জন্ম হোক যথাতথা কর্ম হোক ভাল

লেখক : ইন্দ্রাণী তুলি

বেলুন, কাগজের শিকল, আর ফুল দিয়ে ঘর সাজিয়ে বাবার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে ছেলেমেয়েগুলো। কেক কেনার টাকা যোগাড় হয়নি, কড়াইতে বালি গরম ক’রে, কেক-মিশ্রণের পাত্র রেখে সুন্দর কেক বানিয়েছে অনু।
“মানুষটা রিটায়ার করেছে, এমনিতেই রোজগার কমে যাবে। কিন্তু হাঁ-মুখের সংখ্যা তো কমবে না। আর তোরা জন্মদিন পালনে বাজে খরচা করছিস?”
পরিচিত স্বভাবে খ্যাচখ্যাচ করে উঠলেন মা, কবিতা।
শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে, মা ষষ্ঠীর আশীর্বাদে তাঁদের সন্তান সন্ততির সংখ্যা ডজনের দোরগোড়ায়।
কিন্তু বাবার অবসর প্রাপ্তি আর জন্মদিন মিলে গেছে, এ’টুকু সমাদর তো তাঁর পাওয়াই উচিত।

জন্মদিনেই বাবার প্রাণহীন শরীরটাকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল অজয় আর অতুল, ম্যাসিভ হার্ট-অ্যাটাক।
মা’র গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অনু ভাবল – এই আছে, এই নেই। জন্ম আর মৃত্যু একই সুতোর দুটো মাথা, কখন যে ছিঁড়ে যাবে…

জীবনের প্রতি বিরক্ত কবিতা। সহোদরা নবনীতা যে তাঁর মেয়ে অনসূয়াকে দত্তক নিয়েছিল, যাকে তিনি স্ব-ইচ্ছায় নিঃসন্তান বোনের হাতে তুলে দিয়ে, বলেছিলেন, “আরও ক’টাকে নিয়ে যা না”, তা নিয়েও কবিতার বিরক্তির অন্ত নেই। আর দেখা হলেই এই রাগের ঝাঁঝ সহ্য করতে হয় অনসূয়াকে, কখনও কখনও নবনীতাকেও। অনসূয়া বুঝতে পারত সবকিছুর মূলেই রয়েছে অর্থ।

তিন বছর বয়সেই মায়ের আঁচলছাড়া হয়ে মিসি আর মাসাইয়ের অপার ভালবাসা, অবাধ স্বাধীনতা পেয়ে ছোট থেকেই মুখরা হয়ে উঠেছিল অনসূয়া। কলহপ্রিয়া মা’র প্রভাব তো ছিলই। ছোট থেকেই বাবা-মা আর ভাই-বোনেদের ঝগড়া শুনেই বেড়ে উঠেছিল অনু।
মা অভিযোগ আর অনুযোগের পাহাড় নিয়ে হাজির হলেই পাঁচ কথা শুনিয়ে দিত সে। শান্ত স্বভাবের, আভিজাত্যে মোড়া মিসি সামনে থাকলে বাধা দিতেন, কাছে টেনে বলতেন, “তোর মা তো, মুখে মুখে কথা বলতে হয় না মিসি।”
“মা… তাহলে আমাকে তোমার কাছে পাঠিয়েছে কেন? যখনই এখানে আসি, বন্ধুরা আমাকে খ্যাপায়।
-তোর মা-বাবা থাকতে তুই মাসির কাছে থাকিস কেন, ওরা খুব গরীব, তাই তোকে বিক্রি করে দিয়েছে?”
নবনীতা বাকরুদ্ধ হয়ে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে থাকলেও তার মা তাকে ছেড়ে দেননি।
“আর তুই! মনে নেই তোর, কেমন ঠোঁট মোছা কাগের মতো মাসির কোলে চড়ে চলে গিয়েছিলি। নেমকহারাম, একবার পেছনে ফিরে দেখিসনি পর্যন্ত। ওই ছোট্ট শিশু…”
“ভালবাসার ভাষা পশুতেও বোঝে রে দিদি, অনু তো মানুষের বাচ্চা।”

