নিছক ভূতের গল্প

লেখক : ইন্দ্রনীল চক্রবর্তী

“একটা ভূতের গল্প শুনবেন নাকি?”
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, ভূত নয়, এক গোবেচারা দেখতে লোক আমার পাশে কখন এসে বসেছে। সাদা রঙের হাফহাতা শার্ট, পুরনো ধরণের প্যান্ট। মাথায় কিছুটা টাক, আর বাকিটা সাদাকালো চুলে ভর্তি। চোখে ভাল পাওয়ারের চশমা। হাত কচলানোর ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে কখন একটা জ্যান্ত ভূত হাত কচলানোর ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসবে।
“খামোকা এই বিকেলবেলায় ভূতের গল্প শুনতে যাব কেন? তাছাড়া আপনিই বা কে?”
“আরে শুনেই দেখুন না, ভূতের গল্পের তো আলাদাই মেজাজ। সব সময় কি শীতের রাত, বর্ষার সন্ধ্যে, খিচুড়ি আর ডিমভাজার সাথেই শুনতে হবে? একদিন বিকেলবেলা এই পার্কের পাশে বসে শুনেই দেখুন না।”
“আচ্ছা মুশকিল। ঠিক আছে শুনছি, তবে ভাল গল্প হওয়া চাই।”
রিটায়ারমেণ্টের পর প্রতিদিন বিকেলবেলা পার্কে বেড়াতে আসি, কিছুক্ষণ হাঁটার পর বেঞ্চিতে বসে খেলা দেখি। সকালে পাউরুটিতে মাখন লাগানোর অভ্যাসের মতন বিকেলগুলোও অভ্যেসের পর্যায়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। সেখানে হঠাৎ যদি কেউ এসে বলে “একটু ডিম-টোস্ট করে দিই”, তাহলে তো একটু ভাল লাগবেই। তবু ভদ্রলোক গল্প শুরু করার আগেই জিজ্ঞেস করলাম, “নাম কি আপনার? থাকেন কোথায়? এরকম কি রোজ কাউকে গল্প শোনান?”
“বলছি, বলছি। আমার নাম শরদিন্দুর বরদাও হতে পারে, বা বিভূতিবাবুর তারানাথও হতে পারে। আর থাকি বাংলা গল্পের পাতায় পাতায়, নিছক একটি ভূতের গল্প বলার জন্য।”
কথা শুনে আমার হাসি পেয়ে গেল, “আপনার বেশ রসবোধ আছে। নাম বলতে চাইছেন না, ভাল কথা।”
“তাহলে শুরু করি, কি বলেন?”
“হ্যাঁ, শুরু করুন।”
“সেবার খুব বৃষ্টি হচ্ছিল জানেন? ”
“আরে, সেবার মানে কোন বার?”
“তিন-চার বছর আগে খুব বৃষ্টি হ’ল না, খুব বান এল, একতলায় সব জল ঢুকে গেল এখানে…”
“হ্যাঁ, মনে পড়েছে।”
“সেই বার। আমি গিয়েছিলাম হাওড়ায় দিদির বাড়িতে। বাগনানের অনেকটা ভিতরে দিদি-জামাইবাবুদের বাড়ি। বিরাট পৈতৃক বাড়ি, প্রায় তিন-চারপুরুষের বাড়ি। শুধু বাড়ি নয়, তার চারপাশে ছিল বিরাট বাগান। তখন বয়স কত হবে আমার, এই পঞ্চান্ন কি ছাপ্পান্ন। বুঝলেন, সেবার দিদি খুব রেঁধেবেড়ে খাইয়েছিল। দিদি আমায় এই বয়সেও খোকা বলে ডাকে। আমায় দেখেই বলল, “কি রে খোকা, কতদিন পর এলি ?” বাড়ির বাচ্চাবাচ্চা ছেলেমেয়েদের তখন কি হাসি। খুবই লজ্জা পেয়েছিলাম। তারপর সে কি খাওয়াদাওয়া মশাই, সকালে লুচি আর সাদা আলুর তরকারি, দুপুরে পাবদা-ইলিশ, বিকেলে মুড়ি-কাঁচালঙ্কা-চানাচুর, রাতে রুটি-মাংস। এরকমই চলতে লাগল, বুঝলেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে চা-ব্রেকফাস্ট খাও, খুট খাট করে একটু ল্যাপটপ দেখো। তারপর হাঁটতে বেরিয়ে যেতাম। দিদির বাড়ির চারপাশে সুন্দর বাগানে ভরা, বুঝলেন কিনা। খুব শীতল হাওয়া দিত, আর আমি সেই বাগানের মধ্যিখানে হাঁটতাম। নভেম্বর মাস, রোদ্দুর কম, হালকা শীতের আমেজ। হাঁটতে হাঁটতে জগতের নানান কথা মাথায় আসত, খুব ভাল লাগত। আমি এক সপ্তাহ সময় নিয়ে গেছিলাম।

