নিখোঁজ বুদ্ধি

লেখক : অভি সেখ

এক দেশে ছিল এক রাজ্য, নাম মূর্খরাজ্য। রাজ্যটি এতই অনন্য ছিল যে, এখানে বুদ্ধিমান মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। জন্মের পর শিশুদের প্রথম পরীক্ষায় তাদের মূর্খতা যাচাই করা হত—যদি কেউ ভুল করে বুদ্ধির ছাপ দেখাত, তাকে সঙ্গে সঙ্গে রাজ্য ছাড়া করা হ’ত।

এই রাজ্যের রাজা ছিলেন মহামূর্খ রাজাধিরাজ স্তুপিডানন্দ। তিনি একদিন ঘোষণা করলেন—
“রাজ্যে এত বুদ্ধিমান লোক ঢুকছে কেন? আমাদের মূর্খত্ব রক্ষা করতে হবে!”
মন্ত্রীরা মাথা নাড়লেন। মন্ত্রীপরিষদে ছিলেন কাটমানিচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, যিনি সব সরকারি প্রকল্পে ৯৯% টাকা নিজেই রেখে দিতেন, এবং আলতু-ফালতু বিধানচন্দ্র, যিনি কখনো সংসদে কথা বলেননি, কারণ তিনি মনে করতেন সংসদের চেয়ারগুলো কথা বলার জন্য যথেষ্ট নরম নয়।

একদিন রাজা শুনলেন যে রাজ্যের কিছু নাগরিক কর দিতে চাইছে না। তিনি হুকুম দিলেন—
“তাদের ধরে আনো! আমি নিজেই বিচার করব!”
কয়েকজন সাধারণ নাগরিক ধরা পড়ল। রাজা জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কর দিচ্ছ না কেন?”
একজন ভয়ে ভয়ে বলল, “মহারাজ, আমরা তো গত বছরই কর দিয়েছি!”
রাজা অবাক হয়ে বললেন, “তার মানে কী? কর কি একবার দিলে চিরকাল দেওয়া লাগে না?”
মন্ত্রীদের কেউ একজন ফিসফিস করে বলল, “মহারাজ, এদের বুঝিয়ে বলুন।”
রাজা গম্ভীর হয়ে নাগরিকদের বললেন, “দেখ, কর হ’ল একটা ফ্রিজের মত, যেটা একবার কিনলে চিরকাল চালাতে হয়!”
নাগরিকরা মাথা চুলকে বলল, “এ তো আগে বুঝিনি!”
রাজা গর্বিত হয়ে বললেন, “এই যে, শিক্ষা! আমার রাজ্যে সবাই মূর্খ, কিন্তু শিক্ষিত মূর্খ!”

মূর্খরাজ্যের বিশেষ নিয়ম ছিল—যত বড় মূর্খ, তত বড় পদ!
এ কারণেই রাজা স্তুপিডানন্দ ছিলেন সবচেয়ে বড় মূর্খ, আর তার মন্ত্রীদের মূর্খতার মাত্রা একটু কম হলেও মোটামুটি সন্তোষজনক পর্যায়ে ছিল। কিন্তু সমস্যা বাধল, যখন রাজ্যের এক যুবক হঠাৎ করে কিছু বুদ্ধির ছাপ দেখাতে শুরু করল!
রাজ্যের এক কোণায় বসবাস করত গজানন চণ্ডীমূর্খ। সে একদিন বাজারে গিয়ে দেখল, সব জিনিসের দাম দাম এত বেশি যে এক হাঁড়ি দই কেনার বদলে একটা খালি হাঁড়িই কিনতে পারবে। সে গলায় হাত দিয়ে চেঁচিয়ে বলল—
“রাজ্যের সব টাকা কোথায় যায় ?”
তৎক্ষণাৎ রাজ্যের সিকিউরিটি এলিট ফোর্স (মানে, কয়েকজন অলস প্রহরী) গজাননকে ধরে রাজদরবারে নিয়ে গেল।
রাজা সিংহাসনে বসে ছিলেন, চোখ বন্ধ করে। কারণ, তিনি বিশ্বাস করতেন যে বুদ্ধিমান মানুষের সামনে বেশি চোখ খুললে “বুদ্ধি ঢুকে যেতে পারে!”
রাজা চোখ বন্ধ রেখেই বললেন, “এত হট্টগোল কিসের?”
মন্ত্রী কাটমানিচন্দ্র বললেন, “মহারাজ, এ ব্যক্তি জানতে চেয়েছে, রাজ্যের সব টাকা কোথায় যায় !”
রাজা এক লাফে উঠে দাঁড়ালেন, “কী! এ প্রশ্ন কেউ করতে পারে? এ তো রাষ্ট্রদ্রোহিতা!”
গজানন কাঁপতে কাঁপতে বলল, “মহারাজ, আমি শুধু জানতে চেয়েছি…”
রাজা হাত উঁচিয়ে বললেন, “থামো! আমি নিজে উত্তর দেব। রাজ্যের টাকা কোথায় যায়, জানো? টাকা খুব চালাক জিনিস। ওরা রাতে চুপচাপ হাঁটতে হাঁটতে বাইরে চলে যায়! তুমি কি টাকা পাহারা দিতে বলছ? তাহলে তো আমাদের ঘুম হারাম হয়ে যাবে!”
মন্ত্রীপরিষদ উল্লাসে ফেটে পড়ল। “মহারাজ! কি যুক্তি!”
গজানন বোকার মতো তাকিয়ে থাকল।
রাজা আরও যোগ করলেন, “আমরা রাজ্যে বুদ্ধির সংক্রমণ চাই না! আগামীকাল থেকে বাজারে ‘মূর্খতার প্রশিক্ষণ ক্যাম্প’ খোলা হবে! সবাই সেখানে গিয়ে নিজের মূর্খতা পরীক্ষা করাবে!”
এক মন্ত্রী ফিসফিস করে বলল, “মহারাজ, তাহলে তো আপনাকেও…!”
রাজা চিন্তায় পড়ে গেলেন। একটু ভাবার পর ঘোষণা দিলেন, “আমার পরীক্ষা দেওয়ার দরকার নেই। কারণ আমি জন্ম থেকেই মহামূর্খ !”
গজানন বুঝতে পারল, তার এখানে থাকার আর কোনো মানে নেই। তবে সে জানত না, তার এই প্রশ্নের জন্য তাকে এক ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে পড়তে হবে…
গজাননের মাথায় এখন একটাই চিন্তা—রাজা একেবারে গাধা! তবে এ’কথা প্রকাশ্যে বলার সাহস সে করল না। কারণ এই রাজ্যে যে সত্যি কথা বলে, তাকে ধরে লাঠিপেটা করা হয়!
তবে রাজা এত সহজে গজাননকে ছেড়ে দিতে রাজি নন। তিনি লোক পাঠিয়ে রাজ্যে রটিয়ে দিলেন—
“রাজ্যে একজন বিপজ্জনক ব্যক্তি আছে, যে বেশি ভাবনা-চিন্তা করে! এ ব্যক্তি সমাজের জন্য হুমকি! আগামীকাল তাকে ‘বুদ্ধি সংক্রমণ প্রতিরোধ আইন’ অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া হবে জন সমক্ষে !”

