লেখক : আলো রাণী ভট্টাচার্য্য ঘোষ
কিশোর ও তার সাত বন্ধু মিলে কলেজের ছুটি কাটাতে অযোধ্যা পাহাড়ের পাদদেশে এক রিসর্টে গিয়ে যখন পৌঁছয়, তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে, চারদিক শুনশান। দূর থেকে মাদল বাজার আওয়াজ ভেসে আসছে। সারাদিনের পথযাত্রার ক্লান্তি। ওরা তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু কিশোরের ঘুম আসে না, এলোমেলো নানা চিন্তা করে। একটা গন্ধ সে মাঝেমাঝেই পাচ্ছে, কিসের গন্ধ বুঝতে পারে না। কিন্তু গন্ধটা তার খুব চেনা লাগে। কিছুক্ষণ পর সেও ঘুমিয়ে পড়ে।
ছোটবেলা থেকেই খুব ভোরে উঠে বাইরে হাঁটতে বেরনো তার অভ্যাস। ভোরে ঘুম ভেঙে দেখে তার সঙ্গীরা তখনও ঘুমে অচেতন। সে ঠিক করে বাইরে একটু দেখে আসবে আশপাশটা ওরা ওঠার আগেই।
দারোয়ানের কাছে জানতে পারে কিছু দূরেই একটি নদী আছে এবং তার চারপাশের পরিবেশও খুব সুন্দর। কিশোর হাঁটতে শুরু করে। বড় রাস্তা পেরিয়ে পলাশ বনের মধ্যে দিয়ে মেঠোপথ ধরে সে সামনে এগোতে থাকে। কিছুটা পরই তার মনে হতে থাকে এ পথটা যেন তার খুব চেনা। নদীর পাড়ে পৌঁছে যায় কিশোর। প্রকৃতির রূপ দেখে সে মুগ্ধ হয়। নদীর পরপারে এক উত্তুঙ্গ পাহাড়। নদীর পাড়ে কিশোর বসে পড়ে। প্রভাত রবির কিরণ ছড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ের উপর, নদীর বুকে, শ্যামল বনানীর উপর। বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও কিশোর প্রকৃতিপ্রেমিক। পাথরের ধাপ নেমে গেছে নদীর তীরে। হঠাৎ একটা ডাকে সচকিত হয় কিশোর।
“ই বাবু, মোর কাঠের বোঝাটা টুকুন তুলে দিবি?”
কিশোর দেখে পাথরের ধাপ বেয়ে উঠে আসার সময় কাঠের বোঝাটা পড়ে যাওয়ায় একটি মেয়ে তাকে সাহায্যের জন্য ডাকছে। কিশোর তাড়াতাড়ি নেমে গিয়ে বোঝাটা নিজেই তুলে আনে, ও মেয়েটিকে ওপরে উঠে একটু বসতে বলে, কারণ মেয়েটি হয়তো পরিশ্রমের ফলে খুব হাঁপাচ্ছিল।
মেয়েটি বসার পর কিশোর তাকে লক্ষ্য করে, একটি কুড়ি-একুশ বছরের আদিবাসী মেয়ে। কিন্তু সুন্দর মুখশ্রী, কাজল কালো চোখ, দুটি পেলব বাহু, কপালে কালো টিপ, গলায় কালো একটি কার। সবমিলিয়ে কালো হলেও মেয়েটি সুন্দরী। কিশোর আবার অস্বস্তি বোধ করে, কারণ কালকের সেই গন্ধটা আবার সে পাচ্ছে। ওর একটা মুদ্রাদোষ ছিল, কোন অস্বস্তি হলেই ও ঘাড়ে হাত বোলাতো। সে সময় কাটানোর জন্য মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করতে থাকে তার নাম, ঠিকানা, বাড়িতে কে কে আছে, ইত্যাদি। মেয়েটি উত্তরে বলে এত প্রশ্নের জবাব একবারে তো দিতে পারবে না সে। কিশোর আচমকা তাকে জিজ্ঞেস করে গতকাল রাতে সে কি তাদের রিসোর্টের কাছে গিয়ে ছিল।
মেয়েটি বলে, “হঁ। গেছিলাম তো।”
“কেন?”
“আমি সব জায়গায় যেতে পারি।”
“মানে?”
“তোর সব উত্তর পাবি, মোর কাহিনীটো আগে শুন। তার আগে আমাকে বল তো, তোর ঘাড়ে কিসের দাগ?”
