মনস্টার

লেখক : সুস্মিতা সরকার

“হুমম্, ইটস্ এ ডেভিলস কার্ড উইথ হার্ট হোল্ডিং এ ম্যান। ইটস্ কলিঙ্ ফর এ ম্যান চার্মিঙ বাট উইল বী লাইক এ ডেভিলস ক্যারেক্টার। দিস রিলেশনশিপ উইল গীভ ইউ বোথ জয়েস্ এন্ড সরোস্। দ্য ম্যান হ্যাজ্ হিজ্ ব্ল্যাক সেডস।”, ট্যারো রিডার তারা জশওয়াল আমার পারসোনাল রিডিং পড়ে এই জানালেন। আমি বেশ একটা কনফিউশন নিয়ে বাড়ি এলাম আজ। আমি নন্দিতা সেন – বাবা মহীতোশ সেন ও মা নলীনি সেন – এদের ছত্রছায়াতেই বেড়ে উঠেছি। দাদু ঠাকুমা সকলকেই ছোট থাকতেই হারিয়েছি। গান গাইতে ভীষণ ভালোবাসি, অনুপম গুপ্ত জীবনে আসার পর গান যেন আরও মন থেকে সাবলীল ভঙ্গীমায় বেরিয়ে আসে। একটা খুব বাজে সময়ের মধ্য দিয়েই যাচ্ছিলাম, কর্মজীবনে অনুপম কীরকম যেন ‘কাল হো না হো’-র শাহরুখ খানের মতন আমার জীবনকে রাঙিয়ে দিয়ে এল।

প্রথম পরিচয়ে খুব অদ্ভুত লাগলো, কথা বলে ভালো লাগা শুরু, কত ফোন আসত, কত ফোন আমিও করতাম।  কবে যে দু’জনে রাতজাগা তারা হয়ে গেলাম কথা বলতে বলতে বুঝতে পারলাম না। অনুপমের সাথে বন্ধুত্ব জীবনে নতুন উদ্যম এনে দেয়। রাইসে নতুন ফ্যাকাল্টি হিসেবে জয়েন করেছি এক বছর মাত্র হয়েছে, অনুপম শিয়ালদহ রাইসের কাছেই ডালহৌসিতে একটা কম্পানিতে তখন কর্মরত। বাবা মা দিন রাত আমাকে অনুপমের সাথে ফোনে কথা বলতে দেখে ভেবে নিলেন, মেয়ের এবার বুঝি কাউকে ভালো লাগতে শুরু করেছে। ওয়েল, কথাটা বর্তমানে পুরো ঠিক না হলেও ভবিষ্যতে সঠিক হয়ে দাঁড়ায়। আমার দিনের শুরু গুড মর্নিং থেকে শুরু করে সারা দিন কোথায় কখন কী করছি প্লাস বাড়ি ফেরার পথে, সন্ধ্যা ও রাতে ঘুমানোর আগে অবধি আমি ও অনুপম মেসেজ, কল, ভিসি অলয়েজ কানেক্টেড। আই জাস্ট স্টার্টেড টু ফিল দ্যাট অনুপম ইজ্ এ ফ্যামিলি মেম্বার, আই রিয়েলি কান্ট থিঙ্ক উইদাউট হিম।