এরকমই একদিন বুঝলেন, সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে হাঁটতে বেরিয়েছি। বেশ ভাল লাগছিল, চারিদিকে মৃদুমন্দ হাওয়া, বহু পুরনো আর বড় বড় গাছ, হালকা শীতের আমেজ – সব মিলিয়ে এক মনোরম পরিবেশ, বুঝলেন। কত যে গাছগাছড়া কল্পনা করতে পারবেন না। একদিকে দেবদারু, বট, আম, কাঁঠাল, বাবলা, নিম, পেয়ারা গাছ যেমন আছে, তেমনই অন্যদিকে ফণীমনসা, বেতুলা, পুঁইশাক, মুশা গাছে ভর্তি সেই বাগান। চারিদিকে লালচে রঙের মাটি, হাঁটতে ভীষণ ভাল লাগছিল। অনেকদিনের পুরনো বাগান। জামাইবাবুদের পরিবার তিন পুরুষ আগে এই বাগান তৈরি করেছিল। বাগানের ভিতরে একটা কুয়ো ছিল, সেখান থেকে আগে গাছে জল দেওয়া হত। এখন ট্যাপ লাগিয়ে তার থেকে পাইপ দিয়ে জল দেওয়া হয়। কুয়োর উল্টো দিকে একটা বড় নিম গাছ দেখে আমি বসে পড়েছিলাম। ঠিক মনে নেই কতক্ষণ বসে ছিলাম। তারপরে হঠাৎ একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল, বুঝলেন কিনা!”
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কি ঘটনা?”
“কুয়োর দিকে তাকিয়ে দেখি, ভিতর থেকে একটা সোনালী রঙের পাতা উপরে উড়তে উড়তে বেরিয়ে এল। কি তাজ্জব ব্যাপার মশাই, মাধ্যাকর্ষণ অগ্রাহ্য করে বেরিয়ে এল।”
“সোনালী পাতাটা ভারি অদ্ভুত। তবে পাতা হালকা বলে উপরে উড়ে আসতেই পারে।”
“কিন্তু কুয়োর একদম ভিতর থেকে আসতে পারবে? ওখানে হাওয়া পৌঁছবে? তবে ব্যাপারটা এখানেই শেষ নয়।”
“তাহলে?”
“একটা পাতা নয়, অনেক এরকম সোনালি পাতা একে একে কুয়োর ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল। বললে বিশ্বাস করবেন না, পাতাগুলো উড়ে উড়ে এসে আমার পায়ের সামনে জড় হ’ল। সে কি বিচিত্র দৃশ্য! এক একটা পাতা কুয়োর ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে, আর উড়তে উড়তে এসে আমার পায়ে পড়ছে।”
“স্ট্রেঞ্জ। আপনি তো সব পাতাগুলো বিক্রি করে কোটিপতি হয়ে যেতেন মশাই।”
“সে সৌভাগ্য কি কপালে আছে? সে গুড়ে বালি। আরও আশ্চর্য ব্যাপার কী জানেন মশাই, পাতাগুলো এক এক করে জ্বলে গেল। আমি তো পুরো থ। এমন কাণ্ড বাপের জন্মে দেখিনি। দিনের বেলা কুয়ো থেকে একের পর এক পাতা উঠে উঠে আসছে। তাও যে সে পাতা নয়, সোনার পাতা। সে পাতাগুলো জড়ো হতে না হতেই পুড়ে গেল। ভাবলুম, কুয়োর মধ্যে কিছু-না-কিছু রহস্য নিশ্চয়ই আছে। কুয়োর দিকে এগিয়ে দেখতে গেলাম ভিতরে আছেটা কি।”
“কি দেখলেন?”
“দেখতে আর পারলাম কই। মুখ বাড়াতে গেছি, কি একটা চাপা কষ্ট হ’ল, আর আমি ফ্ল্যাট। আই মিন, জ্ঞান হারিয়ে গেল।”
“এক মিনিট, এক মিনিট। এইটা কিসের ভূতের গল্প হ’ল? সবটাই তো ফ্যাণ্টাসি। ম্যাজিকের গল্প বলতে পারেন।”
“দাঁড়ান, এখনও পুরোটা শেষ হয়নি।”
“বেশ, বলুন।”
“আমি তো ওই যে ফ্ল্যাট হ’লাম, তারপর জ্ঞান ফিরল বিছানায়। চেয়ে দেখি, দিদি-জামাইবাবু আমার দিকে উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে আছে। তারপর বুঝলেন, এল ধুম জ্বর। ১০৩-১০৫ জ্বর, তিন-চার দিন জ্বর চলল, হাসপাতালেও নিয়ে যাওয়া হ’ল। এক সপ্তাহ বাদে সবাইকে কাঁচকলা দেখিয়ে পরলোকপ্রাপ্তি হ’ল আমার। এই হ’ল আমার গল্প। আপনারা যাকে বলেন ভূত, আমি এখন তাই। যদিও এ গল্প জীবিত অবস্থার গল্প, কিন্তু এখন তো আমি ভূত। তাই এটাকে ভূতের গল্প বলতেই পারেন।”