মাসাইয়ের ভাই প্রবাসী, মাসাইয়ের মা সেই ছেলের কাছেই থাকেন। ছেলে-বউ দু’জনেই কাজে বেরিয়ে যায়, বাচ্চার দেখাশোনার ভার একা ন্যানীর ওপরে ছাড়া যায় না।
দুপুরে অফিস থেকে ফিরেই মাসাই ডাকলেন, “অনু-মা কোথায়? আজ তোমাকে একটা খুশির খবর দেব…”
অনু, নিজের ঘর থেকে বেরতেই তিনি বললেন, “দিদা আসছেন তো!”
ভীষণ খুশি হলো অনু।
মাসাইয়ের কাছে শুনেছে তাঁদের দু’ভাইকে অনেক কষ্ট করে বড় করেছেন তাঁদের বাবা-মা। নিজের চেষ্টাতে অনেক ধনবান হয়েছিলেন মাসাইয়ের বাবা।

অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকল অনু। কোন ঘরে থাকবেন দিদা, কী খেতে ভালবাসেন তিনি, ইত্যাদি প্রশ্নে নিত্য মাসি আর মাসাইকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল সে।
জেদ করে, মাসাইয়ের সঙ্গে এয়ারপোর্টে গেল অনু। নবনীতা রয়ে গেলেন বাড়িতে শাশুড়ি মায়ের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনাতে। তাঁর পুজোর জায়গা করা, তাঁর নিরামিষ হেঁশেলের বন্দোবস্ত…
এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি ফিরে দিদার সঙ্গ আর ছাড়েই না অনু, তাকে দেখে মনে হয় প্রতিমা দেবীর সঙ্গে তার জন্মজন্মান্তরের সম্পর্ক। প্রতিমা দেবীও প্রথম দর্শনেই মেয়েটাকে ভালবেসে ফেলেছেন।
“আমাকে পুজো করতে শেখাবে দিদা? তুমি শুধু নিরামিষ খাও…কেন? ডিমও ভাল লাগে না? আমার তো ডিম আর মাংস খেতে খুব ভাল লাগে… মাছ না।”
“তুই একদম তোর দিদির উল্টো…”
“কোন দিদি…অনুপমা না অনিন্দিতা? তুমি কী করে চিনলে আমার দিদিদের? তুমি তো কত বচ্ছর বাদে দেশে ফিরলে। কেন দিদা, ইন্ডিয়া তোমার ভাল লাগে না?”
“একটু শ্বাস নে দিদি, আর আমাকেও নিতে দে। বাপরে বাপ! কথার ঝুড়ি একখানি। এত প্রশ্ন একসঙ্গে করলে উত্তর দেব কী করে?”
অনু চোখ ঘোরাল।
“না তোর দিদি, কবিতার মেয়েদের আমি চিনি না, আমি তোর নিজের দিদির কথা বলছি। আমার বৌমা নবনীতার মেয়ে, মনোপ্রীতার কথা। এখন তো তুই আর কবিতার মেয়ে নো’স। নীতা আর বুদ্ধর মেয়ে, তাই তো?”
“আমার দিদি… মনোপ্রীতা! মিসির মেয়ে? আমি তো তার কথা জানিই না। কোথায় থাকে আমার দিদি, তোমার সঙ্গে বিদেশে?”
