লেখক : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী
খুব শীত পড়েছে এ’বছর। খুনখুনে বুড়োবুড়ি অনেকেই পটল তুলল আশপাশের গ্রামে। মহিশবেড়ের হিরু নাপিত, ঝগড়পাড়ার পতা বামনি, শ্রীহরিপুরের মদনা পাড়ুই আর এ গাঁয়ে নীলু। বুদে শীতে হি হি করতে করতে বাড়ির সামনের রোয়াকে এসে গুটিসুটি মেরে বসে থাকে। সকালে সুয্যিদেব একটু ওপর দিকে উঠলেই বুদের পাকা দোতলা বাড়ি রোদে ঝলমল করে। সেই আগের খোড়ো মাটির ঘর তো আর নেই। সেই মাটির ঘরের ভেতর আলো ঢুকতে পারত না। খড়ের চাল এমনভাবে দেওয়া হত আলো উঠোন পর্যন্ত এসে মাটির দাওয়ায় থমকে থাকত। আর অনুমতি পেত না বলেই মাটির ঘর গ্রীষ্মকালে ঠান্ডা থাকত। তবে শীতের সময় গরম থাকত। কিন্তু বুদে বসে বসে ভাবে তাদের ভাঙা মাটির বাড়ি শীতকালে গরম থাকত কি! আসলে একটা দুটো ঘরে তখন গরু ছাগলের পালের মত লোক শুত। গায়ের গরমই তো আসল গরম।
বাড়ির কিছু দূরে বেহুলা নদীর চরে মেলা লোক জমেছে। বুদে রোয়াকে বসেই সোজা জোড়পুকুরের ওপর দিয়ে চোখ মেলে দেয়। সূর্য ঠিক চোখে এসে পড়েছে বলে চোখের ওপর হাত চাপা দিয়ে আড়াল করে দূরের দিকে দেখে সে। সত্যি কী হুজ্জত আজকালের ছেলে ছোকরারা করতে পারে! শীত পড়লেই সব দলে দলে কোত্থেকে এসে নদীর চরে ভিড় জমায়। এ গ্রামের ছেলেমেয়েরাও যায়। অন্য গ্রাম থেকেও আসে। এমনকী আজকাল শহর থেকেও আসতে লেগেছে। আর সব শেষে নদীর চর একেবারে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে রেখে যায়। যেন খুবলে খাবলে ভোগ করে ফেলে রেখে যাওয়া। বুদে বিড়বিড় করে গাল দেয় ‘বানচোতের দল সব’ বলে। তাতে ভেতরের জ্বালা একটু হলেও কমে।
মাইকে ভেসে আসছে ‘টুম্পাসোনা একটা হাম্পি দেনা না না না না ননননননননা’। বিকট আওয়াজের সঙ্গে উৎকট অঙ্গভঙ্গী করে নাচছে একদল ছেলেমেয়ে। এখন তো আবার মেয়েরাও ছেলেদের গায়ে গা ঘেঁষে নাচে। মেজছেলে সুবু, পাশের গাঁয়েই হাইইস্কুলে পড়ায়। অ্যাসিসটেন হেডমাস্টার না কী একটা হয়েচে… তিনটে পাশ করা ছেলে বুদের, সে বলে, “বাবা, এসবে মাথা গলাতে যেও না। এখন আধুনিক যুগ। ছেলে-মেয়ের কোন তফাৎ নেই।” আরে মোলো যা!