গত বছর এপ্রিল মাসে হঠাৎ অনুপম রাতে মেসেজ করতে করতে জানালো ও ভালোবাসে আমাকে। ও আমার বন্ধুত্বকে আরও অন্যভাবে দেখতে চায়। অনুপম বলে, “নন্দিতা, আমি তোমার কাছে উজাড় করা ভালোবাসা চাই, তোমার মতন একজন নিখাদ মানুষ পেতে অনুপমকে এত বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে; তুমি জেম নন্দিতা, বহু মেয়ের অভিশাপ আমি কুড়িয়েছি হয়তো, কিছু ভালো কাজ করেছি বলে তোমাকে বন্ধু রূপে পেলাম। ঈশ্বর আমাদের দ্যাখা করালেন। ইউ আর মাই পাওয়ার, ইউ আর মাই লাভ, ড্রিমগার্ল।” এত এত কথা শুনে আমি অবাক হই সেই রাতে। অনুপমকে ভালো লাগত, ভালোবাসতাম কিন্তু বন্ধু থেকে প্রেমিকা হওয়ার জন্য হয়তো তৈরী ছিলাম না মানসিক ভাবে। অনুপমকে শুধু এটুকুই বলি, “ভালোবাসি আমিও তোমাকে, কিন্তু বন্ধু রূপে, ঠিক যে ভালোবাসার কথা তুমি বলছো, আমি খুব ভয় পাই সেই ভালোবাসাকে। আমার ব্যক্তিগত জীবনে পূর্বের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। আমি প্রেমে জড়িয়ে গেলে শেষ আমিই হবো, তোমার কিছু হবে না অনুপম, কারণ পুরুষের ভালোবাসা ও একজন নারীর ভালোবাসায় আকাশ ও পাতাল তফাৎ। তুমি আমি চলো নিজেদের অন্যভাবে মোটিভেট করি, আমরা একসাথে কিছু ভালো কাজ করি, তোমার আমার কমন ভালোবাসা গান, চলো দুজনে গান গেয়ে মুখরিত হই।”

সেদিন কী যেন বুকের মধ্যে বয়ে গেল, ঠিক কোন সে ঢেউ কিছুই বুঝলাম না। খুব অস্থির লাগছিল, অনুপমকে খুব সম্মান করতাম আমি, অনুপমকে এত আবেগী হতে দেখে অবাক হয়েছি বটে। মনে মনে ভাবলাম, আমি অনুপমকে বাদ দিয়ে কোনো কাজ করি না, ও কাছে থাকলে শান্তি পাই। ওর জন্য অপেক্ষা করা, ওকে মিস করা সব কিছুর মধ্যে আনন্দ পাই। তবে ও যখন প্রস্তাব দিলো বন্ধু থেকে আরো এক ধাপ এগোতে, আমি কেন পারলাম না?? অনুপম দু’দিন নিজে থেকেই চুপচাপ, নিজে থেকে কথা আর বলছে না। সাইলেন্স ইজ্ হরিব্যল, “কী হলো অনুপম, কুছ তো বলো মেরে ইয়ার?”
-“লিসেন নন্দিতা, আই লাভ ইউ, ইট মিনস, আই ফিল ইউ আর মোর দ্যান এ বন্ধু, রাইট?”
-“আমি বুঝলাম বাট তুমি ভাবো যদি ইন ফিউচার, ভগবান না করুক, কিছু যদি অঘটন ঘটে, আই উইল বি ফিনিশড। অনুপম তুমি খুব মূল্যবান মানুষ, তোমাকে হারাতে আমি চাই না। আর বন্ধুত্ব পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র সুরক্ষিত সম্পর্ক। এখানে ওই ইমোশনাল অত্যাচারগুলো নেই।”