“না রে, সে তো আর আমাদের কাছে নেই। ঈশ্বরের প্রিয় হয়ে, আকাশের তারা হয়ে গেছে। আমার সঙ্গে ছাদে চল তো।”
“চল।”
“আশ্বিন মাস গেল, শরৎকাল শেষ হয়ে হেমন্তের দিন শুরু হয় কার্ত্তিক মাসে। আকাশ প্রদীপ জ্বালাবার সময়।”
“এইসব কী নাম বলছ, আমি বুঝতেই পারছি না।”
“সব শিখে যাবি। মহালয়ার তর্পণের জল পেয়ে মর্ত্যে আসেন স্বর্গবাসী আত্মীয়স্বজনেরা। কার্ত্তিক মাস শুরু হলেই ফিরে যেতে থাকেন। তাই আকাশের পথ আলোয় আলোয় ভরে দিতে জ্বলে ওঠে অসংখ্য আকাশপ্রদীপ, তাঁদের পথ দেখিয়ে নির্বিঘ্নে স্বর্গলোকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে।”
উদাস হলেন প্রতিমা দেবী।
“কার্ত্তিক সংক্রান্তির পরের দিন, বাঁশের মাথার সেই লন্ঠন নামিয়ে এনে, পুরোহিতকে দান করতে হয়।”
অনু কাঁদছিল।
“কোন তারাটায় আছে আমার দিদি?”
“আমি চিনিয়ে দেব।”
“কেমন ছিল দিদি, মিসির মতো না মাসাইয়ের মতো? আমাকে ছবি দেখাবে?”
“না রে, বাবা-মা কারোও মতই দেখতে ছিল না তাকে। ওরা দুজনেই তো দস্তুর মতো ফর্সা। সে ছিল উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা, পাতলা ছিপছিপে। মুখখানি প্রতিমার মতো, তার মুখ থেকে নজর সরানো যেত না, বার বার দেখতে ইচ্ছে করত। আমার গায়ের রঙ পেয়েছিল সে।”
“তার মানে তাকে তোমার মতই দেখতে ছিল। তোমার মুখটাও তো দুগ্গা ঠাকুরের মতো। দিদা, তাই কি তোমার নাম প্রতিমা?”
“আজ থেকে তোর নাম দিলাম ফুলঝুরি! কী কথাটাই না বলতে পারিস!”
“দিদি বুঝি খুব শান্ত ছিল?”
“শিশু বয়েসেই তো এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে ফেলেছিল সে। যে বয়েসে বাচ্চারা হেসে-খেলে নেচে-গেয়ে ঝগড়া ক’রে বাড়ি মাথায় তোলে, সে জানলা ধরে গাছ-পালা, আকাশ-চাঁদ-তারা দেখত। সেই শিশু-মুখে অদ্ভুত এক গাম্ভীর্য দেখে সকলে অবাক হয়ে যেত। পাড়ার বাচ্চারা ডাকতে আসত তাকে কিন্তু খেলাধুলোতে তার মন লাগত না। আমার সঙ্গেই ছিল তার যত গল্প।”
“আমারও তো ভাল লাগে তোমার সঙ্গে গল্প করতে।”
“হয়েছে, আর গপ্প করতে হবে না। পরীক্ষা না? পড়তে যাও।”
দিদার গালে চুমু দিয়ে পড়তে গেল অনসূয়া।