পরদিন সকালবেলা রাজদরবারে বসে বিচার শুরু হলো। রাজা সিংহাসনে আরাম করে বসে আছেন, পাশে মন্ত্রীরা হালকা গরম চা চুমুক দিচ্ছেন।
গজাননকে আবার রাজার সামনে আনা হ’ল।
রাজা চোখ বন্ধ রেখেই গম্ভীর মুখে বললেন, “বলো গজানন, তুমি রাজ্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছ কেন?”
গজানন শান্ত ভাবে বলল, “মহারাজ, আমি কিছু করিনি! আমি শুধু জানতে চেয়েছি, রাজ্যে সব টাকা কোথায় যায় !”
রাজা ভ্রু কুঁচকে বললেন, “তোমার সন্দেহজনক প্রশ্নের কারণেই তো আমরা নতুন তদন্ত কমিটি গঠন করতে বাধ্য হয়েছি! কাল সারারাত ধরে তদন্ত চলেছে।”
মন্ত্রী কাটমানিচন্দ্র দাঁড়িয়ে বললেন, “তদন্ত কমিটির রিপোর্ট এসেছে মহারাজ! আমরা খুঁজে পেয়েছি যে রাজ্যের টাকা যায় জনগণের পকেটে!”
গজানন বিস্মিত হয়ে বলল, “কী! জনগণের পকেটে? কিন্তু আমরা তো কিছুই পাইনি!”
রাজা মাথা নাড়লেন, “তোমরা পেয়েছ, কিন্তু বুঝতে পারোনি! রাজ্যের সেরা অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, টাকা আসলে আত্মার মতো—ওটা থাকে, কিন্তু দেখা যায় না!”
গজানন হতভম্ব হয়ে গেল।
মন্ত্রীপরিষদ সবাই একসঙ্গে মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, মহারাজ ঠিকই বলেছেন!”
রাজা ঘোষণা দিলেন, “এখন গজাননের শাস্তি ঘোষণা করা হবে! যেহেতু সে বেশি বুদ্ধিমান হওয়ার চেষ্টা করেছে, তাই তাকে পাঠানো হবে… রাজ্যের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জায়গায়!”
গজানন তো শুনেছে, এই রাজ্যে অনেক আজব জিনিস হয়। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জায়গাটা আবার কী?
রাজা হাসিমুখে বললেন, “ওকে পাঠানো হবে আমাদের ‘রাজকীয় শিক্ষা কেন্দ্র’-এ!”

মূর্খরাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল একেবারে বিশেষ। এখানে পড়াশোনা বলতে বোঝাত, কীভাবে কম বোঝা যায়! রাজ্যের একমাত্র বিদ্যালয়ের নাম ছিল “মহামূর্খ বিদ্যা মন্দির”। এখানে শিক্ষকদের মূল দায়িত্ব ছিল ছাত্রদের ভুল শেখানো। যেমন:
“গরু ডিম পাড়ে”
“নদী পাহাড়ের ওপরে বয়ে যায়”
“সূর্য রাতে ওঠে, কিন্তু সবাই ঘুমিয়ে থাকায় কেউ দেখতে পায় না!”
গজানন বুঝতে পারল, তাকে ভয়ংকর শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এখানে বেশি দিন থাকলে তার মস্তিষ্কের অবস্থা সস্তা রাবারের ব্যান্ডের মতো হয়ে যাবে—টান দিলেই ছিঁড়ে যাবে!
তাই সে সিদ্ধান্ত নিল—যেভাবেই হোক পালাতে হবে!

