হাউজ হাজবেন্ড

লেখক : জয়দীপ চক্রবর্তী

হাউজ হাজবেন্ড – প্রথম পর্ব

(অন্তিম পর্ব)

বিনীতা, সংবৃতির খুব কাছের বন্ধু। সংবৃতির বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে শুরু করে, খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া, ওদের বাড়িতে পূর্ণিতের আসার কথা কোন কিছুই অজানা নয় বিনীতার। ফেসবুকে পূর্ণিতের ছবিও দেখেছে বিনীতা। সেই বিনীতা, সংবৃতিকে হোয়াটস-অ্যাপ মেসেজ করে লেখে, “তোর পূর্ণিত তো ছুপারুস্তম। ও তো মোটেও বেকার নয়। মাস গেলে ও তোর থেকে অনেক বেশি আয় করে। নিচে একটা ইউটিউব লিংক পাঠালাম দেখে নে।”

লিংকে ক্লিক করে ভিডিওটা ওপেন করল সংবৃতি। দশম শ্রেণী থেকে সসম্মানে  উত্তীর্ণ হয়ে যারা সাইন্স নিয়ে পড়ে, তারা হঠাৎ করে পাহাড় প্রমাণ সিলেবাসে হাঁপিয়ে ওঠে। যেন পুকুর থেকে তাদের সমুদ্রে ফেলা হয়েছে। সব বিষয়ের মত সমস্যা হয় অঙ্কেতেও। এই বিষয়ের সিলেবাসে এমন কিছু অধ্যায় যুক্ত হয়, যার সাথে তাদের বিন্দু মাত্র পূর্ব পরিচয় ছিল না। এই সমস্যাটিকে ছাত্র-ছাত্রীরা কিভাবে অতিক্রম করবে, কিভাবে এগোলে অঙ্ককে তাদের আর বোঝা বলে মনে হবে না, সেই সব কৌশলই পূর্ণিত তার এই ভিডিওটিতে শেয়ার করেছে। কয়েক মিলিয়ন ভিউ হয়েছে এই ভিডিওটিতে। শুধু এই একটি ভিডিও নয়, “অঙ্ক নয় আতঙ্ক” নামের এই ইউটিউব চ্যানেলটিতে একাদশ, দ্বাদশ ও স্নাতকের ছাত্র ছাত্রীদের জন্য অঙ্ক করার পদ্ধতি, দ্রুত সাফল্য পাওয়ার কৌশল, ও বিভিন্ন কঠিন অঙ্ক নিয়ে আলোচনা, প্রভৃতি নিয়ে অসংখ্য ভিডিও পোস্ট করা রয়েছে।  এই ভিডিও গুলো ছাত্র ছাত্রীদের পড়াশোনায় ভীষণ সাহায্য করছে। “অঙ্ক নয় আতঙ্ক” চ্যানেলটি বছর তিনেক আগে তৈরি। এরমধ্যেই সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা দশ লক্ষ ছাড়িয়েছে। সংবৃতি খোঁজ নিয়ে জেনেছে যে ভারতে ইউটিউবের কস্ট পার থাউজেন্ট ইমপ্রেশনস প্রায় এক থেকে তিন ডলার পর্যন্ত হতে পারে। “অঙ্ক নয় আতঙ্ক”-এর প্রতি মাসে ভিউ গড়ে পনেরো লক্ষের কম নয়। সেই হিসেবে পূর্ণিতের মাসিক উপার্জন দুই থেকে আড়াই লক্ষ্য টাকা, যা সংবৃতির মাসিক উপার্জন থেকে অনেকটাই বেশি।

অঙ্কটা সংবৃতির কাছে পরিষ্কার হওয়ার পর পূর্ণিতের ওপর ওর বেশ রাগ হল। সেই রাগের প্রকাশ ঘটানোর জন্য তৎক্ষণাৎ পূর্ণিতকে ফোন করল ও।

পূর্ণিত ফোন ধরে শান্ত ও স্নিগ্ধ গলায় বলল, “হ্যাঁ বলুন ম্যাডাম, আমি তো আপনার ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলাম। একটা সিদ্ধান্তে আসতে তিন দিন কাটিয়ে দিলেন?”

পূর্ণিতের প্রশ্নের উত্তরটা বেশ ঝাঁঝাল কণ্ঠস্বরে দিল সংবৃতি। “কোন সিদ্ধান্তে আসিনি। আর আপনার মতন একজন মিথ্যাবাদীকে নিয়ে কি সিদ্ধান্তে আসবো বলুন?”

