হাউজ হাজবেন্ড

লেখক : জয়দীপ চক্রবর্তী

(প্রথম পর্ব)

হোয়াটস-অ্যাপে বিনীতার ম্যাসেজটা পড়ে, ইউটিউব লিঙ্কে ক্লিক করল সংবৃতি। ভিডিওটা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল ও। সেই সঙ্গে মাথাটা ভীষণ ভারী অনুভব করল। যথা সম্ভব মাথা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করে, সংবৃতি ঐ ইউটিউব চ্যানেলটির বেশ কয়েকটি ভিডিও অল্প অল্প করে দেখল।

তিন দিন আগের ঘটনা।

দিনের আলো তখনো বেশ স্পষ্ট। সন্ধে নামতে অনেকটা সময় বাকি। জাগৃতি সংঘের সামনে পৌঁছে সংবৃতিকে ফোন করল পূর্ণিত। সংবৃতি যেন এই ফোনের অপেক্ষাতেই ছিল। একবার রিং হতেই ফোন ধরে বাড়িতে আসার পথ নির্দেশ দিল। ফোন রেখে বাড়ির কাজের মেয়ে শম্পাকে ডেকে বলল, “উনি এসে গেছেন। বেল বাজালে দরজা খুলে ওনাকে নিচের বসার ঘরে বসিয়ে সরবত দিবি। আমি নামছি।“

“আচ্ছা।” সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে সংবৃতির ঘর থেকে বেরিয়ে এলো শম্পা। এবারে সংবৃতি আয়নার সামনে দাঁড়াল। ওর চুল কালো ও সোজা, কাঁধ পর্যন্ত লম্বা। আজ ও সেগুলো বন্ধনহীন রেখেছে। হালকা পীচ রঙের সুতির শাড়ি পরেছে সংবৃতি। কানের একজোড়া ছোট সোনার দুল, দু’হাতের পাতলা সরু সোনার বালা, গলার হালকা সোনার চেন এবং কপালের সূক্ষ্ম টিপ সংবৃতির পরিশীলিত ও মার্জিত রুচিকে প্রকাশ করছে। খুব বেশি মেকআপ করা সংবৃতি কখনই পছন্দ করে না। শুধুমাত্র হালকা লিপস্টিক এবং আই-লাইনার দিয়েছে ও। এই সাধারণ সাজটি সংবৃতির আত্মবিশ্বাসকে যেমন ফুটিয়ে তুলেছে, তেমন ওর লাবণ্য, সৌন্দর্য ও শারীরিক গঠন বয়েসটাকে অনেকটাই আড়াল করে রেখেছে।

কলিং বেলের আওয়াজটা কানে আসতেই শেষ প্রস্তুতি সেরে, আয়নায় এক ঝলক নিজেকে দেখে নিয়ে, দোতলা থেকে নিচে নামল সংবৃতি। পূর্ণিত তখন সোফায় বসে শম্পার দিয়ে যাওয়া সরবতে একটা চুমুক দিয়ে, গ্লাসটা সামনে রাখা সেন্টার টেবিলে নামিয়ে রেখে বসার ঘরটি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।

আভিজাত্য ও রুচির পরিচয় ঘরটির সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। দুধ সাদা টাইলসে ঢাকা মেঝের ওপর বিছানো রয়েছে সুন্দর একটি ফারের কার্পেট। হালকা ধূসর রঙের সোফার ওপর হালকা ডিজাইনের কয়েকটি কুশন রয়েছে। দেয়ালের একপাশে রাখা আছে সোফার সাথে মানানসই কাঠের তৈরি একজোড়া আর্মচেয়ার। সোফার সামনে থাকা সেগুন কাঠের সেন্টার টেবিলের ওপর একজোড়া মিনিমালিস্টিক ফুলদানিতে অর্কিড শোভা পাচ্ছে। পূর্ণিতের ডান দিকের হালকা ক্রিম রঙের দেওয়ালে একটি শৈল্পিক পেইন্টিং রয়েছে, যাতে ধ্রুপদী দৃশ্যপটের চিত্রকর্ম ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বিপরীত দিকের দেওয়ালে রয়েছে একটি ডেকোরেটিভ কেবিনেট। যেখানে রাখা আছে প্রসিদ্ধ সাহিত্যিকদের কিছু বই, ক্রিস্টাল শোপিস, ছোট্ট বুদ্ধ মূর্তি এবং আরও কিছু ছোটখাটো আর্টিফ্যাক্ট। ঘরের এক কোণে দুটি ইনডোর প্ল্যান্টের টব রয়েছে। যার একটিতে রয়েছে অ্যারিকা পাম, অপরটিতে বাম্বু গাছ, যা ঘরের মধ্যে একটি প্রকৃতির ছোঁয়া নিয়ে এসেছে।