গজানন এখন মূর্খরাজ্যের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জায়গায়—মহামূর্খ বিদ্যা মন্দিরে!
এই স্কুলের একটাই নিয়ম—যা শেখাবে, তা বিশ্বাস করতে হবে! প্রশ্ন করা নিষিদ্ধ!
প্রথম ক্লাসে শিক্ষক আসলেন। তার গলায় সোনার হার, আঙুলে বিশাল আংটি, আর হাতে একগাদা ফাইল। তিনি বোর্ডে বড় বড় অক্ষরে লিখলেন—
“কয়লা সাদা হয়।”
গজানন হতবাক! সে বলল, “স্যার! কয়লা তো কালো হয়!”
শিক্ষক চোখ কুঁচকে বললেন, “কে বলেছে?”
গজানন থতমত খেয়ে বলল, “এটা তো সবাই জানে!”
শিক্ষক হাসলেন, “এটা হলো তোমার ভুল শিক্ষা! কয়লা আসলে সাদা, কিন্তু সরকার সেটাকে কালো রঙ দিয়ে ঢেকে দেয়, যাতে জনগণ চিনতে না পারে! তাই কয়লা কোথায় গেল, কখনো বোঝাও যায় না!”
গজাননের মাথা ঘুরতে লাগল।
পরের ক্লাসে শিক্ষক বোর্ডে লিখলেন—
“বালিই হলো আসল চাকরি!”
গজানন হতভম্ব হয়ে বলল, “বালি আবার চাকরি হয় নাকি?”
শিক্ষক মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, “হয়! তুমি যদি কারও চাকরি দাও, সে তোমার কাছে বালি ফেলে রেখে যাবে! কিন্তু তুমি যদি চাকরি না পাও, তাহলে দেখবে সব বালির মতো হাত ফসকে চলে গেছে! তাই বলা হয়, চাকরি মানেই বালি, বালি মানেই চাকরি!”
গজানন মনে মনে বলল, “এখানে থাকলে আমার মাথার বুদ্ধি চুলের মতো পড়ে যাবে!”
এক শিক্ষক বোর্ডে লিখলেন—
“সব জমির মালিক সরকার!”
গজানন এবার চুপ করে থাকল।
শিক্ষক বললেন, “কেন চুপ? প্রশ্ন নেই?”
গজানন ভয় পেয়ে বলল, “স্যার, মানুষ জমি কেনে না?”
শিক্ষক গম্ভীর মুখে বললেন, “মানুষ জমি কেনে না, জমি মানুষকে কেনে! তুমি টাকা দিয়ে জমি কিনলে সেটা একদিন সরকার নিয়ে নেবে, আর সরকার কাউকে জমি দিলে, সেটা একদিন বালি হয়ে যাবে!”
গজানন এবার বোঝার চেষ্টা না করেই মাথা নাড়ল।
শিক্ষক খুশি হয়ে বললেন, “বাহ! তুমি বুঝতে শিখেছ! এটাই হলো শিক্ষা!”
গজানন বুঝতে পারল, এখানে থাকলে তার মস্তিষ্কও ‘বালির চাকরি’ হয়ে যাবে! তাই সে পালানোর প্ল্যান করল।

সে গার্ডের কাছে গিয়ে বলল, “গার্ড বাবু, একটা দরকারি প্রশ্ন আছে!”
গার্ড বলল, “বলো!”
গজানন বলল, “কয়লা কি আসলে বালি?”
গার্ড থমকে গেল।
গজানন যোগ করল, “জমি কি সত্যিই চাকরি?”
গার্ডের মাথায় বুদ্ধি জট পাকিয়ে গেল। সে একদিকে কয়লা, অন্যদিকে জমি ও বালি আর মাঝে সরকারি চাকরীর হিসাব মেলানোর চেষ্টা করতে করতে বসে পড়ল।
গজানন সুযোগ বুঝে দ্রুত পালিয়ে গেল!

রাজা যখন শুনল যে গজানন পালিয়েছে, সে ঘোষণা করল—
“এই গজানন মূর্খরাজ্যের জন্য বিপজ্জনক! ওকে ধরতে হবে!”
এবার রাজ্যের সবচেয়ে বড় মূর্খ সৈন্যরা গজাননের পিছু নিল!
গজানন চণ্ডীমূর্খ বুঝতে পারল, মূর্খরাজ্য থেকে পালানো এত সহজ নয়! এখানে পালানোর প্রতিটি রাস্তা অসীম মূর্খতাজালে ঢাকা!
তবুও সে দৌড়াতে লাগল।
গজানন কিছু দূর গিয়ে একটা নিল রঙের পুরনো সাইকেল পেল। তবে মূর্খরাজ্যে কিছুই সাধারণভাবে চলে না। এই সাইকেল ছিল ‘ধুলো চালিত’!
যতক্ষণ না কেউ প্যাডেলে ধুলো ছিটিয়ে দিচ্ছে, সাইকেল নড়বেই না!
গজানন ভাবল, “ঠিক আছে! আমি নিজেই ধুলো ছিটিয়ে চালাব!”
কিন্তু সে ধুলো ফেলতেই সাইকেল তীব্র গতিতে উল্টোদিকে ছুটল এবং সে রাজ্যের এক বিশাল সাইনবোর্ডের সামনে গিয়ে ধাক্কা খেলো, যেখানে লেখা ছিল—
“গতি যত কম, উন্নয়ন তত বেশি!”
গজানন মাথা চেপে ধরে বলল, “হায় ভগবান! এ রাজ্যে কিছুই ঠিকভাবে চলে না!”
সে এবার রাজ্যের একমাত্র ট্রেনে চড়ার চেষ্টা করল—’পেট্রল এক্সপ্রেস’!
ট্রেনের টিকিট কেটে বোর্ডিং গেটের সামনে গেল, কিন্তু গার্ড বলল—
“আপনার পেট্রল কোথায়?”
গজানন অবাক, “কেন?”
গার্ড বলল, “এ ট্রেন পেট্রলে চলে! প্যাসেঞ্জারদের নিজেদের পেট্রল আনতে হয়!”
গজানন মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল।