ভটভট শব্দে নতুন মোটর সাইকেলখানা এনে দাঁড়াল লাল্টু। দুলের ঘরে যেন রাজপুত্তুর হয়েছে বেটা খান। টকটকে রঙ, নাক মুখ টুলটুলে। হবে না? ওর মা যে ডাকসাইটে সুন্দুরী। “বড়বাবু, একটা জিনিস এনেছি তোমার জন্যে” বলেই একখানা গরম চাদর জড়িয়ে দিল লাল্টু। “বলি ও লবাবপুত্তুর! এত ট্যাকা বিনে কারণে কে খরচ করতে বলেচে রে তোকে? হ্যাঁ?” বুদে চিৎকার করে। লাল্টু পাত্তা না দিয়ে হেসে ঢুকে পড়ে ঘরে। চাদরটাতে বেশ আরাম বোধ হয় বুদের। আরও ভাল করে জড়িয়ে নিয়ে আবার গাল পাড়ে, “হারামজাদা”। সূর্যের আলো পড়ে বুদের মুখ সুখে চকচক করে।
ফুলি, ছোট বউ, বাঁহাতে একগোছ বাসন উঁচু করে ধ’রে আর ডানহাতে একটা পেতলের ঝকঝকে বালতিতে জল নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। মাথায় ঘোমটা রয়েছে, তবে মুখ ঢাকা নয়। বুদে তাকিয়ে আছে দেখে ছোট বউ হাসে। হাসিটি ভারি মিঠে, এখনও। সেই বিয়ের পর পেত্থম যেদিন এল সেদিনও ঠিক এরকম হাসি লেগে ছিল মুখে। ছোট বউয়ের পিছু পিছু বুদের দুই ছেলের বৌ, চারটি ছোট নাতিনাতনি বেরিয়ে এল। প্রত্যেকের হাতে কিছু না কিছু রান্নার সরঞ্জাম। তার মানে আজ ওদের ভলগ্ আছে। তার মানে বুদেকেও এখন এই রোদ্দুরের ওম ছেড়ে ওই বাগানে যেতে হবে খড়ের ছাউনির নিচে। ভাগ্যিস ঘোষেদের অতবড় বাগানটা বিক্রি আছে বলে বুদে ঠিক সময়ে জানতে পেরেছিল। তাই তো ছোট বউয়ের ভলগের টাকায় ওটা এক লফ্তে কিনে নেয়া গেল। এখন সপ্তাহে একটা করে দিন ওই বাগানে বুদেদের ফিস্টি হয়। এক একদিন এক একরকম নতুন রান্না মাটির হাঁড়িতে বসিয়ে ওরা করে। তারপর সক্কলে মিলে বাগানের মাটিতে বসে তৃপ্তি করে খায়। সেই সব ছবি তুলে রাখে ওই হারামজাদা লেল্টো। তারপর ফোনে ছেড়ে দেয় আর লাখে লাখে লোকে দেখে।
ছোট নাতনি এসে হাঁকে, “ও দাদু! চলো। বাগানে যেতে হবে আজ।” বুদের আজ বড় শীত লেগেছে। রোয়াক ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু বুদে না গেলে আবার নাকি দেখার লোক কমে যায়। লেল্টো বলে ‘ভিউ’ পড়ে যায়। ওই যে ছোট বউয়ের রান্না বুদে পরিতৃপ্তি সহকারে ভক্ষণ করে, সেটাই ‘ইউএসপি’ না কী একটা বলে। বুদে খায় আর ছোটবউ হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে থাকে। হারামজাদা লেল্টো ক্যামেরা ওই সময় একবার তার মায়ের মুখে আর একবার জ্যেঠার মুখে রাখে। বুদের অবিশ্যি ভালই লাগে, মুখে স্বীকার করে না।
বাগানে মাটির উনুনে মাটির হাঁড়ি বসিয়ে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে সুন্দর করে হেসে আজকের রান্নার বিবরণ দিতে দিতেই কাজ করতে থাকে ফুলমালা অর্থাৎ দুলেবাড়ির ছোট বউ। বয়েস নয় নয় করে পঞ্চাশ পুরেছে কে বলবে। এখনও মাগির কী ছব্বা, কী চেহারা! বাগানের এক পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বুদের সহধর্মিণী কালী। নামেও কালী, অঙ্গে কালী, মনেও