“আমি মিথ্যেবাদী? এটা কিন্তু আপনার ম্যাডাম সম্পূর্ণ অন্যায় অভিযোগ। আমি আপনাকে কোন মিথ্যে কথা বলেছি বলে তো আমার মনে পড়ছে না।” পূর্ণিতের কণ্ঠস্বর এখনও শান্ত।

“আপনি ইউটিউব ব্লগ করে মাসে লাখ লাখ টাকা উপার্জন করছেন। অথচ আমাকে বললেন যে আপনি কিছুই করেন না।” মোবাইল ফোন কানে দিয়ে নিজের ঘরে পায়চারি করছে সংবৃতি।

ভুল করছেন ম্যাডাম। আমার যে কোন রোজগার নেই, সে কথা তো আপনাকে আমি বলিনি। আমার যতদূর মনে হচ্ছে আমি বলেছি যে টিউশন করতে আমার ভালো লাগে না। বেশ কয়েকবার ডাবলুবিসিএস পরীক্ষা দিয়েছি। লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেও ইন্টারভিউতে সিলেক্ট হইনি। এক সময় টিউশন করতাম বেশ কিছুদিন যাবত টিউশনের উপার্জন স্বেচ্ছায় বন্ধ করেছি। চার দেয়ালে বন্দি থেকে মোবাইল ট্যাব ঘাটাঘাটি করে দিনের বেশির ভাগ সময়টা কেটে যায়। এগুলো সবটাই ভীষণভাবে সত্যি।

সে হতে পারে। তবে আপনি মাস গেলে এত টাকা উপার্জন করেন, অথচ আমার কাছে হাত খরচা দাবি করছেন! ম্যাডাম, আমি এমন অনেক হাউস ওয়াইফকে চিনি যারা বাড়িতে বসে শাড়ি গয়না কসমেটিক্স প্রভৃতি বিক্রি করে, নাচ গান বা পড়াশোনার টিউশন করে, অনেক টাকা রোজগার করে। অথচ তারা প্রত্যেকেই স্বামীর কাছে হাত খরচা নেয়। তাছাড়া আমার একজন পরিচিত ভদ্রমহিলা তো চাকুরীজীবী হওয়া সত্ত্বেও বরের থেকে পকেট মানি নেন। তিনি অবশ্য এটাকে পকেট মানি না বলে ফোকট মানি বলেন। হাউজ ওয়াইফরা স্বামীর থেকে ফোকট মানি নিতে পারলে, হাউজ হাজবেন্ডরা স্ত্রীর থেকে সেটা নিতে পারবে না কেন?

দেখুন পূর্ণিতবাবু, সেদিনের আপনার বলা কথাগুলো নিয়ে আমি যথেষ্ট ভাবনা চিন্তা করেছি। ব্যাপারটা নিয়ে আমার বাবার সাথেও আলোচনা হয়েছে। আপনার সাথে আমার সম্পর্ক স্থাপন হোক আর নাই হোক, আমরা ঠিক করেছি কোন ছেলেকেই ঘরজামাই বা গৃহস্বামী করব না। এটা সেই ছেলেটির পক্ষেও যেমন অপমানজনক, তেমন আমাদের কাছেও সম্মানের নয়। তবে আমার বাবাকে একা বাড়িতে বা কোন বৃদ্ধাশ্রমে রেখে নতুন সংসার পাতাও আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। তাই আমি অবিবাহিত থাকবো বলেই ঠিক করেছি। তবে একটা সত্যি কথা না বলে পারছি না। আপনার কথাবার্তা, সেন্স অফ হিউমার আমার বেশ ভালো লেগেছে। আরও ভালো লেগেছে আপনার হার না মানার ক্ষমতাটাকে। ডাবলু বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে দুইবার লিখিত পরীক্ষায় পাশ করে, ইন্টারভিউতে চান্স না পেয়ে, ইউটিউব ব্লগের মত একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের প্রফেশন বেছে নিয়ে, মাত্র তিন বছরের মধ্যে সেখানে সাফল্য লাভ করা সহজ কথা নয়।