“নমস্কার, আমি সংবৃতি মজুমদার। ফোনে আমার সাথেই আপনার কথা হয়েছে।“ কথা বলতে বলতে একটি আর্মচেয়ার টেনে নিয়ে পূর্ণিতের মুখোমুখি বসল সংবৃতি।

“আপনার বাবা …” কথাটা অর্ধ সমাপ্ত রেখে সরবতের গ্লাসে চুমুক দিল পূর্ণিত।

“বাবা পাশের ঘরে রয়েছে। কদিন ধরে বাবার শরীরটা বিশেষ ভালো যাচ্ছে না। তাই শুয়ে রয়েছে। আমাদের প্রাথমিক কথাবার্তা হয়ে যাক। তারপর নিয়ে আসব। বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারবে না।“ আলগোছে পূর্ণিতের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করে বলল সংবৃতি।

“ঠিক আছে, ওঁকে এখানে এনে কষ্ট দিয়ে লাভ নেই। প্রয়োজন হলে আমিও ওঁর ঘরে গিয়ে দেখা করে আসতে পারি। তা আপনার কি জানার আছে বলুন।” সরবতটা সম্পূর্ণ শেষ করে টেবিলে গ্লাস রেখে সোফায় হেলান দিয়ে বসল পূর্ণিত। প্রশ্নটাতে সামান্য বিব্রত বোধ করল সংবৃতি। সেটা কাটিয়ে উঠতে কৃত্রিম হাসি মুখে মাখল ও। হাসলে সংবৃতির ডান গালে টোল পড়ে। যেটা ওর সৌন্দর্য অনেকটা বাড়িয়ে দেয়।

“না, না। আমি এক তরফা প্রশ্ন করে যাব, আর আপনি তার উত্তর দেবেন, তেমন কোনও কথা নেই। এখানে তো আপনি ইন্টারভিউ দিতে আসেননি। আপনার কিছু জানার থাকলে আপনিও নির্দ্বিধায় আমাকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন”।

পূর্ণিত এবার ওর কোমরের ওপরের অংশটা সোফার থেকে সামান্য সরিয়ে এনে, শ্রাগ করে, তারপর কাঁধ স্বাভাবিক অবস্থায় রেখে বলল, “আপনার সম্পর্কে তো আমি বিজ্ঞাপনে, আর ফোনে কথা বলেই যা জানার জেনে নিয়েছি। আপনি সি.এ পাশ করে একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কে সিনিয়র অ্যানালিস্ট পদে চাকরি করছেন। বয়স টেন্ডস টু থারটি। অর্থাৎ উনত্রিশ ছাড়িয়ে ত্রিশের দিকে এগোচ্ছে। বার্ষিক আয় আঠেরো লক্ষ টাকা। বাবা-মার এক মাত্র সন্তান। বৃদ্ধ বয়েসে তাদেরকে একা রাখবেন না বলে, এক সময় বিয়ে করবেন না বলেই ঠিক করে ছিলেন। সম্প্রতি মাকে হারিয়েছেন। এখন বাবার চাপে বিয়েতে রাজি হয়েছেন। তবে আপনার একমাত্র শর্ত হল পাত্রকে বিয়ের পর আপনাদের বাড়িতে থেকে আপনার বাবাকে দেখাশোনা করতে হবে। পাত্র বেকার হলেও আপনার কোনও আপত্তি নেই। তাই তো?”