গজানন ভাবলো, পালানোর আরেকটা উপায় হলো রাজ্যের সবচেয়ে ধূর্ত ব্যবসায়ীদের সাহায্য নেওয়া। তারা এমন জমি বিক্রি করে, যা কেউ কখনো খুঁজে পায় না!
গজানন এক জমি ফেরিওয়ালার কাছে গিয়ে বলল, “আমাকে একটা জমি দিন, যেটা সরাসরি রাজ্যের বাইরে চলে গেছে!”
ফেরিওয়ালা খুশি হয়ে বলল, “অবশ্যই! দেখুন, এই জমি কিনলেই আপনি সরাসরি সীমান্তে পৌঁছে যাবেন!”
গজানন টাকা দিল, ফেরিওয়ালা তাকে চোখ বেঁধে নিয়ে গিয়ে এক জায়গায় নামিয়ে দিল।
গজানন চোখ খুলে দেখল—
সে আবারও মহামূর্খ বিদ্যা মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে!
ফেরিওয়ালা দূর থেকে চেঁচিয়ে বলল, “এটাই আমাদের বিশেষত্ব! জমি কেনার পর মানুষ কোথায় যাবে, সেটা আমরাই ঠিক করি!”
গজানন এবার পুরোপুরি হতাশ হয়ে পড়ল।
সে বাধ্য হয়ে আবার বিদ্যা মন্দিরে প্রবেশ করলো।

কয়েকদিন পর সে শুনতে পেল, রাজ্যে নতুন স্কিম এসেছে —
“যে সবচেয়ে মূর্খ, সে সরাসরি সবচেয়ে ভালো সরকারি চাকরি পাবে!”
গজানন ভাবল, “এইবারই সুযোগ! যদি আমি সরকারি চাকরি পাই, তাহলে বদলির নামে নিজেকে বাইরে পাঠিয়ে দিতে পারব!”
এই ভেবে গজানন চাকরির ফর্ম ফিলআপ করল, প্রচুর টাকা খরচা করে। তারপর এক বছর ধরে প্রিপারেশন নিল… শেষে এল পরীক্ষার দিন।

পরীক্ষায় প্রশ্ন এল—
১) যদি আপনার হাতে এক বালতি টাকা থাকে, তবে কী করবেন?
ক) সরকারকে ফিরিয়ে দেব
খ) বাড়ি বানিয়ে ফেলব
গ) গরিবদের জন্য ঘর বানাব
ঘ) ‘টাকা নেই’ বলে ঘোষণা দেব
গজানন সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, “ঘ!”
বোর্ড ঘোষণা করল, “অভিনন্দন! আপনি চাকরির জন্য নির্বাচিত হয়েছেন!”
গজানন খুশি হয়ে চাকরির জন্য অপেক্ষা করল, কিন্তু সে যা পেল তা হলো—
একটা শূন্য চিঠি , যেখানে লেখা—”আপনার চাকরি নিয়োগপ্রক্রিয়ার ফাইল উন্নয়নের মধ্যে হারিয়ে গেছে!” এবং সে খবর পেল ওই চাকরি করছে রাজার এক নিকটবর্তী আত্মীয়।
গজানন এবার সত্যি সত্যি কাঁদতে বসল।

গজানন বুঝে গেছে, মূর্খরাজ্য থেকে পালানো সহজ নয়। এখানে পালানোর প্রতিটি রাস্তা একেকটা বুদ্ধিহীনতার বিস্ময়!
কিন্তু সে নিরাশ হয়নি। সে পালাতে চায়। সে রাজ্যের বাইরে যেতে চায়।
সমস্যা একটাই—
মূর্খরাজ্যে আইন ছিল: “যে একবার জন্মাবে, সে আর বেরোতে পারবে না! কারণ বাইরে গেলে সে বুঝে যাবে আমরা কত বড় মূর্খ!”
তবু গজানন হাল ছাড়েনি। সে একের পর এক পদ্ধতিতে পালানোর চেষ্টা করল।

গজানন শুনেছিল, রাজ্যের একদল বিজ্ঞানী গরুকে উড়াতে শিখিয়েছে। তারা গোমূত্র এবং গোবর দিয়ে এই টেকনোলজি তৈরি করেছে।
সে ভাবল, যদি একটা উড়ন্ত গরু পায়, তাহলে গরুর পিঠে চড়ে রাজ্যের বাইরে চলে যেতে পারবে!
সে বিজ্ঞানীদের কাছে গেল।
গজানন: “আমাকে একটা উড়ন্ত গরু দিন!”
বিজ্ঞানী: “আমাদের গরু এখনো উড়তে পারে না!”
গজানন: “কেন?”
বিজ্ঞানী: “কারণ আমরা গরুকে বলিনি যে সে উড়তে পারে!”
গজানন হতাশ হয়ে বেরিয়ে গেল।