কালী। কালী সম্বন্ধে বুদের মনোভাব তাই বলে। যখনই ভলগ্ হবে বড় বউ ঠিক এসে দাঁড়ায়, অতচ ক্যামেরার সামনে আসবে না। ছোট বউ কম হাতে পায়ে ধরেচে তাকে। কিন্তু কী যে বিষনজরে সে ছোট বউকে দ্যাখে কে জানে। আর ওই বিশে, ছোট কত্তা, যতো গুজগুজ ওর সনে। দুটোই জম্ম কুচুক্কুরে। সব বোঝে বুদে, কিন্তু বাড়ির বড় কত্তা হওয়ার জন্যে আর আগের মত চিল্লামিল্লি করে না। তকন দুলেপাড়া মানেই চেঁচামেচি, বউ পেটানো, তাড়ি খেয়ে পড়ে থাকা। মাটির ভাঙা দাওয়ায় সানকিতে কাঁচা লঙ্কা ডলে চাট্টি পান্তা হুপুসহাপুস গিলে বাবুদের পুকুরে জাল ফেলা,নারকোল পেড়ে দেওয়া, জমিতে হাল দেওয়া। তাপ্পর সেই সত্তর সালে বুদের চোকের সামনে কত কী-ই তো ঘটল। কলকাতার তিনটে ছেলে এসে রইল বাঁড়ুজ্জেবাড়ি। পেথম পেথম মাঠেঘাটে যেত। বুদের সঙ্গে কতা কইত। তাপ্পর, তাপ্পর একদিন…।
“ও দাদু, কী ভাবচো?” সেজ নাতিটা গা ঘেঁষে আসে। লেল্টোর দেওয়া চাদরটা নাতির গায়ে দিয়ে কোলে নিয়ে বসে বুদে। এই পোড়া চোকদুটি তো কম কিচু দেকল না। এই যে ঘোষেদের বাগান আজ বুদনের নামে হয়েচে ছোট বউয়ের ট্যাকায়, এই বাগানে একদিন কী মারটাই না মেরেচিল ঘোষেদের মেজ কত্তা। কী না, দু’টো পেয়ারা পেড়েচিল সে। আজ মেজ কত্তা কোতায় আর বুদন কোতায়। শেষটায় তো কতদিন বিছনায় পড়ে হেগেমুতে একাকার করত। মুখটাও গেচিল বেঁকে। যাবে না? অত পাপ। ধম্মে সয়? অমন সুন্দর ছেলেগুলোকে ধানের ক্ষেতের আল দিয়ে ছুটতে বলে পেচন থেকে – উঃ মাগো! বুদে চোখ বুজে ফেলে।
ছোট বউ তাড়াতাড়ি জল এগিয়ে দেয়। বুদে বাঁচাতে পারেনি ওদের। কী করে পারবে? বুদনের বয়েস তো তখন ওদেরই মত, কী আরও কম। আর দুঁদে দারোগা ওই মেজ কত্তা। বুদে তখন কিচুই বোঝেনি, কেন ওদের মেরে ফেলল পুলিশ। রাত থাকতে বাহ্যে গেছিল বলেই ও সব কিছু দেখতে পেয়েছিল। ভয়ে একটা শব্দও করতে পারেনি। তারপর বাড়ি ফিরে শুধু গুঙিয়ে গুঙিয়ে কেঁদেছিল। মা ভেবেছিল ভূতে ধরেচে। ওঝা এনেছিল ওর বাপ। ভাগ্যিস ওঝা ঝ্যাঁটা পেটা না করে ওকে দেখে বলেছিল, “ওরে ভূতে ধরে নাই। ওর ভয়নক ভয় লেগিচে। কী দেকেচিস বুদে?” বুদে কোনও উত্তর করেনি। তবে বুঝতে পারছিল সে, বদল আসচে। ওই ছেলেগুলোর রক্ত জমিতে পড়ে আচে। কিচু একটা হবেই।
তা আস্তে আস্তে বদল এসেছিল বৈকি। যারা তাদের পায়ের তলায় পিষে রাখত, তাদের ব্যবহার একটু একটু করে পাল্টে যাচ্ছিল। যারা ওদের ছুঁতো না, তারা একটু আধটু ওদের ছুঁয়ে ফেললে আবার চান করা বন্ধ করল। দুলেবাড়ির বুদনের একসঙ্গে জোড়া বউ এল। শ্যামাকালী আর নেত্যকালী। দু’ বোন। তখন হ’ত এরকম বিয়ে। দোষ ছিল না। দুটো বউ নিয়ে এসে ক’দিন কী মোচ্ছব। আর তারপরই দুই বউয়ে চুলোচুলি শুরু। দেখলে কে বলবে ওরা মায়ের পেটের দু’ বোন। বুদনের মা ক্ষেন্তি কেবল কপাল চাপড়ে কাঁদত খুনখুন করে। “ওরে বুদে! তোর ইকি সব্বোনাশ করে দিলুম রে! ভাবলুম দুটো বউ এনে নক্ষী আনলুম ঘরে, আর এ যে পাখি বসতে দেয় না কো। নক্ষীপেঁচা আসবে কোন মুখে?” বুদে মায়ের কান্না সহ্য করতে না পেরে দিত দুঘা দু’ বউকে। এ’যুগ হলে পারত না বুদে, জানে। মোবাইলে সব জানা যায়।