“হ্যাঁ, অনেকটাই তাই। তবে আমার বাবার দেখাশোনা ভার পুরোপুরি আপনার ওপর চাপাব, এমনটা নয়। ওষুধপত্র দেওয়া থেকে বাবার সব দেখাশোনা শম্পাই করে। তাছাড়া আমি তো রয়েছিই।” এবারে একটু থেমে, চুলের গোছা পিঠ থেকে সরিয়ে সামনের দিকে ডান কাঁধের সামনে এনে সংবৃতি বলল, আপনি দেখছি, আমার কোয়ালিফিকেশন, চাকরি, স্যালারি,সবকিছু একেবারে মুখস্থ করে ফেলেছেন”।

“সে তো করতেই হবে। যার গৃহ-স্বামী হতে চলেছি, তার সবকিছু তো ঠোঁটস্থ রাখতেই হবে।”

“গৃহ-স্বামী!!” সংবৃতির ডান গালে আবার টোল পড়ল।

“হ্যাঁ, গৃহ-স্বামী। ইংরাজিতে যাকে বলে হাউজ হাজবেন্ড। মেয়েদেরকে যেমন বলা হয়, গৃহ-বধূ বা হাউজ ওয়াইফ। ওদেরটা বহুল প্রচলিত। সকলে শুনে অভ্যস্ত। গৃহ-স্বামী সেভাবে সচরাচর শোনা যায় না, তাই একটু কানে লাগছে।” কথা বলতে বলতে দেওয়াল চিত্রটির দিকে নজর ঘুরিয়েছে পূর্ণিত।

সংবৃতি সেটা লক্ষ্য করে, দেওয়াল চিত্র সংক্রান্ত কোনও প্রশ্ন আসবে এমন আশঙ্কা করে প্রসঙ্গ ঘোরায়।

“ চা-টা, চলবে তো?”

“কফি-টা হলে চলতে পারে।“

ডান গালে টোল ফেলে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায় সংবৃতি। “দাঁড়ান, বলে আসছি।” বসার ঘর থেকে ভেতরের ঘরে যায় ও।

শম্পাকে কফি করার কথা বলে, বাবার সাথে দুই-একটা প্রয়োজনীয় কথা সেরে বসার ঘরে ঢুকল সংবৃতি। ও ঘরে ঢুকে দেখল পূর্ণিত ডেকোরেটিভ কেবিনেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সংবৃতি আসা মাত্র পূর্ণিত জিজ্ঞাসা করল, এসব কালেকশন, সাজ-সজ্জা সবটাই কি আপনার মস্তিষ্ক প্রসূত?

“একদমই নয়। এর পুরো কৃতিত্ব আমার মায়ের। আমার মা একজন সাধারণ গৃহ-বধূ হলেও, একজন পেশাদার ইন্টরিয়র ডিজাইনার থেকে কোনও অংশে কম ছিল না।” এটুকু বলে একটু থেমে চেয়ারে বসল সংবৃতি। তারপর একটা দীর্ঘ-শ্বাস ছেড়ে বলল, “হেঁটে-চলে বেড়ান সুস্থ মানুষটা হঠাৎ করে চলে গেল।”

পূর্ণিতও নীরব। কেবিনেটের সামনে থেকে সরে সোফায় গিয়ে বসল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, “কী হয়েছিল?”