রাজ্যের একমাত্র সুপার ফাস্ট ট্রেনের নাম ছিল “মহামূর্খ এক্সপ্রেস”।
এই ট্রেন রাজ্যের বাইরে যায়, কিন্তু ফিরে আসে উল্টো পথ দিয়ে!
গজানন চুপচাপ ট্রেনে চড়ে বসল।
কিন্তু সমস্যা হলো, রাজ্যের ট্রেনে কোনো চালক ছিল না!
ট্রেন এমনিই চলত “যেখানে ট্র্যাক যাবে, সেখানে ট্রেনও যাবে” নিয়মে।
গজানন জানালা দিয়ে দেখল, ট্রেন রাজ্যের বাইরে যেতে যেতে হঠাৎ বাঁক নিল এবং আবার রাজ্যের ভেতরেই ঢুকে পড়ল!
ট্রেন থেকে নেমে সে দেখল—
সে যেখানে উঠেছিল, সেখানেই ফিরে এসেছে!
গজানন মাথা ধরে বসে পড়ল।

গজানন ভাবল, যদি সে নিজেকে কিছুদিনের জন্য “নিখোঁজ” ঘোষণা করতে পারে, তাহলে লোকজন তাকে খুঁজতে থাকবে, আর সে পালিয়ে যেতে পারবে।
গজানন নিজের নিখোঁজ পোস্টার ছাপিয়ে গোটা রাজ্যে লাগিয়ে দিল। আশা ছিল, লোকজন তার খোঁজে ব্যস্ত থাকবে, আর সে ফাঁক গলে পালিয়ে যেতে পারবে।
কিন্তু সমস্যা হলো— রাজ্যের লোকজন এতটাই মূর্খ ছিল যে তারা পোস্টারটা না পড়ে শুধু ছবিটাই দেখল!
এক লোক এসে গজাননের সামনেই দাঁড়িয়ে বলল,
“এই লোকটাকে খুঁজছি! আপনি কোথাও দেখেছেন?”
গজানন হতভম্ব! সে বলল,
“হুম… দেখেছি… আয়নার সামনে!”
কিন্তু লোকজন এতটাই বোকা ছিল যে তারা বুঝতেই পারল না। ঠিক তখনই রাজ্যের সেনাপতি ধুমধাম শব্দ করে ঘোড়ায় চড়ে এলো। তার হাতে ছিল এক বিশাল চামচ!
গজানন অবাক হয়ে বলল, “এটা কি তলোয়ারের নতুন মডেল?”
সেনাপতি গম্ভীর মুখে বলল, “না, রাজ্যে এত দুর্নীতি যে তলোয়ারের বাজেট ছিল না, তাই রান্নাঘরের চামচ দিয়েই কাজ চালাচ্ছি!”
তারপর সেনাপতি গজাননের দিকে চামচ উঁচিয়ে বলল—
“তুমি তো নিজেই আছো! তুমি নিখোঁজ নও! রাজ্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আর বিদ্যামন্দির থেকে পালানোর অপরাধে তুমি গ্রেফতার!”
গজানন বুঝল, তার বুদ্ধি উল্টে গেছে!
কিন্তু গজানন সহজে ধরা দেওয়ার লোক নয়! সে তাড়াতাড়ি নিজের গায়ের জামা খুলে ফেলল আর চিৎকার করে বলল—
“দেখো! আমি তো আর সেই লোক নই! পোস্টারে লোকটার জামা আছে, আর আমার নেই! এটা ভুল বোঝাবুঝি!”
সেনাপতি কিছুটা বিভ্রান্ত হলো। রাজ্যের লোকজনও বলাবলি শুরু করল,
“হুম… পোস্টারে তো জামা পরা লোক, আর এখানে জামা ছাড়া লোক… তাহলে তো অবশ্যই দুজন আলাদা।”
গজানন তখনই সুযোগ বুঝে আবার দৌড় দিল।
সেনাপতি তাড়া করল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সে ভুল করে ঘোড়া থেকে পড়ে গেল আর তার চামচটা উল্টে গিয়ে তার মাথায় পড়ল!
সেনাপতি তখন পুরোপুরি কনফিউজড হয়ে গেল এবং নিজের পোস্টার বের করে আবার তাকে খুঁজতে লাগল!

সে শুনেছিল, রাজ্যে এক গোপন সংগঠন আছে, যারা নিজেরা পালিয়ে যেতে চায় এবং অন্যদের তাড়িয়ে দিতে চায়।
সে সংগঠনের খোঁজ করল, এবং এক রাতে এক গোপন গুহায় পৌঁছল।
সংগঠনের প্রধান তার সামনে এসে দাঁড়াল।
প্রধান: “আমরা তোমাকে সাহায্য করতে পারি! আমাদের একটা গোপন সুড়ঙ্গ আছে!”
গজানন: “সত্যি? আমাকে নিয়ে চল!”
প্রধান: “কিন্তু তার জন্য তোমাকে আমাদের একজন হতে হবে। আমাদের এলাকার লোকজন ছাড়া বাকি সমস্ত মানুষদের ঘেন্না করতে হবে। আর চিৎকার করে স্লোগান দিতে হবে ‘জয় গামলা’। পারবে?”
গজানন: “কিন্তু এটা তো অন্যায়।”
প্রধান: “আজ আমাদের রাজ্যের এই অবস্থা শুধু ওই বহিরাগতদের জন্য, ওদের নির্মূল করলেই পুরো রাজ্যে শান্তি নেমে আসবে।”
গজানন: “বেশ আমি রাজি…” এই বলে গজানন জোরে চিৎকার করে বলল “জয় গামলা”।