অনুপম আর আমার কথার মীমাংসা কিছুই হলো না। উলটে অনুপম খুব রেগে ওঠে, একটু যেন জোর করেই  সব কিছু এগোতে চাইছে মনে হলো। গত বছর ঠিক এপ্রিল মাসে বাবাকে নিয়ে লখনউ বেড়াতে গেছিলাম, কিছু গিফট নিয়ে এসেছিলাম অনুপমের জন্য। সেই গিফট অনুপম আমাকে ফেরত দিতে চায় বলে মরিয়া হয়ে ওঠে, আমারও রাগ ওঠে, ওর দেওয়া মেডিসিন বক্স আমিও বলে উঠি ফেরত দেব। যে মানুষ দেরী করে ঘুম থেকে ওঠে, সে অনেক সকালে উঠে পড়েছে আজ। দশটার মধ্যে বাড়ির কাছে বাইক নিয়ে হাজির, দুজনের আজ অফিস ডে অফ থাকায় সুবিধা হলো। আমি সকালে এক কাপ  চা খেয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। গিফট ফেরত দেবার বিষয়টি খুব কষ্ট দিচ্ছিলো মনে মনে, রাগে অনুপমকে দেখা মাত্রই ওর চোখের সানগ্লাসেস টেনে মটকে ভেঙে দিলাম, নির্বিকার অনুপম  গিফট এর প্যাকেট দেওয়া মাত্র আমি সেটাকে পাশে এক পানা পুকুরে ফেলে দিই, অনুপম পাগলের মতন ওই পানা পুকুরে নেমে গিফটের প্যাকেট নিয়ে চলে আসে, ওর পা ঢুকেই যাচ্ছিলো জলে কাদায়, আমি বুঝতে পেরে ওকে সজোড়ে টেনে তুলি, রোদে গরমে দুজনেই ঘেমে নেয়ে এক শেষ, মুখ দুটি লালচে ভাব। এই অভিনব পানা পুকুর পর্বের আগে আমার ফেরত দেওয়া ওষুধের বক্স রাস্তায় অনুপম ফেলেও দিয়েছে নিজে কিন্তু দোষ চাপালো আমি ফেলেছি। যাই হোক অকারণ ঝামেলা একটু হলেও থামলো, না খাওয়া পেটে আমার মাথা ঘোরাতে শুরু করে, অনুপম সঙ্গে সঙ্গে আমার হাত ধরে বসে যাতে হড়কে না যাই। বাইকে কোনো রকমে ওর কাঁধে মাথা রেখে এক জলের দোকানে এসে দাঁড়াই। ঠান্ডা জল খাই দুজনেই এবং ওর পায়ের ময়লা পরিষ্কার করতে আমি আরও জল কিনে নিজেই ধুয়ে দিই। দু’জনেই চোখের দিকে তাকিয়ে একে অপরকে দেখছি, আমার মনে অদ্ভুত এক অজানা কষ্টের ফল্গুধারা বয়ে চলেছে, অনুপমকে মনে হচ্ছিল জড়িয়ে ধরে কাঁদি, কিন্তু কিছু বোঝানোর আগেই অনুপম আমাকে জড়িয়ে ধরলো এই প্রথম। পুরো বলিউড ফিল্ম। নায়ক নায়িকা আলিঙ্গন পর্ব। সেদিন একদম শান্তভাবে আমি অনুপমের বুকে মাথা রেখে কেঁদে ফেল্লাম, আর বল্লাম, “আমাকে ছেড়ে কোনদিনই যাবে না তো? আমাকে ঠকাবে না তো?” অনুপম মুচকি হেসে বললো, “ধুর পাগলি, আমার সোনা মানিককে ছেড়ে কোথাও যাব না। তুমি আমার নন্দিতা, অনুপমও নন্দিতার।”