“দুপুরে খেতে বসে কাশি উঠেছিল হঠাৎ। খাবার শ্বাসনালীতে চলে গিয়েছিল। আমি তখন অফিসে ছিলাম। বাবা ও শম্পা সাধ্যমত চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বিশেষ কিছু করতে পারেনি। মিনিট খানেকের মধ্যেই মা অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। বাবা পাড়া প্রতিবেশীদের ডেকে হাসপাতালে নিয়ে যায় মাকে। শম্পার ফোন পেয়ে আমি সরাসরি হাসপাতালে যাই। তিন দিন ভেনটিলেশনে ছিল। তারপর সব শেষ।” কথা বলতে বলতে গলা ভার হয়ে আসে সংবৃতির।

অল্পক্ষণ আবার দুজনে নীরব। নীরবতা কাটিয়ে পূর্ণিত বলল, “সবটাই নিয়তি। এর ওপর আমাদের কারো হাত নেই। কোভিডে আমার বাবা মা দুজনে প্রায় একসাথেই চলে গেল। শেষকৃত্য করার সুযোগটাও পেলাম না।”

একটা ট্রেতে দুই কাপ কফি, এক প্লেট নিমকি, আর বেশ কয়েকটা ড্রাই কেক সাজিয়ে ঘরে ঢুকল শম্পা। ট্রেটা সেন্টার টেবিলে নামিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ও।

“নিন, আপনার কফি ও টা দুটোই চলে এসেছে। এগুলোর দ্রুত সদ্গতি করুন।” পূর্ণিতকে নির্দেশ দিয়ে কফির একটা কাপ তুলে নেয় সংবৃতি।

“আরে এতটা টা-টা নয়। এত কিছু খেতে পারব না।” কফির কাপ তুলে নিলো পূর্ণিত। আলতো একটা চুমুক দিয়ে, কাপটা টেবিলে নামিয়ে দুটো নিমকি তুলে নিয়ে বলল, “তা আপনি আপনার হাউজ হাজবেন্ডকে হাত খরচা দেবেন তো?”

“প্রয়োজন হলে অবশ্যই দেব। আমার বাবা সেন্ট্রাল গভরমেন্টের চাকুরীজীবী ছিলেন। এখন পেনশন খুব একটা খারাপ পান না। আর আমার রোজগারের অঙ্ক তো আপনার জানাই আছে। তাই হাত খরচা দিতে কোনও অসুবিধে নেই।  তা আপনি অঙ্কে মাস্টার ডিগ্রি করেও একদম বেকার!! টিউশানি করেন না?”

“দেখুন ছাত্র পড়াতে আমার কোনও কালেই তেমন ভাল লাগত না। বেশ কয়েকবার ডাবলু.বি.সি.এস পরীক্ষা দিয়েছি। লিখিত পরীক্ষায় পাশও করেছি দু’বার। তবে ইন্টারভিউতে সিলেক্ট হইনি। টিউশানি করতাম। বেশ কিছুদিন হল সব টিউশন ছেড়ে দিয়েছি। অর্থাৎ টিউশনের রোজগার বর্তমানে বন্ধ।”

“সব টিউশন ছেড়ে দিলেন? তাহলে এখন সময় কাটে কিভাবে?”

সংবৃতির প্রশ্নের উত্তরে পূর্ণিত ওর হাতের মোবাইলটা দেখিয়ে বলল, “এটা একটা অদ্ভুত যন্ত্র ম্যাডাম। এখন মোবাইল, ট্যাব ঘাঁটাঘাঁটি করে দিনের অধিকাংশ সময় কোথা দিয়ে যে কেটে যায়, টেরই পাইনা। সারাদিন বাড়িতে চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দী থাকতে থাকতে এমন অভ্যস্ত হয়ে পরেছি যে, এখন খুব প্রয়োজন না হলে বাড়ির বাইরে বের হই না।”

“হ্যাঁ, মোবাইলের নেশা সাংঘাতিক। তবে  টিউশনি গুলো ছাড়তে গেলেন কেন? নিজের হাত খরচা তো চলে যেত।” কথা শেষ করে কফির কাপে শেষ চুমুক দিল সংবৃতি।

কফির কাপ নামিয়ে একটা ড্রাই কেকে কামড় বসিয়ে পূর্ণিত বলল, “কি লাভ হতো? আমাকে তো আপনাদের বাড়িতে এসে থাকতে হবে। এই বাড়িতে থেকে তো ওই টিউশনগুলো করা যেত না। মাঝপথে ছেড়ে দিলে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে অসুবিধায় ফেলা হত না?”