এবার গজানন সেই প্রধান কে জানালো যে তার প্রাপ্য চাকরি রাজা অন্যজনকে দিয়ে দিয়েছে, এবং তার নিজের এলাকার মানুষের সাথে রাজা অন্যায় করছে। সেই কথা শুনে প্রধান বলল, “এতে আমার কিছু করার নেই। আমাদের সংগঠনের কাজ হল বাইরের এলাকার লোকদের হেনস্থা করা, আর নিজের সংগঠনের লোকদের বাইরের এলাকায় পাঠানো।”
প্রধান এবার গজাননকে একটা গর্তের সামনে নিয়ে গেল।
প্রধান: “এই সুড়ঙ্গ দিয়ে সরাসরি রাজ্যের বাইরে চলে যাবে!”
গজানন খুশি হয়ে ঝাঁপ দিল।
পাঁচ মিনিট হাঁটার পর সে পৌঁছেগেল তার নিজের ঘরের বিছানায়!
গজানন হতবাক!
তার বিছানার পাশে একটা সাইনবোর্ড ঝুলছিল—
“সব সুড়ঙ্গ শেষমেশ নিজের বাড়িতেই ফেরত আসে!” জয় গামলা।
গজানন এবার সত্যিই মাথা ঠুকল।
গজানন বুঝল, একজন মানুষই স্বাধীনভাবে বাইরে যেতে পারে—রাজা!
সে নিজেকে রাজার মতো সাজিয়ে প্রাসাদে ঢুকে পড়ল।
পরের দিন গজানন চিৎকার করে বলল, “আমি রাজা! আমাকে বাইরে যেতে দাও!”
দুই মিনিট পর প্রকৃত রাজা এসে হাজির হল, গজাননের মতোই পোশাক পরে!
রাজা বললেন, “ওই দেখো, ভুয়া রাজা! ধরে ফেলো!”
গজানন আতঙ্কে পালানোর চেষ্টা করল, কিন্তু প্রাসাদে এত দরজা ছিল যে সে কোনটা দিয়ে পালাবে বুঝতেই পারল না।
শেষমেশ সে রান্নাঘরে গিয়ে লুকোল এবং রাঁধুনির ছদ্দবেশ নিল।
সে ভাবল, যদি রাজাকে এমন কিছু খাওয়ানো যায়, যাতে রাজা নিজেই তাকে রাজ্য থেকে বের করে দেন!
সে ঝটপট এক থালা সাধারণ খাবার বানিয়ে রাজাকে দিল।
রাজা এক গ্রাস খেয়ে চিৎকার করে উঠলেন—
“এ খাবারে কোনো রাজকীয় স্বাদ নেই! এটা সাধারণ মানুষের খাবার!”
তারপর হুকুম দিলেন, “ওকে এই খাবারসহ রাজ্যের বাইরে ফেলে দিয়ে আসো! আমাদের রাজ্যে এমন সাধারণ খাবার চলবে না!”
সেনারা তাকে খাবারের সাথে বেঁধে একটি গাধার পিঠে চাপিয়ে রাজ্যের বাইরে পাঠিয়ে দিল।
গজানন অবশেষে মুক্তি পেল!

কিন্তু সমস্যা একটাই—
সে মুক্তির আনন্দে এতটাই মগ্ন ছিল যে ভুলেই গিয়েছিল…
গাধাটি আবার মূর্খরাজ্যের মধ্যেই ঘুরে ফিরে আসে!
গাধাটি ধীরে ধীরে রাজ্যের দিকে ফিরতে লাগল…
গজানন আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠল—
রাজ্যে এসে সে শুনতে পায় রাজা আবার ঘোষণা করেছে রাজ্যের সবচেয়ে বড় মূর্খকে পুরস্কার দেওয়া হবে।
সে সরকারি দফতরে গিয়ে বলল, “আমি রাজ্যের সবচেয়ে বড় মূর্খ! আমাকে পুরস্কার দিন!”
অফিসার খাতা খুলে প্রশ্ন করল—
“তুমি যদি রাজ্যের বাইরে যাও, তবে কী নিয়ে যাবে?”
গজানন বলল, “আমি শুধু বাতাস নিয়ে যাব, কারণ বাতাস সবজায়গায় থাকে !”
অফিসার খুশি হয়ে বলল, “বাহ! তাহলে তোমার জন্য স্পেশাল নিয়ম—তুমি বাতাস নিয়েই থাকবে, কোথাও যেতে হবে না কারণ বাতাস সব জায়গায় থাকে !”
গজানন হতাশ হয়ে বেরিয়ে এল।

