লেখক: ঋক ঋকমন্ত্র
এনজেপি থেকে ভাড়ার গাড়িতে চড়ে বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ দার্জিলিং পৌঁছলেও হোটেলের ঘর থেকে কিন্তু বিকেল চারটে নাগাদ বেরোলো বিমান। হোটেলেই বিকেলের চা’টা খেয়েছে সে। সঙ্গে মুচমুচে বিস্কুট। এবার হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যেতে হবে দার্জিলিংয়ের প্রাণকেন্দ্র ম্যাল-এ।
ঠিক হাতে গোনা কুড়ি বছর পর আবার শৈলশহরে এসেছে বিমান। দু’দশক আগে যখন সে এসেছিল তখন সেটা ছিল তার মধুচন্দ্রিমা সফর। সঙ্গে অমৃতা ছিল। দুজনেই নবদম্পতি তখন। বয়স কম। উৎসাহ বা উদ্দীপনা – কোনোটারই ঘাটতি ছিল না। আবহাওয়াও দারুণ ছিল সে বার। ফলে হানিমুন ট্রিপটা জমে একেবারে ক্ষীর হয়ে গিয়েছিল।
বিমান অনেক কষ্ট করে হেঁটে হেঁটে ম্যালে পৌঁছলো। ম্যালের রাস্তাটায় হাঁটতে হাঁটতে সে বুঝলো, দার্জিলিং অনেক বদলে গিয়েছে। নতুন-নতুন অসংখ্য সব আধুনিক দোকান হয়েছে। পরিকাঠামো বলতে যেটাকে বোঝায়, সেটার ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। তবে ম্যাল যেন সেই আগের মতোই আছে। শুধু একটা বড় এলসিডি স্ক্রীন বসেছে আর বসেছে কবি ভানুভক্তের একটা বিশাল মূর্তি।
এখন সিজন চলছে। তাই ম্যালে থিকথিক করছে ভিড়। বিমান অনেক কষ্টে খুঁজে-খুঁজে একটা অর্ধেক ফাঁকা বেঞ্চে গিয়ে বসলো। মাফলারটা গলায় ভালো করে জড়িয়ে নিলো। টুপিটা টেনে সযত্নে কান দু’টোকে ঢাকলো। তারপর একটা সিগারেট ধরালো।
বিমান নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে দেখেছে, অনুভব করেছে, বাঙালি যতই ছাপোষা হোক না কেন, দার্জিলিংয়ে এলেই তার ভাবগতিক আমূল বদলে যায়। সে যেন নিজেকে সাহেব বলে মনে করতে শুরু করে। নিজেকে সাহেব-ভাবা এরকম অনেক বাঙালি এই মুহূর্তে বিমানের সামনে দিয়ে যাতায়াত করছে, অনেকেই আশেপাশের বেঞ্চে বসে আছে।
বিমান সিগারেটে শেষ টান দিয়ে সেটা পাশে ফেলে দিলো। তারপর উঠে হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙলো। ম্যালের একদিকের একটা রাস্তা ধরে সে কুড়ি বছর আগে অনেকটা হেঁটে একটা চমৎকার জায়গায় পৌঁছেছিল, যেখান থেকে পরিস্কার দেখা গিয়েছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা। বিমান হাঁটা শুরু করলো সেই জায়গাটার উদ্দেশ্যে। জায়গাটার নাম বোধ’য় মর্নিং ওয়াক পয়েন্ট বা এরকম কিছু একটা, এত বছর পরে সঠিক নামটা বিমান ঠিক মনে করে উঠতে পারলো না।