“সে অবশ্য ঠিক। তবে চিন্তার কিছু নেই। এখানেও আপনি টিউশন পেয়ে যাবেন। ” পূর্ণিতকে ভরসা জোগানোর চেষ্টা করে সংবৃতি। তবে সেই চেষ্টার ফল হল হিতে বিপরীত।

গলার স্বর সামান্য তুলে পূর্ণিত বলে, “আচ্ছা ম্যাডাম আপনি হাউজ হাজবেন্ড খুঁজছেন। তাহলে তার রোজগার নিয়ে আপনি এত চিন্তিত কেন? এসব প্রশ্ন ছেড়ে আমি রান্নাবান্না জানি কিনা, ঘরের কাজকর্ম ঠিকমতো করতে পারি কিনা, সেসব জেনে নেওয়া আপনার উচিত ছিল না? পাত্রপক্ষ মেয়ে দেখতে গিয়ে তো এই প্রশ্নগুলোই করে।”

পূর্ণিতের কথার ইঙ্গিত বা উদ্দেশ্য যাই থাকুক না কেন, ওর বক্তব্যের যুক্তিকে অগ্রাহ্য করতে পারল না সংবৃতি। “তা অবশ্য ঠিক। তবে রোজগার-পাতি কিছু না করে, একদম ঘরে বসে রান্না-বান্না, ঘরের কাজকর্ম করতে, আর বউয়ের কাছ থেকে হাত পেতে টাকা নিতে আপনার সম্মানে বাঁধবে না তো?”

“লক্ষ লক্ষ গৃহবধূদের যদি এই কাজটা করতে কোন সম্মানহানি না হয়, তাহলে গৃহস্বামী হয়ে আমার এই একই কাজ করতে সম্মানহানি হবে কেন? তবে আপনার দিকটা একটু ভেবে দেখুন। আপনার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেলে, সকলেই প্রশ্ন করবে ছেলে কি করে? তাদের প্রশ্নের উত্তরে সত্যি কথাটা বলতে পারবেন তো? বলতে পারবেন তো ‘আমার স্বামী হাউজ হাজবেন্ড। চাকরি-বাকরি কিছু করেনা।’ দেখুন একটা কথা আগে থেকে বলে রাখি, কোন রকম মিথ্যের আশ্রয় নেওয়াটা আমি কিন্তু একদম পছন্দ করি না। “

“হ্যাঁ সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে একটু তো অসুবিধা হবেই।” সংবৃতির কথায় দ্বিধা ও ইতস্তত-বোধ ফুটে ওঠে।

“শুধু বিয়ের আগে এই প্রশ্নটাই নয়, বিয়ের পরে অফিস পার্টিতে, বা আপনার আত্মীয়-স্বজনের বিয়ে বা কোন আমন্ত্রণে আমাকে নিয়ে গেলে এই প্রশ্নগুলো আপনাকে সব-সময় শুনতে হবে। মহিলা-মহলে আপনাকে নিয়ে যথেষ্ট সমালোচনা চলবে। এইসব সমালোচনা সামাল দেওয়ার জন্য আপনি যদি মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকেন তাহলে আপনার গৃহস্বামী হতে, আপনাদের বাড়িতে ঘর জামাই হয়ে থাকতে আমার কোন আপত্তি নেই। তবে একটা কথা আপনার জ্ঞাতার্থে জানাই, আমি রান্নাবান্না এবং ঘরের কাজ ভালই জানি। সমস্ত পরিস্থিতি বিচার করে আপনি যদি আমাকে গৃহস্বামী করতে রাজি থাকেন তবে একদিন ফোন করে আমার বাড়িতে সকাল সকাল চলে আসবেন।  বিয়ের পাকা কথা আর মধ্যাহ্নভোজন সেরে যাবেন। তাহলে আমার রান্নাবান্না ও ঘর সামলানোর দক্ষতারও প্রমাণ হয়ে যাবে।”