বেহুলার চর যেন আস্তাকুঁড়। বুদন একটি একটি করে প্লাস্টিকের ব্যাগ, বোতল, মদের বোতল সব জড়ো করে। ছোট বউ, দুটো নাতিনাতনিও হাত লাগায় ওর সঙ্গে। ছোট বউয়ের শিক্ষাদীক্ষায় এ বাড়ির ছেলেমেয়ে মানুষ হয়ে উটেচে। কিন্তু তবু কালীর জ্বালা কমে না। ‘শতেকখাকী’ ‘ছেলেখাকী’ বলে নিত্য গাল দেয়। অবশ্যি কালীরই বা দোষ দেয় কী করে বুদে। অমন টাটকা ছেলেটা চোকের সামনে ডুবে যেতে দেকলে…। বুদের বুকটাও কি টনটন করে না? করে, খুউব করে, কিন্তু সে সব বুকে চেপে ধরে বসে থাকে। কত কথা কাউকে বলাই হল না এ জেবনে। পড়াশোনা তো তকন দুলেপাড়ার কেউ শিখত না। বুদের তাই কতার পিটে কতা সাজিয়ে বলা হয় না। বুদের এক ছেলে মাস্টার, এক ছেলে রেলে। রেলে সেজ ছেলে কোয়াটার পেয়েচে। আসে মাঝে মাঝে। টান কমেচে। বুদের বুঝতে অসুবিধে হয় না।
বিশে মদ খেয়ে উপুড় হয়ে ঘুমোচ্ছে। একবার তার দিকে তাকিয়ে ফুলমালার গা গুলিয়ে ওঠে। লুঙ্গিটা পেছনের দিকে উঠে গেছে। নামিয়ে দিতে ইচ্ছে করল না তার। বেরিয়ে এল ঘর থেকে দুয়ারে। লাল্টু ওঘরে এডিট করছে গতকালের রান্নার ভিডিওটা। বড়বাবু আজকাল আর বাগানে যেতে চান না। কেমন যেন বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন দিনকে দিন। অথচ এমন আর কী বয়েস হয়েছে? চুয়াত্তর কি পঁচাত্তর হবে। এখনও কেমন পেটানো সোজা চেহারা। মনে হয় যেন কত কষ্ট গিলে রেখেছেন, বলতে পারছেন না। বড়দিদি না হয় ঝগড়াটি, কুচুটে। তা ব’লে কি তিনি ফুলিকেও বলতে পারেন না? ভাইবউ হলেও সম্বন্ধটা কি শুধু তাই! এখনও ওঁর চোখে ভালবাসা ফুলি খুব বুঝতে পারে। ঘরে উপুড় হয়ে যে শুয়ে আছে সে তো শুধু নামেই সোয়ামী। মেজদিদি থাকলে তবু একটা কথা বলার মানুষ পেত ফুলি। আহা, মানুষটা বড় ভাল ছিলেন।
কালী কাঁথা সেলাই করতে করতে মাঝেমাঝেই ‘মর’ ‘মর’ বলে কাকে গাল দেয় সে ও নিজেই জানে না। কাক ডাকলে তাকেও দেয় আবার কখনও নিজেকেও দেয় বোধহয়। ওকে তো কেউ বুঝলে না। কোলের ছেলেটা চোখের সামনে ভুস করে জলের ঘূর্ণিতে ডুবে গেল, শ্যামা ওকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেও চলে গেছে জলের তলায়। আর জোয়ান মরদ ওদের সোয়ামী, সে তখন ছোট বউ আর তার বাচ্চাকে বাঁচিয়ে পাড়ে রেখে আসতে গেল। একবার যদি ওদের ছেড়ে জলে ঝাঁপ দিয়ে নিজের ছেলেটার হাত ধরত, বেঁচে যেত কালীর ছেলেটা। এখন তো কালীর নিজের কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। শ্যামার তিনটে ছেলে একটা মেয়ে তাকেই মা বলে বটে, কিন্তু তারাও জানে, কালী নিজেও জানে, ওরা নিজের নয়। আর ছোট তো সবার নয়নের মণি। সব বোঝে কালী, আর তাই এই বুড়ো বয়সে এসেও আগুন জ্বলে তার বুকে।