অনেক বড় হয়ে গেছে অনসূয়া, কিন্তু এখনও কথায় কথায় তার গালে আদর করে নাক ঘষে দেন মিসি। কপালে চুমু দিয়ে রাতে ঘুমোতে পাঠান আর সকালে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। মিসিকে খুব ভালবাসলেও, এ’বাড়ির সাহেবি কায়দা কানুন আর ভাল লাগে না অনুর, প্রাণ হাঁফিয়ে ওঠে।
মিসি বললেন, “তোর আঠেরো বছরের জন্মদিনে একটা সুন্দর গাউন তৈরি করিয়ে দেব।”
আপত্তি জানিয়ে অনু বলেছিল, “না মিসি, আমি শাড়ি পরব।”
কিন্তু তা’ও তৈরি হয়ে এসেছিল কাঁধ-খোলা এক মস্ত দামী গাউন। অনুর একদমই পছন্দ হয়নি ওই শরীর দেখানো পোশাক।

জন্মদিনের পার্টি শুরু হওয়ার আগে, একটা আকাশী-নীল, রূপোলী পাড় বসানো সুন্দর শাড়িতে নিজেকে সাজিয়েছিল অনসূয়া। কানে ঝুলিয়েছিল মিসির দেওয়া বড় বড় ঝুমকো। হাত ভর্তি নীল-রূপোলী কাচের চুড়ি, কপালে সিঁদুরের ফোঁটা।
নিত্য-দাসী তার বাক্স থেকে আলতা বার করে, পরিয়ে দিয়েছিল অনুর পায়ে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থেকে নিত্য-মাসি বলেছিল, “এই না হলে সাজ?”
নীল শাড়ির রূপোলী পাড় পিঠ দিয়ে ঘুরিয়ে এনে ডান কাঁধে ফেলে, নিজেকে আয়নাতে দেখে মোহিত হয়ে গেল অনসূয়া। এতদিন ধরে পরা, ওই পা বার করা, হাত খোলা বিদেশি জামাগুলোর থেকে কত বেশি সুন্দর এই ভারতীয় সাজ। চুলটা ঠিক কীভাবে বাঁধলে ভাল দেখাবে তাকে, বুঝে উঠতে পারল না সে।
ঠিক এই সময়েই ঘরে ঢুকলেন মিসি। অবাক বিস্ময়ে অনুর মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখতে থাকলেন তিনি। তাঁর বোধহয় বিশ্বাসই হচ্ছিল না, মিসি তাঁর কথা না শুনে নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করবে।
মিসির কাছে গিয়ে তাঁর হাতদুটো ধরে অনু বলল, “খারাপ দেখাচ্ছে মিসি… বদলে ফেলব?”
তাঁর চোখে দুঃখের ঝলক দেখল অনু, কিন্তু জোর করে হেসে তিনি বললেন, “না থাক, বেশ দেখাচ্ছে।”
তিনি সাজ বদলে ফেলতে বললে, অনু বদলে ফেলত। কিন্তু তার মন ভরে উঠত অভিমানে, দুঃখ পেত সেও, কিন্তু মিসি তো খুশি হতেন। দু’জনের একসঙ্গে খুশি হওয়ার কায়দা তো অনুর জানা ছিল না।
মিসির গলা জড়িয়ে ধরে সে বলল, “চুলটাকে কী করব বুঝতে পারছি না…”
অনুকে আদর করে মিসি বললেন, “এস, আমি ঠিক করে দিচ্ছি।”
“দেখ, ছোটবেলার মতো আবার কাঁচি নিয়ে ঠিক করতে যেও না যেন।”
বলে ফেলেই খুব খারাপ লাগল অনুর। মিসিকে দুঃখের পরে দুঃখ দিয়ে চলেছে সে। মিসি হাসলেন, কিন্তু সে হাসিতে ছিল না আনন্দ, না ছিল উজ্জ্বলতা। মিসি বললেন, “বস, আমি আসছি।”
ফিতে-কাঁটা এনে তিনি অনুর চুলে বড়, এক সুন্দর খোঁপা বেঁধে দিলেন। আবারও আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল অনু। শাড়ি ছেড়ে কেউ ফ্রক-গাউন পরে? নিজের এই নতুন সাজ তার খুব ভাল লাগল।

আঠেরো বছরের জন্মদিনে অনসূয়া প্রথম বার তার মিসিকে প্রণাম করল। অবাক মিসি ছিটকে সরে গেলেন। এই বাড়িতে তো প্রণামের চল নেই।
তারপরে মাথায় হাত রেখে হয়তো আশীর্বাদই করলেন। জলে তাঁর চোখ ভরে উঠেছিল, মুখ ঘুরিয়ে চোখের জল গোপন ক’রে তিনি বললেন, “মাসাইয়ের কাছে যাও।”