সত্যি প্রেম ধূমকেতুর মতনই আসে, চারপাশটা নতুন করে দিয়ে যায়। অবশেষে সেই প্রেমজ বিষয়বস্তু চলেই এল। বাবা মা অনুপমকে পছন্দ করতেন। আমাদের সম্পর্ক নিয়েও আপত্তি ছিলো না কিছুই। প্রেম আপন মহিমা নিয়ে সদর্পে এগোচ্ছে। কাজ সেরে রোজ দেখা করা, গল্পের বন্যা বয়ে যেত, এরই মাঝে খুনসুটি আদর সব সুন্দর ভাবে এগোচ্ছে। আমি অনুপমকে আরও কাছ থেকে চেনার সুযোগ পাই, ভালোবাসা, আবেগ, নির্ভরশীলতা বাড়তে থাকে আমার। তিন মাস ভালোমন্দ নিয়ে কেটে গেল। বন্ধু অনুপম, কখন যে মনের অলিন্দে রাজসিংহাসন দখল করে নিলো বুঝতে পারিনি।


এদিকে অনুপমের অফিসে কিছু গন্ডগোল দেখা যায়, যার ফলে ওকে বেশ কিছুদিন উদ্বিগ্ন লাগছিল, মেজাজ দেখছি সবসময় খিটখিটে হয়ে আছে, যখন তখন ঝগড়া অশান্তি শুরু করছে। শান্ত মনে সব সহ্য করে চুপচাপ রইলাম। অফিসের ঝামেলা নিয়ে বিশেষ কিছু আলোচনা করতে চাইলে দেখতাম এড়িয়ে যেত। অনুপম আমার সাথে সব কথাই শেয়ার করতো, কিন্তু ধীরে ধীরে কেমন যেন হতে লাগল। বাড়িতে আসা কমিয়ে দিলো। মা বাবার খোঁজ নিত যে মানুষটা, হঠাৎ মা বাবার কথা আর বলতোই না। অনুপমের মা অসুস্থ থাকাকালীন কাকিমার দেখা শোনা আমি আর অনুপম দুজনেই দায়িত্ব নিয়ে পালন করি। অনুপম ও আমার বয়সের ফারাক মোটামুটি সাত বছর মতন ছিল। স্বভাবতই আমি অনুপমকে অভিভাবক হিসেবে দেখতাম। বাবার পরে খুব প্রিয় পুরুষ বলতে অনুপম ছাড়া অন্য কোনো পুরুষ বন্ধু বা কলিগকেও সেই জায়গা দিতে পারিনি। বন্ধু অনুপম ভীষণ ভাবে আমার একান্ত মনের একজন মানুষ ছিল। বিগত তিন মাসে সম্পর্কে ঝগড়া ঝামেলা যেটুকু করার অনুপম নিজেই করতো, হঠাৎ করে ওর মুড চেঞ্জ, হঠাৎ করেই আমার ফোন ব্যস্ত পেয়ে রাগারাগি, অযথা সন্দেহ, কখনো রেগে স্ল্যাঙ্ বলে ফেলা, এগুলো আমি সহ্য করেছি। প্রেমিক অনুপমের এই উগ্র রূপ নিয়ে আমার আগে এতটা ধারণা ছিল না। অনুপম আমার মন ও ভালোবাসার গভীরতা বোঝার পর থেকেই সময় অসময়ে অশালীন আচরণ করে ফেলত। আমি ভাবতাম, অফিসের অনেক জটিল বিষয়ে জর্জরিত বলে হয়তো এমন করছে। কিন্তু ওর ছেলেবেলার এক বন্ধুর সাথে একদিন কাকতালীয়ভাবে আলাপ হয়, তখন জানতে পারি অনুপমের বহুরূপী স্বভাবের কথা। একটু আপসেট হই শুনে সব কিছু।