দৌড়ে যাচ্ছে তিনটে ছেলে। এক মাথা চুল, এলোমেলো, কুয়াশার মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে ছেলে তিনটে। গাছের আড়ালে অবাক হয়ে দেখছে বুদে। হঠাৎ দেখল মেজ কত্তার বন্দুক থেকে ছিটকে বেরোল গুলি। সব দেখতে পাচ্ছে সে আবার, একেবারে স্পষ্ট। তারপর মেজ কত্তা ফিরল ওর দিকে, অবাক হয়ে বড় বড় চোখ আরও বড় হল। অন্য দুজন পুলিশ বলল, “কী হবে স্যার? একেও?” বুদে তখন থরথর করে কাঁপছে। মেজ কত্তা হাত তুলে ওদের থামালেন। বললেন, “ও কাউকে কোনদিন বলবে না। আপনারা আপনাদের কাজ করুন। জলদি। সকাল হবার আগেই।” তারপর বুদের মুখটা আস্তে আস্তে পুরো মেজ কত্তার মত হয়ে গেল। একদম এক। খাড়া নাক, বড় চোখ, দৃঢ় চিবুক, ফর্সা রঙ। ঘুম ভেঙে যায় বুদের। এই শীতেও বড় তেষ্টা পায় তার। পাশে নেত্য হাঁ করে ঘুমোচ্ছে। আহা, ঘুমোক, বড় দুখী বউটা।
বুকটাতে একটু চাপ লাগছে আজ। নদীর পাড় পরিষ্কার করতে আজ যেন দমে টান লাগছিল বুদনের। তবু ফিস্টি করে যাওয়া ছেলেপিলেদের গাল দিতে দিতে কাজটা করে ফেলা হয়েছে। কাল নদীর ধারে ধারে জলে ফেলে যাওয়া নোংরাটা পরিষ্কার করতে হবে। জল খেয়ে রোয়াকে নামে বুদে। আজকাল বারে বারে পেচ্ছাপ পায় তার। ছেলেরা মিষ্টি খেতে বারণ করে। বুদনের বয়েই গেছে শুনতে। সে চিরটাকাল খেতে ভালবাসে। ছোটবেলাটা তো শুধু পান্তা ছাড়া আর কিছু জোটেনি। শুধু যেদিন যেদিন দুকুরে মেজ কত্তা মায়ের হাতে কিছু গুঁজে দিয়ে যেত সেদিন একটু ভালোমন্দ জুটত। তাও এতগুলো পেট ছিল যে মা কার পাতে কী দেবে ঠিক করে উঠতে পারত না। মেজ কত্তা, মুখটা মনে করতেই বুদনের মাথা টাল খেল একটু। পড়েই যেত, নিঃশব্দে কখন ছোট বউ এসে দুহাত বেড় দিয়ে ধরে ফেলেছে বুঝতে পারেনি বুদে। শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগল ফুলি আমার কে ছিল গত জন্মে, এ জন্মেই বা কি সম্বন্ধ তার সঙ্গে? বুদে লেখাপড়া শেখেনি, তাই বেশি ভাবলে তার ঘুম এসে যায়।
নদীতে আসার আগে নেত্য আজ বড় গাল দিচ্ছিল তাকে। ভালর জন্যেই বলছিল, কিন্তু বলার এমন ধারা যে বুদে ছোট বউয়ের দেওয়া চা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নদীতে চলে এসেছে। বুকটাতে আজও ব্যথা রয়েছে। বুড়ো বয়সে বোধহয় এসব খাওয়াদাওয়া আর সহ্য হচ্ছে না বুদনের। লেল্টো বলে ভলগ্ করার সময় খাওয়ার অভিনয় করতে, বেশি না খেতে। আরে হারামজাদা! সামনে খাবার নিয়ে কখনো অভিনয় করা যায়! তুই, তোরা কী করে জানবি ক্ষিদে কী জিনিস? এত ক্ষিদে ছিল মনে হত আকাশ পাতাল সব খেয়ে ফেলি। কিন্তু তখন খাবার ছিল না।
জল পরিষ্কার করতে করতে হঠাৎ সামনে ডুব দিয়ে ভেসে উঠল দিবু। দিবাকর। গোটা গায়ে জল ঝরছে। গায়ের রং অনেকদিন জলে থাকলে যেমন সাদাটে মেরে যায় তেমনি। বুকের ব্যথাটা চাগাড় দিল। বুকটা খামচে ধরে বুদে বলে উঠল, “তুই!”