পূর্ণিতের কথার কি উত্তর দেবে ভেবে পেল না সংবৃতি। অল্পক্ষণ চুপ থেকে পূর্ণিত বলল, “চলুন আপনার বাবার সাথে দেখা করে আসি। তারপর আজকের মত বিদায় নেব।“

পূর্ণিতের অনুরোধে সংবৃতি ওকে বাবার ঘরে নিয়ে গেল।

সংবৃতির সঙ্গে পূর্ণিত পাশের ঘরে গিয়ে দেখল একজন বয়স্ক ভদ্রলোক টিভির দিকে চোখ রেখে বিষ্ণু শয্যায় শুয়ে রয়েছেন। টিভিতে চালানো রয়েছে একটি বাংলা সংবাদ চ্যানেল। খাটের একপাশে রয়েছে একটি ওয়াকার। এটাতে দুহাতে ভর দিয়েই ভদ্রলোক এ ঘরে ও ঘরে যাতায়াত করেন। বসার ঘরে গিয়ে ভদ্রলোকের পূর্ণিতের সাথে দেখা করার ইচ্ছেটাও ছিল। তবে সংবৃতি শম্পাকে কফি বানাতে বলতে গিয়ে, বাবাকে নিজের ঘরে বসেই অপেক্ষা করতে বলে গেছে। তাই টিভির দিকে চোখ রেখে অধীর আগ্রহে পূর্ণিতের জন্য অপেক্ষা করছিলেন ভদ্রলোক। ওরা দুজন ঘরে ঢুকলে রিমোট দিয়ে টিভি বন্ধ করলেন উনি। তারপর হাতের ইশারায় পূর্ণিতকে খাটে বসতে বললেন। পূর্ণিত বসলে উনি বললেন, “আমি জানি আমার মেয়ে একটা অন্যায় আবদার করছে। ঘর-জামাই হয়ে থাকা কোন ছেলের পক্ষেই সম্মানজনক নয়। তবে আমাকে একা ফেলে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে থাকাও ওর পক্ষে সম্ভব নয়। এই কারণে কোনদিন বিয়েই করবে না বলে ঠিক করেছিল ও। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমি ওকে বিয়েতে রাজি করেছি। তবে আমি বেঁচে থাকতে ওর বিয়ে দেখে যেতে পারব কিনা জানি না।”

“মেসোমশাই, এমন কথা আপনি কখনও মনেও আনবেন না। মনের জোর রাখুন। আপনি শুধু মেয়ে-জামাই কেন, নাতিপুতিও দেখে যেতে পারবেন। আর আমি তো ঠিক ঘর-জামাই নই, হাউজ হাজব্যান্ড অর্থাৎ গৃহস্বামী হয়ে এ বাড়িতে থাকব। আর তাতে আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। আপনার মেয়ের সাথে সবকিছু নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়ে গিয়েছে। ওঁর কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপার রয়েছে। সেসব সেরে উনি ফোন করলে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করা যাবে। আপনি অনুমতি দিলে আজ আমি বিদায় নেব।” কথা শেষ করে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো পূর্ণিত।

“হ্যাঁ তুমি অনেকক্ষণ হয়েছে এসেছ। তোমাকে আমি আর আটকাব না। আশা করছি আমাদের আবার দেখা হবে।”