কিশোর বলে, “ওটা আমার জন্ম দাগ। তোমার গল্পটা বল।”
মেয়েটি বলে চলে, “কুসুমডীহ গেরামে আমার জন্ম। বাপ ছিল ক্ষেতমজুর, মা বাঙালি বাবুর বাড়ি কাজ করত। আর এক ক্ষেতমজুরের ছেলে ছিল ভীমা। গেরামের মুখিয়া বা মোড়লের ছেলে ছিল বুধুয়া। আমরা সবাই ছোট থেকেই বড় হচ্ছিলাম খেলাধুলা, কাজের মধ্যে দিয়ে। দেখতে দেখতে বড় হলাম। ভীমা, বুধুয়া জোয়ান হয়ে উঠল। ভীমাও ক্ষেতে কাজ করত, সন্ঝাবেলা নদীর পাড়ে বসে মাদল বাজাত, হাড়িয়া খেত, নাচত, বাঁশি বাজাতে উস্তাদ ছিল। গাঁয়ের মেয়েরা উয়ার লেগে পাগল ছিল। কিন্তু এর মধ্যে ভীমা আর আমার মন দেওয়া নেওয়া হয়ে গেছিল। আমরা নদীর পাড়ে বসে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতাম। পলাশ ফুল দিয়ে ভীমা আমারে সাজাইত।
কিন্তু একদিন সন্ঝাবেলা মুখিয়া আর বুধুয়া আমার বাপের কাছে এল, আর বলল বুধুয়ার সাথে আমার বিয়া দিতে হবে, তাও দু’দিনের মধ্যে। বদলে মুখিয়া বাপের ঘরটা পাকা করে দিবে, না হলে আমার আর ভীমার লাশ ফেলে দিবে। ওরা চলে গেল। বাপ আর মা আমারে ঘরে আটক করে রাখল।
পরদিন ছিল হাট বার। বাপ হাটে গেল, মা বাবুর বাড়ি কাজে। আমি দরজার আগড় ভেঙে নদীর পাড়ে ভীমার কাছে গিয়ে সব কথা তারে বললাম। দু’জনে কাঁদলাম। তারপর একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। নদী পার হয়ে পাহাড়ের তলে গেলাম। তারপর দু’জনে পাহাড়ের উপর উঠে পড়লাম অনেক কষ্টে। দু’জনে দু’জনের হাত ধরে দিলাম ঝাঁপ – মরণ ঝাঁপ। সব শেষ।
পরদিন ভোরে ভীমার বাপ, আমার বাপ, গাঁয়ের লোক সবাই মিলে খুঁজতে খুঁজতে ওখানে আসে। ভীমার দেহটা পায়, কিন্তু আমারটা নয়। ওরা ভীমা কে নিয়ে গিয়ে নিয়ম মত অন্তিম সংস্কার করে। আমারে সেই রাতেই জঙ্গলের মধ্যে এক বাঘিনী টেনে নিয়ে যায়। কতগুলা হাড়গোড় ছাড়া দেহের আর কোন অবশিষ্ট ছিল না। তার পর থেকে আমি সব জায়গায় ঘুরে বেড়াই, সব দেখতে পাই, কিন্তু আমারে কেউ দেখতে পায় না। এ বড় কষ্ট রে!”
কিশোর এতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মত সব শুনছিল, তার চোখের ওপর থেকে যেন পর্দার পর পর্দা সরে যাচ্ছিল। হঠাৎ সে বুক ভাঙা আর্তনাদ করে ওঠে, “চিন্তা, চিন্তা রে!”
চিন্তা বলে, “চিনতে পারলি তাহলে ভীমা আমারে! আমার আর সময় নাই রে। এই দেহধারণ করতে বড় কষ্ট হচ্ছে। তোর কাছে আমার একটাই অনুরোধ আছে। তুই নিয়ম মত আমার অন্তিম সংস্কারটা করিস। এভাবে থাকতে বড় কষ্ট রে। এ জনমে হ’ল না, পরজন্মে যেন তোরে পাইরে!”
কিশোর দুহাত বাড়িয়ে দেয়, চিন্তাকে ধরার জন্য। কিন্তু কেউ নেই সেখানে। নদীর ওপর দিয়ে একটা দমকা বাতাস ভেসে আসে। কিশোর একভাবে একই কথার পুনরাবৃত্তি করে চলে, “তাই হবে রে চিন্তা, তাই হবে।”
লেখক পরিচিতি : আলো রাণী ভট্টাচার্য্য ঘোষ
রিষড়া উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা। হুগলি জেলার কোন্নগরের বাসিন্দা। কবি, বই পড়া, পড়ানো ওঁর নেশা - এতেই তিনি আনন্দ পান৷ মাঝে মাঝে নিজের মতো করে কিছু কিছু লেখেন।