মাসাইয়ের খোঁজে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামল অনু। তিনি তাঁর লাইব্রেরীতে ছিলেন, পড়াশোনার কাজে ব্যস্ত। অনু ঢুকে, একটু ইতস্তত করে মাসাইয়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। বই থেকে মুখ তুলে মাসাই তাকালেন অনুর দিকে। তাঁর দৃষ্টিতে অনুকে চিনতে পারার কোনও লক্ষণ ছিল না, ছিল বিস্ময়। উঠে দাঁড়িয়ে, মাসাই বললেন, “ওহ তুমি! কত বড় লাগছে তোমাকে, আমি তো চিনতেই পারিনি। আজ তোমাকে একদম তোমার মা, কবিতার মতো দেখাচ্ছে।”
লজ্জায় লাল হয়ে গেল অনু।
মাসাই হঠাৎ করে দরজার দিকে তাকাতে, তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে অনু দেখল দরজায় মিসি দাঁড়িয়ে। কী ভীষণ বিষণ্ণ তাঁর চোখদু’টো। ঘরে ঢুকে মিসি বললেন, “দেখলে তো বুদ্ধ, আমার কথা কেমন ফলে গেল। আমি বলেছিলাম রক্তের টানেরই জয় হবে। তুমি অনেক তর্ক করেছিলে আমার সঙ্গে, বলেছিলে নেচার আর নার্চার! ইতিহাস বলছে, সবসময়েই বংশগতি হেরে গেছে পরিবেশের সঙ্গে মোকাবিলায়। ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে আমার, ডিবেটে এই টপিকে আমি সাপোর্টার ছিলাম নার্চারের, কিন্তু হেরে গিয়েছিলাম আমার প্রতিপক্ষের জোরালো বক্তব্যের সামনে। আজও হেরে গেলাম আরও একবার। জন্মসূত্র সব খান-খান করে ভেঙে দিল। ওর মা সারাজীবন আমাকে হিংসে করে এসেছে, আমার পড়াশোনা-খেলাধুলো, আমার ভাগ্য নিয়ে। আজ তার রক্তের সম্পর্ক দিয়ে তার শোধ তুলে নিল। এই জন্যেই হয়তো সে তার মেয়েকে নিঃশর্তে আমার হাতে সঁপে দিয়েছিল। ও জানত, ওর মেয়েকে আমি কখনই আমার মতো ক’রে গড়ে তুলতে পারব না। দিদির অভিশাপ ফলে গেল।
কতগুলো সস্তা কাচের চুড়ি পরেছে, নিত্য-দাসীর কাছ থেকে আলতা নিয়েছে, ঠিক ওর মা’র সাজের ধারা। আমার দেওয়া উপহারের দামী গাউনের দিকে তাকিয়েও দেখল না। সেই শিশু বয়েস থেকে আমার রুচি পছন্দ মতো বড় হয়ে উঠে, এক মুহূর্তে সব ছুঁড়ে ফেলে দিল। দূরে থেকেও ওর নিজের মা, হ্যাঁ ওর জন্মদাত্রী ওকে ওর মতো করেই গড়তে সফল হলো হলো। তাই-ই, আমি ওর চুল বেঁধে দিলাম দিদির মতো করেই।
আমি জানতাম, এত যত্ন, এত ভালবাসা, সব একদিন বিফলে যাবে। যে আমার নয়, সে কোনদিনও আমার হবে না। তুমিই বরাবর আমার মনে আশা জাগিয়েছ, বলেছ জন্মদাত্রীর থেকে পালনকর্ত্রীর দাবী অনেক বেশি। শিশু তার পালিকার শিক্ষা মতই বেড়ে ওঠে। ভুল ভুল ভুল।”

মিসিকে এরকম উতলা হতে, এত শক্ত শক্ত কথা বলতে আগে কখনও দেখেনি অনু, শোনেওনি। ভয়ে, অনুতাপে, লজ্জায় জড়সড় হয়ে ঘরের এককোণে দাঁড়িয়েছিল সে।
মাসাই অনুর কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন, তাকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে বললেন, “কী হচ্ছে কী নীতা? তুমি কবে থেকে এত ছেলেমানুষ হয়ে গেলে? অনুমা-র আজ জন্মদিন, ওকে আশীর্বাদ কর। আজ ওর মনে কষ্ট দেবে তুমি? তুমি কী করে ভুলে গেলে, ওর শরীরে তোমারও রক্ত বইছে, আর তাই-ই আজ সে পড়াশোনা-খেলাধুলোয় সবার সেরা, ঠিক তোমারই মতো। ওর আজ শাড়ি পরতে ইচ্ছে হয়েছে, পরেছে। তাতে তুমি এত উত্তেজিত হচ্ছ কেন? ওকে কিন্তু সত্যিই খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।”
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মাসাই বললেন, “গেস্ট আসার সময় হয়ে গেল তো, সব রেডি আছে?”