মেলাতে পারছিলাম না কিছু আর। বাড়িতে মা বাবাকে জানাই, তারা খানিকটা চিন্তায় পড়ে যান। তবে মা বলেন, আরেকটু সময় নিয়ে ভাবতে। ইতিমধ্যে বাড়িতে আমাদের এনগেজমেন্ট নিয়ে একদফা আলোচনা হয়ে গেছে, কিন্তু অনুপমের নতুন ভাবমূর্তি দেখে আমি সন্তুষ্ট ছিলাম না। আত্মসম্মানকে আঘাত দিয়ে কথা বলত, বড় ছোটো  মান্যতা দিতে ভুলেই গেছে, এত যে বদরাগী বুঝতে পারিনি মিশে। অনুপমকে একদিন সাহস করে জিজ্ঞাসা করেই ফেলি, “আচ্ছা সত্যি করে বলো তো কী হয়েছে তোমার? এত বদরাগী আগে থেকেই ছিলে? আমি তাহলে ভুল চিনেছি? আমি তো জানতাম, আমাকে কোনো মিথ্যে বলো না, আজকাল ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে শুনি কেন? কী হয়েছে তোমার, অনুপম, বলো না প্লিজ?”
অনুপম নিরুওর, তারপর একটু মেজাজ দিয়ে বলে উঠলো, “তোমার এসব প্রশ্নের জবাব দিতে আমি বাধ্য নই, কী হবে আমার! কিছুই হয়নি; তোমার অনেক মেন্টাল সমস্যা আছে, নার্ভের পেসেন্ট তুমি ও তোমার বাবা-মা, তাই তোমাদের এত প্রশ্ন মনে। কাজের পরিমাণ এত কম তোমার যে সারাক্ষণ আমার পিছনে পড়ে থাকো। জ্বালাতন করা একটা হ্যাবিট তোমার ও তোমাদের।”
আই এম জাস্ট শকড! “হোয়াট আর ইউ সেয়িঙ্ অনুপম? পাগল হয়ে গেলে, যা নয় তাই বলে যাচ্ছ। তোমার যদি কোনো অভিযোগ থাকে পরিষ্কার করে বলো, এত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলার তো মানে নেই।”
এরকম মোটামুটি তিন-চার মাস আরও বাজে অপমানজনক কথা বার্তা হজম করলাম। মন ইতিমধ্যে ভাঙতে বসেছে, যে সঠিক পথে এগোচ্ছি না হয়তো! আমাদের মধ্যে তালমিল খুঁজে পাই না। সব কিছু নিয়েই অনুপম মিথ্যের পর মিথ্যে বলতে থাকে, ওর ফোন অনেক সময় এনগেজড পাই, কে ফোন করেছে জানতে চাইলে সঠিক উত্তর আর পেতাম না। ডিনার করে রোজ কথা বলার আমার অভ্যাস ছিলো, সেটাও অনুপম নিজের মতন করে বদলে নিল। ও দিব্যি হোয়াটসঅ্যাপ এ ব্যস্ত থাকতে লাগলো, আমার মেসেজ পেয়েও সীন করত না, দেরী করে জবাব দিতো বা দেওয়া বন্ধ করে দিলো। আমি বহুবার এমন আচরণের কারণ জানতে চেয়ে হতাশ হয়েছি। হতাশা থেকে অসুস্থ হতে থাকি, কাজ স্টপড হয়ে যায়। বাড়িতে ছুটি কাটানোর প্রবণতা বাড়তে থাকে। আমার ফুরফুরে দিনগুলো থমকে যায়। গানের প্রতি ঝোঁক কমে যায়। আমি বুঝতে পারি আমি ভিতরে ভিতরে শেষ হচ্ছি। ডাক্তার দেখিয়ে মেডিসিনও নিতে হয়েছে, কিন্তু শরীর ও মনে সবকিছুই বাজেভাবে ইফেক্ট করেছিল। অনুপম কথা বলে, দেখাও করত, কিন্তু আমি আগের মতন কিছুই আর অনুভব করতে পারতাম না। অনুপমের মিথ্যাচারিতা, বদরাগী মনোভাব, গোপনীয়তা, আমার মনে অনুপমের ইমেজ নষ্ট করে দেয়। আমি বুঝতে পারি উই আর নট মেড ফর ইচ আদার। আরও কষ্ট বেড়ে যায় যখন দেখি, অনুপম ইজ এনগেজড উইথ অ্যান আদার ওম্যান। আমি ভীষণ ভাবে কষ্ট পাই। তখন জলের মতন পরিষ্কার হয়, আগের বলা সব আবেগ ভালোবাসার কথা জাস্ট ক্যাজুয়াল ছিলো, আমাকে ফাঁদে ফেলার টোপ।

অনুপমকে বললামও যে এসব না করলেও হয়তো পারতে, বন্ধুত্বপূর্ণ থাকলে আমি আজ ভেঙে চুরমার হতাম না। ঠকালে অনুপম আমাকে? পারলে গো ঠকাতে? সোনা মানিক বলে যাকে একদিন বুকে আগলে নিয়েছিলে, পারলে তাকে ঠকাতে? এতটুকু আমার কথা মনে এলো না অনুপম?? অনুপম সাইলেন্স ছাড়া কিছু জানতো না। নিজের দোষ কোনো দিন ও স্বীকার করেনি, আমি দোষে দূষিত হয়েছি। টক্সিক সম্পর্ক যাকে বলে তেমন একটা অভিজ্ঞতা পাই। অনুপম সত্যি আমাকে ছেড়ে চলেই গেল অফিসের এক উইডো মহিলার কাছে। আমি কিছু আর জানতে চাইনি কোনোদিন। কথা হত, কিন্তু মনের দূরত্ব বেড়ে গেছিলো। আমরা দুজনেই দুজনের থেকে কৈফিয়ত নেওয়া অনেক আগে থেকেই বন্ধ করে দিলাম। মেনে নিলাম নিয়তি, এটাই হবার ছিলো। আমার প্রাপ্য হয়তো ছিলো। অনুপম বিয়ে করে সেটলমেন্ট করলো। আমি গুড উইশ জানাই মেসেজ করে। ওটাই আমার শেষ মেসেজ ছিলো। জীবন বেজায় রোমাঞ্চক, মানুষের মধ্যে যে দৈত্য থাকে তাকে চিনতে পারিনা বলেই ঠকে যেতে হয়।