সংবৃতির বাবার থেকে বিদায় নিয়ে ওই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো পূর্ণিত। বাড়ির প্রবেশ দরজা পর্যন্ত সংবৃতি ওকে এগিয়ে দিল। ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় পূর্ণিত সংবৃতিকে বলল, “ম্যাডাম, একটু সময় নিয়ে বেশ ভালোভাবে ভাবনা চিন্তা করে সিদ্ধান্তটা নেবেন। সমস্যাটা শুধু বিয়ের আগে বা পরে কয়েকজনের কথাবার্তাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। দিন যত যাবে সমস্যা কিন্তু তত বাড়বে বই কমবে না। আমাদের কোন ইস্যু হলে, মানে কোন শিশু এলে, আরেক রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে। আমি যতই ভাল হাউস হাজব্যান্ড হই না কেন, শিশুকে ব্রেস্ট ফিডিংটা তো করাতে পারব না। ওটা আপনাকেই করাতে হবে। তারপর ধরুন, বাবা-মা কারোরই চিরকাল থাকে না। আপনারও থাকবে না। আপনার বাবার অনুপস্থিতিতেও আমাকে গৃহস্বামী করে রাখবেন তো! তখনও আমার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব, আমার যাবতীয় খরচ আপনি সামলাবেন তো? দেখুন ম্যাডাম, কোন ছেলে যত কমই রোজগার করুক না কেন, একজন বেকার মেয়েকে বিয়ে করতে কোন দ্বিধা-বোধ করে না। তবে কোন মেয়ে সে যত রোজগার করুক না কেন, একজন বেকার ছেলেকে বিয়ে করতে তার যথেষ্ট সম্মানে লাগে। আমরা যতই নারী পুরুষ সমান সমান বলি না কেন, বাস্তবে তা হওয়া কখনই সম্ভব নয়। এখন তো প্রচুর মেয়ে চাকরি করছে। হেলথ সেন্টারগুলোতে তো মহিলা স্টাফের সংখ্যাই বেশি। তারা কি কেউ বেকার ছেলেকে বিয়ে করতে চাইবে? ভাবুন ভাবুন। কথায় আছে, ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।’ এখন তবে আমি আসি। যে সিদ্ধান্তই আপনি নিন না কেন, আমাকে কিন্তু অবশ্যই জানাবেন।”

কথা শেষ করে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো পূর্ণিত। বসার ঘরে এসে সোফায় বসে চিন্তায় ডুব দিল সংবৃতি। পূর্ণিতের সব কথাগুলোই বেশ যুক্তিযুক্ত। ভবিষ্যতে এই সমস্যাগুলো আসা অসম্ভব কিছু নয়। তবে অনেক ভেবেও সংবৃতি  কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারল না। এরপর তিনটে দিন কেটে গেল। সংবৃতি পূর্ণিতকে ফোন করে কোন সিদ্ধান্ত জানাতে পারেনি। সেই সময় হোয়াটস-অ্যাপে বিনীতার একটা মেসেজ পায় সংবৃতি।

হাউজ হাজবেন্ড – অন্তিম পর্ব


লেখক পরিচিতি : জয়দীপ চক্রবর্তী
লেখক জয়দীপ চক্রবর্তী প্রতিলিপিতে একটি পরিচিত নাম। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়ে চলেছে তার লেখা। আকাশবাণী কোলকাতায় সম্প্রচারিত হয়েছে তার লেখা নাটক। পেশাদারী থিয়েটার দল “অবেক্ষণ” তার লেখা নাটক মঞ্চস্থ করছে কোলকাতার নামকরা কিছু মঞ্চে। তার কাহিনী চিত্রনাট্যে তৈরি সর্ট ফিল্ম, অডিও স্টোরি, প্রচারিত হয়ে চলেছে ইউটিউব চ্যানেলে। প্রতিলিপি এফ.এমেও প্রচারিত হয়েছে তার লেখা অডিও-স্টোরি। ২০১৮-এর কোলকাতা বইমেলায় তার লেখা হাস্য রসাত্মক বই “রাশি রাশি রসিকতা” প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিলিপি আয়োজিত প্রতিযোগিতা গুলিতে অংশগ্রহণ করে বহুবার জিতে নিয়েছে নানা প্রকার পুরষ্কার। লেখকের “লাল-গোলাপ” উপন্যাসটি প্রতিলিপি পুস্তক আকারে মুদ্রিত ও প্রকাশিত করেছে। লেখকের সাথে মোট চৌত্রিশটি গল্প নিয়ে বাণিজ্যিক চুক্তিবদ্ধ হয়েছে প্রতিলিপি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।