝলাম। আসলে এই মাসে বেশিরভাগ স্কুলে ছুটি চলছে বলে কারও হাতে টিউশন নেই। আর এই সময়টায় কোচিং সেণ্টারগুলোতেও কোন পরীক্ষা হয় না, তাই খাতা দেখার কাজটাও নেই। যথারীতি হস্টেলে বেশির ভাগ জনতার পকেটে বাজে রকমের টান পড়েছে। সবাই একটু চিন্তার সাথে বাইরে দাঁড়িয়ে সেই নিয়েই কথা বলছে।
“ধুর শালা, কোন পয়সাপাতি নেই। এভাবে চলে নাকি?”
“টিউশন নেই, কোচিংগুলো ঝোলাছে – হাতা হয়ে গেল মাইরি। বাড়িতে বলব?”
“যা যা বল, বল না একবার। বাপ এসে পিছনে হাম্পু দিয়ে প্যাণ্ডেল বানিয়ে দেবে।”
“হে হে হে, তা যা বলেছিস মাইরি।”
“দোকানের খাতায় আর কত লিখে রাখব বে? এবারে তো খিস্তি মেরে পোঁদের গোড়ায় লাথি মেরে ভাগাবে।”
“শালা, কিছুতেই বুঝে পাই না, পাবলিক এই শুকনো বাজারে প্রেম করার পুরকি পায় কোত্থেকে মাইরি? এদিকে তো শালা বিড়ি কিনতে গিয়ে জাঙ্গিয়া বিক্রি হয়ে যাবে।”
“এই দাঁড়া দাঁড়া, একটা আইডিয়া এসেছে।” আমি হঠাৎ করে বলে উঠলাম।
“এই না না, তোর আইডিয়া না, একদম না। শালা শেষবারের মত আবার গাধার ইয়েতে গুঁজে দিবি। তোর আইডিয়া একেবারেই না।” এখানে বলে রাখি, এই শেষবার আমারই আইডিয়াতে সবাই মিলে একটা ধাবাতে মাল গিলে পয়সা না দিয়ে পালাতে গিয়ে শেষে কপালজোরে ক্যলানি খেতে খেতে বেঁচে গিয়েছিলাম। “গতবার কপালজোরে বেঁচে গেছি, এবারে একটা ক্যলানিও মাটিতে পড়বে না।”
“তাহলে ছেঁড়। আমি আমারটা ঠিক ম্যানেজ করে নেব, তোরা বসে বসে চোষ।” বলে আমি কিছুটা রাগ করেই নিজের ঘরে ঢুকে গেলাম।
কিছুক্ষণ পরেই আমার ঘরের দরজায় টোকা। আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখি বাইরে সবাই এসে জড়ো হয়েছে। আমি একটু ঝাঁঝিয়েই উঠলাম, “কী হয়েছে?”
পাবলিক একটু মুখ চুণ করেই বলল, “এই বাঁ, আর রাগ করিস না।”
“কেন বে? আমার আইডিয়া নিলে তো গাধার ইয়েতে যাবি। তাহলে এসেছিস কেন বাল?”
“রাগ করিস না মাইরি। এই নে, একটা সিগারেট নে।”
চোখের সামনে সিগারেটটা দেখে মাথাটা এক ধাক্কায় শান্ত হয়ে গেল। “ভিতরে আয়, বলছি,” বলে সবাইকে ঘরের মধ্যে ডাকলাম। সবাই ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে পড়লে আমি সিগারেটটা ধরিয়ে শুরু করলাম, “দেখ, আইডিয়াটা খুব সহজ। যাদের কাছে পয়সা আছে, তাদের কাছ থেকে পয়সা বের করতে হবে।”
“সেটা আবার কী?”
“সোজা কথায়, হপ্তা উশুল,” বলে আমি সোজা হয়ে বসে সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে প্ল্যানটা শোনালাম। পাবলিক পুরো প্ল্যানটা শুনে খুশিতে গদগদ হয়ে বলল, “একটা কথা বল, তোর মাথায় এ’সব গাছঢ্যামনামার্কা আইডিয়া আসে কোত্থেকে বে?”