ক্রমাগত নিজের প্রশংসা শুনতে শুনতে একটু বিব্রত বোধ করে পূর্ণিত। সংবৃতির কথা তাই মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ও বলে, ” হ্যাঁ এই কাজটা বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। তবে এখন সেসব কথা থাক। আপনার বাবাকে বাড়িতে একা রেখে বা কোন বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে আপনি নতুন সংসার পাতবেন, এমনটা আমি কখনোই সমর্থন করব না। একটি ছেলের বিয়ের পর তার বাবা-মা যদি তাদের সাথে এক ছাদের তলায় থাকতে পারে, তাহলে মেয়ের বিয়ের পর তার বাবা-মায়ের, মেয়ে জামাইয়ের সাথে থাকতে অসুবিধা কোথায়? আমার বাবা মা কেউ বেঁচে নেই, আপনার বাবা আমার পিতৃস্থানীয়। উনি আমার সাথে থাকলে তো, আমার বাবা কাছে আছে বলেই মনে হবে। তাছাড়া সবাই মিলে মাঝে মাঝে শ্বশুর মশাই-এর বাড়িতে গিয়ে থাকাতেও কোনও অসুবিধে নেই।“

পূর্ণিতের কথাগুলো সংবৃতির বেশ ভালো লাগল। অল্পক্ষণ চুপ থেকে সংবৃতি ভাবল, সত্যিই তো, বাবাকে একা বাড়িতে না রাখা মানে যে কাউকে ঘর-জামাই হয়ে ওদের বাড়িতে থাকতে হবে, এমন কোনও কথা নেই। বাবাও সংবৃতিদের সাথে গিয়ে থাকতে পারে। আর পূর্ণিতের বাবা, মা নেই। ও বাড়িতে একাই থাকে। তাই সংবৃতির বাবা ওদের সাথে থাকলে খুব একটা সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

কী হল ম্যাডাম, চুপ করে গেলেন যে?

আপনার কথাগুলো ভাবছিলাম। এমনটা তো হতেই পারে। ঠিক আছে আমি ব্যাপারটা নিয়ে বাবার সাথে আলোচনা করছি। বাবার সম্মতি থাকলে আমরা কয়েকজন আগামী রবিবার সকালে আপনার বাড়ি চলে যাব। ফাইনাল কথাবার্তা ও মধ্যাহ্নভোজন সেরে ফিরব। অসুবিধা নেই তো?

না, এমনিতে কোন অসুবিধা নেই। তবে রোববার সকালটা হবে না। আমার একটা কাজ আছে। আপনারা বরং রোববার সন্ধ্যায় আসুন।

এই রবিবার অসুবিধা থাকলে পরের রবিবারও হতে পারে।

না আমি প্রতি রবিবার সকালেই একটু ব্যস্ত থাকি।

ঠিক আছে, তাহলে রবিবার সন্ধ্যাতেই যাবখন।

হ্যাঁ রবিবার সন্ধ্যায় আসুন। একদম ডিনার করে ফিরবেন।

ওকে, মোটামুটি কথা হয়ে রইলো। আমি বাবার সাথে কথা বলে, আমরা কতজন যাব সেটা আপনাকে হোয়াটস-অ্যাপে জানিয়ে দেব। আর আপনিও আপনার বাড়ির ঠিকানা ও ডাইরেকশন আমাকে পাঠিয়ে দেবেন।

সংবৃতির কথায় সম্মতি জানিয়ে ফোন রাখল পূর্ণিত।

পূর্ণিতের প্রস্তাব নিয়ে বাবার সঙ্গে আলোচনা করলো সংবৃতি। সেই সঙ্গে  পূর্ণিতের রোজগার সম্পর্কেও বাবাকে একটা ধারণা দিল ও। ভদ্রলোক এখন মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য ভীষণই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। পূর্ণিতকে সেদিন ওনার ভালই লেগেছিল। যথেষ্ট নম্র ও ভদ্র। তবে পূর্ণিত বেকার জেনে যে সংশয় মনের মধ্যে জন্মেছিল, এখন ওর উপার্জনের বৃত্তান্ত শুনে সেই সংশয় পুরোপুরি ভাবে কেটে গেল। এই ছেলেকে জামাই হিসেবে পেতে গেলে যদি তার বাড়িতে শেষ জীবনটা কাটাতে হয়, তাতে ওঁর কোন আপত্তি নেই। তাই রবিবার সন্ধ্যায়  সংবৃতি, ওর বাবা, বিনীতা এবং সংবৃতির এক মাসি পূর্ণিতের বাড়ি যাবে বলে ঠিক হল। সেই খবর হোয়াটস-অ্যাপের মাধ্যমে পূর্ণিতকে জানিয়ে দিল সংবৃতি।

সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেলেও একটা সংশয়, একটা প্রশ্ন, সংবৃতির মনের মধ্যে রয়ে গেল। প্রতি রবিবার সকালে পূর্ণিত কোথায় যায়? আর সেই কথাটা সংবৃতির কাছে লুকোতে চাইছে কেন পূর্ণিত। আর সেই জায়গায় যাওয়াটা পূর্ণিতের কাছে এতটা গুরুত্বপূর্ণ কেন, যে একদিনের জন্য সেখানে যাওয়া বন্ধ রেখে রবিবার সকালে সংবৃতিদের বাড়িতে ডেকে নেওয়া গেল না? মনের এই সংশয় গুলো নিয়ে বিনীতার সাথে আলোচনা করলো সংবৃতি।

সব শুনে বিনীতা বলল, “হ্যাঁরে ব্যাপারটা আমার কাছেও একটু গোলমেলে ঠেকছে। তুই পূর্ণিতের বাড়ির ঠিকানা, রোড ডাইরেকশন সব আমাকে পাঠিয়ে দে। আমি রবিবার সকালে ওর পিছনে লোক লাগাবো। দেখবো ব্যাটা কোথায় যায়।”

“নারে, এসব ঝামেলার মধ্যে যাস না। পূর্ণিত জানতে পারলে আমাদের খুব খারাপ ভাববে।”

“তুই একদম নিশ্চিন্তে থাক। পূর্ণিত বিন্দুবিসর্গ টের পাবে না। তুই যার সাথে সারা জীবনটা কাটাবি, তার সবকিছু জানার তোর অধিকার রয়েছে।”

বিনীতার প্রস্তাবে সম্মতি প্রকাশ করতে হল সংবৃতিকে। পূর্ণিত ওর বাড়ির ঠিকানা ও পথনির্দেশ সংবৃতিকে হোয়াটস- অ্যাপ করলে সেটা বিনীতাকে পাঠিয়ে দিল সংবৃতি। এরপর রবিবার দুপুরে ফোন করে বিনীতা যা বলল তা শুনে সংবৃতির ভীষণ খারাপ লাগলো।

মিথ্যে কথা বলাটা সংবৃতি একেবারেই পছন্দ করে না। তার উপর যে ছেলেটির সাথে ও সম্পর্ক গড়তে চলেছে, যার সাথে সংবৃতি সারাটা জীবন কাটাবে ঠিক করেছে, সে যদি অকারণে মিথ্যে কথা বলে, তাহলে খারাপ লাগাটা খুব স্বাভাবিক। আজ সন্ধ্যায় সংবৃতির পূর্ণিতের বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু সব কথাবার্তা হয়ে রয়েছে। পূর্ণিত হয়তো সব আয়োজনই করে ফেলেছে। একটু পরে মাসিও চলে আসবে। তাছাড়া বাবাকে এখনই সব কথা বলে আঘাত দিতে চাইছে না সংবৃতি। তাই সন্ধ্যায় পূর্ণিতের বাড়ি যাওয়ার পরিকল্পনায় কোন পরিবর্তন আনল না ও।

বিনীতা ওর পাড়ার একটি ছেলেকে পূর্ণিতের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে রোববার সকালে ও কোথায় যায় সেটা নজর রাখতে বলেছিল। বিনীতার নির্দেশ পালন করেছিল ছেলেটি। সকাল দশটা নাগাদ পূর্ণিত ওর গাড়ি নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়। বাইক নিয়ে সেই গাড়ির পিছু নেয় ছেলেটি। একটি বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড় করায় পূর্ণিত। সেই বাড়ির সামনে চোদ্দ পনেরো বছরের কয়েকটি ছেলে মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। পূর্ণিতকে দেখামাত্র “স্যার এসেছে, স্যার এসেছে” বলতে বলতে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল সকলে। যথাস্থানে গাড়ি পার্ক করে সেই বাড়িতে ঢুকে পড়ানো শুরু করলো পূর্ণিত। বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে সেই অধ্যয়নের কাজ কিছুটা কর্ণগোচর করে, ওখান থেকে চলে আসে ছেলেটি।