গজানন শুনেছিল, রাজ্যের এক জায়গায় এক বিশেষ উড়ন্ত হাতি আছে, যে আকাশে উড়ে যেতে পারে।
“এটাই আমার শেষ ভরসা!”—বলে সে ছুটল সেই স্থানের দিকে ।
অতঃপর সে সেখানে পৌঁছে দেখল এক বিশাল হাতি, যার মাথার ওপর বাঁশি লাগানো!
গজানন চোখ বড় করে জিজ্ঞেস করল—
“এটাই কি সেই উড়ন্ত হাতি?”
এক বৃদ্ধ বলল—
“হ্যাঁ! তবে চালু করার জন্য হাতির মাথার উপরে থাকা এই বাঁশি বাজাতে হবে!”
গজানন উত্তেজিত হয়ে বাঁশি বাজাল… হাতিটি এক ইঞ্চিও নড়ল না।
কিন্তু রাজ্যের একদল সৈন্য বাঁশির আওয়াজ শুনে ছুটে এল!
গজানন তখন বুঝল, “হায় হায়! এ তো আসলে রাজ্যের এলার্ম সিস্টেম!”
সে দ্রুত পালানোর জন্য দৌড় লাগাল, আর পেছনে সেনারা চেঁচাতে লাগল—
“থামো! রাজা মহামূর্খের নির্দেশে তুমি গ্রেফতার!” গজানন কিছু না বুঝে ঝাঁপ দিল নদীতে। সাঁতার কাটতে গিয়ে সে দেখল নদীতে জল নেই শুধু বই আর খাতায় ভরে আছে নদীর সমস্ত অংশ। এই বই খাতা গুলো মানুষ বহুকাল আগে ফেলে দিয়েছে।
গজানন তখন উঠে দাঁড়ালো , আর সৈন্যরা তীরে দাঁড়িয়ে হাহাহাহা করে হাসে গড়াগড়ি খাচ্ছে আর হাততালি দিচ্ছে।
“দারুণ! এবার রাজা মহামূর্খ তোমার বিচার করবে!”
রাজা মহামূর্খ তাকে দেখে রাগে গজগজ করতে লাগলেন।
“তুমি আবার পালানোর চেষ্টা করছিলে!”
গজানন মাথা নিচু করে বলল—
“জি রাজামশাই! তবে এবার আমি উপলব্ধি করেছি, আমি আসলে রাজ্যেরই একজন! আমাকেই দয়া করে নতুন মন্ত্রী বানান!”
রাজা মহামূর্খ চমকে বললেন—
“নতুন মন্ত্রী? তুমি কী কী জানো?”
গজানন চোখ বন্ধ করে ভাবল, “আমার আসলে কিছুই জানার দরকার নেই! এটাই তো মূর্খরাজ্যের নিয়ম!”
তাই সে বলল—
“আমি কিছুই জানি না! আমি কিছুই পারি না! আমি একেবারেই অযোগ্য!”
রাজা মহামূর্খ খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলেন—
“অসাধারণ! তুমি আমাদের পরবর্তী বাতাস মন্ত্রী!”
রাজ্যের লোকজন করতালি দিয়ে বলল—
“দারুণ! এটাই তো চাই! আমাদের মূর্খ রাজ্যে নতুন মূর্খ নেতা!”
গজানন বুঝল, সে পালাতে পারেনি, কিন্তু আরও বড় কিছু অর্জন করেছে।
সে এখন “মূর্খরাজ্যের বাতাস মন্ত্রী!”
সে রাজা মহামূর্খের পাশে বসে ঘোষণা দিল—
“আজ থেকে, আমাদের রাজ্যে সবাই মন্ত্রী হবে! কারণ আমরা সবাই সমান মূর্খ !”
এবং তারপর থেকে, মূর্খরাজ্যে সবাই মন্ত্রী হয়ে গেল!
এখন আর কেউ রাজ্য থেকে পালানোর চেষ্টা করত না। কারণ প্রত্যেকেই নিজের মতো করে, মন্ত্রী!
আর রাজা মহামূর্খ গজাননকে দেখে বললেন—
“দেখেছ? পালানোর চেষ্টার কী দরকার, যখন তুমি নিজেই রাজ্যের নেতা হতে পার?”
গজানন মুচকি হেসে ভাবল, “সত্যিই তো! মূর্খদের মাঝে পালানোর চেয়ে বড় বুদ্ধিমানের কাজ আর কী হতে পারে?”

মূর্খরাজ্যের সুবিশাল দরবার। সোনার সিংহাসনে বসে আছেন রাজা মহামূর্খ। চারপাশে দাঁড়িয়ে তার বিশ্বস্ত মন্ত্রীগণ—যারা কোনদিন কোন কাজ করেননি, কারণ তারা কাজ কী জিনিস, তা-ই জানে না!
গজানন চণ্ডীমূর্খ, সদ্য ঘোষিত মন্ত্রী, দরবারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন।
রাজা মহামূর্খ হাতে এক বিরাট কাঠের রাজদণ্ড ঘুরিয়ে বললেন—
“ওহে প্রিয় মূর্খরা! আজকের দরবার শুরু হোক! কেহ কি কিছু বলিবে?”

প্রথম অভিযোগ: গরুর উড়োজাহাজ প্রকল্প
এক মন্ত্রী উঠে দাঁড়ালেন। তিনি ছিলেন “উন্নয়ন ও ব্যর্থ প্রকল্প মন্ত্রী”।
তিনি ঘোষণা করলেন—
“মহারাজ! আমাদের রাজ্যের নতুন উন্নয়ন প্রকল্প ‘গরুর উড়োজাহাজ’ ব্যর্থ হয়েছে!”
রাজা হতভম্ব হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন—
“কী! গরু কেন উড়ল না?”
মন্ত্রী মাথা চুলকে বললেন—
“গরুকে পাখা লাগিয়েছিলাম, কিন্তু সে উড়তে চাইল না কারণ আমরা তাকে বলতে ভুলে গেছিলাম সে উড়তে পারে !”
রাজা কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন, তারপর বললেন—
“হুম! তবে, গরুর মনোবল বাড়ানোর জন্য তাকে ‘রাজ্যের প্রথম উড়ন্ত গরু’ খেতাব দেওয়া হোক!”
দরবার করতালিতে ফেটে পড়ল—
“জয় মহামূর্খের জয় !”