“কেন? আসতে নেই? পোস্কার শুদু তুমিই করবে? আজ আমিও পোস্কার করবো।”
“কী পোস্কার করবি তুই?”
“কেন? তোমাকে। তুমিই তো জঞ্জাল।”
বুকটা আবারও খামচে ওঠে বুদনের।
“বাপরে, বাপ আমার, আমি তোকেও বাঁচাতাম বাপ। পারিনি, কারণ লেল্টো তখন দুধের শিশু। ওকে আগে রেখে তোকে আমি বাঁচাতাম বাপ। তুই যে আমার আপন রে বাপ। “
“আমি আপন?” হা হা করে হাসে দিবা। “আর লালু? লেল্টো তোমার কে বাবা? ও কেন তোমায় বড়বাবু বলে ডাকে? ছোটমা কেন ওকে জেঠা ডাকতে শেখালনা বাবা? তুমি কেন ওকে এত ভালবাস? কেন ওকে একবারে তোমার মতো দেখতে?”
বুদনের যন্ত্রণা তীব্র হয়ে ওঠে। অনেক কথা বুকে চেপে রাখতে রাখতে বুকটা বোধহয় ফোঁপরা হয়ে গেছে। যাক গে, সেও তো সত্যিই জঞ্জাল একটা। দু’-দু’টো বউ, কাউকে সুখী সে করতে পারেনি। তার বাপ ধীরু দুলে তাকে দেকলেই থুথু ফেলত, কেন সেটা ছোট থাকতে সে বোঝেনি। দুলেপাড়ার অনেকেই বড়বাবুদের মত দেখতে হত তখন। কেউ কোনও প্রশ্ন করত না। তবে আজ কেন দিবা প্রশ্ন করে? ও কি তবে বেঁচে আছে! বয়েসটা ওর এখনও বাড়েনি কেন! জলে থাকলে বুঝি বয়েস বাড়ে না? মুখ গুঁজে জলে পড়ে যায় বুদন। মুখে নাকে জল ঢুকে যাচ্ছে। অথচ সে গঙ্গা এপাড় ওপাড় করতে পারত এক সময়। আজ নদীর ঘাটে হাবুডুবু খাচ্ছে বুদন। হাতটা তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে একবার বাড়াল দিবার দিকে, তার ছেলের দিকে। দিবা হাসছে। দিবা হাসতে হাসতে সরে যাচ্ছে দূরে, আরও দূরে।
লেখক পরিচিতি : মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী
মৈত্রেয়ী ব্যানার্জীর জন্ম পূর্ব বর্ধমান জেলার কালনার নিকটবর্তী বানীনাথপুর গ্রামে। শৈশবেই হাওড়া জেলার বালীতে চলে আসেন। কলকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর। লেখিকা একজন বাচিক শিল্পী। দুটি একক গল্প সংকলন ও বহু পত্র পত্রিকায় (প্রিন্ট মিডিয়া) গল্প, প্রবন্ধ ও কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। একটি আন্তর্জাতিক গল্প সংকলনেও লেখা প্রকাশিত হয়েছে।