আমি মাথা চুলকে বললাম, “এসব পোঁদ খাটিয়ে বের করতে হয় বে। এবারে বল, চলবে?”
“চলবে কি বে কাকা? উড়বে। তাহলে কি কাল থেকেই?” পাবলিক উত্তেজনার সাথে প্রায় সমস্বরে বলে উঠল।
“একদম, কাল থেকেই কাজে লেগে পড়তে হবে।”

পরের দিন বিকেল হতে না হতেই প্রায় জনাবিশেক পাবলিক এসে জড় হয়েছি কলেজের গেটের বাইরে চায়ের দোকানে। সবার নজর কলেজের গেটের দিকে। একটু অপেক্ষা করতেই কলেজের গেট দিয়ে বেরোতে শুরু করল একের পর এক প্রেমীযুগল। তিন-চারটে যুগল বেরোতেই আমরা একটু দূরত্ব রেখে তাদের ধাওয়া করলাম। কথাপ্রসঙ্গে বলে রাখি, আমাদের কলেজের কাছেই দু’-তিনটে পার্ক ছিল, যেগুলো ছিল এনাদের বৃন্দাবন। বিকেল হলেই এই পার্কগুলি হয়ে উঠত এনাদের রাসমঞ্চ। তবে আজ গল্প কিছুটা আলাদাই হবে, কারণ আজ গল্পে স্বয়ং ভিলেনদের আবির্ভাব হয়েছে। তাগড়া ভিলেন ছাড়া শুধু হিরো-হিরোইন দিয়ে কি আর সিনেমা জমে নাকি? গব্বর সিং ছাড়া শোলে, মোগ্যাম্বো ছাড়া মিস্টার ইণ্ডিয়া, অথবা শাকাল ছাড়া শান তো পোস্ত ছাড়া আলুপোস্তর শামিল। কলেজ থেকে বেরিয়ে চৌমাথা থেকে যুগলদের দল নিজেদের পছন্দমত এদিক-ওদিক চলে গেল। আমরাও প্ল্যানমাফিক সেইমত ছোট ছোট দলে ভেঙে তাদের পিছু নিলাম। আমাদের দলটির সামনে দু’টি যুগল। দেখতে দেখতে তারা গিয়ে ঢুকল কাছের পার্কটায়, পিছনে কিছুটা দূরত্ব রেখে আমরা। পার্কের ভিতর দু’টি নির্জন নিভৃত জায়গা দেখে তাঁরা বসলেন আপন আপন অভিসারযাপনে, আমরা তখনও একটা বড় ঝোপের পিছনে লুকিয়ে। আর একটু অপেক্ষা, তার পরেই…

মিনিট পনের কেটে যেতেই পাবলিক একটু অধৈর্য্য হয়ে উঠল।
“আর কতক্ষণ বে? মশা কামড়াচ্ছে।” একজন উশখুশ করে বলে উঠল।
“দাঁড়া দাঁড়া, খেলাটা আরেকটু জমুক,” আমি ফিসফিস করে বললাম।
“আবে এদের দেখে তো নিজেরাই ফ্রাস্টু খেয়ে যাচ্ছি বে।” আরেকজন বলল।
“চাপ নিস না বে, আজ সব হিসেব বরাবর হয়ে যাবে।”
বলতে বলতে আমাদের চোখের সামনে প্রেমিকাদেবী তাঁর প্রেমিকদেবের কাঁধে মাথা রাখলেন। আমি এবার ফিসফিসিয়ে বলে উঠলাম, “সবাই রেডি?”
“একদম।”
বলে আড়াল থেকে ওদের বসার জায়গাটা আগে ভাল করে দেখে নিলাম সবাই। তারপরে আবার দু’টো দলে ভেঙ্গে গিয়ে প্রায় নিঃশব্দে গুঁড়ি মেরে এগোতে লাগলাম যুগলদ্বয়ের দিকে। কয়েক সেকেণ্ড পরে “এবার” বলে আমরা সবাই উঠে দাঁড়ালাম আর সোজা হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে সোজা গিয়ে মাটিতে বসে পড়লাম আমাদের টার্গেট যুগলটির ঠিক সামনে, হাততিনেক দূরে। তাদের তো আমাদের দেখেই পিলে চমকে যাওয়ার জোগাড়।
“অ্যাই, তোরা এখানে কী করছিস?”