ভদ্রলোক এতক্ষণ এক নাগাড়ে বলে জোরে জোরে শ্বাস নিলেন। ঠিক সেই সময়ে খেলার মাঠের ক্রিকেট বলটি আমার সূক্ষ্ম শরীর ভেদ করে আমার পেটের মধ্যে এসে পড়ে। উইকেট কিপার ছেলেটি এসে আমার পেট এর ভিতর থেকে বলটি নিয়ে যায়। ভদ্রলোক তাই দেখে বললেন, “এ বাবা! আগে বলবেন তো? আমি ভাবলাম যে সন্ধ্যেবেলা ভয় দেখাব। এখন দেখি বেকার সময় নষ্ট। যাই, অনেক কাজ পড়ে রয়েছে।”
বলেই তিনি ভ্যানিশ হ’লেন। আমারও আবার ভ্যানিশ হবার সময় হ’ল। বিকেলটা ভালই কাটল, নিছক একটা ভূতের গল্প শোনা গেল। শুধু গল্পটা কেমন লাগল, সেটাই ওনাকে জানানো হ’ল না। না শুনেই চলে গেলেন, এত তাড়া।


লেখক পরিচিতি : ইন্দ্রনীল চক্রবর্তী
ইন্দ্রনীল চক্রবর্তীর জন্ম ১৯৭৮ সালে। লেখালেখির শুরু একুশ-দশের গোড়ায়। পেশায় ট্রিপলআইটি-হায়দ্রাবাদে কর্মরত গবেষক ও সহযোগী অধ্যাপক। দুটি কবিতার বই। কবিতা, অনুগল্প, অনুবাদের মাধ্যমে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখা লেখির শুরু। কবিতার লেখার পাশাপাশি রয়েছেচলচ্চিত্রের প্রতি অনুরাগ। নিজের কবিতা প্রসঙ্গে ইন্দ্রনীল উবাচ - যেটুকু বলা হল কবিতায় তার বাইরে আসল কবিতাটুকু রয়ে গেল।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা জমা দিতে ছবিতে ক্লিক করুন