ম্যালকে পিছনে ফেলে পাহাড়ি পথ ধরে টুকটুক করে হাঁটতে হাঁটতে বিমান অবশেষে পৌঁছে গেলো তার সেই কাঙ্খিত জায়গাটায়। কপাল ভালো, এবারও পরিষ্কার কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। পড়ন্ত বিকেলের সোনালী রোদ মেখে আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। তার এই জ্বলন্ত রূপ যেন চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। এ রূপ একবার দেখলে এই মানবজনমে আর সহজে ভোলা যায় না।
মিনিক পাঁচেক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ উপভোগ করার পর যেন হঠাৎ সম্বিৎ ফিরলো বিমানের। চারপাশটা ভালো করে তাকিয়ে দেখলো সে। বিশ বছরে খুব একটা অদল-বদল হয়নি। সেই বেঞ্চিগুলো এখনো আছে। লোহার মরচে পড়া রেলিং এখনো আছে। কাঠের ছাউনির দল এখনো আছে আর এখনো এখানে ভিড় জমিয়ে বসে-দাঁড়িয়ে হিমালয়ের শোভা উপভোগ করছে পর্যটকের দল। সেই সঙ্গে ছবি তুলছে, চা-কফি সেবন করছে।
হ্যাঁ, একটু চা হলে মন্দ হয় না। বিমান মাফলারটা ভালো করে জড়িয়ে এগিয়ে গেলো আপেলের মত টুকটুকে লাল গালওয়ালা গুর্খা মেয়েটির দিকে। একগাদা কেটলি, কাপ ইত্যাদি নিয়ে বসে সে চা-কফি বিক্রি করছে। আগের বার এখানে একজন গুর্খা বুড়ির কাছ থেকে কিনে চা খাওয়া হয়েছিল। বুড়িটা বোধহয় এতদিনে আর বেঁচে নেই। হয়তো এই মেয়েটি ওই বৃদ্ধারই কন্যা বা নাতনি কেউ হবে। এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই এক কাপ চা নিয়ে একটা বেঞ্চের কোণে বসে পড়লো বিমান।
চেয়ে চুমুক দিয়ে আঁৎকে উঠলো বিমান, ‘এ্যাতো মিষ্টি!’ বেশ জোরেই বলে উঠেছে সে আর সঙ্গে সঙ্গে তার ঠিক পেছন থেকেই কে যেন বলে উঠলো, ‘পুরো রসগোল্লা!’
বিমান চমকে পেছন ঘুরে তাকিয়ে যেন চারশো চল্লিশ ভোল্টের বৈদ্যুতিক শক খেলো। কথাটা যার মুখ থেকে বেরিয়েছে, সে আর অন্য কেউ নয়, বিমানের একদা-অর্ধাঙ্গিনী অমৃতা।
অমৃতাও বিমানকে দেখে যেন পাথর বনে গিয়েছে। দু’জন দু’জনার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে। যেন শুভদৃষ্টি হচ্ছে। ঠিক যেমনটা হয়েছিল কুড়ি বছর আগের এক রাতের লগ্নে, কলকাতার এক বিয়েবাড়ির ছাদনাতলায়।
বিমান ও অমৃতার বিয়েটা সম্বন্ধ করেই হয়েছিল। খুব ধুমধাম হয়েছিল। প্রায় সাতশো লোক খেয়েছিল। দেদার ছবি উঠেছিল, ভিডিও হয়েছিল। দেবতারা যেন স্বর্গ থেকে পুষ্পবৃষ্টি করেছিলেন। শখ করে মধুচন্দ্রিমাও হয়েছিল। কিন্তু এক বছরের বেশি বিয়েটা টেঁকেনি।
বিয়েটা কার দোষে ভেঙেছিল, কে বিচ্ছেদের জন্যে দায়ী ছিল, সেই নিয়ে অনেক কাটাছেঁড়া হয়েছে, অনেক ময়নাতদন্ত হয়েছে। কিন্তু, বিমান আর কোনো তিক্ততা মনে পুষে রাখতে চায় না। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে, মুখে হাসি ফুটিয়ে সে জিজ্ঞেস করলো, ‘চিনতে পারছেন?’
অমৃতাও নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তর দিলো, ‘হ্যাঁ, ভালো আছেন?