তিন বছর বাদে চায়ের পাতা কিনতে গিয়ে পরিচিত মুখ সামনে। ওপাশ থেকে আওয়াজ ভেসে এলো, “আরে নন্দিতা না তুমি?”
আমি তখন তিনমাসের প্রেগন্যান্সি নিয়ে রয়েছি, সাথে আমার হাসবেন্ড নির্মাল্য। আমি খানিকটা অচেনা হবার ভান করেই বললাম, “হুম নন্দিতা দেব সেন আমি। কেমন আছো?” অনুপম জবাবে জানালো জীবন যেমন রেখেছে তেমন। আমি কিছুই বুঝলাম না। নির্মাল্যর সাথে আলাপ করিয়ে দিলাম। বরকে সব আগেই জানিয়ে রেখেছিলাম, তাই কোনো সমস্যা আমার মনে ছিলো না। নির্মাল্য আমার জীবনে গড’স গিফ্ট। ওর ভালোবাসা আমাকে পূর্ণতা এনে দেয়। সেদিন আমি অনুপমের চোখে অদ্ভুত এক জ্বালা-যন্ত্রনা ফিল করি। বুঝতে পারি অনুপম আজ পাঁচ বছর পরে কিছু ভেবে অনুতপ্ত। আমি আর অনুপমের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কোন প্রশ্ন তুলিনি। আমার বর জিজ্ঞাসা করাতে জানালো অনুপমের বউ ছ’মাস হলো ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। আমি চুপ থাকি শুনে। ভেবেছিলাম কিছু বলবো, কিন্তু কিছু আর বলতে পারলাম না সেদিন। দুমাস পরে আমার বাপের বাড়ির ঠিকানাতে একটি গোলাপ ফুল সহ একটি চিঠি আসে, চিঠিতে লেখা,

কাছের নন্দিতা,
আমি জানি তোমার জীবনের বড় একজন অপরাধী আমি। তোমার যোগ্য কোনোদিনই হতে পারিনি। আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, ঠকিয়ে। অনুশোচনা করার সময়ও পেরিয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছি। আজ একটা কনফেশন করতে চিঠি লিখলাম, লিজা আমার মৃত ওয়াইফ, ওকে আমি খানিকটা বাধ্য হয়ে বিয়ে করি, ও বিয়ের আগে আমার কারণে প্রেগন্যান্ট ছিলো। আমি খুব ভয়ে পেয়ে গেছিলাম। তোমাকে ফেস করার মতন সাহস আমার ছিলো না বলেই চেয়েছিলাম নিজে থেকেই দূরে সরে যাও। আমি বুঝতাম আমার অপরাধ তুমি পারবে না সহ্য করতে, আমি অনেক পাপ করেছি জীবনে, তবে বিশ্বাস করো তোমাকে খুব সম্মান করি আজও। তুমি জেম। নির্মাল্য তোমাকে ভালো রেখেছে দেখে আমি আজ হ্যাপী। তোমরা ভালো থেকো দুজনে। আমি তোমার যোগ্য কোনোদিনই ছিলাম না নন্দু। প্লিজ ফরগীভ মী। 🙏
ইতি,
অপরাধী  অনুপম (মনস্টার)

লেখক পরিচিতি : সুস্মিতা সরকার
পেশাগতভাবে বর্তমানে রামপুর হাই স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। পলতা নিবাসী, ভ্রমণপ্রিয় ব্যক্তি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা আহ্বান - বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন

দীপায়ন