দ্বিতীয় অভিযোগ: শূন্য বাজেটের প্রকল্প
একজন মন্ত্রী দাঁড়িয়ে বললেন—
“মহারাজ! রাজ্যের নতুন প্রকল্প ‘সবার জন্য টাকা, কাজ ছাড়া’ খুব ভালো চলছে!”
রাজা খুশি হয়ে বললেন—
“দারুণ! তবে টাকা কোথা থেকে আসছে?”
মন্ত্রী মাথা চুলকে বললেন—
“কোথাও থেকে আসছে না! আমরা শুধু সবাইকে বলছি যে তারা ধনী হয়ে গেছে, আর সবাই বিশ্বাস করছে!”
রাজা আনন্দে চিৎকার করলেন—
“বাহ! এটাই তো প্রকৃত অর্থনীতি! সবাই ধনী, শুধু টাকাটাই নেই!”

এবার রাজ্যের গুপ্তচর উঠে দাঁড়াল।
“মহারাজ! আমি একটি গোপন তথ্য পেয়েছি!”
রাজা চমকে বললেন—
“বল! বল! মূর্খ রাজ্যে গোপন তথ্য বলতে কী?”
গুপ্তচর গম্ভীর মুখে বললেন—
“এই যে গজানন চণ্ডীমূর্খ, নতুন মন্ত্রী, সে আসলে একসময় রাজ্য থেকে পালাতে চেয়েছিল। কারণ সে বুদ্ধিমান, সে মূর্খ নয়!”
দরবারে নিস্তব্ধতা নেমে এল।
সব মন্ত্রী একে অপরের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করতে লাগল।
রাজা ধীরে ধীরে বললেন—
“এ কি সত্য?”
গজানন এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল। তারপর মৃদু হেসে বলল—
“হ্যাঁ, মহারাজ! সত্যিই আমি পালাতে চেয়েছিলাম। কারণ, এই রাজ্য মূর্খদের, আর আমার দম বন্ধ হয়ে আসে এখানে।
আমি ভেবেছিলাম, এই রাজ্য থেকে পালিয়ে গেলে বুদ্ধিমানদের রাজ্যে যেতে পারব। কিন্তু পরে বুঝলাম, আসলে কোথাও বুদ্ধিমানদের রাজ্য নেই।”
দরবার স্তব্ধ। গজানন বলল—
“সব জায়গায় মূর্খরা রাজত্ব করছে। কেবল আমাদের রাজ্য তা স্বীকার করতে ভয় পায় না।”
মন্ত্রীদের চোয়াল কাঁপতে লাগল। রাজা একটু চিন্তিত মুখে তাকালেন। গজানন এবার আরও গম্ভীর স্বরে বলল—
“বাইরের রাজ্যে যারা নিজেদের বুদ্ধিমান বলে, তারাই আমাদের চেয়েও ভয়ংকর। তারা নিজেদের ভুলও স্বীকার করতে পারে না, তারা যুদ্ধ করে , একে অপর কে বোমা মেরে শেষ করে দেয় আর আমাদের মতো মজা করে কথাও বলতে পারে না।”
রাজা ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন।
“তাহলে বলো গজানন, তুমি এখন কী করবে?”
গজানন মুচকি হেসে বলল—
“আমি পালাব না, মহারাজ। কারণ পালিয়ে কোনো লাভ নেই। আমি এখানেই থাকব, কারণ এখানেই অন্তত সত্য বোঝা যায়।”
দরবার কিছুক্ষণ নীরব, তারপর একসঙ্গে গর্জে উঠল—
“জয় মহামূর্খ! জয় মহামূর্খ!”

সন্ধ্যা নামে, দরবারের আলো নিভে যায়।
রাজা মহামূর্খ সিংহাসনে বসে একা চুপচাপ থাকেন।
তার সামনে গজানন দাঁড়িয়ে, চোখে মৃদু হাসি।
রাজা ফিসফিস করে বললেন—
“তুমি কি জানো, আমিও একসময় পালাতে চেয়েছিলাম?”
গজানন অবাক হয়ে তাকালেন।
রাজা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন—
“কিন্তু পরে বুঝলাম, আমি যেখানে যাব, সেখানেও একই রকম মূর্খতা থাকবে। তাই থেকে গেলাম।”
গজানন মৃদু হাসলেন।
“তাহলে, মহারাজ… আমরাও কি বুদ্ধিমান?”
রাজা একবার মাথা নিচু করলেন, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন—
“আমরা সবচেয়ে বুদ্ধিমান, কারণ আমরা জানি যে আমরা মূর্খ!”
আর সেই মুহূর্তে, রাজ্যের দূরে কোথাও বাজনা বেজে উঠল।
গজানন চেয়ে দেখল, একদল লোক হাততালি দিচ্ছে, উল্লাস করছে।
আর রাজা মহামূর্খ সিংহাসনে ফিরে গিয়ে বসে রইলেন।
তার মুখে এক অদ্ভুত হাসি।
কিন্তু সেই হাসির ভেতরে ছিল এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা।


লেখক পরিচিতি : অভি সেখ
Composer, Writer, Vocalist.

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to Top
error: লেখা নয়, লিঙ্কটি কপি করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

লেখা আহ্বান - বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন

দীপায়ন