‘ওই চলছে আর কি…’, জবাব দিলো বিমান।
‘কবে এসেছেন?’ জিজ্ঞেস করেই হাতে ধরা কাগজের কাপে চুমুক দিলো অমৃতা।
‘আজকেই..’, সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলো বিমান।
‘একাই?’ অমৃতার গলায় কৌতূহল।
‘হ্যাঁ, আপনি নিশ্চই…’, বিমানের গলাতেও কৌতূহলের সুর।
‘স্বামী আর ছেলের সাথে…আমাকে এখানে বসিয়ে ওরা ওদিকটায় গেছে…হাঁটতে…’, অমৃতার মুখ জুড়ে হাসি।
‘ঠিক আছে…চলি…ভালো থাকবেন…’
আর কথা না বাড়িয়ে কাপটা বেঞ্চের তলায় বসিয়ে দিয়ে উঠে পড়ে বিমান। গুর্খা মেয়েটাকে চায়ের দাম দিয়ে সে সটান হাঁটা দেয় ম্যালের দিকে। আলো কমে আসছে। আকাশে মেঘ জমছে। গুড়গুড় করে মেঘ ডাকছে। বৃষ্টি নামবে মনে হয়। তাড়াতাড়ি তাই হোটেলে ফিরতে হবে। কিন্তু বিমানের পা দু’টো যেন চলতেই চাইছে না। কেমন যেন ভারী-অবসন্ন লাগছে। মনটাও কেমন যেন ভারী, কেমন যেন অবসন্ন হয়ে গেছে হঠাৎ। বুকের কোথাও যেন একটা চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে।সব হিসেব গুলিয়ে যাচ্ছে। সব যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। সব যেন….
হোটেলটা অনেক উঁচুতে হলেও ব্যবস্থাপাতি ভারী চমৎকার। সুন্দর করে সাজানো সব ছোট-বড় ঘর। পরিষেবাও বেশ ভালো। রাত সাড়ে ন’টায় ডাক পেয়ে হোটেলের লবিতে রাখা সার সার ডাইনিং টেবিলের একটায় গিয়ে বসলো বিমান। চারপাশে আরও কয়েকজন আবাসিক রাতের খাওয়াদাওয়া সারছে। টিভিতে সজোরে একটা হিন্দি গান চলছে। বিমানের ঠিক খিদে নেই। তবু অনেক কষ্টে সে দু’টো রুটি আর এক বাটি পাহাড়ি স্কোয়াশের ঝালঝাল তরকারি খেলো। তারপর ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে সটান গিয়ে দাঁড়ালো কাঁচের জানলাটার সামনে। একটা পাল্লা খোলা। সেই খোলা অংশ দিয়ে হু হু করে ঢুকছে হিমেল হাওয়া। বিমান একটা সিগারেট ধরিয়ে বাইরে তাকালো। রাতের উপত্যকা বড়ই সুন্দরী। তার ওপর এখন পাহাড়ের বুকে জায়গায়-জায়গায় আলোর মেলা। ঠিক যেন মনে হয়, কেউ লক্ষ প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছে। এই সহস্র প্রদীপের আলো বড়ই মনমুগ্ধকর, বড়ই মায়াবী, বড়ই রহস্যময়।
কিন্তু, এসবের সৌন্দর্য যেন ভোগ করতে পারছে না বিমান। সে গত কুড়ি বছর ধরে অন্য এক কল্পনার জগতে ছিল। ঠিক যেমন ছোট-ছোট ছবির টুকরো দিয়ে বড় ছবির কোলাজ তৈরী হয়, ঠিক তেমনি বিমানও ছোট-ছোট সব কষ্টকল্পনাকে সাজিয়ে নিজের মনের মতো একটা গল্প তৈরি করে নিয়েছিল। যে গল্পে অমৃতা একজন ব্যর্থ নারী। যে গল্পে অমৃতার কপালে কোনোদিন সুখ জোটেনি। যে গল্পে অমৃতা ঘর পায়নি। যে গল্পে অমৃতা আর বর পায়নি। যে গল্পে অমৃতা মা হতে পারেনি।
কিন্তু আজকের বিকেলটা বিমানের সেই কল্পনার জগতটাকে ভেঙে একেবারে চুরমার করে দিয়েছে। অমৃতার সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে, তার রূপ দেখে, তার কথা শুনে সে বুঝতে পেরেছে, অমৃতা ঘর-বর-সন্তান সবই পেয়েছে। সে আনন্দেই আছে। আর এখানেই বিমানের সমস্যা। সে অমৃতার সাফল্যে আঘাত পেয়েছে। নিদারুণ আঘাত। তাই সে ছটফট করছে। তার পৌরুষ তাকে কষ্ট দিচ্ছে। তার পুরুষত্বের অহংকার তাকে রক্তাক্ত করছে। বারবার মনে একটাই প্রশ্ন জাগছে, ‘অমৃতা এইভাবে জিতে গেলো?’