“এই একটু পার্কে হাওয়া খেতে এসেছি। আপত্তি আছে?”
“তো শালা পার্কের অন্যদিকে গিয়ে বস না, এখানে কেন?”
“আসলে এদিকটার হাওয়াটা বেশ পুষ্টিকর।”
“মাইরি জ্বালাস না এখন, এদিক থেকে কেটে পড়। দেখছিস তো এখানে আমরা বসে আছি।”
“তোরা যা করছিস কর না, আমরা তো খালি এখানে বসে বসে দেখব। মাইরি বলছি, একদম ডিস্টার্ব করব না।”
“এই চল তো, আমরা ওদিকটায় গিয়ে বসি।” বলে সেই যুগল আমাদের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করতে করতে সেখান থেকে উঠে অন্যদিকে গিয়ে বসল। আমরাও তাদের দেখাদেখি সেখান থেকে উঠে আবার গিয়ে বসলাম তাদের সামনে। এবারে তারা কিছুটা অসহিষ্ণুতার সাথেই বলল, “তোরা আবার এদিকে এসেছিস? দাবীটা কী তোদের?”
“কী আবার দাবী? কিছুই না।”
“তাহলে পিছনে ঘুরছিস কেন?”
“পিছনে ঘুরব কেন রে, আমরা তো তোদের সামনেই বসে আছি। তোরা যা করছিস কর না, আরাম সে কর। আমরা কি বারণ করেছি? আমরা তো খালি বসে বসে দেখব।”
“ধুর শালা,” বলে তারা উঠে আবার একটু অন্যদিকে গিয়ে বসল। যথারীতি আমরাও তাদের পিছু নিলাম।

এইভাবে চার-পাঁচবার জায়গা বদল করার পরে সেই যুগল রণেভঙ্গ দিয়ে আমাদের বলল, “এবারে বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।”
আমরাও একদম নির্লিপ্তস্বরে উত্তর দিলাম, “আচ্ছা বল, আমরা কি কিছু করেছি? আমরা তো শুধু এসে চুপচাপ বসে আছি।”
“মাইরি বহুত জ্বালাচ্ছিস কিন্তু।”
“একেবারেই না। আমরা ঠিক করেছি আজ শুধু তোদের সামনে চুপ করে বসে থাকব।”
“কী চাই বল?”
“মাল্লু ছাড়।”
“পেঁয়াজি নাকি বে? মাল্লু ছাড় বললেই দিয়ে দেব?”
“তাহলে আমরা এখানেই বসলাম।”
আমাদের ভাবগতিক দেখে প্রেমিকাদেবী তাঁর প্রেমিকদেবের কানে ফুসফুস করে কিছু বললেন। সেটা শুনে প্রেমিকদেব আমাদের দিকে একটু রাগতভাব নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কত চাই?”
“কুড়ি টাকা ছাড়।” সেই সময় একপ্লেট বাটার চিকেনের দাম ছিল ত্রিশ টাকা, রুটি এক টাকা, গোল্ড ফ্লেক দেড় টাকা, আর এক বোতল ওল্ড মঙ্ক চল্লিশ টাকা।
“পাগল নাকি? পাঁচ টাকা দিচ্ছি।”
“তাহলে আমরা এখানেই বসলাম।”
আমাদের দাবিদাওয়ার বহর দেখে ততক্ষণে প্রেমিকদেবের মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। “ভাই, ওকে নিয়ে একটু খেতে যাব রে। একটু তো কনসেশন দে রে ভাই।”
আমরা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বললাম, “ঠিক আছে। তুই পাঁচ টাকা দিচ্ছিলি, আমরা তোকে পাঁচ টাকা কনসেশন দিচ্ছি। পনের টাকা দে।”
“দেখ, তোরও না, আমারও না, দশ টাকা। পায়ে পড়ছি মাইরি, কিছু তো ছাড় দে।”
“ঠিক আছে, দশ টাকাই দে। বাকিটা কাল দেখছি।”
প্রেমিকদেব প্রায় চমকে উঠে জিজ্ঞাসা করলেন, “কাল দেখছি মানে কী?”