সন্ধ্যার পরে ওরা চারজন এক হাড়ি রসগোল্লা নিয়ে পূর্ণিতের বাড়ি পৌঁছয়। সংবৃতিদের গাড়ি পূর্ণিতদের বাড়ির সামনে পৌঁছলে পূর্ণিত সংবৃতির বাবাকে হাত ধরে ঘরে নিয়ে আসে। একজন বয়স্ক লোক বাকিদের সাদর আমন্ত্রণ করে বাড়ির ভেতর নিয়ে বসায়। পূর্ণিত এই বয়স্ক ভদ্রলোকের সাথে সকলের আলাপ করিয়ে দেয়। ভদ্রলোক পাশের বাড়িতে থাকেন। অভিভাবক হিসেবে কথা বলার জন্য পূর্ণিত ওনাকে ডেকে এনেছে। একতলা বাড়িটির যে ঘরে সংবৃতিরা বসেছে, সেই ঘরে কয়েকটি কাঠের চেয়ার ও একটি টেবিল রয়েছে। একটি দেওয়ালে সাদা বোর্ড ঝুলছে।

“এখানে বোর্ড রয়েছে যে? তুমি কি বাড়িতেও ছাত্র-ছাত্রী পড়াও?” পূর্ণিতের হাত ধরে চেয়ারে বসতে বসতে সংবৃতির বাবা প্রশ্ন করলেন ওকে।

“এই বোর্ডেই অংক বুঝিয়ে ইউটিউবে ব্লগ করি আমি।” পূর্ণিতের উত্তর।

একটি আমের শরবত নিয়ে আনন্দী নামে একটি পনেরো ষোলো বছরের মেয়ে ঘরে ঢুকল। মেয়েটিও পূর্ণিতদের পাড়াতে থাকে। পূর্ণিতকে অতিথি আপ্যায়নে সহযোগিতা করতে ও এখন এই বাড়িতে রয়েছে।

“সংবৃতির কাছে তোমার রোজগারের কথা শুনলাম। ইউটিউবে ব্লগ করে এত রোজগার হয় ধারণা ছিল না।” শরবতের গ্লাসে দ্বিতীয়বার চুমুক দিয়ে বললেন সংবৃতির মাসি।

“শুধু ইউটিউবে ব্লগ নয়, সম্প্রতি একটি কোর্স বিক্রয়কারী সংস্থা আমাকে স্পন্সরশীপ অফার করেছে। ঐ সংস্থার হয়ে একটি শিক্ষামূলক চ্যানেলে আমাকে ক্লাস নিতে হবে। এক লক্ষ টাকা মাসিক আয় হবে ওখান থেকে।” কথা বলতে আনন্দীর দিকে চোখ যায় পূর্ণিতের। আনন্দী ওকে ইশারা করে কিছু বলতে চাইছে। “আপনারা কথা বলুন। আমি একটু ভেতর থেকে আসছি।“

পূর্ণিত ভেতরের ঘরে চলে গেলে সংবৃতির মাসি সংবৃতিকে চাপা গলায় বললেন, “তোর হবু বরের ইনকাম তো মাসে তিন লক্ষ টাকার ওপরে। ও আবার তোর কাছ থেকে হাত খরচা চায়? তোর উল্টো ওর কাছ থেকে হাত খরচা আদায় করা উচিত।”

ভদ্রমহিলা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ওই সময় বাড়ির কলিং বেলটা বেজে উঠলে কথাটা মাঝপথে থামাতে হল। পাশের বাড়ির ভদ্রলোক দরজা খুলতে যাচ্ছিলেন। বিনীতা ওঁকে বসতে বলে নিজে গিয়ে দরজা খুলল। একজন মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

মাস্টারমশাই বাড়িতে আছেন?

হ্যাঁ, ভেতরের ঘরে আছে। দাঁড়ান ডাকছি।

না না, ডাকতে হবে না। আমার ছেলেটা ভালোভাবে পাশ করেছে। তাই মিষ্টি নিয়ে এসেছিলাম। আপনি ওঁকে এটা দিয়ে দেবেন।

“আপনার ছেলে বুঝি পূর্ণিত স্যারের কোচিং সেন্টারে পড়ে? ” মিষ্টির প্যাকেট হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল বিনীতা।

“না না কোন সেন্টারে গিয়ে নয়, ওরা কয়েকজন মিলে তো স্যারের বাড়িতে এসেই পড়ে। আমি এখন আসছি, প্যাকেটটা স্যারকে দিয়ে দেবেন।” ভদ্রমহিলা চলে গেলে দরজা বন্ধ করে মিষ্টির প্যাকেটটা টেবিলের উপর রাখল বিনীতা। অল্প কিছুক্ষণ পর একটি ট্রেতে করে ছয় প্লেট ফিস-ফ্রাই নিয়ে ঢুকল পূর্ণিত।

“নিজের হাতে ভেজে এনেছি। নিন গরম গরম খেয়ে নিন।” ট্রেটা টেবিলে রাখতে গিয়ে মিষ্টির প্যাকেটটা পূর্ণিতের নজরে পরল।

“আরে কত মিষ্টি এনেছেন আপনারা!”