সিগারেটে শেষ টান দিয়ে সেটাকে নিচে ছুঁড়ে ফেলতেই মোবাইল বাজার শব্দে চমকে উঠলো বিমান। টেবিলে রাখা তার মুঠোফোনটা সশব্দে বাজছে। বিরক্তমুখে এগিয়ে গিয়ে যন্ত্রটা তুলে বোতাম টিপে কানে ধরলো বিমান, ‘হ্যাঁ বলো…’
-‘ডিনার হয়ে গেছে?’
-‘হ্যাঁ…’
-‘শুয়ে পড়েছ নাকি?’
-‘না…’
-‘একা একা বেশ ঘুরে নিচ্ছ…’
-‘আর কিছু বলবে?’
-‘একটা খবর আছে…’
-‘কী?’
-‘সুখবর…’
-‘আরে ধ্যাৎ বলো না!’
-‘ইমেল এসে গেছে, আকাশের ভিসাটা হয়ে গেছে…’
‘এক্সেলেন্ট!’, বিমানের মুখে মুহূর্তে হাসি ফুটে ওঠে, ‘কাল সক্কাল সক্কাল ফোন করবো, রাখি!’ বলে বিমান মোবাইলটা কান থেকে নামায়। মনটা এতক্ষণ সুনামির সমুদ্রের মতো অস্থির ছিল। এখন যেন তাতে প্রশান্তির ঢেউ, আনন্দের ঢেউ।
অমৃতা চলে গিয়েছিল উনিশ বছর আগে। এখন সে স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখী। কিন্তু বিমানও তো কম সুখী নয়। তার ছেলে আকাশ এই বয়সেই ভিসা পেয়ে ইউএস যাচ্ছে ওয়ার্কশপে যোগ দিতে। এ তো বাবা হিসেবে তার কাছে গর্বের বিষয়। ঠিক যেমন দ্বিতীয় স্ত্রী মঞ্জুলাকে পাওয়াটাও ভাগ্যের ব্যাপার।
হ্যাঁ, হয়তো মঞ্জুলা অমৃতার মতো শিক্ষিত নয়, সুন্দরী নয়, কিন্তু তাতে কী? বিমানকে তো সে নিজের মতো করে বাঁচার স্বাধীনতা দিয়েছে। তাই তো বিমান আজ নিজের ইচ্ছেমতো একাই দার্জিলিং বেড়াতে আসতে পেরেছে, যা অমৃতা থাকলে কখনোই সম্ভব হতো না।
নাহ, বিমানের আর নিজেকে পরাজিত বলে মনে হচ্ছে না। নীল পাহাড়ের দেশে এসে সে নতুন করে জয়ী হয়েছে, জীবনকে নতুন করে আবিষ্কার করেছে। ধন্যবাদ হিমালয়!
লেখকের কথা: ঋক ঋকমন্ত্র
ঋক ঋকমন্ত্র একজন চিত্রনাট্যকার ও সংলাপ লেখক। চিত্রনাট্য রচনার পাশাপাশি তিনি নিয়মিত গল্প-কবিতা ইত্যাদি লেখালিখি করেন।
দারুন লিখেছিস ভাই
খুব ভালো লাগলো।
বাঃ বেশ হয়েছে। একটা রেশ থেকে যায়।
Darun