আমরা সেই আগের মত নির্লিপ্তস্বরেই বললাম, “মানে কাল আবার বাকিটা নিতে আসব।”
“শালা, শুয়োর। এই নে ধর পনের টাকা। গুঁজে নে নিজেদের পিছনে।” বলে প্রেমিকদেব আমাদের হাতে টাকাটা গুঁজে দিলেন।
“থ্যাঙ্ক ইউ ভাই, থ্যাঙ্ক ইউ বৌদি। আবার খুব শিগগিরই দেখা হবে।”
“এবারে দেখতে পেলে কিন্তু উধুম ক্যালাব বলে দিচ্ছি।”
“বাল করবি,” বলে আমরা হো-হো করে হাসতে হাসতে পার্ক থেকে বেরোলাম। ইতিমধ্যে আমাদের অন্য দলটি অন্য যুগলের কাছ থেকে কুড়ি টাকা জোগাড় করেছে। তারপরে নির্ধারিত সময় মত সবাই কলেজের সামনে চায়ের দোকানের এসে জড় হলাম। হিসেব করে দেখলাম, সব মিলিয়ে প্রায় পঁচাশি টাকার মত জোগাড় হয়েছে।
“কাকা, মাইরি এতো বিশ্বাসই হচ্ছে না রে।”
“বললে হবে কাকা, খরচা আছে।” আমি বললাম।
“যাক, নেক্সট এক-দেড় সপ্তাহের চা-বিড়ির খরচাটা উঠে গেল মাইরি।”
“আর এটা শেষ হয়ে গেলে?”
আমি একটা বিড়ি ধরিয়ে তাতে একটা লম্বা টান দিয়ে বললাম, “অমলেট দেওয়া মুরগী তো পক-পক করে ঘুরেই বেড়াচ্ছে। আবার গিয়ে পকাৎ করে ধরে নেব।”

এই পর্যন্ত বলে থামলাম। সান্যালদা এতক্ষণ হাঁ করে শুনছিল। এবারে মুখ খুলল, “শালা যন্ত্র জিনিস তুমি মাইরি। তোমাকে দেখলে তো কোনদিক থেকেই তোলাবাজ বলে মনে হয় না।”
“কি যে বলো গুরু,” আমি চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে বললাম, “হপ্তা উশুল তো এখনও করি।”
“মানে?”
আমি মুচকি হেসে সান্যালদার দিকে তাকিয়ে বললাম, “প্রতি হপ্তার শুরুতেই ক্লাসে একটা করে অ্যাসাইনমেণ্ট দিয়ে হপ্তার শেষে উশুল করি।”
সান্যালদা মাথায় দু’হাত ঠেকিয়ে হাসতে হাসতে বলল, “তোমার খুরে দণ্ডবৎ।”


আগের ও পরের পর্বের লিঙ্ক<< ভূত দেখেছি

লেখক পরিচিতি : অভীক সিংহ
গল্পটির লেখক ড: অভীক সিংহের জন্ম পশ্চিমবঙ্গে। পেশায় অর্থনীতির অধ্যাপক এবং গবেষক, যুক্ত আছেন লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে, বর্তমান বাসস্থান চীন। তবে ভালবাসাটা আজও লেখালিখি, পেন্সিল স্কেচ, যন্ত্রসংগীত, এবং নিত্যনতুন রান্নাবান্নার সাথেই রয়ে গিয়েছে। প্রথম বই "R.E.CALL: এক Recollian-এর গল্প" প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। দাদুর হাত ধরে কবিতা দিয়ে লেখালিখির সূত্রপাত হলেও এখন প্রবন্ধ এবং গল্পতেই মনোনিবেশ করেছেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।