“এটা আমরা আনিনি। আপনার এক ছাত্রের মা, ছেলে ভালোভাবে পাশ করেছে বলে দিয়ে গেছে। আপনি রবিবার সকালে গাড়ি চালিয়ে টিউশন করতে যান, আবার বাড়িতেও ছাত্রছাত্রী পড়ান। তাহলে আপনি টিউশন করেন না এই মিথ্যে কথাটা বলার প্রয়োজন ছিল কি? ” যথাসম্ভব রাগের বহিঃপ্রকাশ না ঘটিয়ে বলল সংবৃতি।

“আপনারা যখন সব জেনেই গেছেন তাহলে পুরোটা খুলে বলি। আমি আপনাকে আগেই বলেছি, পারিশ্রমিকের বিনিময়ে টিউশন করা বেশ কিছুদিন যাবত আমি ছেড়ে দিয়েছি। এই কথার মধ্যে বিন্দুমাত্র মিথ্যে নেই। আর্থিক অসচ্ছল পরিবারের বেশ কিছু মেধাবী ছেলেমেয়েকে আমি বিনা পারিশ্রমিকে পড়িয়ে, প্রয়োজনীয় বই খাতা দিয়ে, ওদের পড়াশোনা করতে সাহায্য করি। এই যে আনন্দীকে দেখছেন, আপনাদের আপ্যায়নে সাহায্য করতে নিজে থেকে আজ এখানে উপস্থিত হয়েছে, সেও আমার ছাত্রী। আমি আত্মস্তুতি করতে পছন্দ করি না। তাই এই ব্যাপারটা একটু গোপন রেখেছিলাম। “

পূর্ণিতের কথার কোনও উত্তর দিল না সংবৃতি।

কিছুক্ষণ সবাই নীরব। ফিস ফ্রাই খাওয়া শেষ করে, পূর্ণিতের পাশের বাড়ির ভদ্রলোকের সাথে পঞ্জিকা দেখে সবার সাথে আলোচনা করে মেয়ের বিয়ের একটা শুভ দিন ঠিক করলেন সংবৃতির বাবা।

নিরামিষ মুগের ডাল, ঝুরঝুরে আলু ভাজা, পাঁঠার মাংস ও চাটনি, ডিনারের মেনু উপভোগ করল সকলে। প্রতিটি পদই পূর্ণিতের তৈরি। সেই রান্নারও প্রশংসা করল সকলে। ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠে সংবৃতির মনে হল পূর্ণিত যথার্থই একজন সফল শিক্ষক। এই অল্প কদিনে সংবৃতি পূর্ণিতের থেকে যে শিক্ষা পেয়েছে, তা ওর সারা জীবনের সঞ্চয় হয়ে থাকবে।


লেখক পরিচিতি : জয়দীপ চক্রবর্তী
লেখক জয়দীপ চক্রবর্তী প্রতিলিপিতে একটি পরিচিত নাম। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়ে চলেছে তার লেখা। আকাশবাণী কলকাতায় সম্প্রচারিত হয়েছে তার লেখা নাটক। পেশাদারী থিয়েটার দল “অবেক্ষণ” তার লেখা নাটক মঞ্চস্থ করছে কলকাতার নামকরা কিছু মঞ্চে। তার কাহিনী চিত্রনাট্যে তৈরি সর্ট ফিল্ম, অডিও স্টোরি, প্রচারিত হয়ে চলেছে ইউটিউব চ্যানেলে। প্রতিলিপি এফ.এমেও প্রচারিত হয়েছে তার লেখা অডিও-স্টোরি। ২০১৮-এর কলকাতা বইমেলায় তার লেখা হাস্য রসাত্মক বই “রাশি রাশি রসিকতা” প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিলিপি আয়োজিত প্রতিযোগিতা গুলিতে অংশগ্রহণ করে বহুবার জিতে নিয়েছে নানা প্রকার পুরষ্কার। লেখকের “লাল-গোলাপ” উপন্যাসটি প্রতিলিপি পুস্তক আকারে মুদ্রিত ও প্রকাশিত করেছে। লেখকের সাথে মোট চৌত্রিশটি গল্প নিয়ে বাণিজ্যিক চুক্তিবদ্ধ হয়েছে প্রতিলিপি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।