ধীরে ধীরে বন্ধুরা সবাই এসে পড়ল।
শ্রীশংকর, পুনম, চেরিয়েন, সুনীত, রাজিয়া, ভেরোনিকা। সকলেই বলল অনুকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। চেরিয়েন বলল, “ইউ আর লুকিং সো ভেরি ওরিয়েন্টাল!”
রাজিয়া বলল, “অনসূইয়া, তেরা বাল বনানে কা তরীকা তো গজব হ্যায়… ইটস মীথিক্যাল।”
শ্রীশংকর বলল, “এই ধরনের সাজের কথা তোর মাথায় এল কীভাবে?”
সকলেই তাকে নাচবার জন্যে অনুরোধ করল কিন্তু অনু তো শিখেছে বিদেশি নাচ, এই পোশাকের সঙ্গে তো সেই নাচ মানাবে না।
প্রশংসার বন্যায় ভেসে গেল অনসূয়া।
চলল খাওয়া দাওয়া, হাসি-হট্টগোল। মাঝেমাঝেই ছেলের দলের স্তুতিতে তার কান লাল হয়ে উঠছিল, মনে হচ্ছিল সকলেই তার সান্নিধ্য কামনা করছে।
একটু দেরি করে এসেছিল জুলী আর জন, তারা ভাইবোন। প্রায় সকলের ফিরে যাওয়ার সময়ে এল ফক্কড় রজার্স। সকলেই একবাক্যে জানিয়ে গেল যে সন্ধেটা দারুণ এনজয় করেছে তারা।

ভাললাগা-আনন্দ-উত্তেজনায় ভরা মনে, বেশ পরিবর্তন করে শুতে গেল অনু। এই আঠেরো বছরের জীবনে এরকম কখনও হয়নি যে মিসি তাকে গুড-নাইট জানাতে আসেননি। খানিক্ষণ অপেক্ষা করল অনু, মিসি কিন্তু এলেন না। মনটা খারাপ হয়ে গেল, তাঁকে বড় বেশি দুঃখ দিয়ে ফেলেছে তাঁর প্রাণাধিক অনু।
ধীরে ধীরে মিসির দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল অনু, তার মনে হচ্ছিল মিসির গলা জড়িয়ে ধরে তাঁকে ‘সরি’ বলে, কিন্তু তার মন বিদ্রোহ করল, বলল, “সরি কেন, কী দোষ করেছ তুমি?”
মিসিই তো তার জন্মদিনের রাতে তাকে আদর করতে ভুলে গেলেন।

বিছানায় আধশোয়া হয়ে বই পড়ছিলেন মিসি।
অনু বলল, “মিসি, আমি শুতে যাচ্ছি।”
দরজার দিকে মুখ ফেরালেন মিসি, বিছানা ছেড়ে উঠে এসে অনুর কপালে চুমু খেলেন তিনি, কেমন যেন স্নেহহীন সেই চুম্বন। অনুর নিজেকে খুব একা মনে হ’ল, মিসি যেন তার থেকে অনেক দূরে চলে গেছেন।
সেই রাতের পর থেকে রোজই অনু গিয়ে দাঁড়ায় মিসির ঘরের দরজায়, মিসি তাকে শুভরাত্রি জানিয়ে কপালে চুমু দেন।
আর কখনও অনুর গালে তাঁর নাক ঘষে আদর করেননি মিসি।
মা তো তার জীবনে কখনও ছিলেনই না, মিসিও দূরে চলে গেলেন।
এবারে একা একা নিজের মতো করেই বড় হয়ে উঠবে অনসূয়া। দেখা যাক, তার জীবন-পথ তাকে কোথায় নিয়ে যায়।


লেখক পরিচিতি : ইন্দ্রাণী তুলি
ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য ওরফে ইন্দ্রাণী তুলি বাংলা এবং ইংরিজি দুই ভাষাতেই লেখালিখি করেন। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দুই, ই-বুক এবং বিভিন্ন প্রকাশনার সংকলনে প্রকাশিত এবং সমাদৃত হয়েছে তাঁর লেখা। বহু পুরস্কারে ভূষিত ইন্দ্রাণী তুলি

One comment

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।